গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭

ইন্দিরা দাশ

রূপান্তর

বিরক্ত হয়ে জোহান ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়ল এবার। দারুণ উত্তেজনায় যতবার সে ফোন করে বাবাকে বলার চেষ্টা করছে চমৎকার খবরটা, তিনি ফোনই তুলছেন না। অথচ আজই সবে জানানো হয়েছে স্কুলে যে ড্রেসডেন শহরের ইন্টারস্কুল প্রতিযোগিতায় স্কুলের মুখপাত্র হিসেবে মনোনীত হয়েছেজোহান ক্রাউস, নির্বাচিত হয়েছে প্রধান গীটারিস্ট হিসেবে।

পুর্ব-জার্মানীর ড্রেসডেন শহরের অধিবাসী জোহানরা। জোহান গীটার বাজায় সেই নবছর বয়েস থেকে। অ্যান্টন-মামুই তো প্রথমগীটার বাজিয়ে শুনিয়েছিল জোহানকে। শহরের এল্বে নদীর তীরে নরম রোদে মাখামাখি পান্না-সবুজ ঘাসে চড়ুইভাতি করতে গিয়ে,সেদিন সেই ছোট জোহান সারাটা সকাল-দুপুর বাকি বাচ্চাদের সাথে হুল্লোড় করে খেলতেই পারল না। তার দুচোখ শুধু গীটারের ছয়খানা তারের ওপর ফ্রেট ধরে ধরে মামুর আঙ্গুলগুলোর অনায়াস চলাফেরা করাকেঅনুসরণ করে গেল! সেই প্রথমবার দেখা অ্যান্টন-মামার সঙ্গে। ঢাকনায় মোড়া স্প্যানিশ গীটারটা মামু নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে। মামা বোধ হয় মায়ের দূর সম্পর্কের ভাই, চাকরি করেন লিপজিগে। তার নিজস্ব সংসার, বউ-ছেলেমেয়ের কথা শোনেনি জোহান। মাই যেন তার একমাত্র আত্মীয়া ছিলেন। কিন্তু প্রথম দেখাতেই জোহানের চোখে নায়ক হয়ে উঠেছিলেন মামু, তার গীটারটায় শুধু হাত দিতে দিলেন তাই না, গীটারের সম্বন্ধে অনেক গল্প বললেন তাকে, জোহান গোগ্রাসে গিলতে থাকল তার প্রতিটি কথা।

দিনগুলো কাটত চমৎকার। মহানন্দে জোহানও মামাকে দেখিয়ে নিয়ে বেড়াত ড্রেসডেন শহর। মা কাণ্ড দেখে মুচকি মুচকি হাসতেন। মার্থা নিজেও তোখুব মিষ্টি সুরে গান গাইতে পারতেন,নাচও শিখেছিলেন ছোটবেলায়। তাই বাজনায় জোহানের আগ্রহ দেখে অখুশি হতেন না। অথচ বাবার দিক থেকে গানবাজনার প্রতি কোনরকম উৎসাহ কোনদিন ছিলনা। স্কুলের মাইনে, বইপত্তর, জামাকাপড়, সব কিছুরই ব্যাবস্থা সময়মত করে রাখতেন তিনি। এমনকি জন্মদিনে মাছধরার বড়শিটাও তো বাবাই কিনে এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু ডমিনিকের খুব ইচ্ছে ছিল ছেলে তার মত লোহালক্করের অফিসে কেরানীগিরি না করে, পড়াশোনা করে বিজ্ঞানী অথবা ইঞ্জিনীয়ার গোছের কিছু একটা হোক। তাই জোহানের গীটার কেনার বায়নাটা নিয়ে জোহানের মায়ের সাথে একটু তর্কাতর্কিও হয়েছিল তাঁর। জোহান কিন্তু ততদিনে অ্যান্টন-মামুর একমাস ছুটির পরিধির মধ্যেক্রোম্যাটিকস আর কিছু সোজা কর্ডস শিখে নিয়েছে। সময় শেষ হলে মামু যেই তার গীটার নিয়ে ফিরে গেল, একখানা গীটারের জন্য খনই বাপের কাছে বায়না ধরল জোহান।

ইস্কুলের মিউজিক-রুমে গিয়ে পুরনো গীটার ঝেড়েঝুড়ে বাজানোর চেষ্টা করে জোহান। কিন্তু বাজনাগুলোর তারে মরচে পড়ে রয়েছে, ফ্রেটবোর্ড পুরনো, বারবার সুর করার চেষ্টাও বিশেষ সফল হয়না। আনন্দ পায়না ছেলেটা। অবশেষে স্ত্রী-পুত্রের কাকুতি-মিনতি, মান-অভিমানের কাছে হার মেনে গীটারটা কিনে দিলেন ডমিনিক, তবে শর্ত রাখলেন যেন পড়াশোনায় কোন রকম গাফিলতি ধরা না পড়ে। এরপরও অ্যান্টন-মামু বারকয়েক এসেছেন, ভাগ্নের অধ্যবসায় দেখে উপহার এনে দিয়েছেন ভাল টিউনার, কিছু ভালো অনুশীলনের বই।

মা-মার্থা যেমন সুন্দর গান গাইতেন তেমনই সুন্দর ছিলেন দেখতে। পার্টিতে যাওয়ার আগে বাদামী চুলের বড়সড় খোঁপাখানার ঠিক নীচে মার ফর্সা ঘাড়ের পেছনে যত্ন করে কেমন মুক্তোর মালাখানা আটকে দিতেন বাবা । শহরে কান্ট্রি-ফেস্টিভ্যালে মাজুর্‌কা, ফক্স-ট্রট যাই হোক না কেন, সবরকম নাচে সবার মধ্যে আলাদা রকম সুন্দর লাগত মা'কে। জোহান হাঁ করে দেখত তার অপূর্ব নৃত্যরতা মার মার সরু কোমর ঘিরে বিরাট ঘের-ওয়ালা সাদা লেসের পোশাক ঘুরত পাকে পাকে।

সে সময়ে ইস্কুলের পর বাড়ি ফিরে পড়াশোনা সেরেই সে বসে যেত বাজনানিয়ে। মা মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে পায়ে পায়ে তার ঘরের দরজায় এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতেন। কি যে ভাললাগত তখন জোহানের। সে ভাব দেখাত যেন সে জানতেই পারেনি মা যে এসে শুনছেন তার বাজনা। কিন্তু যেটুকু উৎসাহ সে পেত তাও বন্ধ হয়ে গেল। একবছর শীতে কঠিন নিউমোনিয়ায় শয্যাশায়ী হলেন মার্থা। সাতদিনের জ্বরে মারা গেলেন তিনি। জোহান তখন সবে হাইস্কুলের পরীক্ষা দিয়েছে। পড়াশোনাতেও সে পরিশ্রমী, তাই ফাইনালে সে ভালো ফল করবে, সে তা জানে। অথচ রেজাল্ট বেরনোর দিন ফলাফলের কাগজটা নিয়ে খুশিতে লাফাতে লাফাতে বাড়ি পৌঁছে কোনও লাভ হোলনা। আনন্দে মা যে বিছানায় উঠে বসবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল জোহান। কিন্তু মায়ের ঘরের দরজার কাছে পৌঁছতে সে দেখতে পেল নার্স-আন্টি চোখে রুমাল চেপে বেরিয়ে গেলেন। বিছানার পাশে দুহাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বড়সড় চেহারার ডমিনিক ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। এই প্রথম জোহান বাবাকে দেখল এতটা ভেঙ্গে পড়তে। মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মিটে গেল। অ্যান্টন-মামা দিন দুয়েকের জন্য এসেছিলেন, ফিরেও গেলেন। কিন্তু ডমিনিক নীরব হয়ে গেলেন। অন্তর্মুখী মানুষ, কথাবার্তা তিনি বরাবরই কম বলতেন।

জোহান এখন সতেরো বছরের টগবগে জোয়ান। চমৎকার বাজনা বাজায় সে। স্কুলের গীটার টীমে সবার হিরো। ইস্কুলের মিউজিক টিচাররা অনেকেই অনুরোধ করেছেন ডমিনিককে, ছেলেটাকে বার্লিনে ইন্টারন্যাশনাল গীটার অ্যাকাডেমীতে পাঠানো উচিত। অ্যান্টন-মামুর সাথে যোগাযোগ করে বার্লিন যাওয়ার সম্বন্ধে জানতে চাওয়ার জন্য বাবাকেবেশ কয়েকবার বলল জোহান। কিন্তু ডমিনিকের সময়ই নেই। এদিকে মা মারা যাওয়ার পর মামুও যেন  দূরের মানুষ হয়ে গিয়েছে। জোহানের ফোন, চিঠি, কিছুরই জবাব দেন না আর।

মেধাবী জোহান শহরের ইন্টারস্কুল প্রতিযোগিতায় জোহান মনোনীত হোল, সে খুব চাইছিল প্রতিযোগিতার দিনটিতে বাকি সমস্ত ছেলেমেয়েদের মত তারও কোনও এক নিকটাত্মীয় প্রেক্ষাগৃহে বসে খুব জোরে জোরে হাততালি দিক, শুধু তারই জন্য। কিন্তু সে এই প্রতিযোগিতার খবরটা দেবে কি করে! ফোনটাই তার বাবা তুলল না। অভিমানে ফেটে পড়ল জোহান। চলেই যাবে সে, যেমন করেই হোক, বার্লিন শহরের সেই বিশাল অ্যাকাডেমিতে, তার জীবনের স্বপ্নকে সার্থক করতে।

প্রতিযোগিতার ফলাফল আশানুরূপ ভালো হোল, কিছু সান্মানিক জুটল জোহানের। কিন্তু এ আনন্দের সময় কার সাথে উদযাপন করবে সে! বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যে অবধি হৈ-চৈ করে বাড়ি ফিরে সেই একই দৃশ্য, বাবা একহাতে খবরের কাগজ, অন্য হাতে কফির কাপনিয়ে, নিজের কাজের বিষয়ের নানা ফাইল-পত্র নিয়ে বসে আছেন নিজস্ব চিন্তায় মগ্ন হয়ে। সমস্ত ঘটনা বলার পর উঠে দাঁড়িয়ে জোহানকে এক মুহুর্তের জন্য বুকের কাছে টেনে নিয়েই তারপর নিজের ঘরে চলে গেলেন ডমিনিক।

এত শৈত্য, এতটা দুরত্ব জোহানের সহ্য হলনা। সে চেষ্টাচরিত্র করে, ইস্কুলের মিউজিক শিক্ষকদের সাহায্য নিয়েবার্লিন আন্তর্জাতিক গীটার অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়ার ব্যাবস্থা করে ফেলল। তার পুরস্কারের টাকাটা কাজে লাগল। অবশ্য যাওয়ার আগে বাবা ডমিনিক আরও কিছু আর্থিক সাহায্য সাথে দিয়ে দিলেন। সে ব্যাপারে কার্পণ্য তিনি কখনোই করেন না, তা ঠিক। কিন্তু ছেলে যে উষ্ণতা তার থেকে চায়, তা পিতা ডমিনিকের ব্যাক্তিত্বের মধ্যে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

বিদায়ের সময় হাতের মালপত্র সামলে বাবাকে আলগোছে একবার জড়িয়ে ধরল জোহান। বয়েসের ভারে, স্ত্রী-বিয়োগের পর ডমিনিক একটু কুঁজো হয়েছেন, লক্ষ করলেন উচ্চতায়ছেলে অনেকটা ছাড়িয়ে গিয়েছে তাকে। চাকরীতে অবসরের দিন শুরু হতে তার আর বেশী বাকি নেই তার। ততদিনে ছেলেটা নিজের পায়ে দাঁড়ালে হয়, বললেন, ‘ঈশ্বর তোর সঙ্গে থাকুন
অ্যাকাডেমিতে জোহানের সাথে যোগ দিয়েছে অনেক ছাত্রছাত্রী। হোস্টেলে পৌঁছতেহোস্টেল অধিপক্ষ জানালেন,একটি ঘর তার নামে বুকিং করা রয়েছে, এবং পুরো বছরের জন্যই তার খরচা জমা করা আছে।

মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর ভিড়, স্নাতক ছাত্রছাত্রী,দেশবিদেশ থেকে আমন্ত্রিত মাননীয় শিক্ষকেরা, রুটিন, শিক্ষণপ্রণালী,   পরীক্ষার কারিক্রম সমস্ত জেনেশুনে জোহানের মনে হোল, এতদিনে সে গীটার শেখার পীঠস্থানে এসে পৌঁছতে পারল। পড়াশোনার জন্য বইপত্তর ল্যাপটপের ব্যাবস্থা করা হয়ে গেল। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা, অনুশীলন করতে লাগল জোহান। দিনে দিনে তার ফলাফল দেখে তার শিক্ষকরাও খুশি।
বাড়ির সাথে সম্পর্ক ক্ষীণতর হয়ে আসে। কয়েকমাস পরে ডমিনিক জানালেন কর্মসূত্রে তার এবার অন্যান্য দেশে ট্যুরে যেতে হতে পারে, তাই যোগাযোগ হয়ত সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।তবে জোহানের পড়াশোনার জন্য খরচার ব্যাবস্থা করা থাকবে। অথচ জোহানের স্বপ্নের অ্যাকাডেমি তার কেমন লাগছে সে ব্যাপারে ডমিনিক বিশেষ উৎসাহ  দেখালেন না। অবশ্য এমনটাই যেন প্রত্যাশিত ছিল।
সারাদিনের ক্লাস, সেমিনার,অনুশীলন জোহানকে ব্যাস্ত রাখত। সন্ধ্যের পর হোস্টেলের ঘরে ফিরে গিয়ে একটু একা লাগত তার। ল্যাপটপে ফেসবুক খুলে নানা পুরনো বন্ধুদের খুঁজে গল্পস্বল্প করার চেষ্টা করত সে। সেইসময়েই আলাপ হোল সাইমনের সঙ্গে।

সাইমন হ্যামবার্গে থাকে, চাকরীকরে। তার একটিমাত্র ফটো ফেসবুকে। লেকের পাশে দাঁড়ানো লম্বা-চওড়া মানুষটিকে দেখে মনে হয় বছর তিরিশ থেকে মাঝবয়েসী পর্যন্ত যে কোনও বয়েসরই হতে পারে সে।ফটোতে বিকেলের সুর্যের  আলো হেলে পড়েছে মাথার পেছনে, তাছাড়া উঁচু লম্বা সিডার, পাইন গাছগুলোর মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে, মুখখানা খুব একটা পরিস্কার নয়। লাজুক সাইমনতার মুখবইতে নিজের আত্মীয়স্বজনদের সম্বন্ধে, বা নিজের সম্বন্ধে বেশী কিছু লিখত না। লোক হিসেবেওসে খুব একটা মজাদার নয়। তার মা-বাবা নেই। বিয়ে-থা হয়েছে বলে মনে হয়না, স্ত্রীর কথা কখনো সে বলেনি,হয়ত ডিভোর্সি। অভব্যতা হতে পারে ভেবে যেচে জোহান এই ব্যাপারে কিছু জিগ্যেস করেনা। চাকরি করে অবসর সময়ে বই-পত্রিকা এইসব পড়েইসাইমনদিন কাটায়। কিন্তু সে ভালো বন্ধু, বেশ মন দিয়ে জোহানের নতুন জীবনের অধ্যায়গুলোর খুঁটিনাটি সব বৃত্তান্ত শুনে চলে দিনের পর দিন। মহা উৎসাহে নতুন কর্ডসঅনুশীলনের কথা জোহান জানায় সাইমনকে চ্যাট-বাক্সে। সাইমন অতটা না বুঝলেও, দুই-তিন দিন পরপরই জানতে চায় আর কি নতুন শিখল জোহান। সখ্যতা বেড়ে ওঠে।

ড্রেসডেনের ইস্কুলের পুরনো বন্ধুদের সাথে কিছুদিন যোগাযোগ থাকলেও প্রাক্তন সহপাঠীরা বেশির ভাগই কেরানীগিরি, চাকরিবাকরি নিয়ে ব্যাস্ত। তারা কি বুঝবে পেন্টাটনিক্‌স্‌ প্র্যাকটিসের জন্য কত পরিশ্রমকরা প্রয়োজন, কেউ শুনতে চায়না গীটারের ফিঙ্গার স্টাইলিংএ তরতরিয়ে কেমন এগোচ্ছে জোহান।

তাই সাইমনের উৎসাহটুকুই জোহানের জন্য অনেকটা পাওয়া। নতুন শেখা মেলোডির কথা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে চ্যাটবক্সে লেখেসঙ্গীত-পাগল জোহান, পরিবর্তে খোঁজ নিতে ভুলে যায় বন্ধুর জীবনযাত্রার কথা। হঠাত কখনও জিগ্যেস করলে  সাইমন বলতে বসে- এ বছর হ্যামবার্গে শীত আসবে বোধ হয় দেরীতে, কিন্তু থাকবে অনেকদিন।হ্যামবার্গের নর্থ-সীর কাছাকাছি নিউওয়ের্ক আর সারহর্ন দুটি দ্বীপে বারদুয়েক সে বেড়াতে গিয়েছে, তবে নিগেহর্ন দ্বীপটিতে তার যাওয়া হয়নি। গল্পই শোনায়সে, জোহানকে কোনোদিন অবশ্য তার নিজের শহরে নেমন্তন্ন করেনা। তার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করার থেকে জোহান তাই বিরত থাকে।

অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়ার পর শুরু শুরুতে ড্রেসডেনে বারকয়েক ছুটির সময় গিয়েছে জোহান। শেষবারের কথা মনে পরে তার। মায়ের কবরে ফুল রেখে অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল সে। বাবার সাথে দৈনন্দিন জীবনের সাদামাটা কথাবার্তা বলতে বলতেই দিনকয়েকের ছুটি শেষ হয়েছিল। পুরনো শহর, আর কিছু ছোটবেলার বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এসেছিল জোহান।কেমন একটা দৃঢ় ভাবনা ভরে ফেলছিল তার মন, ধীরে ধীরে সংযোগ হারাচ্ছে সে পুরনো জীবনের সাথে - নিঃশব্দে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে।
মনখারাপটা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল সে, যখন এলমার আগমন হোল তার জীবনে। একদল নতুনদের সাথে পরের  বছর চশমা পরা, সোনালী চুল, রোগাটে মেয়েটি ভর্তি হোল। কোনওমতে মস্তবড় ব্যাগ, হাতের কাগজপত্রের ফাইল আর কাঁধের গীটারখানা সামলে ভীতু ভীতু মুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে করিডোর পেরিয়ে চলেছে সে ক্লাসরুম আর গ্যালারী চিনতে। জোহান খোঁজ নিয়ে জানল এলমা এসেছে বার্লিনের দক্ষিণ-পুর্ব ছোট্ট দ্বীপ-শহর ওয়ার্ডার থেকে। জায়গাটি হাভেল নদীর ওপর অবস্থিত। মেয়েটির ওপর একটা সহানুভূতি তৈরি হোল জোহানের। তারই মত, অথবা তারও চেয়ে একটু অপেক্ষাকৃত অশ্রুত জায়গার মেয়ে এলমা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল জোহান আলাপ সারতে। গুটেন মর্গেনবলতেই মেয়েটা এমন চমকে গেল যে তার পিঠে ঝোলানো গীটারের গুঁতোয় জোহানের নাকখানা টমাটোর মত লাল হোল। বেশ কয়েকবার ক্ষমাপ্রার্থনা করল কন্যে। যখন কফির কাপ নিয়ে বসল ওরা, প্রথমেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল নবাগতা। একদম হারিয়ে যাচ্ছে সে এত্তবড় শহরে, এই এতবড় প্রতিষ্ঠানে। পালিয়ে বাড়ি ফেরত যেতে ইচ্ছে হচ্ছে যে তার! আলাপ জমাতে অন্ততঃ নামটা জানা প্রয়োজন। নিজের নাম জানিয়ে, “উই হাইবেন সীদু-চারবার জিগ্যেস করেও জোহান সোনালী-চুলো ছিঁচকাঁদুনের নাম জানতে পারলনা। সে তখনও ধরা গলায় বলে যাচ্ছে তার শহর হাভেল-ওয়ার্ডার কত স্নিগ্ধ মনোরম, বলে চলেছে সেখানকার মাছধরা নৌকাদের কথা, বসন্তের আপেল গাছের মিষ্টি ফলের কথা ইত্যাদি। জোহান ততক্ষণে বুঝে গেছে, এ মেয়ে একদমই শহরের সপ্রতিভ মেয়েদের মতন নয়, বরং জোহানের চেয়েও চলতি ভাষায় যাকে বলে গেঁয়ো। অনেকক্ষণ একাই কথা বলে বোধহয় একটু সুস্থ বোধ করলো মেয়েটা। এবার ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফি এক নিঃশ্বাসে শেষ করেই বলে উঠল, “আচ্ছা আমার একটা নাম আছে, তুমি আমায় এলমা বলে ডাকছ না কেন বলত!?” মুচকি হেসে জোহান জবাব দিল, ‘তাইতো, একদম ভুলে গেছি

জোহানের ওপর দারুন ভরসা তৈরি হোল এলমার। পড়াশোনা, প্র্যাকটিস সম্বন্ধে আলোচনা ছাড়াও যখন সে জানতে পারল অ্যাকাডেমির বেশ কয়েকটি স্কলারশিপ পেয়েছে ছেলেটি, তখন শ্রদ্ধা মেশানো একটা ভালোলাগা তৈরি হওয়া তো অবশ্যম্ভাবী। কথায় কথায় এলমার বাবা-মা আর ছোট বোনের কথা জানল জোহান।জোহান জানালো তার উদাসীন বাবা, হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মা, ফেলে আসা শহর ড্রেসডেনের কথা, ও প্রিয় বন্ধু সাইমনের কথা, সাইমন - যাকে সে এখন অবধি দেখেনি, দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও কম, অথচ যার সাথে বন্ধুত্ব প্রগাঢ়।

স্নাতক জোহান অতিক্রম করেছে সাধারণ ও উচ্চতর ও উচ্চতমস্তরের পরীক্ষাগুলি। ফাইনালের পর কনসার্টে বাজানোর প্রশিক্ষণে সে ব্যাস্ত। তার প্রতিটি বছরের মানপত্র, পুরস্কারের ছবি সে সাইমনকে ইন্টারনেটে পাঠায়। প্রাণ খুলে অভিনন্দন জানায় বন্ধু, আশা দেয় একদিন জোহান হবে ক্রীস র্যানসের মতন বিখ্যাত গীটারবাদক, যিনি ছিলেন জোহানেরই মত পূর্ব-জার্মানির মানুষ, ড্রেসডেন হাই-স্কুল-অফ-মিউজিকে হাতেখড়ি নিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে অ্যাকুস্টিক গীটারের জগতে দারুন বিখ্যাত হয়েছিলেন। জোহানের ভালো লাগে এই সহৃদয় অনুপ্রেরণা। ইদানীং সে সাইমনকে মেল করে এলমার ছবিও পাঠিয়েছে। সাইমনের তো স্কাইপের কানেকশন নেই।

এলমার সাথে সম্পর্কটা কোন দিকে যাচ্ছে সেটা জোহান ঠিক আঁচ না করতে পারলেও সাইমন নিশ্চিত, এলমাই হবে জোহানের যোগ্য জীবনসঙ্গিনী। পাশ করার পর উচ্চতর ট্রেনিং এর জন্য এলমা বেছে নিয়েছে ক্লাসিক্যাল গীটারের প্রশিক্ষণ। নাইলন তারের যন্ত্রে আঙ্গুল দিয়ে বাজিয়ে অদম্য আগ্রহে জোহানকে শোনায় সদ্য শেখা ফলসেটা,ফ্ল্যামেঙ্কো স্টাইলের বাজনার বিন্যাস। দুজনে ভেসে যায় সুরের মূর্ছনায়, এক সুন্দর পারস্পরিক ভালোলাগা আর মুগ্ধতায়ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। জোহানের একাকিত্বের দিন বোধহয় শেষ হোল।

ড্রেসডেনে বাড়ি যাওয়া হয়নি অনেকদিন। বড়দিনও গতবছর বার্লিনেই কাটিয়েছে জোহান। এলমা নিজের বাড়ি গিয়েছিল, বাড়িতে বলেছে জোহানের কথা, আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন ওর বাবা-মা জোহানকে। জোহানের বাবা খুব কমই যোগাযোগ করেন আজকাল। চাকরীর থেকে অবসর নেওয়ার পরও তিনি কিছু বেসরকারি সংস্থায় কাজকর্ম করছেন, অন্তত যতদিন না জোহান রোজগারপাতির উপযুক্ত হয়।
জোহানের প্রথম দুটি একক অনুষ্ঠান হয়ে গেছে।একবার সে বাবাকে কনসার্টের কার্ড পাঠাতে চেয়েছিল, কি ভেবে আর পাঠায়নি। কার্ড ইন্টারনেটে পাঠিয়েছে সে প্রিয় বন্ধু সাইমনকে। এলমার বাবা-মা এসেছিলেন, অভিনন্দন জানিয়ে গিয়েছেন। ইন্টারনেটে কার্ড কিনেছে অনেকেই। তার মধ্যে একজন ভক্ত অনুগামী কিনেছে কুড়িখানা কার্ড। সে পাগল আর কেউ নয়, সাইমন নিজে। চাকরীর ব্যাস্ততার জন্য সে নিজে আসতে পারবেনা, কিন্তু তার নানা বন্ধু-বান্ধবীকে সে ফাংশনে উপস্থিত থাকার জন্যকার্ড পাঠাবে। ভিড় হয়েছিল, সভাগৃহ দুদিনই ভর্তি। উচ্ছসিত প্রশংসা পেয়েছে জোহান শ্রোতা, খবরের কাগজ, টি-ভি চ্যানেলদের কাছে।

এবার জোহান এনগেজমেন্টটা সেরেই ফেলল এলমার সঙ্গে। ডমিনিক ব্যাস্ততার মধ্যে বেশ মোটা টাকার চেক পাঠিয়ে আশীর্বাদ জানালেন। বিয়ের অনুষ্ঠান হোল এলমাদের ছবির মতন সুন্দর ছোট্ট দ্বীপের কটেজে। তার বাবা-মা-বোন আত্মীয়স্বজন অনেক আনন্দ করলেন। নুন এবং রুটি নিয়ে এলমা এলো বিয়ের মন্ডপে, আর জোহানের হাতে তাজা শস্য। এ দেশে বিয়ের অনুষ্ঠানে এমনটাই প্রথা। আঙটি বদলের পর বর-বউ গ্লাসে চুমুক দিয়ে একসাথে শেষ করল শ্যাম্পেন, বিয়ারের মগ তুলে অভিনন্দন জানালেন আত্মীয়-বন্ধুরা, তারপর শুরু হোল জার্মান ওয়ল্‌ট্‌জ। অজান্তেই চোখ ভিজে উঠছিল জোহানের মার কথা ভেবে। তার রাজহংসীর মত সুন্দরী মা, তিনিও আজ কাছে নেই তাকে আর তার নতুন বধূকে আশীর্বাদ করতে। কিন্তু এলমার আঙ্গুলের বড় হীরের আংটিটাও অনেকখানি আত্মপ্রসাদ এনে দিলো তার মনে। ড্যাড ডমিনিক নিজে না আসতে পারলেও চমৎকার উপহারটির ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন।

সবচেয়ে বেশী তাদের অবাক করল কিন্তু বন্ধু সাইমন। কাজে ব্যাস্ত থাকায় ভোজসভায় আসতে পারেনি সে ঠিকই। কিন্তু বিয়ের পরের পরদিনই রাইন নদীর ওপর রোম্যান্টিকনৌকাবিলাসের দুটি টিকিট এসে পৌঁছল নবদম্পতির নামে। হয়ত এই জন্যই সাইমন এলমার বাড়ির ঠিকানাটা অত করে জানতে চেয়েছিল। লোকটির ফোন-নম্বর ইন্টারনেট থেকে খুঁজে আগেও ফোন করেছে জোহান, কথা বলতে পারেনি। এবারও কৃতজ্ঞতা জানাতে দুই-তিন দিন ধরে বারবার চেষ্টা করে ধরে নিতে হোল হয়ত বা তার ফোন খারাপ। মধুচন্দ্রিমার বেড়াতে যাওয়ার দিন আগত প্রায়। ফেসবুকের মেসেজ-বাক্সেই ধন্যবাদ জানিয়ে দয়ালু বন্ধুর জন্য একটি সুন্দর চিঠি লিখে রাখল জোহান-এলমা ।

রাইন ক্রুইসের মনোরম যাত্রা দুটি রাত ও তিনটি দিন ধরে। অনেক ছবি বন্ধু সাইমনকে ই-মেল করে পাঠিয়েছে জোহান। এমন চমৎকার ভ্রমণ তো তারই দেওয়া আশাতীত উপহার।

বার্লিন ফেরার পর কাজে ডুবে গেল ওরা দুজনেই। কিছু মিউজিক অ্যালবাম জোহানের ততদিনে প্রকাশ হয়েছে। সঙ্গীতজগতে সুনাম অর্জন করছে সে। নানা জায়গার থেকে আমন্ত্রণ আসে তার কাছে বাজনা শোনাবার জন্য। তাছাড়া আকাডেমির শিক্ষক হিসেবে সে পড়ায়, শেখায়, আরও হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে উজ্জীবিত করে।সহধর্মিণী এলমাও  চাকরি পেয়েছে।

কিন্তু কিছুদিন হোল সাইমনের কোন খবর নেই। ফেসবুকে, চ্যাটবাক্সে তার এইরকম অনুপস্থিতি তো আগে দেখেনি জোহান! হয়ত সে কাজের চাপে খুবই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে, মনকে প্রবোধ দেয় জোহান। কিন্তু ই-মেলে কুশল জিজ্ঞাসার  যখন জবাব পাওয়া গেলনা তখন চিন্তায় পড়ল সে। এ বন্ধুর সাথে যদিও দেখা হয়নি কোনদিন, তবুও যেন বহুদিনের পরিচিতির ভরসা-সৌহার্দ্যে ভরপুর হয়েছিল তাদের সম্পর্ক।জোহানের জন্য সে ছিল আপনজনের চেয়েও প্রিয়, একমাত্র অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের উৎসস্থল।

রাগ, অভিমান, একটু দুশ্চিন্তা নিয়ে তাকে আবার একদিন ফোন করল জোহান, কিন্তু আবার বিফল হোল সে। সাইমন কি জেনেশুনেই তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে? পুরনো বন্ধু যে এমন ব্যাবহার করতে পারে ভেবে খারাপ লাগল জোহানের। কই, সে নিজে তো সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেও বন্ধুকেভোলেনি। চেষ্টা করেও যোগাযোগ স্থাপন না করতে পেরে হাল ছাড়তে বাধ্য হোল জোহান। কাজকর্মের ব্যাস্ততা টেনে নিল তাকে যতদিন না পুরনো শহর ড্রেসডেন থেকে হঠাৎ পিতৃবিয়োগেরখবর এলো। বাবা বৃদ্ধ হলেও সুস্থ্ই ছিলেন, চলাফেরাকরতেন, অন্তত তাই তিনি জানিয়েছিলেন। হঠাৎই হৃদরোগে মারা গেছেন তিনি, পাশের বাড়ির পড়শী জানালেন। দেরী করেনি জোহান। এলমাকে নিয়ে ট্রেন ধরল তাড়াতাড়িই। এলমা অন্তঃসত্বা। অথচ তাদের ছোট্ট নবাগত বা নবাগতাকে বাবা দেখে যেতে পারলেন না, সফর করার সময় কষ্টে গলার কাছটা একটু ব্যাথা করে ওঠে জোহানের।

পুরনো বাড়িটা একই রকম রয়েছে। বাবার কিছু বন্ধু, সহকর্মী ও পাড়া-প্রতিবেশীর সাহায্যে শেষকৃত্য সেরে বাড়ি ফিরল জোহান। দু-চারদিন পার হয়ে গেল। এক বিকেলে এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বাবার প্রিয় পড়ার ঘরে গিয়ে তার আরাম কেদারায় বসল সে। মস্তবড় পুরনো দেরাজ-টেবিলটা ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে। তার ওপরে রাখা টুকিটাকি জিনিষের মধ্যে বাবার তামাকের পাইপ আর মার সাদাকালো ছবিখানা রাখা। শীত বেড়েছে এসময়ে। যেন অস্পষ্ট স্মৃতির মত বাইরের কুয়াশা ঘন হয়ে আসছে। সন্ধ্যেটা যেন একটু বেশী নিঃস্তব্ধ সেদিন।

কি ভেবে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো জোহান, এগিয়ে গেল পায়ে পায়ে ভারী টেবিলটার সামনে। চায়ের কাপ হাতে এলমা সবে এসে ঢুকেছে ততক্ষণে ঘরে। সেও এসে দাঁড়ালো প্রিয় মানুষটির পাশে। একটা একটা করে দেরাজ খুলতে শুরু করল জোহান। নানা কাগজপত্র, বাড়ির জরুরী নথিপত্র, আর টুকিটাকির মধ্যে প্রথম জিনিষ যেটা চমকে দিল জোহানকে সেটা হচ্ছে তার বার্লিন অ্যাকাডেমিতে স্নাতক উপাধিলাভ ফটোটির প্রতিলিপি। এটা এখানে এলো কি করে, আকাশ থেকে পড়ল জোহান! বাবা না তো এসে পৌঁছতে পেরেছিলেন সেদিন, না তো জোহান পাঠিয়েছিল এ ফটো তাকে। স্বল্পকথার চিঠিতে খবরটুকুই পাঠানো হয়েছিল শুধু। কবোষ্ণ জবাবে আশীর্বাণী এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু এটা ফটো হলেও অল্প একটু ঝাপসা, যেন ইন্টারনেট থেকে ছাপিয়ে নেওয়া হয়েছে ছবিখানা ! ড্রয়ারের এই ফটোর তলাতে পরতে পরতে আরও বিস্ময় জমে রয়েছে। জোহানের ছোটবেলার স্কুলের মিউজিক ক্লাসের সার্টিফিকেট, এমনকি বার্লিন অ্যাকাডেমিতে ভর্তিরপুরনো রসিদখানাও রক্ষিত আছে। কিন্তু এ কি দেখছে জোহান- তার অনুষ্ঠানেরএত টিকিট এভাবে গুছিয়ে রাখা রয়েছে কেন ? নীচের ড্রয়ার থেকে ততক্ষণে হাতে হাতে অনেকগুলো মিউজিক অ্যালবামটেনে বের করেছে এলমা। জোহানের প্রতিটি মিউজিক অ্যালবামের ওপর রিলিজের তারিখ লিখে রেখেছে এক চেনা হাতের লেখা। ড্রয়ার ভর্তি জোহানের ছবিতে কোথাও সে অপেক্ষাকৃত তরুণ, নতুন গীটার হাতে দাঁড়িয়ে, কোথাও বা এলমার সাথে বার্লিনে হাভেল নদীর ধারে দাঁড়িয়ে প্রেমময় আবেশে একাত্ম । বেশ কিছু ফটো তাদের দুজনের রাইন-নদীতে ভ্রমণের সময়  তোলা। এই মধুচন্দ্রিমা যাপনের কথাটাবাবাকে তো বিশদ বিবরণে জানানোও হয়নি জোহানের।সবশেষে পাওয়া গেল একখানা মোটা খাতা। জোহানের সব কয়টি অনুষ্ঠানের ছবি তার মধ্যে তারিখ দিয়ে পরপর যত্নে সাজিয়ে রাখা। শেষপাতায় পৌঁছে একদম থমকে গেল জোহান। অদ্ভুত ব্যাপার, পাঁচটি অক্ষর ও চারটি নম্বর মিলিয়ে ঠিক যেন একটি সাংকেতিক পাসওয়র্‌ড লিখে রাখা রয়েছে। অক্ষরগুলিতে জোহানের নাম সাজানো, নম্বরের জায়গায় তার জন্মের বছরখানা লেখা। বাবার শোয়ার ঘরে দৌড়ে গেল জোহান তাঁর পুরনো ডেস্কটপ কম্পুটারখানা খুঁজতে। বাবার বন্ধুরা বেলেছিল শেষ কয়েকমাস ডমিনিক এই ঘর থেকে আর বিশেষ বেরোতেন না। কি ভেবে সেই অদ্ভুত পাসওয়র্‌ড দিয়ে যন্ত্রটাকে জাগিয়েতুললজোহান। যন্ত্র কথা বলে উঠল, বলতে শুরু করল বিগত প্রায় এক দশকের ঘটনাবলী। লেকের ধারে দাঁড়ানো দূর থেকে তোলা সাইমনের ছবি ফুটে উঠল ফেসবুকের দেওয়ালে। সাইমন হয়ে জোহান দেখতে শুরু করল নিজেকে,দেখতে শুরু করল তার নিজের ছাত্রজীবন, তার বাবা ডমিনিকের উদাসীনতা নিয়ে তার নিজস্ব বিরক্তি ও হতাশার স্বীকারোক্তি, এলমার প্রতি আকর্ষণের দিনগুলো, রাইন ক্রুইসের সুন্দর সময়, নানা অনুষ্ঠান ও জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠার ছবি।


মাসচারেক পরে জন্ম হোল জোহান-এলমার প্রথম সন্তানের। নাম রাখা হোল সাইমন জোহান ক্রাউস।