মুক্তি আসন্ন জেনে পবন ছটফট করছে । বাড়ি যাবে সে । ঘরে যাবে । সেখানে তার মেয়ে
আছে । কতটা বড় হয়েছে মেয়েটা ? তাকে দেখলে চিনতে পারবে তো ? বাবা বলে ডাকবে ? রিতাই বা কেমন আছে ? সে কি ভাবে সংসার চালিয়ে
এলো এতদিন ? ভালো আছে তো সবাই ? শেষ দেখা হয়েছিল সাজা ঘোষণার দিন । তারপর আর দেখা হয় নি ।পবন দাস
মুচির ছেলে । ঢাক - ঢোল বানানো এবং বাজানোটাই ওদের পেশা । গরু- ছাগলের চামরা শুকিয়ে
বিক্রি করতো সে ।কোন রকমে দিন গুজরান হতো ।
পবন মানে হাওয়া । বাতাস । গ্রামে থাকতে কেউ কখনও তাকে পবন নামে ডাকেনি ।এমনকি
পবনের বাবা ও মা দুজনেই পবনকে পবনা বলে ডাকতো ।সেই পবনা এবার মুক্তি পাবে । বাড়ি ফিরবে
।আশায় বুক বেঁধে সে আরও ভাল থাকার চেষ্টা করে । সে খুনের আসামী । রয়েছে জেলে । ভিন
জেলার সংশোধনাগার । সে নাকি খুব ভয়ংকর লোক । সেজন্য জেলা থেকে দূরে তাকে পাঠানো হয়েছিল
।'হে পরম শক্তিমান , আমি যা বদলাতে পারি না তা যেন মেনে নিতে পারি !' পবন শিখেছে কখনও আইন নিজের
হাতে তুলে নিতে নেই ।আর সে ভুল করবে না । কখনই না ।রিতাকে কতদিন দেখেনি পবন । তার মনের
ভিতর তোলপাড় চলছে ।
স্কুলটা ছিল কো - এডুকেশন । পবন পড়ে টেনে । রিতার সেভেন । ' প্রেমের পারদ চরলে মাথায়
কি যে হয় , তা কে জানে ?' রোশনারা তাকে ভালবেসেছিল । কেন বেসেছিল কে জানে ? দেখতে ভাল না কি বাজনা বাজানোতে
ওস্তাদ বলে ? তবে হ্যাঁ , একবার পবন তর্ক করে স্কুলের দিঘিটা কুড়ি মিনিটে সাঁতার কেটে পাড়
হয়েছিল আর দূর থেকে সেটা দেখেছিল রিতা । সে সব কথা আজ মনে পরছে পবনের ।
রোশনারা তাদের বাড়ি এসে হয়ে গেল রিতা । আকাশে বাতাসে সানাইয়ের সুর । দিকবিদিক
জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটেছিল তারা । আশ্রয় খুজেছিল এখানে ওখানে । ভয় । সমাজের চোখরাঙ্গানি
উপেক্ষা করে নতুন জীবনে প্রবেশ করার প্রবল ইচ্ছা তাদের । কিন্তু প্রথমটায় ভীষণ বাঁধা
এসেছিল । মাঝখান থেকে রিতার আত্মীয়রাই পবনকে বাঁচিয়েছিল । সে কথা পবন কখনও ভুলবে না
।
পবনের একটা ডাবলি ছিল । সে নিজেই ছাগলের চামড়া দিয়ে ওটা বানিয়েছিল । যে কোন অনুষ্ঠানে
পবনের ডাবলি ছিল অবশ্যম্ভাবী । স্কুলের অনুষ্ঠান কিম্বা গ্রামের জলসা । সকলেই পবনের
জন্য অপেক্ষা করত । পবন ওই অঞ্চলের একজন ফেমাস বাদ্যকর হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে ছিল ।
আর এই সমস্ত গুনের জন্যই রোশনারা তাকে ভালবেসেছিল ।
অল্প বয়সে প্রেম কিন্তু বিয়ে? না , কখনই নয় । সেই সেভেন থেকে টুয়েলভ ছ' বছরের প্রেম তাদের সার্থকতা পেল যখন , তখন পবন স্নাতক হয়ে গেছে
। রিতার বিয়ে দেবার জন্য রীতিমত চেষ্টা চলছে ।পবন চাকরি বাকরি না পেয়ে জাত ব্যবসা শুরু
করে দিয়েছে ।হটাত মোবাইলটা বেজে উঠল । রিতার ফোন , ' শোন , আর দেরি করা যাবে না । আব্বা একটা কশাইয়ের
সাথে আমার শাদি ঠিক করেছে ।"
পবন অনেক দিন ধরেই ভাবছিল । আর যে উপায় নাই । মাকে কথাটা বলেছে সে । রিতা যে মুসলমান
তা মা জানে । একসময় ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া মরা গরু - মোষের মাংস তারাও খেয়েছে । মুচিদের
কাজটাই তো চামড়া নিয়ে । সুতরাং সে দিক দিয়ে অসুবিধা কিছু নেই । বিপদ অন্যখানে । সমাজের
কর্তাব্যক্তিদের নিয়েই যত ভয় । তারা কি বলবে ?
পবন বলে , "কশাই মানে ?"
"আরে বাবা মাংস কাটে যারা , তাদের তো কশাই বলে ? সেরকম একজনের সাথে বাবা
আমার বিয়ে ঠিক করেছে ।"
" ঠিক আছে , তুমি কিছু ভেব না । আমি দেখছি , কি করা যায় !" পবন
চিন্তা করে ।
" আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না । তুমি যা করবে
, তাড়াতাড়ি করো কিন্তু " রিতা ফোনের অপর প্রান্ত থেকে অনুনয় করে ।
তারপর ইতিহাসের শুরু । শেষ কোথায় হবে তা পবন জানে না । পালিয়েছিল বেশ কয়েকদিন
।ফিরে এসেছিল দুই পরিবারের মধ্যস্থতায় । আর মাঝে ছিল গোলাম স্যার । তিনি ছিলেন প্রধান
। ওই সব মানুষগুলো না থাকলে পবন - রিতারা বাঁচতেই পারতো না । তবু এতো কিছু ভালোর ভিতর
অশুভর বীজ লুকিয়ে ছিল ।
খাল খিঁচে জীবন অতিবাহন করা পবন জানতো না ইট- পাথরের কেরামতি । গোমাংসের জন্য
দেশের ক্ষতি দশের ক্ষতির কথা । দেশ জোড়া প্রচার । যে ঈশ্বর ইতিহাসে নেই তার জন্মস্থানের
নামে আলোড়ন । মন্দির নির্মাণের প্রস্তাব । সেজন্য বিধর্মীদের উৎখাত । পবন সে পথে বাঁধা
। সংঘাত থেকে শ্ত্রুতা ।
ডাবলিবালা পবন । বিয়ে করেছে মুসলমানের মেয়েকে । প্রচারের বিপরীতে তার অবস্থান
। অতএব ওকে আঘাত করো ! মন্দির নির্মাণ পর্বে প্রচার করা হত মুসলিম যুবকরাই কেবল হিন্দু
যুবতীদের ফুসলে নিয়ে যায় । কিন্তু পবন তার বিরুদ্ধ মতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়
। তাই ওকে বধ কর !
ততদিনে রিতা একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে । নাম শ্রীপর্ণা । রোশনারা আর তার
নামের সাথে সংযোগ রেখেই নামকরণ । গোলাম চাচার জন্য তাদের কেউ কিছু বলতে পারে না , তবে প্রছন্ন একটা বয়কটের
আবহাওয়া তারা অনুভব করে । সুখের জীবন তাদের ।
রোশনারা ঈদে - মহরমে বাপের ঘর যায় । তাদের উৎসবে রোশনারার ভাই , মা - বাবা আসে । এটা অনেকের
সহ্য হচ্ছিল না । বিশেষ করে বিশুর । বিশু মুচির ছেলে । কিন্তু ও এখন রাম ভক্ত হনুমান
। বজরঙ্গি বাবার পূজারী । এসব অনাচার নাকি তার সহ্য হয় না ।
সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার । বিশু সেদিন ঢাক - ঢোল কাঁসর - ঘণ্টা পিটিয়ে বীর হনুমানের
পুজো করেছে । ভাং - গাঁজা আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে মদ মেরে এসে ব্যাটা বলে কিনা বাড়ি
থেকে রোশনারাকে বের করে দিতে হবে ?
পবন বলেছিল , " তুই এখন যা ! নেশা করে আছিস । তোর সাথে পরে কথা বলবো !"
বিশু নাছোড় , " আজই তুই অকে খেদিয়ে দে ! "সেদিন বাড়িতে এসেছিল রোশনারার আব্বা
। তাকে উদ্দেশ্য করে বিশু বলেছিল , " নিয়ে যাও তোমার মেয়েকে ! না হলে খুন করে দেব !"
আর সহ্য হয় নি পবনের । সে একটা ধাক্কা মেরে ছিল কেবল বিশুকে । তাতেই সে ঘুরে পরে
গিয়েছিল । আর মাথায় আঘাত লেগেছিল উঠানে পরে থাকা একটা ইটের । বিশু রোশনারার বাবাকে
খুন করতে চেয়েছিল । কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস ! উল্টে সে ই খুন হয়ে গেল । বেচারা পবন
!
ডাবলিবালা পবন আবার ফিরে আসছে গ্রামে । আমরা যা বদলাতে পারি না , তা যেন মেনে নিতে পারি ।
--------