গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

ধারাবাহিক

এই প্রবাস (৪)

 
বাজারের দিকে আসতে গিয়ে দুলুর আবদারে ওরা তিনজন বব্বন সিং এর দোকানের দিকেই এগিয়ে এলো। বব্বন সিং এর চায়ের দোকান এ তল্লাটের সবচেয়ে বড় চায়ের দোকান। চায়ের দোকান দিয়ে যে কেউ এত বড়লোক হতে পারে, ধারণা করা যায় না। শহরে তার দুটো তিনতলা বাড়ি, একটা আম্বাসাডার গাড়ী, আরো একটা জীপগাড়ির মত বড় গাড়ি আছে যেটা শহরের বাচ্চাদের নার্সারি স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসার
  জন্য ভাড়া খাটে।  এছাড়াও গরু, মোষ সব মিলে অনেক কিছু। সকাল-বিকেল বোধ হয় শহরের অর্ধেক লোক এই দোকানে জমায়েত হয় চায়ের জন্য। আর শুধু কি চা! চায়ের সমস্তরকম সরঞ্জাম বিক্রি হয় এখানে। ছাঁকনি থেকে বড় ডেকচি মায় তোলা উনুন পর্য্যন্ত।

বিরাট একটা হলঘর। চারিদিকে অনেক  বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল পাতা আছে। দোকানে ঢুকতেই ডাইনে-বাঁয়ে দুটো বড় বড় উনুনে প্রকান্ড বড় দুটো লোহার কড়াই চাপানো। তাতে ইয়া বড় বড় লোহার হাতা ডুবোন  আছে। সব সময় দুধ ফুটছে। আর একটু এগিয়ে একটা উনুনে বিরাট বড় আরো একটা ডেকচি চাপানো,  হরবখত তাতে চা ফুটছে। এই দোকানের চা যে আর পাঁচটা দোকানের চায়ের চেয়ে আলাদা  স্বাদের, তা ওরা জানে। দুলু তো বলেই দিয়েছে—বব্বন শালা নির্ঘাত চায়ে হেরোইন মেশায়, নইলে এতো ভিড় হবে কেন? নির্ঘাৎ সবাই ঐ লোভেই এই চা খেতে আসে। দুলুর কথা শুনে ওরা সবাই হাসে,কিন্তু এটাও ঠিকএই  চায়ের লোভে ওরাও এই দোকানেই আসে।

তিনজনেই দোকানে গিয়ে দ্যাখে আজ ভিড় একদম নেই, দোকান একেবারে  শুনশান। কি ব্যাপার, কিছু হয়েছে নাকি! এতো ফাঁকা তো কোনদিন থাকে না, শহরে কিছু নাকি বব্বনের কিছু হল? দুধ জ্বাল দিচ্ছিল মোটা মত যে লোকটা, দুলু তাকে জিজ্ঞেস করল—কেয়া হুয়া ভাইসাব, কৈ আদমী দিখতা নহী, কুছ হুয়া, কেয়া?’
--হম কা জানে সাব, পুলিশ লোগ আনে সে সব ভাগ গয়ে...’
--পুলিশ! পুলিশ কিউঁ?
-- হম ন জানে সাব, সব কই
  কহ রহে থে  কি বব্বন কো উঠাকে লে গয়ে...বহোত মারা, বহোত পিটা...’
--তোকে বলেছি না, শালা নিশচয়ই হেরোইনের চক্কর...বাটু বলে ওঠে।
--তুই থাম, একটা এতো বড় দোকানের মালিক, রোজ দুবেলা সবাই আসছে, খাচ্ছে এখানে, আর আজকে তাকে পুলিশ নিয়ে গেল বলে কেউ তাকিয়েও দেখবে না, সবাই নিজের প্রাণ বাঁচাতে ভেগে যাবে! চল তো, চল দেখি সীতারামের দোকানে চল... কি লোক মাইরি সব!’ টুটুল বাটু আর দুলুর হাত ধরে টানতে টানতে দোকানের বাইরে বেরিয়ে এলো। মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না টুটুল। এতো দিনের পরিচয়, বন্ধুত্ব, ভালবাসার কি তাহলে কোন দাম নেই? একটা লোককে এভাবে তোমরা সবাই ছেড়ে দিলে! সীতারামের দোকানের দিকে যেতে যেতে ওরা দেখল একটা পুলিশের গাড়ি বব্বনের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল।

 -পুলিশ ছুলে আঠারো ঘা জানিস তো, বব্বনের এখন অনেক ফ্যাকড়া যাবে’ বলল দুলু। সীতারামের দোকানের কাছে আসতে আসতে দেখল বাদল আর লাল্টু বসে আছে। দোকানের সীতারামের কাজ করে  দেয় যে ছেলেটা, মানকে, সে হাত-পা নেড়ে কিসব বোঝাছে ওদের। দুলু, বাটূ, টুটুলরা দোকানে এসে পড়ল।   



বব্বন সিংয়ের
  দোকানের গোলমালের খবরটা সীতেশ আগেই পেয়েছিল। অফিস থেকে ফিরে চা খেতে খেতে বাড়িতে কণার কাছে  শুনেছিল।
 --জানো,আজকে না ঐ বব্বন সিং...ওই যে গো, তোমাদের বড় চায়ের দোকানের মালিক, ওকে...পুলিশে ধরেছে’।
-কে বলল, তোমার গেজেট?’ বিদ্রূপ করল সীতেশ।
--হ্যাঁ, আমার গেজেট...’ হেসে ফেলে কণা। ‘ কিন্তু সত্যি ওকে পুলিশে ধরেছে, কি নাকি মেয়েদের নিয়ে...   কি একটা হয়েছে, কাকে যেন ঘরে রেখেছিল, সব বলাবলি করছিল...’ আবার বলে কণা। 
--যদি, নাকি,বোধহয়...এভাবে কথা বলো কেন, ঠিক করে বলতে পারো না?’ একটু যেন বিরক্ত হল সীতেশ। পুরোটা না জেনে কথা বলাই বা কেন!
--আমি কি ওখানে গেছি নাকি!’ অনুযোগের সুর কণার গলায়।
--দ্যাখোগে, কি শুনতে কি শুনে এসেছে, তোমার ইনফর্মার তো!’ এবার হেসে ফেলে সীতেশ।
-বেশ তো, নিয়ে এসো না কি খবর, এখন তো পাড়া বেড়াতেই যাবে!’
--পাড়া বেড়াতে যাবো, কত কাজ বাকি এখনও, আর কটা দিন পড়ে আছে পুজোর, সে খেয়াল আছে কারো? পাড়া বেড়ানোই বটে। সব সীতুদার মাথায় চাপিয়ে বসে আছে!’ কিছুটা ছদ্মরাগে বলে সীতেশ।  জানে সকলে তাকে ভালবেসেই এই কাজেই দায়িত্ব দিয়েছে।
 

চা-টা খেয়ে স্কুটারটা নিয়ে বাজারের দিকে বেরোল সীতেশ। কৌতূহল একটা ছিলই। তাছাড়া কাজও আছে। পুজোর মাত্র আর কটা দিন বাকি, লাল্টুদের আজ বলেছে সীতারামের দোকানে আসতে। চাঁদা কালেকশনের আজকেই শেষ দিন, বাকি টাকা ওদের নিয়ে এসে দোকানেই জমা দিতে বলা হয়েছে, কিছু কাজ এখনও বুঝিয়ে দিতে হবে। লাল্টুর ওপরই দায়িত্বটা দিয়েছিলো সীতেশ। দুলুরা এখনও ছোট, তাছাড়া
 ওদের দায়িত্ববোধটাও যেন ঠিকমত গড়ে ওঠেনি।  এখনকার এই বয়সের ছেলেরা এতো বেশী গুলতানিতে সময় নষ্ট করে! মনে মনে বিরক্ত বোধ করে সীতেশ, তাদের সময় ঠিক এইরকম ছিল না। পাড়ার বড়রা কিছু বললে ঠিক সময়ে ঠিক কাজটা করে দিত ওরা।  বাপি, তনু, শুভ, ঋষি এদেরও সীতেশ দেখেছে। বিনয়ী, পরিশ্রমী ছেলে ছিল সব। এরাও যে মুখের ওপর খুব একটা ওজর আপত্তি করে তা নয়, তবে ঐ যে কি যেন বলে মস্তি, সেটা এদের চাই, আর বড়দের সামনেও কোন কথা বলা আটকায় না। ইব্রাহিম, না টুটুল  বেশ মজা করে বলে কথাটা –ম স্‌ তি! এদের সব সময় মসতি চাই, মসতি! মনে মনে উচ্চারণ করে হেসে ফেলল সীতেশ। সীতারামের দোকানের কাছে এসে দেখল মানকে একনাগাড়ে হাত পা-মুখের বিচিত্র ভঙ্গিমা করে কি যেন বলে যাচ্ছে আর দুলুরা হাঁ করে শুনছে।  স্কুটারটা দোকানের সামনে এনে রাখল সীতেশ।

সীতারামের দোকানে এসে বব্বন সিংয়ের ঘটনায় যত না অবাক হল সীতেশ, তার চেয়েও সে অবাক হল মানকের বাচনভঙ্গীতে। মানকে, এই সেদিনের বাচ্চা, মা ভিক্ষে করে বেড়াত, মারা গেলে সীতারাম তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল। পরে বড় হলে দোকানের কাজে লাগিয়ে দেয়, ওর বাড়িতেই থাকে কাজের লোকজনদের সঙ্গে। সেই মানকে, যার কিনা মেরে কেটে বছর দশেক বয়স হবে, সে হাত-পা নেড়ে বিচিত্র ভঙ্গীতে বর্ণনা করে যাচ্ছে বব্বন এর ঘটনা, তাও আবার যা কিনা নারীঘটিত! আর ছেলে গুলোকেও দেখো, হাঁ করে গিলছ ওর কথা। দোকানে পা দিয়েই মানকে কে এক ধমক লাগাল সীতেশ—এই, যা ভাগ, ভাগ বলছি! আর তোদের কাজ নেই, বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিস...’ ছেলেদের বলে সীতেশ। দোকানে আসার পথেই কিছুটা শুনে এসেছে সীতেশ। বব্বনের সম্ভবতঃ অন্য কোন নারীর প্রতি আকর্ষণ, তার থেকেই সংসারে অশান্তি, মনকষাকষি। এরা পারেও বটে, সারাদিন ঐ হাড়ভাঙ্গা খাটুনি তার পরে আবার এইসব! বিচিত্র একটুকরো হাসি খেলে গেল সীতেশের মুখে। বাজারে এখন কতরকমের গুজব ছড়াবে এই নিয়ে। কিন্তু এরা কাজকর্ম ফেলে এইসব নিয়ে আলোচনা করুক মোটেও চায় না সীতেশ। কতকাজ বাকি...! সীতেশের ধমকানিতে বাদল, লাল্টুরা লজ্জ্বা পেল। কেউ উঠে দাঁড়াল, কেউ মুখ নিচু করল। লাল্টু এক থোক টাকা দিল সীতেশের হাতে, আজকেই শেষ চাঁদার টাকা। বাদল কয়েকটা টাকা মানকের হাতে দিয়ে বলল-যা, কেটলি নিয়ে যা, চা নিয়ে আয় সবার জন্য। দৌড়ে যা, অনেক কাজ এখন।‘

সীতেশ গম্ভীর মুখে কাগজপত্র নিয়ে বসল। দুলুরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল তারপর সবাই মিলে সীতেশকে ঘিরে গোল হয়ে বসল।
আর কথা নয়, এবার পুজোর কথা, কাজের ফিরিস্তি। পুজোর আর চারদিন বাকি।

(ক্রমশঃ)