গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭

আফরোজা অদিতি

অচেনা পথ তবুও

    মাঝরাত। সংজ্ঞা ফিরেছে রুণার। চারদিক চোখ ঘুরিয়েও বুঝতে পারলো না কোথায় আছে!  বুকের ওপর ভাজ করা ডান হাত ব্যথা করছে; পাশে রাখতে ঠাণ্ডা স্পর্শে গা শিরশির করে ওঠে। তেষ্টা পেয়েছে খুব। ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে শরীরে। মেঝের ঠাণ্ডা,শরীরে ঠাণ্ডা বাতাস; এতো ঠাণ্ডা-শীত-শীত লাগছে কেন তা বুঝতে সময় লাগে ওর! দরোজা খুলে রেখে ঘুমিয়েছে ভেবে,মাকে ডাকলো, ‘মা,মাগো,দরোজা দিয়ে দাও না মা, আমি উঠতে পারছি না হাত ব্যথা করছে! খুব আলসেমী লাগছে মা; ও মা,শোন না। তুমি এসো না মা!’ এভাবে মাকে ডেকে গেল একনাগাড়ে; বারবার।
    ওর ডাকে সাড়া দিলো না মা;কোথায় গেল মা! ভাবতে ভাবতে বসতে গিয়ে বুঝতে পারলো পুরো শরীর জুড়ে ব্যথা। এতো ব্যথা কেন শরীরে!উঃ! বলে বুকের ওপর হাত রাখতে গিয়ে বুঝতে পারলো বুকে কাপড় নেই;পাশে হাত রেখে বুঝলো শক্ত মেঝে। খালি গায়ে শুয়েছে কেন? মেঝেতেই বা কেন?ভাবলো কিছুক্ষণ। কী হয়েছে মনে করতে পারলো না। মায়ের ওপর রাগ হলো। এইভাবে খালি গায়ে উদোম হয়ে শুয়ে আছে মেঝেতে আর মা ডাকেনি ওকে। মা তো এমন নয়! সব সময় খেয়াল রাখে;কেন এভাবে শুয়েছে?ঘরের বাতি নিভছে না জ্বেলছে? কিন্তু আজ কী হয়েছে মায়ের! আবার ডাকলো মাকে।মা, শোন,ও  মা, মাগো।
    এলো না মা। মায়ের ওপর অভিমানে ভাইকে ডাকলো, ডাকলো বোনকে। সবশেষে ডাকলো,    ‘বাবা, বাবাগো, ও বাবা। আমার তেষ্টা পেয়েছে, জল দাও।’ ওর বিশ্বাস ওর ডাকে কেউ না আসুক বাবা আসবেই, আসবেই বাবা। বাবার আদরের মেয়ে। প্রায়ই সকালে চা খেতে খেতে মা-কে ডেকে বাবা বলেন,  ‘আমাদের রুণা একদিন নামিদামি কেউকেটা হবে দেখবে। বড় লক্ষ্ণী মেয়ে।’কখনও বলে ওকে, ‘তোকে আমি ম্যাজিস্ট্রেট বানাবো রে। তুই সকল নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিবি। কখনও পিছ পা হবি না।’
    রুণা চোখের জলে ডাকে, ‘বাবা, বাবা, বাবাগো।’ এলো না বাবা। কেউ এলো না যখন তখন দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদলো, অনেকক্ষণ কাঁদলো; কাঁদতে কাঁদতে হালকা হলে মনে পড়লো সব। কী ঘটেছে ওর সঙ্গে;বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে কান্না বন্ধ হয়ে গেল। জ্বলে উঠলো চোখ।
    ঘটনা মনে পড়লো; কয়েকদিনের বৃষ্টি থামলেও সকাল থেকে গুমোট ছিল আকাশ। চারদিক থইথই বন্যা। বন্যার জল ডুকেছে শহরে, জলাবদ্ধ শহর। কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি লক্ষ্য করে মা বলেছিলেন, সারারাত বৃষ্টি হয়েছে, এখনও গুমোট মেঘলা আকাশ; বৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া জলাবদ্ধতায় রিকশা পাবি না। আজ কলেজে যাস না।’ মাকে জড়িয়ে বলেছিল, ‘মা, ভেবো না, ঠিক যেতে পারবো, আবার আসতেও পারবো। ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে মা, না গেলে বুঝতে অসুবিধা হবে! তুমি চিন্তা করো না মা। নৌকা করে কিছুদূর গেলে ঠিকই রিকশা পেয়ে যাবো।’
    মায়ের বারণ না মেনে ভুল করেছে রুণা। কলেজে পৌঁছানোর পরেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। চার ঘণ্টা এক নাগাড়ে ঝরলো, তারপরে থামলো। ওদের ক্লাসটাও হলো না। বৃষ্টি একটু ধরে এলে পথে নামে। থৈথৈ রাস্তা। রিকশা নেই। কলেজে মেয়ে এসেছে কয়েকজন। যে কয়েকজন এসেছিল তারা অন্য এলাকার। চলে গেছে ওরা। রুণা অপেক্ষা করতে থাকে রিকশার জন্য; একা একা ভয় লাগে ওর। নির্জন রাস্তা; জল জমা রাস্তাতে ছপছপ শব্দে হাঁটতে থাকে। কিছুদূর হেঁটে একটা রিকশা পেয়ে উঠে পড়ে। চলেছে রিকশা; হঠাৎ খেয়াল হয় ভাড়া মিটানো হয়নি। ভাড়া মিটানোর কথা মনেও হয়নি, রিকশা পেয়েছে উঠে পড়েছে। খেয়াল হতে ভাড়ার কথা বলতে যাবে ঠিক তখনই থেমে গেল রিকশা।

    ‘তুমি থামলে কেন?’ওর কথা রিকশাওয়ালা গাছের আড়াল দেখায় আঙুল তুলে। রুণা ভাবলো রিকশাওয়ালা বুঝি প্রকৃতির ডাকে যাচ্ছে। একটু লক্ষ্য করলে বুঝতে পারতো ওর ধারণা কতো ভুল! বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে আবার। বিরক্ত লাগছে রিকশাওয়ালার ওপর। মায়ের রাগের কথা ভাবছে; মা খুব বকা দিবে। মায়েরা সব সময় ঠিক কথা বলে; মায়ের বারণ না শুনে খুব ভুল করেছে; নিজেকেই বকা দিতে ইচ্ছা করছে। রিকশাওয়ালা দেরি করছে কেন? কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে;বিপদের গন্ধ আসছে।‘এই রিকশাওয়ালা গেলে কোথায়...’ বলতেই লক্ষ্য করে আসছে রিকশাওয়ালার পেছনে আরও চারজন। ওরা কারা?

    ভয় পায় রুণা। তাড়াতাড়ি আসতে বলে রিকশাওয়ালাকে; আসে না সে, আসে ওরা চারজন। নাকে রুমাল চেপে ধরে। তারপর আর মনে নেই। প্রতিদিন পাশের বাড়ির শীলা আর ও আসে-যায় একত্রে। আজ শীলা আসেনি; ওর জ্বর। শীলার কথা মনে হতেই মনে পড়ে অমিতের কথা। অমিত বিসিএস দিয়ে কাস্টম্‌স অফিসার হিসেবে জয়েন করেছে। অনার্স শেষে বিয়ে হবে ওদের। বিয়ের কথা মনে হতেই ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। এই শরীর তো শরীর নেই; নষ্ট হয়ে গেছে। শরীর শেষ হলেও জীবন তো শেষ হয়নি। তাছাড়া রোমাঞ্চের কথা ভাবার সময় নয় এখন, এখন যুদ্ধের সময়। সে যুদ্ধের জন্য সময় এবং প্রস্তুতি দুটোরই প্রয়োজন;তৈরী হতে হবে ওকে।
    অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায় রুণা। গায়ে কাপড় নেই। এদিক-ওদিক হাতড়ে ঘরের এককোণে খুঁজে পায় ছেঁড়াফাটা জামা-পাজামা-ওড়না। ওগুলো কোনমতে গায়ে পেঁচিয়ে পথে নামে। কোথায় ওকে এনেছে,কোথায় আছে অন্ধকারে কিছুই বুঝতে পারছে না। তবুও পায়ে পায়ে এগুতে থাকে।
    পথ যতো অচেনাই হোক,শরীর যতো ক্লান্ত,অবশ,এই অবস্থাতে পথ চলতে অসমর্থ হোক না কেন রাত শেষ হওয়ার আগেই ঘরে ফিরতে হবে-ই ওকে; যেভাবেই হোক।