গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

শেষ ইচ্ছে


অমিত বোধহয় বুঝেছিল এই ধাক্কাটা সুধীরেন্দ্র আর শেষ পর্যন্ত সামলে উঠতে পারবেন না । জিজ্ঞাসা করলো, ‘জেঠু অনির্বাণদাকে আসতে বলবো ? আমি তো নেট ব্যবহা করি । আমাকে ফোন নম্বরটা জানালে ফোনও করতে পারি । বলবো জেঠু’ ? অমিত ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞাসা করেছিল কথাটা । ও জানতো সুধীরেন্দ্র তার আমেরিকায় থাকা ছেলে অনির্বাণের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চান না । তবু, একমাত্র ছেলে তো !

চোখ খুলে এক প্রশান্ত চাউনি সুধীরেন্দ্রর । প্রশান্ত, কিন্তু কঠিন । স্পষ্ট উচ্চারণে সুধীরেন্দ্র বললেন, ‘তোর কি খুব অসুবিধা হচ্ছে অমিত রোজ রোজ আসতে ? আমি তো তোকে বলিনি রোজ রোজ আসতে’ । আর কিছু বলার ছিল না অমিতের । এমনই সুধীরেন্দ্র সান্যাল । নামি অভিনেতা, মধ্যম গ্রামের  এ তল্লাটে এক ডাকে সবাই চেনে । খুব শ্রদ্ধেয় মানুষ । অমিতকে খুব ভালোবাসেন । মনে আছে অমিতের, সুধীরেন্দ্র তাকে বলেছিলেন দেখ থিয়েটারকে যদি ভালোবাসতে পারিস তবেই থিয়েটারে আসবি । থিয়েটার থেকে টাকা পয়সা উপার্জনের কথা যদি ভাবিস তাহলে আসিসনি । সুধীরেন্দ্রর হাত ধরেই আমিতের থিয়েটারে আসা । আজ নাট্যাভিনেতা অমিত গাঙ্গুলী্র যেটুকু খ্যাতি তা সুধীরেন্দ্র জেঠুর জন্যই, এটা অমিত সব সময়েই স্বীকার করে । সুধীরেন্দ্রও তাকে নিজের ছেলের মতই ভালোবাসেন ।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় রিহার্শালে যাবার আগে ঘন্টাখানেক জেঠুর সঙ্গে কাটিয়ে যেতো । নানান কথা । বড় বড় অভিনেতাদের জীবন কথা । শেষ জীবনে থিয়েটার করতে না পারায় শিশিরকুমার ভাদুড়ীর নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা জেঠুই তাকে বলেছিল । বলেছিল কোন অভিমানে শম্ভূমিত্র তার শেষ ইচ্ছাপত্রে লিখে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃতদেহ যেন সোজা স্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর অনুরাগীদের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ না দিয়ে ।  এইসব কথা ভাবতে ভাবতে একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল অমিত । কছুটা চমকে উঠলো সুধীরেন্দ্রর কথায় । সোমেশকে একবার আসতে বলবি অমিত ? সোমেশ চ্যাটার্জী, নামি এডভোকেট । সোমেশ আগেও একদিন এসেছিল কি সব কাগজ-পত্র নিয়ে । বোধয় উইল করতে চান সুধীরেন্দ্র । অমিত ভেবে পায়না, উইল করতে হবে কেন ? একটাই তো ছেলে, বাবার মৃত্যুর পর স্বাভাবিক নিয়মে সেইইতো উত্তরাধিকারী । তবে ? তবে কি অন্য কিছু ভেবেছেন সুধীরেন্দ্র ? বললো ‘ঠিক আছে, কাল আসতে বলব’ । সুধীরেন্দ্র তাকে থামিয়ে বলল ‘কাল নয় রে, আজ সন্ধ্যাতেই আসতে বল, সময় বেশি নেই । তারপর ধীরে ধিরে বললেন, ‘তুই এখন যা অমিত । তোর তো, আজ রবিবার, দু’বেলাই রিহার্শাল । যাবার পথে সোমেশকে খবর দিয়ে যাবি’, আজ সন্ধ্যাতেই আসতে বলবি । কাজের মেয়েটা এসে গেছে অনেকক্ষণ, অমিত ওঠে ।  যাবার সময় বলে ‘আজ সন্ধ্যায় আসতে একটু  দেরি হবে জেঠু, বিকেল চারটে থেকে ফুল রিহার্শাল আছে তো’ ।

দুবছর আগে স্ত্রী সীমা মারা যাবার পর থেকেই নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নিতে শুরু করেন সুধীরেন্দ্র । প্রিয় নাটকের দল থেকে সরে এসেছেন একবছর হল । একটু জোরাজুরি করলে হয়তো থেকে যেতেন । ওরা বলেনি । বয়সে অনেক ছোট প্রদ্যোৎ বলেছিল ‘বৌদি মারা যাবার পর আপনি একটু অমনোযোগী হয়ে গেছেন সুধীদা । নতুন নাট্যভাবনার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না’ । প্রদ্যোৎরা একটা সম্বর্ধনার আয়োজন করেছিল  সুধীরেন্দ্র না করে দিয়েছিল । তাতে অবশ্য অমিতের কোন এদিক-সেদিক হয়নি । সুধীরেন্দ্র যেদিন বিছানা নিল সেদিন সকালে কাজের মেয়েটাই অমিতকে খবর দিয়েছিল । ছুটে গিয়েছিল অমিত । বাথরুম যাওয়ার সময় পড়ে গেছেন । দিনের বেলা বলেই খবরটা সময়মত পেলো । রাত্রে হলে তো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়টুকুও পেত না । দিন পাঁচেক পরেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল । শরীরের ডানদিকটা অবশ হয়ে আসছে । এখন বাড়িতেই বিছানায় শুয়ে থাকা, ওষুধগুলো নিয়মিত খাওয়া । প্রায় একমাস এই অবস্থায় । একজন আয়া আর রাত্রে থাকার জন্য একজন ছেলেকে ঠিক করে দিয়েছে অমিতই । সারাক্ষণ সুধীরেন্দ্রর কাছে একজন থাকা দরকার । ডাক্তার বলে  দিয়েছিলেন ।

হাসপাতাল থেকে ফিরে একটু সুস্থ্য হওয়ার পর অমিত একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল ‘জেঠু, অনির্বাণদাকে একটা খবর দিতে হবে তো’ । সুধীরেন্দ্র বলেছিল ‘না, আমি চাই না আমার সঙ্গে ওর আর দেখা হোক । ঐ নামটা আর আমার সামনে উচ্চারণ করিস না’ । অমিত ভাবার চেষ্টা করে বাবার মনে তার ছেলে সম্পর্কে কতখানি ক্রোধ জমলে এমন কথা কেউ বলতে পারে । অমিত অবশ্য তার জেঠুর কোন দোষ দেখে না । বিয়ের একমাস পরেই অনির্বাণ সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকায় চলে গেল। পনেরো বছরে একদিনের জন্যেও বাবা মার সঙ্গে দেখা করতে এলো না । সীমা চায়নি, ছেলে বিদেশে যাক । অনির্বাণ বলেছিল ‘মাত্র তিন বছর তো মা’ । তিন বছর পরেই ফিরে আসবো । এখন তো দূরত্বটা কোন ব্যাপারই না’ । একটা ওয়েবক্যাম কিনে কি করে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে তাও শিখিয়ে দিয়েছিল বাবাকে ।

অনেকগুলো ‘তিন বছর’ পেরিয়ে গেল, এলো না। সুধীরেন্দ্র বুঝতে পেরেছিল, ছেলে আর ফিরবে না । একবার বাবা-মাকে মাসখানেকের জন্য তার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, সুধীরেন্দ্র সম্মত হননি । তবু ভেবেছিল সুধীরেন্দ্র, মায়ের শেষ শয্যার খবর পেয়ে কিংবা জননীর মৃতমুখটা শেষ দেখার জন্য একবার আসবে । মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে সীমার জড়িয়ে আসা কন্ঠে ‘খোকা কখন আসবে ? আসবে না’ ? অনির্বাণ আসেনি । সীমার নিথর দেহটা ছেলের আসার অপেক্ষায় ঠান্ডাঘরে রাখা ছিল একদিন । সে এলোনা, একটা ফোন এলো, ‘যাওয়া যাচ্ছে না বাবা, কাজের ভীষণ চাপ, ছাড়া পাচ্ছি না। তোমরা ক্রিয়া-কর্মটা ভালো করে করে নাও । আমি ক’দিন পরেই যাওয়ার চেষ্টা করছি’ । হৃদয় বোধয় ছিঁড়ে গিয়েছিল সুধীরেন্দ্রর কথাটা বলতে । বলেছিল ‘না এলেই খুশি হবো’ আর একটা কথাও বলেননি । সীমার পারলৌকিক ক্রিয়া-কর্ম মিটে যাবার পর একবার মাত্র ফোনে বলেছিল ছেলেকে । ‘একেবারে বিক্রি হয়ে গেলি রে’ ! ক্রোধ নয়, হাহাকার । হয়তো সুধীরেন্দ্র জানতো,এরকমই হওয়ার ছিল । সেই শেষ কথা ছেলের সঙ্গে। টেলিফোনটাও জমা করে দিয়েছিলেন টেলিফোন অফিসে গিয়ে ।

যেদিন অনির্বাণ সুধীরেন্দ্রকে বলেছিল যে কোম্পানী তাকে আমেরিকায় তাদের হেড অফিসে জয়েন করতে বলছে, তিন বছর থাকতে হবে । সেদিন কি সুধীরেন্দ্র বুঝতে পারেন নি ? পেরেছিলেন বলেই আজকের এই হাহাকার ! সীমা চাননি, সুধীরেন্দ্রও মন থেকে চাননি, কিন্তু বুঝেছিলেন কিছুই তার করার নেই । সময়কে রুখে দেবার ক্ষমতা তাঁর নেই । অনির্বাণ বলেছিল ‘দেখো বাবা, পৃথবীটা এখন খুব ছোট হয়ে গেছে । তোমাদের পুরনো ধ্যান-ধারণগুলো পালটে যাচ্ছে’ ।

সুধীরেন্দ্র ভেবে পায় না, কবে, কেমন করে সব পালটে গেল ! পিতা-মাতার স্নেহ, ভালোবাসা, আকাঙ্খা – এগুলোও কি পালটে যায় ? হয়তো যায় । হয়তো আরো কত কি পালটে যাবে । অমিত একদিন বোকার মত জিজ্ঞাসা করেছিল, জেঠু এখনকার আমরা কেন এমন বদলে যাচ্ছি ? সুধীরেন্দ্র বলেছিল রক্তকরবী নাটকটা দেখেছিস তো । সেই সংলাপটা মনে আছে ? অধ্যাপক নন্দিনীকে বলছে “আমরা যে মরা ধনের শবসাধনা করি । তার প্রেতকে বস করতে চাই । সোনার তালের তাল-বেতালকে বাঁধতে পারলে পৃথিবীকে পাব মুঠোর মধ্যে” । আমিত আর কিছু বলেনি ।  সোনার তাল-বেতালকে বেঁধে ফেলার বাসনা কি আর তিন বছরে মেটে ? মেটেনি ১৫ বছরেও । সুধীরেন্দ্র বুঝে ছিলেন। ছেলে তাঁর ফিরে আসবে এমন আশাকে প্রশ্রয় দেয়নি বছর তিনেক কেটে যাবার পর থেকে ।

সন্ধ্যার রিহার্শাল আর শেষ করা গেলো না । রাত্রি আটটা নাগাদ কাজের মেয়েটা হাঁপাতে হাঁপাতে এলো । ‘শিগগির চলো অমিত দা, জেঠু কেমন করছে । এক্ষুনি তোমাকে ডাকতে বললো’ । উকিল বাবুও এসেছে’ । এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো কথাটা । অমিত চমকে উঠলো । রিহার্শাল বন্ধ করে তাকে যেতে বলার লোক তো জেঠু নয় ! তবে ? আশঙ্কায় ডুবে গেলো অমিত । বললো ‘তুই যা আমরা যাচ্ছি’ ।

রিহার্শাল বন্ধ করে দলের সবাই চলে এলো । পাড়ার দুএকজনও এসেছে দেখলো । আর এক বয়স্ক মানুষকে দেখলো । অমিত খুব একটা চেনে না। তবে দিন দশেক আগে একবার সূধীরেন্দ্রর কাছে আসতে দেখেছিল । দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বারাসাত শহরে দীননাথ একটা বৃদ্ধাশ্রম চালায় শুনেছে । বাড়তি কৌতুহল অমিতের কোনদিনই নেই, সেদিনও কোন কৌতুহল প্রকাশ করেনি ।  ওদের একজন বললেন ‘ডাক্তার ব্যানার্জীকে খবর দিয়েছি, উনি এখনই আসছেন’ । শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে সুধীরেন্দ্রর। তারমধ্যেই তাকালেন উদ্বিগ্ন মুখগুলোর দিকে । ধীর কন্ঠে বললেন ‘তোরা এসেছিস’? সোমেশ উকিলকে বললেন ‘কাগজদুটো দাও’ । কাঁপা হাতে কাগজদুটো হাতে নিলেন সুধীরেন্দ্র, হাতটা এগিয়ে দিয়ে কলমটা চাইলেন । সোমেশ কলমটা হাতে ধরিয়ে দিলেন । সোমেশ বললেন ‘একবার পড়ে দেবো না’ ? সোমেশকে থামিয়ে ক্ষিণ কন্ঠে সুধীরেন্দ্র বললেন ‘সই করার পর অমিত বয়ানটা পড়ে দিবি’ । সুধীরেন্দ্র কাগজদুটো সই করে, দলিলের মত দেখতে কাগজটা সেই দীননাথের হাতে দিলেন আর একটা অমিতকে ফেরত দিলেন পড়বার জন্য । অমিত অপলক চোখে কাগজটাতে চোখ বোলাল । পড়া আর হল না। সুধীরেন্দ্র নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না, মুখটা ফাঁক করে টানছেন শেষ হাওয়াটা যতটুকু শুষে নেওয়া যায় ! দুতিনবার টেনে থেমে গেলেন । ডাক্তার ব্যানার্জী সুধীরেন্দ্রর বুকে স্টেথস্কোপ ধরে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন যেন অপেক্ষা করছেন শেষ স্পন্দনটা শোনার জন্য। স্টেথোটা কান থেকে খুলে শুধু বললেন ‘শেষ’ । অমিত তখনো সোমেশ উকিলের কাগজটা যেটা একটু আগে সুধীরেন্দ্র তাকে দিলেন পড়বার জন্য – অপলক তাকিয়ে আছে । কেউ জানতে চাইলো না, কি লেখা আছে । শুধু অমিত জানলো । লেখা আছে –

আমি, সুধীরেন্দ্র সান্যাল স্বজ্ঞানে, ও পূর্ণ সচেতনতায় এই ইচ্ছাপত্র স্বাক্ষর করছি যে –
(১) আমার মৃত্যুর পর আমার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ওপর আমার আমেরিকা প্রবাসী একমাত্র পুত্র অনির্বাণ সান্যালের বা অন্য কারোর  কোন আইনী অধিকার বর্তাবে না ।
(২) আমার বাসভবন ও তৎসংলগ্ন জমিতে গড়ে উঠবে ‘সীমা স্নেহচ্ছায়া’ নামে এক বৃদ্ধাশ্রম, যেটি গড়ে তুলবেন বারাসাত নিবাসী শ্রী দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । এই উদ্দেশ্যে শ্রী দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে একটি পৃথক দানপত্রও সজ্ঞানে আজকের তারিখে স্বাক্ষর করেছি ।
(৩) স্থানীয় একটি মাত্র ব্যাঙ্কে সঞ্চিত নগদ অর্থ উক্ত ‘সীমা স্নেহচ্ছায়া’ গঠন ও পরিচালনার কাজে শ্রী দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে ব্যয়িত হবে ।
(৪) শ্রী সোমেশ চ্যাটার্জী, এডভোকেট , এই ইচ্ছাপত্র ও শ্রী দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে আমার স্বাক্ষরিত দানপত্রে্র নকল, জন্মসূত্রে আমার পুত্র, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী, শ্রী অনির্বাণ সান্যালের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন ।

সব শেষ । অমিত অপলক তাকিয়ে সুধীরেন্দ্রর নিথর দেহটার দিকে । সন্বিত ফিরলো সোমেশের কথায় । ‘সাক্ষির সইটা করে দাও’পেনটা বাড়িয়ে দিলেন সোমেশ । সই করলো । ওদের দলেরই একজন ফোন করে দিয়েছে নীলরতন সরকার হাসপাতালে । গাড়ি আসবে, দানকরা সুধীরেন্দ্রর দেহটা চলে যাবে নীলরতনে ।