ডাইনিং
টেবিলের সামনে গিয়ে শাশ্বত হতবাক। মা বাড়ি নেই আজ
তিনদিন। তাও ডিনারে ফুলকো লুচি,নারকোল কুচি দিয়ে ছোলার ডাল,বেগুন ভাজা,দই পটল,আমের চাটনি আর সিমাইয়ের পায়েস ! থালা সাজানোর ভঙ্গিটিও চমৎকার ।
মা,বাবা গেছেন কলকাতা থেকে খানিক দূরে এক অসুস্থ আত্মীয়ের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত
করতে।ফিরতে ফিরতে আরো দিন সাতেক।বছর বত্রিশেকের শাশ্বত,তার
একদা সহপাঠিনী স্ত্রী চন্দ্রিমার দিকে অবাক হয়ে তাকায় একবার।মুখে কিছু বলে না।
মুখোমুখি
বসে দুই ভাই শাশ্বত আর অভিনব খুব তৃপ্তি করে আহার সারে।দুজনে যতবার লুচির ফরমাস করেছে,চন্দ্রিমা রান্নাঘর থেকে নিজে এসে গরম,গরম ফুলকো
লুচি দিয়ে গেছে।
অভিনব
চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে,'কেসটা কি রে দাদা---ম্যাজিক?ফেয়ারি গডমাদার টাদারের কেস না কি?
উমা মাসীর চোদ্দ পুরুষের অসাধ্য এমন রান্না করা---হল কি রে ?'
'থাম ছোটকু,খালি চ্যাংড়ামি।তবে আমিও তাজ্জব বড় কম নই । বিলকুল ঘেঁটে ঘ'।
এমন
সময় দুই ভাইয়ের সামনে একটা সন্দেশের বাক্স নিয়ে এসে হাজির,তাদের প্রায় পনেরো বছরের পুরোনো রাতদিনের কাজের লোক---উমা মাসী ।
'ও বড়দা,ও ছোড়দা বউদিদি আপিস থেকে ফেরার সময় জলভরা আনিছে,লেবে আখন না কি কাল খাবা'?
উমাকে
দেখেই অভিনব ধরে পড়ে,'এই মাসী তুমি এত ভাল রান্না
করতে শিখলে কবে গো ? কুটনো
কাটা আর বাটনা বাটা ছাড়া তো তোমাকে মা আর কিছু করতে দেয় না-----দেখে দেখে শিখে গেলে না কি ?'
'আ মরণ, কি কও বাপু তোমরা! আমি গেরামের
গরিব ঘরের মেয়ে,আমি অত গরম মশলা,হিং
এসব দে কি আন্না কত্তে পারি।আজ সব আন্না বউদিদি করেছে----এখনো
ছ্যাঁক ছোঁক করে কি করতেছে, কাল
টিপিন হবে।কি খাবার আমি বলতে পারবোনি----উশ্চারণ হয়নি'।
'বল কি?'
চোখ ছানাবড়া শাশ্বতর ।
রান্নাঘরের
উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,'চন্দ্রি, আজ অফিস যাওনি ?
না কি ম্যানেজ
করে তাড়াতাড়ি কেটে এসেছো
?'
চন্দ্রিমা
সামনে এসে দাঁড়ায়।স্মিত হেসে বলে,'এই সাড়ে তিনটের মধ্যে
ফিরে এসেছি ম্যানেজ করে কোনমতে।'
'তা তো
বুঝলাম । কিন্তু এই ম্যাজিক
দেখালে কি করে?আমরা তো জানি তুমি গৃহকর্ম-অনিপুণা। মা তো তোমাকে দিয়ে কিচ্ছুটি করান না।নিজেই খেটে
মরেন'।
অভিনব
ফুট কাটে,'চাটনিটা কিন্তু মায়ের থেকেও ভাল হয়েছে রে দাদা----মা কালীর দিব্যি।'
শাশ্বত
আবার বলে,'অদ্ভুত ব্যাপার । পারো যদি করো না কেন ? আমার বুড়ি মা কে দুবেলা হেঁসেল ঠেলতে হয় । আর মা থাকাকালীন যাও বা দু একবার রান্নাঘরে ঢুকেছো, যা বানিয়েছো,
তা তো খাবার অযোগ্য।
মুখে তোলা যায় না।আচ্ছা ছুপা রুস্তম তো তুমি ।'
স্বামীর
ভ্রু যত ধনুকের মতন হয়, চন্দ্রিমার
ঠোঁটে তত ত্রয়োদশীর চাঁদ খেলা করে
না, চন্দ্রিমা জবাব দেবার কোন প্রয়োজন বোধ করে না।
সেরাতের
খাবার পাট চুকলে,দেবর আর স্বামী নিজের নিজের
ঘরের দিকে হাঁটা লাগায়।চন্দ্রিমা পরের দিনের জলখাবারের প্রস্তুতি শেষে,এটা সেটা গুছিয়ে যখন খেতে বসবে,বসবে করছে----গ্যাস ওভেনের পাশে রাখা ফোনটা কর্কশ শব্দে বেজে ওঠে।
ফোন
ধরতে দেখে,ফোনের ওপারে সায়ন্তনী----শাশ্বত আর চন্দ্রিমার কলেজবেলার বন্ধু।
ফোন
ধরতেই সায়ন্তনী বলে,'ক্যায়া রে বস ? সমস্যা গম্ভীর হ্যায়।শালা শাশ্বত হারামজাদা আমাকে
ফোন করে বলছে----তুই নাকি ওদের বুরবক বানিয়ে দুর্দান্ত রান্না
করেছিস আজ।আমি বললাম,আরে চন্দ্রি তো স্কুলবেলা থেকেই দারুণ
রান্না করে।বাড়ির ছাদে আমরা ফিস্ট করতাম----বরাবর চন্দ্রি
মাংস আর চাটনিটা করতো।অবাক হবার কি আছে এতে?'
চন্দ্রিমা
উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে,'তোর কথার
উত্তরে ও কি বলল রে ?'
'আরে বলছে,প্রায় দেড় বছর বিয়ে হয়ে গেল,তুই না কি দু তিনদিন
মাত্র রান্না করেছিস।তাও যা বানিয়েছিস তা না কি অখাদ্য।ওর মা এত ভালো যে ওদের আড়ালে
ডেকে বলেছেন তোকে দিয়ে ঘরের কাজ না করাতে।বলেছেন সকলে তো সব পারে না।উনি যতদিন বেঁচে
আছেন,উনিই ছেলেদের রান্না বান্না করে খাওয়াবেন।আমি শুনে তো
তাজ্জব!কেসখান কি খোলসা কর দিকিনি । ন্যাকা সেজে থাকিস কেন?'
চন্দ্রিমা
খানিক হেসে,
আশপাশের দিকে না
তাকিয়েই উত্তর দেয়,'কিছু না,স্রেফ
টিঁকে থাকার স্ট্র্যাটেজি গুরু।শোন আমি বিয়ের আগে তো আর এই
বাড়ি আসিনি।শাশ্বতর মাকে দেখিওনি । এসে দেখলাম মহিলা রীতিমতন কুৎসিত----দাঁত উঁচু,মধ্য পঞ্চাশেই গাল ভাঙা, গ্রাম্য আর চূড়ান্ত অশিক্ষিত।ক্লাস
ফাইভ অবধি পড়েছেন কি না সন্দেহ।সেটা কথা নয়।মহিলা মননেও অশিক্ষিতা।আর বেচারি অসম এক
বিবাহে আবদ্ধ।শাশ্বতর বাবার ডেজিগনেশন আর ডেজিগনেশন জনিত ক্ষমতার বহর তো তুই জানিস
সায়ন ।'
'হুম----ঠিক খোলসা হচ্ছে না ----এ প্রসংগে ওগুলোর
রেলেভেন্স কি?'
'রাই ধ্যৈর্যং । আমি দেখলাম----আমার মতন অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন, তথাকথিত শিক্ষিত আর একটু প্রেজেন্টেবেল বউ বাড়িতে
আসার ফলে,মহিলা প্রচন্ড বিপন্ন বোধ করছেন । দ্যাখ ওনার দোষ নেই----ওনার মনের আগল তো কেউ
খুলে দেয়নি । প্রত্যন্ত গ্রামের
মেয়ে।গরু, জমি,লাঙল নিয়ে কথাবার্তা শুনে শুনে বড় হওয়া।ওনার বাপের বাড়িতে কতজন বাইরের লোক
সকালে,বিকেলে দুধ,মুড়ি খায়---সেটা ওনার গল্পের আর গর্বের বিষয় । উনি অ্যাকসেপটেন্স শিখবেন কি করে ? আধারই তো তৈরী হয়নি ।'
'উফ,ওরে জ্ঞানদানন্দিনী,খোলসা কর----রান্নার সাথে এসব মনন,চিন্তন,মনের অর্গল মার্কা বাতেলাবাজির সম্পর্কটা কি ? রাত দুপুরে বাতল দিচ্ছিস কেন রে ?'
'আসছি।বলতে
দিবি তো । ইন্টারাপ্ট করলে
আর বলবো না বলছি ।'
'না বলো
গুরু,বলো।শালা এম.সি.এ না করে সাইকোলজি পড়লে বোধহয় ভালো করতি---"।
'দূর বলবো
না।দূর হ,হতভাগা ।'
'বলেই ফ্যাল
মা । মুন্নাভাইয়ের মতন টেনশন দেনে কা আদত ছোড় ইয়ার ।'
'দ্যাখ
বিয়ের পর পর একদিন উনি ছিলেন না, একজন গেস্ট আসায় আমি চা করে
দিই । উনি ফিরে এসে রান্নাঘরে
ঢুকেই আমাকে বললেন----দুধের মধ্যে একগাদা চা পাতা পড়ে আছে।উমাকে
বকছিলাম।উমা বলল বউদিদি চা করে দে ছে ।'
'তো ?'
'তো আর
কি ? আমি মুহূর্তে স্ট্র্যাটেজি
ঠিক করে ফেললাম । আমি আদৌ ওই দুধ
দিয়ে চা করিনি । ফ্রিজ থেকে মিল্কমেড
বার করে চা করে দিয়েছিলাম।উনি এনি হাউ মিথ্যে কথা বলে কোথাও একটা জিততে চাইছেন । আমি দেখলাম এই ব্যাপারটা নিয়ে ওনার সাথে লড়তে
যাওয়া মানে নিজের শিক্ষাদীক্ষাকে অসম্মান করা। স্বল্প বুদ্ধি মহিলা
যখন আমাকে প্রতিপক্ষ ভাবছেন,তখন আমাকে হেরে গিয়ে ওনার ইগো
বুস্ট আপ করতে হবে।ওনাকে জিততে দিতে হবে।বোঝাতে হবে সংসারের পিভোটাল ফিগার উনি।উনি
ছাড়া সংসার অন্ধকার । গোমুখ্যু মহিলা----আমার এত ছক বুঝবেন না। মনে মনে ব্যাপক
খুশি হবেন আর আমার আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেকে বলবেন----আমি মরে গেলে যে তোর কি হবে কে জানে! একথা বলে
মনে মনে অত্যন্ত শ্লাঘা অনুভব করবেন।বেচারিকে ঈশ্বর রূপ,গুণ,বুদ্ধি সবেতে বঞ্চিত করেছেন।মরাল গাইডেন্সও পান নি।এই জেতাটুকু জিততে দিলে
ওনার সদা সন্ত্রস্ত আত্মবিশ্বাস আর চুরচুর হবে না।তাই উনি আমাকে রান্না করতে বললে আমি
ইচ্ছে করে আদা বাটা দিই না নয় ঘি দিতে ভুলি নয় বেশি হলুদ দিই।আমি চাই আমার অক্ষমতাটা
উনি রেলিশ করুন।নয়তো অবসাদের শিকার হবেন মহিলা।না হয় আমার সংসার করা হলোই না----আমার তো একটা নিজস্ব জগত আছে।ওনার যে কিছুই নেই!'
'গুরুদেব
তুমি মা জননী----পায়ের ধুলো দাও।তবে চন্দ্রি ধন্দে ফেললি।তোর
স্ট্র্যাটেজি চাতুরি না উদারতা না কি অ্যাটেম্পট টু নারিশ
ইয়োর ওন ইগো ঠিক বুঝতে পারছি না।হোয়াটেভার,শাশ্বত কিন্তু এখন
আর ক্লাসমেট নয়----টিপিক্যাল ইন্ডিয়ান হাসব্যান্ড।তাকে আবার
খোলসা করে সব বলতে যাসনি। ভারতীয় পুরুষ তার মায়ের কোন দোষ বা মীননেস আছে সেটা মানতেই
পারে না।তাই ওসব মনন,চিন্তন,অশিক্ষা,সদা সন্ত্রস্ত আত্মবিশ্বাস কথাগুলো যেন ভুলেও শাশ্বতর কানে না যায়। কথাগুলো
ফেলতেও পারবে না আবার গিলতেও পারবে না।একে ঘাঁটা মাল,আরো ঘেঁটে
যাবে।একদিন বাড়ি আয় না রে----চুটিয়ে আড্ডা হবে।আজ রাখি।'
ফোন
রেখে,খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরে এসে চন্দ্রিমা দেখে নাইট ল্যাম্প
জ্বলছে----শাশ্বত ঘুমিয়ে গেছে।
বালিশে
মাথা দিতেই রাজ্যের ঘুম এসে চোখ জড়িয়ে ধরে । চন্দ্রিমা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে থাকে । শাশ্বত ঘুমের ভান ছেড়ে উঠে বসে।নাইট ল্যাম্পের মায়া আলোয় বউকে দেখে
আপাদমস্তক । অভ্যাস মতন ছুঁতে
গিয়ে হাত সরিয়ে নেয়।
চন্দ্রি
তো জানে না সে ডাইনিং টেবিলে লাইটার ফেলে এসেছিল বলে,দিনের শেষ সিগারেটটা ধরাবার জন্য আবার ডাইনিং হলে ফিরে গিয়েছিল । চন্দ্রি তখন টেলিফোনে বিভোর । ইভসড্রপিং যদিওবা অসভ্যতা কিন্তু পা আটকে গিয়েছিল ।
যা
শুনলো তাতে চন্দ্রির প্রতি সমীহ বাড়ল নি:সন্দেহে
কিন্তু একটা প্রবল অসোয়াস্তি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে শাশ্বতকে ।
বুদ্ধিমতীকে
শ্রদ্ধা করা যায়, সমীহ
করা যায় কিন্তু ভালোবাসা যায় কি ?