—গুল্লুদা অনেক দিন বাদে। খুব ভাল লাগছে।
—আমারও। বিদেশে থাকলেও মন পড়ে থাকে এখানে।
৪/৫ জনের দলটা বই মেলা থেকে বেরিয়ে একাডেমির রাস্তা ধরে এগিয়ে যায় টিএসসিবরাবর ।
এই জায়গাটা একটু অন্ধকার। নিয়ন আলো অবশ্য আছে। কিন্তু মুশকিল হল—নিয়নআলোতে মানুষের মুখে বিচ্ছিরি হলুদ রঙটি গলে তরল হয়ে যায় । ফলে চেহারাটা ঠিককাটা কাটা থাকে না আর । একধরণের বীভৎসতাও ভর করে চোখে মুখে।
হাঁটতে হাঁটতে কে একজন বলল— গুল্লুদা চলেন, চা খাই ।
মেলার বাইরে আশেপাশে অনেক টং দোকানে গরম গরম চা। দাঁড়িয়ে গেলেন গুল্লুরা।
একজন বলল— আপনার ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ত চারদিকে হইচই ফেলে দিয়েছে ।
একজন বলল— ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ সেটাও বা কম কি ?
একজন বলল—নতুন কি লিখছেন গুল্লুদা ?
তিনি হাসেন চায়ে চুমুক দিতে দিতে । কথা বলে্ন না । ভাল লাগাটা শুষতে থাকেন ।
চা শেষ করে আবার ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে লাগল দলটি । হঠাত কি হল কে জানে—গুল্লু দেখেন কিছুক্ষণ আগে নিয়ন বাতি থেকে যে হলুদ আলো বে্রুচ্ছিল ওটি আসলেলাল রক্ত।
অদ্ভুত ত !
গাছের পাতা বেয়ে টুপ টুপ করে অসময়ের বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে— রক্ত , উষ্ণরক্ত।
পায়ের তলায় থকথকে রক্তের কাঁদা ।চটি পায়ে পিছলে পড়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেলেনগুল্লু।
তিনি ভেবে পেলেন না পিচঢালা রাস্তায় রক্ত এলো কোত্থেকে ? তিনি আরো কিছুভাবতে চাচ্ছিলেন । কিন্তু বন্যার কারণে পারছিলেন না । বন্যা ‘হেল্প হেল্প’ করে এতচেঁচামেচি করছে কেন? কার কাছে হেল্প চাচ্ছে সে ?
মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছিল গুল্লুর । তাকিয়ে থাকতে পারছিলেন না । বাংলাএকাডেমির গেট দিয়ে অইটা কিসের স্রোত ধাই ধাই করে এগিয়ে আসছে— রক্তের !
তার চোখ বন্ধ হয়ে এল । বন্ধ হওয়ার আগে চারপাশ ঘিরে অন্ধকার ছেয়ে আসতেলাগল ।লাল অন্ধকার ।
একপাক ঘুরে পড়ে গেলেন তিনি । পাঞ্জাবীর বুক পকেটে ছিল পাঠকদের অটোগ্রাফদেয়ার জন্যে প্রিয় কলম । বেসামাল পড়ে যাবার কারণে কি না , কলমটি গেঁথে গেলবাম নিলয় ধরে সরাসরি হৃদপিঞ্জরে ।
শেষবারের মত শুনতে পেলেন বন্যার কণ্ঠস্বর—হেল্প , হেল্প ।
বন্যা সাড়া পেলেন না ।চারদিকে পোকামাকড়ের দল ঘিরে আছে ।
হিসাব নিকাশ অথবা চন্দনের গন্ধ
আকাশ ফেটে যেদিন চন্দনের গন্ধসহ মেঘের দল এদিকটায় এসে উত্তরের হাওয়ারভেতরে গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে চারপাশ ঘিরে ধরেছিল— চৌধুরীদের গোরস্থানের ভেতরেতখন শুয়ে শুয়ে দু’জন কথা বলছিল । তাদের গলায় ভয় ।
:ও মজিদ ! এ কিসের আলামত ?
:জানি না বাজান। এমুন বাস্ না আসতেছে—কইত্থন ?
:কিয়ামত কি শুরু হয়ে গেল নাকি ?
:কইলেই হইল ? জুম্মার নমাজে ইমাম সাহেব কি কইছে— ? কইছে— মহতারাম,কিয়ামত আসার আগে ইমাম মেহেদী আসবে , ইছা নবী আসবে , দজ্জাল আসবে । এরানা আসা পর্যন্ত কিয়ামত হইবে না । বুঝলা বাজান ?
:এত লোক আইব— কস কি ! আমার ত আর শুইয়া থাকতে ভাল লাগতেছে না । পিঠপুঠসব বেদ্না্ হইয়া গেল । শালার মাটির ভিত্রে পিঁপড়া । কামড়াইয়া জান শ্যাষ কইরাদিতাছে ।
:খিচ মাইরা থাকো । গোরস্থানে এত মশায় কি করে ? রক্ত খাইতে মশা গোরস্থানেআসেনি বাজান ?
:অই হারামজাদা , সেই তখন থেকে তুই আমারে বাজান ডাকস ক্যান ? আমি কি তরবাপ লাগিনি ?
মজিদ খিক খিক করে হাসে । তুমি একটা বুইড়া—বাপ ডাকলে দুষ কি ? আর তুমি তআমারে কত স্নিহ কর সেইটা ত আমি জানি । যেবার আমরা ধরা খাইলাম—তুমিআমারে বাঁচনের লাইগা কত কি কইলা—সব আমার মনে আছে ।
:মনে রাইখা লাভ কি ! কামের কাম কিছুই ত হয় নাই ।চৌধ্রীর লোকেরা কি আমাগোছাইড়া দিছে ?
:তুমি আমার বাপের চেয়েও বেশি ।
কুদ্দুসের চোখ চিক চিক করে উঠল । বাতাসে চন্দনের গন্ধটা তীব্র হল হঠাত ।
:নে উঠ হারামজাদা । আইজ চৌধ্রী সাবরে যদি না পুঁততে পারি— আমার নাম বদলায়াকুত্তা ডাকিছ । আসছে পুন্নিমায় আমরা তিনজন মিল্লা গোরস্থানে শুইয়া দুনিয়ার কায়কারবার দেখুম আর হাসুম ।
তারা উঠে পড়ে । কিন্তু চন্দনের গন্ধের রহস্যটা কেউ ভাঙতে পারল না ।