গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫

অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায়

অনাগরিক

কিছুক্ষনের মধ্যেই আকাশের ঈশান কোনে মেঘ জমে উঠল। নিশুতি রাত। প্রথমে টুপটাপ, অতঃপর মুষল ধারায় বৃষ্টিপাত শুরু হল। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি। সেই সঙ্গে মেঘের গর্জন। চারদিকে শালসেগুন কেঁদ মহুয়ার জঙ্গল। অপ্রশস্ত শুঁড়ি রাস্তা। এবড়ো খেবড়ো পাথুরে পথ। আধিভৌতিক  অন্ধকারে পথ চলাই দায়। ভরসা ক্ষনপ্রভা বিদ্যুত ঝলক। এসময় কেউ কোথাও নেই। থাকার কথাও নয়। জঙ্গলের নিশাচর হরিণ খরগোশও পাথরের কোলে নিরাপদ আশ্রয়ে। কান ফাটানো বজ্রের শব্দ খানখান করে দিচ্ছে পাহাড়ের নিস্তব্ধতা। মেঘ ফেটে গেছে। সরু শুঁড়ি রাস্তা। যত্রতত্র এবড়ো খেবড়ো পাথরের চাঁই। মনেহয় অনেকদিন এ পথে কেউ চলাচল করেনি।
এই দুর্যোগপূর্ণ অমানিশায় ওরা তিনজন। ছেঁড়া কাঁথার ছাউনি দেওয়া দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে আসন্নপ্রসবা ছিপলি। দুঃসময়ে খাটিয়াকে পাল্কি করে দুরবর্তী হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার এটাই এ অঞ্চলে একমাত্র পরিবহন ব্যাবস্থা। এটাই রেওয়াজ।
বেহারা বলতে দুজন। ছিপলির স্বামী দিগম বীরহোড় আর কঙ্কালসার বুড়ো শ্বশুর ভক্তা বীরহোড়। এরা আদিম উপজাতি। যাযাবর। স্থায়ী ঠিকানা নেই। জঙ্গলে ইতিউতি ঝোরার কাছে পাতার কুটিরে এদের বাস। তিন চারটে পাতার কুটির নিয়ে এক একটা ছন্নছাড়া নামহীন গ্রাম। এমনই সাত আটটা গ্রামের প্রসূতির জন্য বীরহোড় সম্প্রদায়ের একজন বুড়ি  দাইমা ভরসা। সে আজ জবাব দিয়েছে। দাইমা বলেছে,  
---ইটা হামার দ্বারা নাই হবেক। বাচ্চাটো লাড়িটাতে ফাঁসিন যাঁয়েছে। একটা বাঁচাইলে আরেকটো মরিন যাবেক।
অগত্যা ভক্তা আর দিগম ঠিক করে যে কোন ভাবে পাথরডিহি ডাক্তারখানায় যেতে হবে। একদিকে পাহাড়ি বিপদসঙ্কুল পথ, অন্যদিকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। প্রতিটি পদক্ষেপে পাহাড়ি বিছে অথবা সর্পাঘাতের ভয়। তবুও ওরা ভিজতে ভিজতে অকুতোভয়ে এগিয়ে চলেছে দুটো প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে।
টাঁড়পানিয়া, বাঁধঘুটু, বামনি, টুরগা, গোঁসাইডিহি পেরিয়ে পাথরডিহি প্রাথমিক হাসপাতালে যখন পৌঁছাল তখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। ওখানে তখন লোডশেডিং। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। আপৎকালীন ব্যাবস্থা হিসেবে তিনটে হ্যারিকেন জ্বলছে টিমটিম করে। মাত্র একজন সিস্টার ও একজন জি ডে এ চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে। রোগী বলতে মাত্র তিনজন। দুজন ফিমেল ওয়ার্ডে আর একজন মেল ওয়ার্ডে। ওরা সবাই অঘোরে ঘুমুচ্ছে। বাইরে দুটো নেড়িকুত্তা দিগমদের দেখে বার কয়েক চিৎকার করে নির্লিপ্ত ভাবে নিজের যায়গায় গিয়ে কুন্ডলি পাকিয়ে ঝিমোতে শুরু করলো। কুকুরের চিৎকারে সিস্টার চমকে উঠে বলেন,---
কে ওখানে?
----হামরা ডাকদর। ভয় মেশানো গলায় জবাব দিল ভক্তা বীরহোড়।
---- কি হয়েছে?
---- পূতহুটা পুয়াতি, গিদরটা লাড়ীটতে আটকিন যাঁয়েছে। ইবারটির মতন বাঁচা ডাকদর।
ভক্তা জানেনা ও কার সঙ্গে কথা বলছে। ও জানে এখানে সবাই ডাক্তার। তখনো ঝিপঝিপ বৃষ্টি পড়ছে। ভক্তা আর দিগম কাঁপছে ঠান্ডায়। এতক্ষন বুঝতে পারেনি। সিস্টার লাবন্য সরকার ভিতরে আসার অনুমতি দিয়ে কাঁথার ছাওনি ওঠাতে বললেন। কাঁথা উঠাতেই আবারও চমকে উঠলেন লাবণ্য। রক্ত আর জলে ভেসে যাচ্ছে মেয়েটা। নেতিয়ে পড়েছে। অস্ফুট গোঙানি সাক্ষ্য দিচ্ছে রোগী বেঁচে আছে। সঙ্গে সঙ্গে গৌরকে বললেন,
----তাড়াতাড়ি  একটা শুকনো তোয়ালে নিয়ে এসো।
অসম্ভব তৎপরতায় গা মুছিয়ে দিয়ে চারজন ধরাধরি করে ফিমেল ওয়ার্ডের বেডে ছিপলিকে শুইয়ে দিলেন লাবন্য। স্যালাইনের বোতল চাপিয়ে ডাক্তার বাবুকে কল বুক করে দিলেন। একটা কেরোসিন স্টোভ জ্বালিয়ে কাপড় সেঁকে রোগীর পায়ের তলায় দিতে লাগলেন। গৌর গেলো ডাক্তার শর্মাকে ডাকতে। অনেকক্ষন ডাকহাঁকের পর ডাক্তার শর্মা দরজা খুলে বললেন,  
---কি হলো আবার! গৌর আদ্যোপান্ত বলতেই ডাক্তার শর্মা বললেন, 
---আমি আসছি তুমি যাও।
মিনিট কুড়ির মধ্যে ডাক্তারবাবু পৌঁছে রোগীকে পরীক্ষা করে দেখেন যে, পথের ধকলে আর বৃষ্টির দাপটে রোগীর অবস্থা সংকটজনক। তিনি লাবণ্যকে বললেন একটা ডেকাড্রন ও একটা ডোভাডুলিন ইঞ্জেকশেন দিতে আর ও টি র ব্যাবস্থা করতে। কেননা সিজার করতে হবে। বেবী কর্ডে ফেঁসে গেছে। প্লাসেন্টা স্থানচ্যুত হয়ে গেছে। জল ভেঙে গেছে অনেক আগেই। পনের বছরের গর্ভবতী মেয়ে কতটা সামাল দিতে পারবে তা ওর দেবতা মারাংবুরুই জানেন।
ভক্তা বীরহোড় বলে উঠল, 'এ ডাগদর বাবু মেয়াটা বাঁচবেক ন নাই।' ডাক্তারবাবু বললেন 'বাঁচাবার চেষ্টাই তো করছি ভক্তু। তা এত কমবয়সে ছেলের বিয়ে দিয়েছ কেন?
---- কি আর বল'ব ডাগদর বাবু। দু বছর আগে হামার বহুটা মরিন গেল ম্যেলেরিতে। বহুত ঝাড়ফুঁক  করালি মেনেক নাই বাঁচল্য। ত ঘরে রাঁধাবাড়া  কে করবেক, সেই ভাব্যে বেটার বিহাট দিঁয়েছিলি ডাগদর বাবু।
--- ওহ।
কিছুক্ষন পরে ইলেকট্রিক এল। ডাক্তার শর্মা ও টি র পোষাক পরে অপারেশন থিয়েটারে চলে গেলেন।
গৌর আর লাবণ্য রোগীকে নিয়ে ঢুকে গেল ও টি তে। দিগম ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল রোগীর যাত্রাপথ।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর হঠাৎ ই অস্পষ্ট কান্নার শব্দ ভেসে এল ও টি থেকে। এতক্ষন দিগম চুপচাপ ছিল। কান্নার শব্দ শুনে থমথমে মুখটা কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তখন রাত প্রায় তিনটে। ডাঃ শর্মা হাতের গ্লাভস খুলে বেরিয়ে এলেন।
---ডাক্তারবাবু ছালিয়াটা আর পূতহুটা কেমন আছে।
---ভক্তু তোমার নাতি হয়েছে, ভাল আছে, কিন্তু___
---মেনেক কি ডাগদর?
---তোমার ছেলের বৌ এর অবস্থা  ভাল নয়। ওকে কাল সদর হাসপাতালে পাঠাতে হবে। তাছাড়া ছেলেটার ওজন কম তাই একটু আলাদা চিকিৎসা করতে হবে। সদরে সব ব্যাবস্থা আছে।
লাবণ্য আর গৌর দুজন মিলে প্রসূতি ও নবজাতককে বেডে এনে শুইয়ে দিল। ডঃ শর্মা ঘন ঘন ভিজিট করতে শুরু করলেন। ভোর চারটে নাগাদ বৃষ্টি থামলো। ডাক্তারবাবু ঘুমুতে গেলেন। সকাল সাতটা নাগাদ ফিরে এসে রোগীকে দেখে বললেন অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। ওদিকে ভক্তুর সকাল হতে না হতেই ধুম জ্বর। ডাক্তারবাবু ওকে প্যারাসিটামল দিতে বলে দিগমকে ডাকলেন,বললেন
---দিগম তোমার বৌকে সদরে বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তুমি এক কাজ কর, এম্বুলেন্স এর জন্য তিনশ টাকা জমা করে দাও। সদরে তাড়াতাড়ি চলে যাও। দেরি কোর না।
--- ক কুড়িতে তিনশ টাকা হয় ডাক্তরবাবু?
---পনের কুড়িতে।
--- হাই বাপ! এতনা টাকা কথায় পাব ডাক্তরবাবু, অত টাকা ত দেখিই নাই। হামার কাছে ত এক কুড়ি সাত টাকা আছে।
--- তোমার বি পি এল কার্ড আছে?
---উটা কি জিনিষ ডাক্তর বাবু?
---অঞ্চলের পঞ্চায়েত প্রধান কার্ডের ব্যাপারে কিছু বলেনি।
--- নাই ডাক্তরবাবু। উয়ারা একশ দিনের কাজে তের দিন খাটাঁয় তিনদিনের মজরী দেয় বাবু। উয়াদেরই পেট নাই ভরে ত হামদিকে কি করে দিবেক। যেটুকু দিবেক তারো আধা ভাগ লেয়  ডাক্তরবাবু।
---রেশন কার্ড আছে?
---নাই বাবু উটাও নাই।
---ভোট দিস? তার কার্ড?
---হামদিকে ভট এ ডাকেই নাই ত ভট দিব কাখে। শুনিনছি দুবছর তিনবছর বাদে বাদে ভট হয়, রাজা হয় তাপর যে কি হয় উটা মারাংবুরুই  জানে।
---বি ডি ও অফিসে যাস না কেন?
--- হামদিকে ঢুকতেই দেয় নাই বাবুরা।
---জানো কি ওই সব কার্ড না থাকলে ভারতের নাগরিক হিসেবে কেউ ধরবে না।
---অতসব নাই জানি ডাক্তর। তবে ইটা জানি যদ্দিন সুয়াং তদ্দিন পেট চলবেক। সুয়াং গেলতো সব গেল, পেটদাবড়ি দিঁয়ে গহলিন গহলিন মরতে হবেক। গরীবের কেউ নাই ডাক্তরবাবু। মিটিনে বড় বড় কথা বলে, ইটা দুবো উটা দুবো রাজা হয়, লংকায় যায় আর হামদিকে ভুলিন যায়। মিটিনে গেলে এক কুড়ি টাকা দেয়। বাস হল্য।
---তাহলে চলে কি করে?
---হামরা চিহড় গাছের ছাল দিঁয়ে দড়ি পাকাই, পাঘা পাকাই, মধুচাক ভাঙ্যে মধু বাহির করিন বাজারে বিকি আর গুঁদলু,কদো,জনহার,মানকচু,খাম আলু, কেঁদপাকা যখন যা পাই তাই খাঁয়ে কনমতে চলিন যায় ডাক্তরবাবু।
ডাক্তারবাবু ভেবে কূল পাননা যে এই একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ এভাবেদিনাতিপাত করে। রাষ্ট্র যেখানে অন্ধ বধির সেখানে তিনিই বা কি করতে পারেন। তবু ডাক্তারবাবু পাঁচশ টাকা দিগমের হাতে দিয়ে বলেন,
--- তাহলে এক কাজ কর, আমি টাকা দিচ্ছি, ভাড়ার তিনশ টাকা আর দুশ টাকা অন্য খরচা বাবদ। তোমার ছেলে বৌকে নিয়ে যাও। আমরা তোমার বাবাকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।
স্ট্রেচারে রোগীকে শুইয়ে লাবণ্য ও গৌর দুজনে মিলে এম্বুলেন্স এ চড়িয়ে দিলেন। দিগমের হাতে স্যালাইনের বোতল। অনন্ত যাত্রায় কিশোরী মা ছিপলি ও তার সংসার।
উদাস চোখে ডাঃ শর্মা চেয়ে থাকলেন ঐ অপসৃয়মান এম্বুলেন্স এর দিকে আর ভাবতে লাগলেন তার সোয়ারী তিন অনাগরিকের কথা।