সন্তানহারা
রশিদা আজকাল স্বামী জাফরের আদর সোহাগের কথা শুনলে, পানি পড়া গরম ছাইয়ের মতো অমনি ফোঁস করে ঠেলে ওঠে! কিন্তু ও মুখে কিছু
না বললেও, ওর ঘোলাচোখের চাহনি,
আর পুরনো হাপরের মতো ছেড়াফাটা বুকের দীর্ঘশ্বাস শুনলে তা কতকটা অনুমান করা যায়--- পোড়া বাসনার শরীরের ভাজে ভাজে কতটা আগুন এখনও লুকোনো রয়েছে!
বেশ
কয়েক মাস হল, ওদের একমাত্র পুত্র সন্তান জহিরুল
মরেছে! সবাই বলে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ওর জীবন কেড়ে নিয়েছে।--- সরকারও বলে তাই! কিন্তু জহিরুলের মা রশিদা একথা মানে না।--ও বলে ‘আমার বাছা পাটীপুটি বুঝত না গো! কচি
আমার একশ দিনের মাটি কাটায় কাজ করতি গেছেলো; গিয়েই কাল
হল!’ এখন
আর কোন সন্তানহারা মা’কেই বেশি কা্ঁদতে দেওয়া হয়না;
এটাই এখন সারাদেশের নিয়ম! তার আগেই ওদের হাতে গুজে দেওয়া হয়
দুলাখ টাকার চকচকে একখানা চেক! মায়ের চোখের জলে যা মোটেই ছেঁড়ে না! রশিদাও পেল।
কারা যেন ওর অশক্ত বিদ্ধস্ত শরীরটাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে, খানিকটা
ভ্যানে, খানিকটা হা্ঁটিয়ে খানিকটা কা্ঁদিয়্ খানিকটা
হাসিয়ে,--- এক ধাক্কায় মঞ্চে তুলে দিল।
খবর
শুনে জাফরও ছুটে এলো বিদেশ থেকে! উঠোনে হাতপা ছড়িয়ে সে অনেকটা কা্ঁদল। অনেকটা বুক
চাপড়ালো।অনেকটা মাটি আঁচড়াল। পাড়ার লোক এসে সান্ত্বনা দিল।পার্টির লোক এসে ওর পিঠ চাপড়ে গেল! আর
পরবর্তী প্রতিবাদ কর্মসূচী কি হবে; কোথায়
হবে,--- এটাও ঠান্ডা মাথায় জানিয়ে গেল! রশিদা এক ঘটি জল এনে
জাফরের মাথায় হাত দিয়ে থাবিয়ে থাবিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা করল! কিন্তু জাফরের
অস্হির বুকের জ্বালা যেন কিছুতেই জুড়োল না! সরকার থেকে পাওয়া দুলাখি চেক খানার কথা
রশিদা মুখে একবারও আনল না! এই সময় গায়ে হাতও তোলা যায় না! চড়ে কথা বললেও মানুষে
মানুষ বলে না! সমাজে মন্দ হবার ভয় পুরুষেরও আছে যে! দিনের খেয়ালে দিন চলে যায়;
কিন্তু এই আটপৌরে জীবন একঘেয়ে শোক আর কতদিন বইতে পারে? জাফর অঙ্ক কষে নেয় মনে মনে! আর ভাবে খালেক মিঞার কাছে তার ধানের জমিটা
বা্ঁধা আছে বহুদিন, ওটা ছাড়াতে হবে! ঘরখানার অবস্হাও খুব
খারাপ! বর্ষার আগে ভাটা থেকে দুশো টালি আনাতে হবে! মাঝে মাঝে ওর এখন কাশতে গেলে
কফের সাথে রক্ত ওঠে।--- এটাও একবার চেক আপ করিয়ে নিলে ভালো হত! সবখানেই যে মুঠো
মুঠো টাকার দরকার! জাফর আরও ভাবে, ‘একজোড়া বলদ কিনে লাঙলা
করে মাঠে নামাতে পারলেও দিনের রোজগারটার জন্য এমন বিদেশ বিভু্ঁয়ে সেন্টারিং কাজে
বিশতলা বিল্ডিংয়ের ওপর এমন প্রাণ হাতে করে ঝুলতে হয়না! দুটো জার্সি গাই গরু কিনলেও
তো ঘরে বসে দিনে বিশ লিটার দুধ পাওয়া যায়! মেয়েছেলের বুদ্ধি বলে কথা! কোথায় কোন
বালিশের তুলোর মধ্যে কোন ন্যাকড়া-চোকড়ার পুটলিতে এমন বহুমূল্যবান চেক খানা গুজে
রাখল কে জানে!’ রাগে ক্ষোভে জাফরের ইচ্ছে হল, ‘ শুধু ক্যা্ঁতা বালিশ নয়,--গোটা ঘরখানাই উঠোনে
আছড়ে এনে ওতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বেলগে দিই!’
রশিদার
সাথে গ্রামের মেয়েরা এখন আর খুব একটা কথা বলতে চায় না। দুলাখ টাকার অহংকারে ওর পা
নাকি এখন আর মাটিতে পড়ে না! একদিন যারা ওর সন্তান হারানোর ব্যথা ভাগ করে নিতো,
উঠোনে বসিয়ে ত্যালাকুচোর পাতার রসের সাথে সর্ষের তেল ফেটিয়ে
মাথার ‘বেম্মতলায়’ জা্ঁপ দিয়ে
সান্ত্বনা দিতো; আজ এখন তারাও ভ্রু কুচকে বলে, ‘বাব্বা! টাকা এমন জিনিস পুত্তুর শোকও চাপা দিয়ে দেয়! দ্যাখো না পুড়ার
চোখে আজ এক ফোঁটা পানি গড়ায়?’
রশিদারও যেন সকল কথা ফুরিয়ে গেছে! বোবার মতো সে একা একা পুকুর ঘাটে বাসন মাজে, একপাশে সরে গিয়ে কাপড় কাচে। আজ সেও যেন স্বঘোষিত একঘরে নির্বাসিত জীবন বেছে নিয়েছে। আর সুযোগ পেলেই ও এখন উনোনে পোড়া মাটি খায় মড়মড়িয়ে।
রশিদারও যেন সকল কথা ফুরিয়ে গেছে! বোবার মতো সে একা একা পুকুর ঘাটে বাসন মাজে, একপাশে সরে গিয়ে কাপড় কাচে। আজ সেও যেন স্বঘোষিত একঘরে নির্বাসিত জীবন বেছে নিয়েছে। আর সুযোগ পেলেই ও এখন উনোনে পোড়া মাটি খায় মড়মড়িয়ে।
বিকট
চামড়া পচা দুর্গন্ধে জাফরের পেটের নাড়ী পাক খেতে লাগল! তবুও সোহাগ ভায়ের কাছ থেকে
উঠতে মন চায় না। সোহাগ ভাই কত কথাই না জানে! দুর্দিনের একমাত্র সান্ত্বনা;
ছোটবেলার বন্ধু। জাফর বসে বসে সোহাগের কার্য কলাপ দ্যাখে আর মনে
মনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, ‘ বলি ও সোহাগ ভাই কর কি? মরা বাছুরের চাম ছুলে এনে ওর মধ্যে বিচলি পুরে দিলিই কি আর জ্যান্ত হয়!’‘কি করব বল! গাইডা আমার দিনে বিশ লিটার দুধ দেয়! সাদেক মিঞার ষা্ঁড়ের
গু্ঁতো খেয়ে সাত দিনের মাথায় আমার বুধি বাছুরটা মারা গেল! সেই শোকে গাভী একেবারে
পাগলা হয়ে গেল! বালতি নিয়ে বাটে হাত ছোঁয়ালেই মারে উড়ো লাথি! কোন দিশে-বিশে না পেয়ে ছুটে গেলাম পশু ডাক্তারের কাছে;
উনিই তো এই পরামর্শ দিলেন।‘
সোহাগের মুখনিঃসৃত মৃতসঞ্জিবনীর ইতিহাস অবাক হয়ে শোনে জাফর। ‘বাড়ি ফেরার আগে এক দৌড়ে ভাগাড়ে ছুটলাম, যেখানে আমার বুধিকে ফেলে দিয়ে এসেছিলাম। গিয়ে দেখি শকুন আর শেয়ালে অনেকটাই ছিঁড়ে ফেলেছে! ওর চোখ ফেটে তখনও পানি গড়াচ্ছে! আমারও চোখে আর পানি ধরে রাখতি পারলাম না! লুঙ্গির খুট থেকে চাকুটা বের করে নাকে ভাল করে গামছা জড়গ্যে নিলাম!-- বড় কঠিন ছিলো সেই জল্লাদের কাজ! এখন বেশ দিব্যি দুধ পাচ্ছি! এই ঝুটা বাছুরটা ওর সামনে এনে ধরলে গাই প্রাণভরে ওর পেছনটা শু্ঁকে নেয়; তার পর চোনালেই পালান একেবারে দুধ ভারে টনটন করে উঠবে। বল এমন গাভীকে বেচা যায়? আর বাছুর ছাড়া ওকে কেই বা নেবে? বিয়োনে গাই গোসের দরেও বিকোয় না যে! তারপর বল, চেকটা ভাঙালি? ভাবি দিতে রাজি হলো?’
সোহাগের মুখনিঃসৃত মৃতসঞ্জিবনীর ইতিহাস অবাক হয়ে শোনে জাফর। ‘বাড়ি ফেরার আগে এক দৌড়ে ভাগাড়ে ছুটলাম, যেখানে আমার বুধিকে ফেলে দিয়ে এসেছিলাম। গিয়ে দেখি শকুন আর শেয়ালে অনেকটাই ছিঁড়ে ফেলেছে! ওর চোখ ফেটে তখনও পানি গড়াচ্ছে! আমারও চোখে আর পানি ধরে রাখতি পারলাম না! লুঙ্গির খুট থেকে চাকুটা বের করে নাকে ভাল করে গামছা জড়গ্যে নিলাম!-- বড় কঠিন ছিলো সেই জল্লাদের কাজ! এখন বেশ দিব্যি দুধ পাচ্ছি! এই ঝুটা বাছুরটা ওর সামনে এনে ধরলে গাই প্রাণভরে ওর পেছনটা শু্ঁকে নেয়; তার পর চোনালেই পালান একেবারে দুধ ভারে টনটন করে উঠবে। বল এমন গাভীকে বেচা যায়? আর বাছুর ছাড়া ওকে কেই বা নেবে? বিয়োনে গাই গোসের দরেও বিকোয় না যে! তারপর বল, চেকটা ভাঙালি? ভাবি দিতে রাজি হলো?’
জাফর
কোন কথার উত্তর দিল না। সে আজ সোহাগের কাছ থেকে চরম একটা উত্তর পেয়ে গেছে। সে
দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিল। মাঝ পথে যেতেই খানিকটা থমকে দা্ঁড়াল সে। আজ হাটবার।হাটে
যেতে হবে। কতদিন হয়ে গেল রশিদাকে একটা নতুন শাড়ি দেওয়া হয় নি! আজ তার জন্যে একটা
নতুন শাড়ি কিনবেই! কিন্তু টাকা কোথায় পাবে? ‘ধুর!
এত ভাবলে চলে না কি? পুরনো সাইকেলটা আছে না ওটাই বেচতে
হবে!’
সন্ধ্যা
বেলা ল্যাম্পের আলোয় পা ছড়িয়ে খে্ঁজুর পাতার চাটাই ভাঙাতে বসেছে রশিদা। জাফরের
জোরাজুরিতে অঙ্গে জড়িয়েছে নতুন ছাপাশাড়ি। কি অদ্ভুত এক মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে ওর
সারা শরীর থেকে! জাফর হাট থেকে ফিরে হাতে মুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওর গা ঘে্ঁষে
বসল। আজ একান্ত ইচ্ছে রশিদাকে খুব আদর করবে, মিষ্টি
মিষ্টি কথা শোনাবে। এমনকি আজ যদি কোন পার্টির লোকও আসতে দ্যাখে অমনি ল্যাম্পটা এক
ফু্ঁ দিয়ে নিভিয়ে দেবে সে! কতদিন সে বাইরে বাইরে কাটিয়ে যৌবনটা মাটি করে ফেলেছে! কিন্তু
রশিদার কোন উৎসাহ নেই এতে! জাফর মনে মনে নিমপাতা হয়ে ওঠে, ‘সত্যিই কি রশি বুড়ি হয়ে গেল? না কি শোকে
ইচ্ছেটা চাপা পড়ে গেছে?’ রশিদার কোন সাড়া না পেয়ে
অগত্যা জহিরের কথা পাড়ল!
‘শুনেছিস রশি? চল আজ আমরা একটু খোকার কাছে যাই! মনটার মদ্দি বড় খামচি মারা ব্যথা রে! আর সহ্য করতি পারছি নে কো!’ জাফরের চোখেও আজ সত্যিই পানি দেখতে পেল রশিদা। স্বামীকে কাছে টেনে নিয়ে নতুন শাড়ির খসখসে আ্ঁচলে জাফরের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘ ব্যাটাছেলে অমন কা্ঁদলে হয় না কি! চলো! কনে যাবা চলো!’
‘শুনেছিস রশি? চল আজ আমরা একটু খোকার কাছে যাই! মনটার মদ্দি বড় খামচি মারা ব্যথা রে! আর সহ্য করতি পারছি নে কো!’ জাফরের চোখেও আজ সত্যিই পানি দেখতে পেল রশিদা। স্বামীকে কাছে টেনে নিয়ে নতুন শাড়ির খসখসে আ্ঁচলে জাফরের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘ ব্যাটাছেলে অমন কা্ঁদলে হয় না কি! চলো! কনে যাবা চলো!’
আজ আর ঝমঝমিয়ে শ্রাবণও নামল না। মায়াময় জ্যোত্স্নাও এল না! শুধু নিকষ কালো অন্ধকারে পাথরের মূর্তির মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল দুইজন! জহিরের কবরের পাশে! সহসা শুকনো বা্ঁশ পাতায় হাওয়া খেলে গেলে যেমন শব্দ হয়, এমন একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জাফর রশিদার গায়ে ঝাকুনি দিয়ে বলল, ‘কা্ঁদ প্রাণ খুলে কা্ঁদ রশি! মনের ভার কমবে কথা বল!-- ওর আত্মা জুড়োক! তুই কি কিছুই বলবি নে? একটি মাত্র সন্তান তাও তুই আগলে রাখতি পারলি নে!---আমি কোন অভিযোগ করেছি? বল এত জেদ কেন বল? মিয়াদ ফুরোলি মানষির তাই কোনও দাম নেই!----আর তো সামান্য একখান কাগজ! কিছু তো এট্টা বলবি না কি?’
‘কি বলব? এই অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে আর কতক্ষণ! ঘরে চলো! আমার কিরাম এট্টা অঞ্জালা হচ্ছে!’
জাফর পুলকিত হয়ে উঠল, ‘চল রশি ঘরে যাই! আজ তোকে খুব খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে’!
আজ বহুদিন পর গভীর রাতে জাফরকে এক অন্যরকম দেখে রশিদা ডুকরে কে্ঁদে উঠল! চেকটা পাওয়ার জন্য ওর স্বামী ওর মোটেই গলা টিপে ধরেনি; শুধুমাত্র ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আর একটি খনন কাজ চালিয়েছে! সেই মর্মভেদি কান্না ভাঙা বেড়া ভেদ করার আগেই জাফর একাই বুক দিয়ে আটকানোর চেষ্টা চালাতে লাগল!
রশিদা
এখন সকাল সন্ধ্যা আকার গরম পোড়া মাটি খায়, আর
ফচ ফচ করে ছ্যাপ ফ্যালে! পাড়ার ছাপিয়া খালা রশিদাকে দেখে আৎকে ওঠে ,‘বলি ও পুড়ার মরণ! এই বুড়ি বয়সে পেটে আবার একটা কা্ঁটা ঢুকোলি? বলি তোর মরণের ডানা গইজেছে? তোর পেটের ঢক দেখে
মনে হচ্ছে জহির আবার ফিরে আসছে দেখিস! তোর শূন্য কোল পূন্ন হোক মা! আমার মতো আবাগী
যেন আর কেউ না থাকে! এক মাত্র ছেলেডা আমার বজ্জাত বৌডার সাথে দ্ন্দ্ব করে নিজের
জীবনডা শেষ করে দেলে! ঝদি বাইরে এসেও দ্বন্দ্ব করতিস তাও আজ আমার খালি পেটে হাউ
হাউ করে কে্ঁদে বেড়াতে হতো না! বলি ও মা তোর ছেলে হলে আমার একখান শাড়ি দিস! তোর তো
শুনি অনেক টাকা সরকার দিয়ে রেখেছে! এই ভিখারীর ভিখারীকে একটু দয়া করিস মা! তোর
ভালো হবে!’
রশিদার
এখন সবসময় গা বমি বমি করে। আর পাড়ার নাছোড় নেতাগুলো যখন উঠোনে এসে বসে,
তখন ওর পেটের নাড়ি একেবারে উল্টে আসে! ‘ওদের
মরণ কি আর কোথাও নেই!’--- রশি ভাবে। ঘন ঘন আসে আর খোঁজ
খবর নিয়ে যায় চেকটা ভাঙানো হলো কি না! আর প্রতি মাসে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মঞ্চ বেঁধে
ষা্ঁড়ের মতো চেঁচিয়ে আবেগে খোঁচা দ্যায়, আর কাঁদতে বলে;
আর পেছন থেকে হাততালির ঝড় ওঠে! কিন্তু ইদানিং রশির পেটটা ফুলে
একেবারে কুমড়োর মতো হয়ে উঠেছে! এই ঢাক ঘাড়ে করে ওই শেয়াল গুলোর সামনে আর সে কি
করেই বা দা্ঁড়াবে, এই ভেবে তার সারা শরীর চিন চিন করতে
থাকে!
খুব
যন্ত্রণা! ঘরের ভেতর কাতরাচ্ছে রশিদা। আর উঠোনে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে জাফর!
গ্রামখানা আজ বড় থমথমে! গোটা তল্লাট একেবারে পুরুষ শূন্য! তবে কি আবার দাঙ্গা
বা্ঁধল? কাল বিরোধী দলের লোকজন এসে সদরে যাওয়ার
রাস্তাটা কেটে দিয়ে গেছে।কালবাটটাও ভেঙে গুড়ো হয়ে পড়ে আছে খালের জলে! জহির মরেছে
কোন কালে! কিন্তু গ্রামের মানুষ গুলো রোজ একটু একটু করে মরতে বসেছে! পাড়ার প্রতিটি
ঘরের মাটির দেওয়ালে, দোকানের চালাঘরে বড় বড় গাছের গুড়িতে
এক একটি পার্টির লোক এক এক রকম ভাবে জহিরের ছবি সা্ঁটিয়ে গেছে। আর নানারকম
ইস্তাহার লিখে গেছে! সকাল সন্ধ্যা মানুষ পথে বেরুতে ভয় পায়! রশিও বেরোয় না! মাঝে
মাঝে পার্টির বড় বড় নেতাদের গাড়ি ঢোকে গ্রামে! ঝোপের আড়ালে মেয়েরা উ্ঁকি দিয়ে ফলো
করে, ‘আবার একখানা চেক দিয়ে গেলো কি না!’ মাঝে মাঝে খালা আম্মা চোখ টিপে জিজ্ঞেস করে, ‘ও
পুড়া! কখান চেক হলো? এইবার একখানা ভাঙ! অঙ্গে দুটো দে!---
তারপরে শোক তাপ করিস!’
একটি
সদ্যোজাত শিশুর কান্নার ছন্দে আজ আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল! জাফর গা খুলে আজ
ভিজছে! বিরাট এক তৃপ্তি সুখ সব পাবে সে! কত কাজ তার হাতে বাকি,
কাল থেকে আবার শুরু করতে হবে! হঠাৎ খালাম্মার ডাকে ওর ধ্যান ভাঙল, ‘ও জাফর আব্বা ঘরে আয়! রশিকে সদরে নে।----- ওর
অবস্হা খুব খারাপ!’ জাফর নির্বিকার! আজ মনটা তার ব্যথা
ভারে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে উঠল, ‘ কি করে সদরে যাব বোঝ না!
বাইরে বেরুলেই এখন গুলি খেতে হবে!’
রাত্রে
জাফরের দুই চোখের পাতা এক হলো না! শুধু পাশের কামরা থেকে ঘু্ঁটে পোড়ার এক অদ্ভুত
চেনা আ্ঁতুড়ের গন্ধ অনুভব করলো সে!
বিহানে পাখি ডাকার আগেই খালাম্মা হাউ মাউ করে যখন কে্ঁদে উঠল, ঘুমচোখে জাফর ধড়ফড়িয়ে রশিকে একটা ঝাকুনি দিয়ে ডাকার চেষ্টা করল; তারপর ওর সারা শরীর, পাশের ন্যাকড়া চোকড়া হাতড়ে একেবারে আর্তনাদ করে কে্ঁদে উঠল! খালাম্মা ভীষন ঘাবড়ে গেল, ‘ও বাপ তুই অমন করে কি খুঁজছিস? তোর জহির এই তো আমার কোলে!’
জাফর কপালে করাঘাত করে বলে উঠল, ‘আমার সব্বনাশ হয়েছে খালা! এতো দামী একখানা কাগজ ও কোথায় রেখে গেলো!’‘ওর মুখের মদ্দি দ্যাখ তো বাপ! ত্যাকন কি একটা চাবাতি চাবাতি ও খুব গোঙানি দে কে্ঁদেই অজ্ঞান হয়ে গেল!’
জাফর তড়িৎ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রশিদার মুখটা হা করে দেখল; সেই চেকটা চিবিয়ে চিবিয়ে একেবারে আঠালো লালার সাথে ওর গায়ে লেখা নম্বর ওর টাকার অঙ্ক সব পিষে একাকার করে ফেলেছে! খালাম্মা দৌড়ে একঘটি পানি এনে বলল, ‘নে বাপ শিগগির ওর মুখে একটু পানি দে ওর ভেতরটা জুড়োক!’
জাফরের চোখ দুটি কাচের গুলির মতো দেখাচ্ছে! বহু কষ্টে খালাম্মার উদ্দেশ্য সে বলল,‘কাকে দেব পানি রশিকে? ও বে্ঁচে আছে? -----মরেনি?’
রণক্লান্ত
একজোড়া শুষ্ক ঠোঁটে জলের স্পর্শ পড়তেই বার কয়েক ‘ওয়াক! ওয়াক’ করে থেমে গেল। নাহ! চেকটা শুকনো
বমির সাথে উঠে এল না। শুধুমাত্র ময়লা কাঁথা মাদুর ফুঁড়ে অদ্ভুদ একটি কান্নার আওয়াজ
ফেটে পড়ল ঘরময়!---- ঠিক জহিরের প্রথম কান্নার মত!