গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫

সুবীর কুমার রায়

 মহাবিদ্যা

কথায় বলে চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। কিন্তু এখানেই কি ব্যাপারটা শেষ হতে পারে? এর পরেও অনেক যদি, কিন্তু থেকেই যায়। চুরি করে বামাল সমেত ধরা পড়লে সেই চুরি বিদ্যা আর বড় বিদ্যা থাকে না মানছি, কিন্তু চুরি করে ধরা পড়েও যদি তার কাছ থেকে চুরি করেছে, একথা স্বীকার করানো না যায়? যদি চুরির মাল ফেরৎ পাওয়া না যায়? তাহলে সেই বিদ্যা কি বড় বিদ্যা বা মহা বিদ্যা নয়? তার সাথে পুঁথিগত বড় বিদ্যার পার্থক্য কোথায়? আর যদি চুরি না করেও ধরা পড়ে চোর বলে সাব্যস্ত হয়? তাকেই বা আমরা কী বলবো? বরং আজ এক চোরের কথা বলি। তাকে দেখে বিষ্মিত না হয়ে পারিনি। পাঠক সব শুনে ঠিক করুন, সে যথার্থ চুরি বিদ্যা অর্জন করেছিল কি না। 
আমরা তখন দশম-একাদশ শ্র্রেণীর ছাত্র। আট-দশজন সমবয়সী ছেলে, পাড়ায় আড্ডা দেওয়া, ফুটবল, ক্রিকেট, সাতগুটি, ইত্যাদি খেলা, এর গাছের পেয়ারা, তার গাছের নারকেল, এইসব নিয়ে বেশ ছিলাম। উঠতি বয়সের এতগুলো ছেলে একসাথে ঘোরাফেরা করে বলেই বোধহয়, সকলে আমাদের একটু সমীহ করে চলে। একটা ছোট মাঠে রোজ বিকালে ফুটবল খেলা হত। মাঠটার দুপাশে লতাপাতা, ঝোপঝাড়, জঙ্গল, একপাশে বড় বড় দেবদারু গাছ, আর একদিকে ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুর না বলে ডোবা বলাই ভাল। ঐ পুকুরে পাড়ার সকলে বাসন মাজে, স্নান করে।
একদিন জোর ফুটবল খেলা চলছে। একটু জোরে বলে কিক্ করলেই, বল পুকুরে গিয়ে পড়ে। সবাই হৈ হৈ করে পুকৃরে নেমে বল তোলা হয়। সঙ্গে পাঁচ সাত মিনিটের স্নান। যাহোক্, খেলায় সেদিন টানটান উত্তেজনা। এর মধ্যে মধুর মায়ের চিৎকারে আমাদের খেলা বন্ধ হল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, একটা ছেলে দুদিন আগে, পুকুর ঘাট থেকে তাঁর একটা বড় জামবাটি চুরি করে নিয়ে গেছে। তিনি ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখেও তাকে ধরতে পারেন নি। আজ আবার সেই ছেলেটা পুকুর পাড়ে আসায়, তাঁর এই চিৎকার। মধু আমাদের থেকে বছরখানেক এর বড়। কলেজে পড়ে। ফলে আমাদের একটা দায়িত্ব থেকেই যায়। দুচারজন ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে ধরে মাঠে নিয়ে এল।
বছর দশেকের একটা ছেলে, নোংরা জামা, হাফ্ প্যান্ট পরা। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, দুদিন আগে চুরি করে আজ ধরা পড়েছে।
বাটিটা কোথায়?
কী করে জানবো, আমি চুরি করি নি।
আবার মিথ্যে কথা? বাটি কোথায় রেখেছিস বল্?
সত্যি বলছি, আমি বাটি চুরি করি নি।
এখানে কী করতে এসেছিস?
এমনি, ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম।
তোর বাড়ি কোথায়?
চৌধুরী পাড়ায়।
একটা ছেলে এগিয়ে এসে পুলিশি কায়দায় বিরাশি শিক্কার চড় কষিয়ে বললো—“বাটি কোথায় রেখেছিস বল্, না হলে পুকুরে পুঁতে ফেলবো। তোর বাপও তোকে বাঁচাতে পারবে না
সত্যি আমি জানি না।
মধুর মা তোকে চুরি করতে দেখেছেন, উনি মিথ্যে কথা বলছেন?
আমি কিছু জানি না।
এতগুলো ছেলে, প্রত্যেকে এক আধটা করে চরচাপড় মেরে যে যার নিজস্ব কায়দায়, বাটি উদ্ধারের চেষ্টা চালালো। আমি নীরব। অতটুকু বাচ্ছার গায়ে হাত তুলতে মায়া হছে।
ক্রমে চরচাপড়, চুলটানা, এমন কী লাথি পর্যন্ত ছেলেটা মুখ বুজে সহ্য করে গেল।
আমার খুব খারাপ লাগছিল। ওদের মারধোর করতে বারণ করায়, তারা আমার ওপর রেগে গেল।
তুই চুপ করে থাক্। তোর মতো নরম মন নিয়ে বাটি উদ্ধার হয় না
একজন জোর করে ছেলেটার জামা প্যান্ট খুলে নিল। সম্পূর্ন উলঙ্গ হয়ে, সে নির্বিকার ভাবে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলো। এবার অপর একজন তাকে পুকুরে নেমে স্নান করতে বললো। ছেলেটাও পুকুরে নেমে সাঁতার কাটতে লাগলো। এবার তাকে জল থেকে তুলে আনা হল।
মাঠের লাগোয়া জঙ্গল থেকে বিছুটি গাছ নিয়ে এসে, দু’-তিনজন তার ভিজে উলঙ্গ দেহে, সপাসপ্ চাবুকের মতো মারতে লাগলো। ছেলেটার সারা শরীর লাল লাল, দাগড়া দাগড়া হয়ে ফুলে উঠলো। ওকে বাঁচাতে গিয়ে আমারও কয়েক জায়গায় বিছুটির আঘাত লাগলো। তাতেও কোন ফল না হওয়ায়, আবার তাকে পুকুরে চুবিয়ে, নতুন বিছুটি লতা দিয়ে মারা শুরু হল। তার কালচে উলঙ্গ শরীর, লালচে হয়ে গেছে।
বাধ্য হয়ে আমাকে আবার এগিয়ে আসতে হল।
তোর বাড়ি কোথায়?
বললাম তো চৌধুরী পাড়ায়।
চল্, তোর বাড়ি যাব।
চলো।
ওকে সঙ্গে নিয়ে, আমরা প্রায় মিনিট পনেরর পথ হেঁটে চৌধুরী পাড়ায় এলাম। এ রাস্তা, ও রাস্তা, এ বাড়ির পাশ দিয়ে, ও বাড়ির পাশের গলি দিয়ে মিনিট দশেক ঘুরিয়ে, সে জানালো তার বাড়ি ভট্টাচার্য্য পাড়ায়।
রাগে তাকে একটা মোক্ষম চড় কষিয়ে, নিয়ে চললাম ভট্টাচার্য্য পাড়ায়। সঙ্গের ছেলেরা খুব উত্তেজিত। তারা বললো— “এ ভাবে হবে না, ওকে নিয়ে পাড়ায় চল্, বাটি ফেরৎ দেয় কী না দেখি
চৌধুরী পাড়া ও ভট্টাচার্য্য পাড়ার কিছু ছেলে ঘটনা শুনে আমাদের দলে ভিড়ে গেল। তারা কিন্তু কেউ ছেলেটাকে চিনতে পারলো না। তারাও তাদের বুদ্ধিমতো বাটি আদায়ের চেষ্টা করলো। সঙ্গে নতুন করে, নতুন হাতে, নতুন কায়দায় প্রহার।
বেশ কিছুক্ষণ ওকে নিয়ে ভট্টাচার্য্য পাড়ায় ঘোরার পর, ও জানালো ওর বাড়ি রেল লাইনের ওপারে মনসাতলায়, অর্থাৎ সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে, প্রায় এক ঘন্টার হাঁটা পথ।
এবার এই ব্যাপারটা আমার হাতের বাইরে চলে গেল। ছেলেরা তাকে মারতে মারতে আবার পুকুর পাড়ের মাঠে নিয়ে এল। তখন তার ঠোঁটের  পাশে কষ বেয়ে রক্ত পড়ছে। মুখটা ফুলে গোল মতো, কেমন একটা হয়ে গেছে। সারা শরীরে লাল কালো দাগ।
এবার তাকে নিয়ে কী করা যায়, সবাই যখন ভাবছে, তখন একজন একটা সেফটি-পিন্ ছেলেটার ঠিক নখের নীচ দিয়ে অনেকটা ঢুকিয়ে দিল। একবার শুধু চোখ মুখ কুঁচকে উঃ আওয়াজ, তারপর আবার আগের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। শুধু অপর হাত দিয়ে ক্ষত হাতটা চেপে ধরে থাকলো।
আমি বুঝতে পারছি এরপর ছেলেটাকে মারধোর করলে, মানুষ খুনের দায়ে জড়িয়ে পড়তে হবে। হঠাৎ দেখি মাঠের একপাশে অনেকটা টাটকা গোবর পড়ে আছে। বোধহয় আমাদের অন্যান্য পাড়া সফরের সুযোগে, কোন গরু কাজটা সেরে গেছে।
ছেলেটাকে বললামবাটিটা ফেরৎ দিয়ে দে, তা না হলে কিন্তু ঐ গোবর খাওয়াবো
গোবর খেলে ছেড়ে দেবে?
হ্যাঁ তা দেব। তবে আগে বাটি ফেরৎ দে।
কিছু বোঝার আগেই ও এক দলা কাঁচা গোবর নিয়ে মুখে পুরে দিল। বুঝলাম ওর কাছ থেকে বাটি উদ্ধার করা আমাদের কর্ম নয়। এই বয়সেই সে এত তৈরী। রেওয়াজ করলে, ওর ভবিষ্যৎ উজ্জল। আমার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত সবাই ওকে ছেড়ে দিল বটে,  কিন্তু  বাটি উদ্ধার করা সম্ভব হল না।
চুরি বিদ্যায়, ধরা পড়েও ও কী মহা বিদ্যান নয়? পাঠক কী বলেন?