গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫

মৌসুমী ঘোষ দাস

  চিংড়ি আর ছোঁবেন না রমাপতি
   
রমাপতি বাবু বেশ কিছুক্ষণ থেকেই চাপটা অনুভব করছিলেন। কিন্তু আসেপাশের কাউকে কিছু বুঝতে দিচ্ছিলেন না মুখচোরা স্বভাবের  রমাপতি। মধ্য গতিতে বাসটা  ছুটে চলেছে জাতীয় সড়ক ধরে। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমে বাসের ভেতর গাদাগাদি ভিড়। তার মধ্যে ভাগ্যক্রমে  বাসের প্রায় পেছন দিকে তিনি একটি বসবার আসন পেয়েছেন  তাই রক্ষে, নইলে এতক্ষণে যে কি হত তা ভেবেই --। যাক, সেই আসনেই  দেহের নিম্নাঙ্গ বেশ চেপেচুপে কোনোক্রমে বসে আছেন, যাতে বেগটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। টেনশনে গলগল করে ঘামছেন  আর ভাবছেন তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছুতে পারলে এ যাত্রায় বাঁচেন আর কি।
 কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেই কি নিয়ন্ত্রণ করা যায়? প্রবল বর্ষা আর বন্যার পর রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। বিশাল বিশাল গর্ত। সেই গর্তগুলিতে বাসের পেছন চাকা পড়ে প্রবল ঝাঁকুনি হচ্ছে। আর তক্ষুনি তার “এই বেরিয়ে যায় তো, সেই বেরিয়ে যায়” অবস্থা হচ্ছে।
           যত রাগ গিয়ে পড়ে গিন্নী চম্পার উপর। এমনিতেই রমাপতি বাবুর ছোটবেলা থেকে একটু আমের ধাত আছে।  তার মধ্যে বেরোনোর আগে অমন ঠেসে ঠুসে খাইয়ে দিয়েছে,  যে এখন তাকে ফল ভুগতে হচ্ছে। চম্পার এই এক দোষ। থালায় ভাত এমন ভাবে মণ্ড করে সাজিয়ে দেবে যে সেই মণ্ড দেখে,  মণ্ডের ভেতর কতটা পরিমাণ ভাত আছে কিছুতেই আন্দাজ করা যায় না। আজও তেমন চম্পার চালাকি বুঝতে পারেননি নিরীহ রমাপতি। যেই ডালটা ঢেলে ভাতের মণ্ডটা ভেঙেছেন আর দেখেন থালা ভর্তি উপচানো ভাত।
            চম্পার যত রাজ্যের ভালবাসা যেন এই উপচানো ভাতের সাথেই ধরা দেয়। সামনে মা হাতপাখা নিয়ে বসে আছেন তাই কিছু বলতেও পারেননি বা ভাত ফেলতেও পারেননি। কারণ, ছোটবেলা থেকেই মা-বাবার কাছে শিক্ষা পেয়েছেন ‘ভাত হল লক্ষ্মীর দানা’, তাকে অবহেলা করলে তিনি রুষ্ট হন। তার ওপর চম্পা চিংড়ির মালাইকারিটা এত ভাল রেঁধেছে যে মনে হচ্ছে সেটা দিয়ে ভাত খেয়েই যাই, খেয়েই যাই।

          এর পরের স্টপেজ ল্যাংমারি।  কন্ডাক্টর টিকিটের জন্য কাছে আসতেই ভাবলেন একটু অনুরোধ করবেন বাসটা কোথাও দাঁড়ানোর জন্য, যাতে কোন ঝোপের আড়ালে –- । কিন্তু জল পাবেন কোথায়? সঙ্গে জলের বোতলও নেই। আর এই গরমে যেসব যাত্রী দীর্ঘক্ষণ ধরে বাসের ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন, তারাই বা মানবে কেন? এসব ভেবে প্রায় চুপসে গেলেন লাজুক রমাপতি।  তিনি যাবেন  ভোঁদড়মারি। এখনো প্রায় মিনিট কুড়ি লাগবে সেই স্টপেজে পৌঁছুতে। অগত্যা ভয়ানক ঘামতে ঘামতে আর ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে  বাসে চোখ বুজে বসে রইলেন।

             কিছুদূর এগোতেই বাসটা ব্রেক কসে থেমে গেল। কারা নাকি রাস্তা সারাইয়ের দাবিতে পথ অবরোধ করেছে। ‘একঘণ্টা কি দেড় ঘণ্টার আগে কিছুতেই বাস এগোতে পারবে বলে মনে হয় না’ - কন্ডাক্টর বললেন। ড্রাইভার স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে আরাম করে সিটে গা এলিয়ে দিলেন। অগত্যা বাসে যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন, বাসের ভেতরের অসহ্য গরম থেকে বাঁচতে  তারা বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশের গাছের ছায়ায় একটু বসলেন। চারদিকে যতদূর চোখ যায়, কেবল ধানের জমি আর ধানের জমি।
              রমাপতি বাবু আর থাকতে না পেরে নিজের ব্যাগটা নিয়ে বাস থেকে সাবধানে নামলেন যদি কোন ব্যবস্থা করা যায় এই ভেবে। একটু এগিয়ে গিয়ে একজন স্থানীয় লোককে জিজ্ঞেস করলেন,
-“এখানে কাছাকাছি কোন ‘বড়বাড়ি’ আছে ভাই? খুব সমস্যায় পড়েছি। না গেলেই নয়।”
-“এখানে তো সেরকম কিছু নেই। ধান জমিটা পেরিয়ে একটু ওদিকে যান, দেখুন, পেয়ে যাবেন হয়তো।“
-“জল টলের ব্যবস্থা?”  চিন্তিত মুখে জানতে চাইলেন রমাপতি বাবু।
-“নদী আছে একটা।“
             রমাপতি বাবু আর কোনোদিকে না তাকিয়ে ব্যাগটা বগলদাবা করে ঊর্ধ্বশ্বাসে সেই ধান জমির আল বরাবর ছুটতে লাগলেন। তিনি যত জোরে ছুটছেন, বেগ তত জোরে বেড়ে চলেছে। ভয় পেয়ে ভাবলেন, ছুটতে ছুটতেই কাপড় চোপড় নষ্ট না হয়ে যায়। ছুটতে ছুটতেই তিনি সময় নষ্ট না করে একে একে  প্যান্টের বেল্ট, প্যান্টের চেইন, হাত ঘড়িটা ইত্যাদি খুলতে লাগলেন। অবশেষে খানিক দৌড়ে নদীর ধারে ঝোপ জঙ্গল মত দেখতে পেলেন একটা। প্যান্ট  আর ব্যাগটা একটু দূরে রেখে, সেখানেই বসে পড়লেন।

          কাজ সেরে ভাবলেন, “আঃ! কি আরাম! এর মত শান্তি আর কি আছে জীবনে? সাধে কি গোপাল ভাঁড় বলেছিল! যাক, এবার নদীর জল  ব্যবহার করে তাড়াতাড়ি বাসের কাছে পৌঁছুতে হবে। নইলে যদি বাস ছেড়ে চলে যায়, তবে আর এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে। কারণ, এইটা কোন স্টপেজ নয়, অবরোধের কারণে বাস দাঁড়িয়েছে। নইলে এখানে যতই বিপদে পরো না কেন, কিছুতেই কোনো রানিং বাস দাঁড়াবে না।“ এই সব ভেবে যেই না উঠতে  যাবেন, দেখেন সামনে টকটকে লাল ধুতি পড়া, মাথায় জটাধারী এক সাধু হাতে এক বস্ত্রখণ্ড নিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছেন। কি সর্বনাশ!  এ তিনি কি করে ফেলেছেন? প্রবল বেগের তাড়নায় তিনি খেয়ালই করেননি যে সামনে একটি ছোট কালী মন্দির রয়েছে। আর যে ঝোপের আড়ালে তিনি কর্মটি সেরেছেন, সেটি একটি জবা ফুল গাছের ঘিঞ্জি ঝোপ। ছিঃ ছিঃ! সাধু কি তাকে  দুষ্কর্ম করতে দেখে ফেলেছেন? কি পাপিষ্ঠ তিনি! “মাগো, ক্ষমা করো তোমার অধম সন্তানকে, ক্ষমা করো মা।“  
          এদিকে সাধুটি তার দিকে এগিয়েই আসছেন।  তিনি ঝোপের ভেতর যতটা পারলেন উবু হয়ে নিজের নধরকান্তি দেহটা  গুঁজে  দিলেন। আড় চোখে দেখলেন সাধুটি কিছুটা এসে সেই বস্ত্রখণ্ডটি সামনে টাঙানো একটি দড়িতে মেলে দিয়ে আবার খড়ম পায়ে খটাস খটাস শব্দ তুলে মন্দিরের দিকে চলে গেলেন। উঃ! যাক বাবা, তার মানে সাধু তাকে দেখেনি।
            এবার আর দেরি না করে রমাপতি বাবু হাত ব্যাগ আর প্যান্টটা ঝোপের মধ্যে গুঁজে রেখে দিয়ে, নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে  প্রায় বুকে হেঁটে ঝোপ জঙ্গল বরাবর নদীর দিকে গেলেন। নদীর পারটা বেশ খাড়া ছিল।  তিনি সেই খাড়া পার থেকে এক লাফ দিয়ে নদীর ধারে গিয়ে পড়লেন। প্রবল বৃষ্টি আর বন্যার দরুন নদীর ধারের মাটি থলথলে অবস্থায় ছিল। তার পা দুটো সেই থলথলে মাটিতে ঢুকে গেল। কি জ্বালা!  অনেক কষ্টে এক পা তুলেন তো আর এক পা মাটিতে ডুবে যায়। এই ভাবেই অনেক চেষ্টায় এক পা দু পা করে এগোতে এগোতে নদীতে গিয়ে জল ব্যবহার করলেন।
                                      
           ভাল করে জল দিয়ে ধোয়াধুয়ি  সেরে নিয়ে নদীর ধার থেকে পারে উঠতে যাবেন, কিছুতেই আর উঠতে পারছেন না। এত খাড়া পার যে যতই চেষ্টা করছেন, ততই ছেঁচড়ে নরম থলথলে মাটিতে পরে যাচ্ছেন। ওদিকে প্যান্ট, হাত ব্যাগ ঝোপের ভেতর পরে আছে। ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লেন তিনি, যদি ব্যাগ আর লজ্জা নিবারণের এই মুহূর্তের একমাত্র উপকরণ সেই প্যান্টটা কেউ নিয়ে নেয় তো আজ তিনি ভয়ানক বিপদে পড়বেন।
              চিন্তিত মুখে  তিনি দেখলেন বন্যার পর নদীর পারে কিছু ছোট ছোট ঝোপ ঝাড়ের মত চারা গাছ গজিয়েছে। ভাবলেন, সে গুলির সাহায্যে যদি ওঠা যায়। সেই মত ভেবে খাড়া পার বরাবর তিনি দৌড়লেন, আর সেই গাছগুলোকে প্রাণপণে মুঠো করে ধরে শরীরটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে, পারে উঠতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু চারা গাছগুলো তার ভারী শরীরের ভার নিতে পারল না। মাটি সহ উপড়ে তার হাতে চলে আসলো, আর তিনি পুনরায় ছেঁচড়ে নীচে নরম থলথলে মাটিতে পরে গেলেন। আবার খানিকবাদে কোণাকুণি পারের দিকে দৌড়ে গেলেন, আর সেই চারাগাছগুলোকে অবলম্বন করে ওঠার চেষ্টা করলেন, এবং যথারীতি চারা গাছগুলো হাতের মুঠোয় করে নিয়ে থলথলে মাটিতে পরে গেলেন।
              এভাবে ছোটাছুটি করতে করতে বেশ খানিক সময় কেটে গেল। শার্টের মধ্যে কাদামাটি মাখামাখি হয়ে গেল। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ফিরতে হবে। নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে রমাপতির।  তখন ভয়ানক কান্না পেতে লাগলো। কিভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবেন তিনি? আসে পাশে কোন জনপ্রাণী নেই। আর যদিও বা থাকতো এই অর্ধ নগ্ন অবস্থায় তার কাছে কিভাবেই বা সাহায্য চাইতেন লাজুক রমাপতি?
            হঠাৎ প্রচণ্ড হাসির শব্দে তাকিয়ে দেখেন কিছু মানুষ এক জায়গায় জটলা মত দাঁড়িয়ে খুব হাসছে। তিনি পরিষ্কার বুঝলেন, নিম্নাঙ্গ আবরণহীন অবস্থায় তার এহেন দৌড়াদৌড়ি আর পুনঃ পুনঃ থলথলে ভুমিতে পতন দেখেই তারা হাসছে। আর তিনি এও দেখলেন যে, সেখান থেকে কিছু দূরে একটা শব দাহ হচ্ছে। এবার তিনি ভাল ভাবে বুঝতে পারলেন, এটা একটা শ্মশান, আর সেই মন্দিরটা একটি শ্মশান কালীর মন্দির, যার প্রান্তভাগের জবা গাছের ঝোপে তিনি অপকর্মটি সেরেছেন। প্রবল বেগের তাড়নায় তখন কিছুই তার চোখে পরে নি।  যাই হোক অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে ঈশ্বরের নাম নিয়ে পুনঃ পুনঃ চেষ্টায় অবশেষে তিনি নদীর পারে উঠতে সমর্থ হলেন। দেখলেন, তার ব্যাগ ও প্যান্টখানাও খোয়া যায়নি, যথাস্থানেই আছে। মনে মনে কঠোর প্রতিজ্ঞা করলেন রমাপতি, “জীবনে আর কোনোদিন চিংড়ি ছোঁবেন না”।