গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫

নির্মাল্য বিশ্বাস

মন দরিয়ার মাঝি

- কি ব্যাপার বলতো, মউকে নিয়ে তোমার এত আগ্রহ? ওকে তোমার ভাল লাগে নাকি? লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয় সজল। - না দাদা, কি যে বলেন? আসলে ওর স্টোরিটা খুব সিম্প্যাথেটিক তো, তাই এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাই আপনার কাছে। ডঃ রায় চৌধুরী হাসেন। - তাহলে ঠিক আছে। তুমি আসো বলে তাও একটু আড্ডা মারা যায়। নাহলে সেই সকাল থেকে রোগী দেখা, বাড়ির লোকেদের সাথে কথাবার্তা, রিসার্চ ওয়ার্ক, সারাদিন মাথাটা জ্যাম হয়ে থাকে।
দুটো বিল্ডিং একদম পাশাপাশি। একটা ডঃ রায় চৌধুরীর আ্যসাইলাম আর একটা বিনোদ পান্ডের লেদার ফ্যাক্টরি। বিকেলের দিকে চা খেতে সজল ডঃ রায় চৌধুরীর আ্যসাইলামে আসে। ডাক্তার বাবুর এই সময়টা অখন্ড অবসর। এইসময় তিনি বাগানের মাটি খোঁড়েন,গাছে জল দেন,সদ্য ফোটা ফুল গুলোর দিকে অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকেন।

সজল দত্ত সারাদিনের ব্যস্ততা সামলে একটু নিঃশ্বাস নিতে আসে এখানে। ডাক্তার বাবুর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বাগানটা চক্কর মারে বার কয়েক।রোগীদের গল্প শোনে,তাদের রোগের ইতিহাস জানে,কখনো বা ঘুরেও দেখে রোগীদের ঘরগুলো। সব দিন সব রোগীদের ঘরে যাওয়া হয় না। তবে নিয়ম করে প্রতিদিন বারো নম্বর ঘরটায় যাবেই সজল। এই ঘরটাতেই মউ থাকে। প্রথম যখন মউ এখানে এসেছিল,মুখ চোখের অবস্থা ছিল রীতিমতো আতঙ্কজনক। কথা বলতই না কারোর সাথে,মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে জিনিষপত্র ছোঁড়া শুরু করে দিত। কখনো বা আয়াদের দিকে তেড়েও আসত। এখন ডঃ রায় চৌধুরীর চিকিৎসায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। ডাক্তারবাবুর মতে কোথাও চাকরি বা কাজকর্ম করলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। কিন্তু কে এত বড় দায়িত্ব ঘাড়ে নেবে? কাজের জায়গায় যে কোন বিপত্তি ঘটাবে না,তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি?

সজল অবশ্য বলেছিল ও নিজে দায়িত্ব নেবে। মউকে ওদের কারখানায় কাজে রাখবে। যদি কোন ঝামেলা বাঁধায়, তাহলে ও সামলে নেবে। ডাক্তারবাবুই বারণ করেছেন। বলেছেন- এখন নয়। আরো কিছুদিন পর। সময় হলে আমি নিজেই বলব। সেই সময় হওয়ার অপেক্ষাতেই এতদিন থেকেছে সজল। বছর দুয়েক পর ডাক্তারবাবু নিজেই বলেছেন এবার তোমাদের কারখানায় নিয়ে গিয়ে দেখতে পারো। তবে এখনো কিন্তু ও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। যদি কোন অঘটন ঘটে, সেটা তোমাকেই সামলাতে হবে কিন্তু।

এক কথায় রাজী হয়েছে সজল। কারখানায় ওর কথাই শেষ কথা। যদিও ও মালিক নয়। তবে বিনোদ পান্ডের কারখানার সব সিদ্ধান্ত ও ই নেয়। সজলের বত্রিশ চলছে এখন। এত অল্প বয়সে এমন বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বিনোদ পান্ডে খুব কমই দেখেছে। মাত্র দু'বছর হল এই কারখানায় ম্যানেজার হয়ে এসেছে, আর এসেই এই ছোট লেদার ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিটাকে নিজের বুদ্ধি আর কৌশলে অনেক বড় করে তুলেছে। তাই কারখানার সব ভালমন্দর দায়িত্ব বিনোদ পান্ডে ওর হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। মউকে কাজে নেওয়ায় সমস্যা যে একটা হবে,সেটা খুব স্বাভাবিক। প্রথম কথা মউ কোন কাজ জানে না, সে কাজ শিখিয়ে নেওয়া যেতেই পারে।তবে তার জন্য যে উদ্যোগটা থাকা দরকার, সেটা ওর নেই। তার প্রথম কারণ ও এখন ট্রিটমেন্ট এর মধ্যে আছে। ডাক্তারবাবু যে সব ওষুধ দেন,সেগুলো খেলে একটা আচ্ছন্নের ভাব থাকে। ঘুম পায় সারাদিন। এই অবস্থায় কাজ শেখা, কাজে মন দেওয়া কষ্টকর। যদিও মউএর চেষ্টায় কোন কসুর থাকে না,তবু ভুলভাল হয়। সেকসান ইনচার্জ বিরক্ত হন,কখনো রাগারাগি করেন।তাতে ফল হয় আরো উল্টো, উত্তেজিত হয়ে মউ ইনচার্জকেই দু-চার কথা শুনিয়ে দেয়। তিনি আবার সজলকে রিপোর্ট করেন,সজল বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা করে।
ডঃ রায় চৌধুরী একা মানুষ, তিনকূলে কেউ নেই। সেই ছোট বয়সে কাউকে ভালবেসে ছিলেন, কিন্তু অপরিণত বয়সের প্রেম পরিণতি পায়নি। সেই থেকে জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছেন ডাক্তারবাবু। মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষগুলোকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটাই ওনার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাদেরকে ভালবেসেই নিজের হারানো ভালোবাসাকে ভুলতে চান। ডাক্তারবাবুর বয়স বেশি নয়।সজলের থেকে পাক্কা দশ বছরের বড়,অর্থাৎ বিয়াল্লিশ চলছে এখন। এই বয়সের মানুষের পোশাক আশাক,জীবনযাপনের ধরণ যেমন হওয়া উচিৎ, তার ঠিক উল্টো উনি। পোশাকে কোন বৈচিত্র্য নেই,জীবনযাত্রায় কোন বিলাসিতা নেই। শুধু এই মানসিক রোগীদের আবাসস্থল টাকে কিভাবে আরো সুন্দর করা যায়,তারই প্রচেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। সরকারী অনুদান সেভাবে আসে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু এন জি ও র সাথে কথাবার্তা বলে যেটুকু সাহায্য আসে,তাতেই কোনরকমে চলে।

এই কোম্পানির ম্যানেজার হয়ে আসার পরই সজলের পরিচয় হয় ডাক্তারবাবুর সাথে। ওনার মুখ থেকেই মউয়ের জীবন ইতিহাস জানতে পারে সজল। ...... ফর্সা,লম্বা,ডাগর দু'টো চোখ আর এক ঝাঁক কোঁকড়ানো চুলের এই মেয়েটাকে ভালবেসেছিল ওদের কলেজের ই একটা ছেলে। প্রথমে পাত্তা দিতে চাইত না মেয়েটা। দেখা হলে এড়িয়ে চলত। তারপর অনুভব করল ওর ভেতরে ছেলেটার প্রতি অনুভূতিগুলো একটু একটু করে বইতে শুরু করেছে। ভালোবাসা হল। বাবা-মা-র সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিল মেয়েটা। যদিও পরিচয়টা বন্ধু বলেই জানল বাড়িতে।আসল পরিচয়টা শুধু মেয়েটার বোনই জানল। সেদিনের সেই মেয়েটাই মউ। ডাক্তারবাবুর বারো নম্বর রুমের পেশেন্ট। একটা উচ্ছল বাইশ -তেইশ বছরের মেয়ে কোন পরিস্থিতিতে মানসিক অশান্তির শিকার হল সেটা জানার কৌতূহল সজলের অনেক দিনের। বিকেলের এই সময়টা চা খেতে খেতে ডাক্তারবাবু মউয়ের সব ইতিহাস বর্ণনা করেন। ...... দু বছরের ছোট বোনটাকে মউ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। নিজের জন্য যা কিনত,তানিশার জন্যও তাই নিয়ে আসত। ওদের পরিবার ছিল ভীষণ রকম রক্ষণশীল।ভালবেসে বিয়ে করবে এটা ভাবাই যেন একটা মস্ত বড় অপরাধ। যদিও ছেলে বন্ধুদের বাড়িতে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধা নিষেধ ছিল না। ভালোবাসার মানুষটির সেই পরিচয়ই দিয়েছে বাড়িতে- বন্ধু। এইভাবে দু' বছর কাটল। একটা সময়ের পর মউ উপলব্ধি করল তমালকে ছাড়া জীবনের একটা দিনও আর থাকা সম্ভব নয়। নিজের জীবনের সবটুকু সমর্পণ করে মউ বসে আছে।নিজের জন্য আর কিছু অবশিষ্ট রাখেনি। যেদিন থেকে এই উপলব্ধি হল,সেদিন থেকে তমালের ভালবাসা উল্টো খাতে বইতে শুরু করল।

আগে আগে তমালই বেশী ফোন করত। দেখা করার জন্য জোরাজুরি করত। ধীরে ধীরে দেখা গেল ফোন করা অনেক কমিয়ে দিয়েছে তমাল। দেখা করতে চাইলে হাজার কাজের ফিরিস্তি শোনায়। ফোন করলেও বিরক্তি ভরে কথা বলে,মউয়ের সব কাজে অসন্তুষ্ট হয়। অকারণে কথা কাটাকাটি হয়। ভালবেসে ভালবাসাকে সহজলভ্য করে দিয়েছে মউ। একদিন মউ ইউনিভারসিটি গেল না। শরীরটা বিশেষ ভাল নেই। জ্বর জ্বর ভাব, গা টাও ম্যাজ-ম্যাজ করছে। তানিশা সকালেই বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে,কোচিন থেকে সোজা কলেজ চলে যাবে বলেছে। বাবা-মারও অফিস। তারাও বেরিয়ে গেছে সময় হলে। মউয়ের এগারোটা থেকে ক্লাস। যাবার ইচ্ছে থাকলেও শরীরটা সায় দিল না, মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকল। ভিতরটা কেমন যেন কাঁপুনি দিচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছিল একবার ফোন করে তমালকে ডাকতে। ও আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে সব জ্বর সেরে যেত। আগে আগেও এরকম কতবার হয়েছে। ফোন করব করব করেও করা হল না মউয়ের। থাক এখন। হয়ত কাজের মধ্যে আছে,ফোন করলে বিরক্ত হবে। তার থেকে ভাল চুপচাপ শুয়ে থাকা। মাথায় চাপা দিয়ে চুপচাপ শুয়েছিল মউ। একটু তন্দ্রা মত এসেছিল। 'খুট' করে শব্দ হতে ঘুমটা ভেঙে গেল। বাইরে থেকে কেউ দরজাটা খুলছে। বাবা-মা-তানিশা-মউ,সবার কাছেই লকের চাবি থাকে। বাইরে থেকে যে যখন আসে,নিজের মত দরজা খুলে নেয়। এই সময়ে কারোর আসার কথা নয়। বাবা-মা-র অফিস আর তানিশার কলেজ থাকে এই সময়। তবে কি জ্বরের ঘোরে ভুল শুনছে মউ? একজন নয়,দু' জন মানুষ ঢুকেছে ঘরে। অস্পষ্ট কথাবার্তা থেকে বুঝে নিতে অসুবিধে হচ্ছে না মানুষ দুজন কারা। মাথার চাপাটা সরায় নি মউ। গলার স্বর দুটো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই ঘরে উঁকি দিয়েই মানুষ দু'জন চলে গেছে পাশের ঘরে। কিছুক্ষণ পর শরীরটাকে হেঁচড়ে বিছানা থেকে নিজেকে টেনে তুলল মউ। পাশের ঘরে দুজন মানুষের অস্পষ্ট উপস্থিতি টের পাচ্ছে। তাদের না দেখা পর্যন্ত ভিতরের অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। ঘরের দরজা খোলাই ছিল, শুধু পর্দাটা টাঙানো ছিল। জানলাগুলো বন্ধ,যার ফলে ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত অন্ধকার ছেয়ে আছে। পর্দাটা ঠেলে সরিয়েছে। আবছা অন্ধকারে যা দেখছে,তাতে নিজের চোখের ওপরেও বিশ্বাস হারাচ্ছে মউ। দেখছে,দেখছে,পাতালের অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে দেখছে। ঘরের মানুষ দুটা ওর নিঃশব্দ উপস্থিতি টের পাচ্ছে না। বাড়িতে এই সময়ে যে কোন মানুষ থাকতে পারে,সেটা এই দুজন মানুষের ধারণার বাইরে। তানিশার পায়ের আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে উষ্ণ ঘন চুমু খাচ্ছে তমাল আর তানিশার হাত দুটা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে তমালকে। মউয়ের দু চোখে গলানো ঘৃণা উপছে পড়ছে। সমস্ত মুখ লাল। নিঃশব্দে সোফার ওপর বসেছে। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে যাবার পর ঘরের মানুষ দুটোর সম্বিৎ ফিরেছে। ঘরে মউয়ের উপস্থিতি টের পেয়েছে। সেটা বুঝতে পেরে মউয়ের অন্তঃস্থল থেকে একটা তীব্র ঘৃণা মিশ্রিত ক্ষোভ বেরিয়ে এসেছে - চমৎকার! তানিশাও বেপরোয়া তেমনি। তমালের হাতের মুঠোটা শক্ত করে ধরে বলল- ওকে আমি ভালবাসি দিদিভাই আর ও-ও আমাকে। আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। আমায় ক্ষমা করে দিস। তমালের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল তানিশা। ফিরল তিন দিন পর,সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে। সংগে তমালও আছে। রেজিস্ট্রি করেছে ওরা। মধুচন্দ্রিমা পর্ব যে বেশী দিন চলবে না,সেটা মউয়ের থেকে ভাল কেউ জানত না। বেকার যুবক তমালের সেই আর্থিক সংগতি নেই যে তানিশার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে পারে। অগত্যা মউয়ের বাবাকেই সব দায়িত্ব নিতে হল। ঠিক হল তমাল যতদিন না একটা ভাল চাকরী পাচ্ছে,ততদিন মেয়ে-জামাই এই বাড়িতেই থাকবে। বাবার এই ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বেশী অসুবিধে হল মউয়ের। ভালবাসার মানুষটাকে অন্যের বাহুলগ্না হয়ে দেখতে হবে,এটা কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি সে। প্রতিদিন তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে থাকল। আস্তে আস্তে নিজের স্বাভাবিক বোধ,বিচার বুদ্ধিগুলো সব হারিয়ে ফেলল। অস্বাভাবিকতা যখন বিকারের রূপ নিল,তখন ডঃ রায় চৌধুরীর আ্যসাইলামে নিয়ে এলেন মউয়ের বাবা। এসব অতীতের কথা। ডঃ রায় চৌধুরীর চিকিৎসায় প্রতিদিন সুস্থ হয়ে ওঠার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে মউ। আর এই যুদ্ধে যে সবচেয়ে বেশী সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, সে হল সজল।

দু'বছর পরের ঘটনা...... ডাক্তারবাবুর আ্যসাইলামটা ঠিক একই রকম আছে। শুধু ঘরগুলো এখন অনেক বেশী পরিচ্ছন্ন লাগে। বাগানেও অনেক নতুন নতুন ফুলের সমারোহ। ডাক্তারবাবুর কাজ এখন অনেক কমে গেছে। রোগীদের দেখাশোনা করা,বাগান পরিচর্যা, রোগীদের ঘর-দোর পরিষ্কার করার কাজটা এখন ডাক্তারবাবুর স্ত্রী নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। ডাক্তারবাবু শুধু এখন নিজের রিসার্চ ওয়ার্ক আর রোগী দেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। বারো নম্বর ঘরটা খালি পড়েছিল অনেক দিন। সম্প্রতি সেখানে একজন রোগী ভর্তি হয়েছে। ডাক্তারবাবুর ঘরণী সব রোগীদের ঘর ঘুরে ঘুরে সমান যত্ন নিয়ে দেখাশোনা করেন। তবে বারো নম্বর ঘরটার প্রতি তার যত্নটা একটু বেশী। সেটা হবে না-ই বা কেন? এই ঘরটাতেই তো সে দীর্ঘ তিন বছর কাটিয়েছে। সুস্থ হওয়ার লড়াই চালিয়েছে।জীবনের ওপর দিয়ে যে ঝড় চলে গেছে সেই ঝড় সামলে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছে। আর যে মানুষটা তাকে মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি যুগিয়েছে,সেই মানুষটাই আজ পেশেন্ট হয়ে এসেছে এই ঘরে।

ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায় জাদু আছে। অতীতকে কি সুন্দর ভুলিয়ে দিতে পারেন। তমালের সাথে মউয়ের ভালবাসার দিনগুলো নিজের ভালবাসা দিয়ে আস্তে আস্তে ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন। এখন তমালের প্রতি মউয়ের যে অনুভূতি আছে সেটা এক ধরণের করুণামিশ্রিত অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু নয়। ডাক্তারবাবু যেটা পারেন নি সেটা হল মউয়ের সুস্থ হয়ে ওঠার পথে সজলের পাশে থাকার মুহূর্তগুলোকে ভুলিয়ে দিতে। এক বছর আগে যেদিন ডাক্তারবাবুর মনে হল মউ সুস্থ হয়ে উঠেছে,তখনই তিনি মউকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। প্রথমে মউ একটু দ্বিধান্বিত ছিল। যদিও পুরোন প্রেমের হ্যাংওভার কাটিয়ে ওঠার জন্য মউয়ের একটা শক্ত কাঁধের প্রয়োজন ছিল। তবে সেই কাঁধটা ডাক্তারবাবু না অন্য কেউ,সেই নিয়ে একটা দ্বিধা ছিল। ডাক্তারবাবু যখন বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন,তখন সব সংশয় ঝেড়ে মনটাকে স্থির করেছে। ডাক্তারবাবুরই ঘরণী হবে। ওনার পাশে থেকে এখানকার রোগীদের পরম যত্ন দিয়ে সুস্থ করে তুলবে। মানসিক ভারসাম্যহীনতার বছরগগুলো ও যেভাবে কাটিয়েছে, তেমন যেন আর কাউকে বেশী দিন না কাটাতে হয়। রোগীদের কেস হিস্ট্রিগুলো জানার অসীম কৌতূহল মউয়ের। ডাক্তারবাবুর ফাইলগুলো নিয়ে নিজেই নাড়াচাড়া করে। রোগের কারণগুলো ঠিক কোন জায়গায় সেটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে। এক বছর আগে যেদিন সজলের হাতে বিয়ের কার্ডটা তুলে দিয়েছিল সেদিন ওর মুখে এক অদ্ভুত হাসি দেখেছিল মউ। তারপর থেকেই সেই মানুষটা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়। অফিসে আসে না,ফোনে সুইচ অফ। কলকাতার যেখানে ভাড়া থাকত সেখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে দেশের বাড়িতে চলে গেছে। বিয়ের এক বছর পর ঠিকানা পত্তর যোগাড় করে ডাক্তারবাবুকে সাথে নিয়ে মউ নিজেই গেছে সজলের গ্রামের বাড়িতে। বাড়ির লোকেদের সাথে কথা বলে ওরা জানতে পারে অনেক দিন হল মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে সজল। তখন ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলে মউ নিজেই ওকে এই আ্যসাইলামে এনে রেখেছে।

একদিন কথাচ্ছলে ডাক্তারবাবুর কাছে জানতে চেয়েছে - কি করে সজলের এমন হল বল তো? - ভালবাসার আঘাত সহ্য করতে পারেনি। - কাউকে ভালোবেসেছিল কোনদিন বলেনি তো? - ওর মতো চরিত্রের মানুষেরা কোনদিন ভালবাসা প্রকাশ করে না। শুধু নীরবেই ভালবেসে যায় আর যখন আঘাত লাগে,সেই হৃদয়টা জোড়া দেওয়ার কাজটা খুব কঠিন হয়ে যায়। সজলের যে অসুখটা হয়েছে, তার নাম পি টি ডি, পোষ্ট ট্রম্যাটিক ডিসঅর্ডার। - সেটা কি? - আসলে সজলের ভালবাসা কেউ বুঝতে পারেনি। না তুমি,না আমি। যখন বুঝলাম ওর পি টি ডি ধরা পড়েছে,তখন আর কিছু করার নেই। অনেক দেরী হয়ে গেছে। - কি বুঝেছ? কাকে ভালোবেসেছে? - তোমাকে। মউ স্তব্ধ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল সিলিং এর দিকে। তারপর উঠল। পাঁচটা বেজে গেছে। বিকেলের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে একজনের। বারো নম্বর ঘরের পেশেন্টটা মউয়ের আসারই প্রতীক্ষা করছে যেন। সজলের মুখটা ফাঁক করে দু' ছিপি ওষুধ ঢেলে দিল মউ। শূণ্য দৃষ্টিতে মউয়ের দিকেই চেয়ে আছে মানুষটা। সেদিকে তাকিয়ে মউয়ের মনে হল অব্যক্ত কিছু কথা যেন মনের বদ্ধ আগল ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মউ মনস্তত্ত্ব বোঝে না, মনের ডাক্তারি জানে না। শুধু এই চাহনির ভাষা বোঝে।

ডাক্তারবাবু বলেছিল মউয়ের প্রতি সজলের ভালবাসা বুঝতে পারেনি। যখন বুঝেছিল তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। সত্যিই কি বুঝতে পারেননি ডাক্তারবাবু?উনি-ই যে সবার মন দরিয়ার মাঝি। তবে? মউ উত্তরটা হাতড়াতে থাকে। হাতড়াতেই থাকে।কিছু উত্তর সজলের চাহনির মত হয়- শূন্য।এখন শূন্যের মানে খুঁজতে পারেনা মউ।কিছু শূন্যের মানে হয় না কখনো।