গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫

অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায়

খেজুর রস

এক ছিল তাড়ি বুড়ো। প্রতিবছর দেখতাম তার দুই সঙ্গী নিয়ে গ্রামের রাণীবাঁধের পাড়ে ডেরা বাঁধতো। কার্তিক মাসে আসত, মাঘ মাসের মাঝামাঝি আবার ফিরে যেত দেশের বাড়িতে। ও এলেই আমরা কেমন যেন শীতের আমেজ অনুভব করতাম। পুকুর পাড়ের সব নোংরা পরিস্কার করে খেজুর ডাল দিয়ে  বেড়া বেঁধে  সুন্দর করে মাটি লেপে দেওয়াল বানাতো। খেজুর পাতার ছাওনি করত। বাইরে বেড়ার চারপাশে গাঁদার চারা লাগাতো। আমরা ছোটরা বসে বসে ওর কেরামতি দেখতাম। ওর বাড়ির মজার মজার গল্প শুনতাম। তিন চারটে বড় বড় উনুন বানাতো আর ভোজপুরী গান গাইতো। একটা ছোট্টো ঢোলকও ছিল। আমরা সে গানের বিন্দু বিসর্গ না বুঝলেও বেশ মজা পেতাম ওর অঙ্গভঙ্গি দেখে। প্রতিবারই আমরা জিজ্ঞেস করতাম,
---এই তাড়ি বুড়ো তোমার নাম কি গো?
--- হামার নাম আছে ভৈঁরো সিং, নামটা বলেই গোঁফটা এমন ভাবে পাকাতো যে আমরা হেসে লুটোপুটি। তারপরেই এক নিশ্বাসে বলতো,
--- মেরা পিতাজীকে নাম পরিচ্ছন সিং, বেটাকে নাম যোগিন্দর সিং, মেরা পোতা কা নাম গুঞ্জন সিং। দেশ হ্যায় লাতেহার পালামু জিলা। পাঁচ বিঘা জমিন আছে হামার, ও জমিনে বহত চানা হোয়। ভাজা চানা আনিয়েছি। লিট্টি ভি আনিয়েছি।
  তুমলোক খাবে? হামি লিয়ে আসছি। বলেই কাপড়ের পুঁটলি খুলে আমাদের ছোলা ভাজা আর একটা করে লিট্টি দিত।
              

প্রতিবছর একই ডায়ালগ। এমনকি কমা পুর্ণচ্ছেদও।  আসলে আমরাও লিট্টির লোভে জেনেশুনে প্রতিবছর ওর নাম জিজ্ঞেস করতাম। তারপরেই ও বলত " বাবুরা এবার তোমরা বাড়ি যাও, সাঁঝবেলা হলো।  হাতি আসবে, শেয়াল আসবে এবার।বাড়ি চলিয়ে যাও।আমরাও একছুট্টে বাড়ি পালাতাম।
তাড়িবুড়োর নামটা ভারিক্কি হলেও ওর শরীরটা ছিল লিকলিকে গঙ্গাফড়িং এর মত। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় তরতর করে খেজুর গাছে চড়ত। কোমরে একটা বেল্ট থাকত, পেছন দিকের হুকে ঝুলত রসের হাঁড়ি,ডানপাশে গোঁজা থাকত ইস্পাতের তীক্ষ্ণ দা। আর পায়ে থাকত একটা ছোট্ট বেল্ট। যা দিয়ে গাছে পা টা সুরক্ষিত রাখা যায়। প্রাতিদিন ভোরবেলা ও সন্ধ্যেবেলা কনকনে ঠান্ডায় গাছে উঠে রস সংগ্রহ করত। ভোরে উঠে আমরাও ছুটতাম তাড়িবুড়োর ডেরায়। সুর্য ওঠার আগের সংগৃহীত রস থেকে ছোট্ট চায়ের গ্লাসে আমাদের প্রত্যেককে খেজুর রস দিত। খাওয়ার পর দু ছটাক ওজনের খেজুরপাটালি দিয়ে বলত " বাবু সব ঘর যাইয়ে সুরজ উঠনে সে পহলে। আউর ইয়াদ রাখিয়ে সুরজ উঠনে কে বাদ ই কভি ভি মত পিজিয়ে।"
আমরা বলতাম "কাল হাতি  এসেছিল ?" ও বলত " দশ বারাঠো আয়া থা। বহত বাত চিত হুয়া। হাম তো জংলী আদমি আছে পালামু জিলা কা, উনকো রিস্তাদার কা খবর দিয়া। বাতো বাতো মে বহত রাত ভি হয়ে গেলো। একঠো বাচ্চা হাতি তো হামারা কাঁন্ধে পর চড় গিয়া থা। ও বোল্লো হামকো লিট্টি দো। হাম বোলা লেলো বেটা,খা লো।হামারা সব লিট্টি আউর আলু পরাঠা খেয়ে লিলো। হমকো ভুখা রহনা পড়া।
আমরা বললাম "তারপর কি হলো?" ও বলল,"বাকী হাতিগুলানকে তাড়ি খাইয়ে দিলম। ওদের নেশা হোয়ে গেলো। নেশা করকে লাচ ভি শুরু করিয়ে দিলো।আর টলতে টলতে ওয়াপস বাড়ি চলে গেলো।"
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত মিথ্যে গল্পগুলো  শুনতাম। ওর হনুমান চালিশা শোনার সুযোগ হয়নি,তবে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে জয় হনুমানজী জয় হনুমানজী করত। শুনেছি রাতের বেলা খাওয়ার আগে শুদ্ধচিত্তে নাকি হনুমান চালিশা পড়ত। আমরা জিজ্ঞেস করতাম  "হনুমান চালিশা পড়ে কি হয়।"
ও বলতো, "বহত তাকোত হোয়। ভুত পেরেত কাছে আসতে পারে না। শ্মশান মশানে হামরা থাকিতো, রাত বিরাত এখান ওখান পড়ে থাকতে হোয়, জন্তু জানোয়ার ভি আসে, হনুমানজীকে নাম লিলে কুছু হয় না। এই দেখো বলেই জামা খুলে বুকটা দেখিয়ে দিতো।আমরা অবাক হয়ে দেখতাম ওর বুকে উল্কি দিয়ে আঁকা হনুমানের ছবি।
ভৈঁরোর দুই সাথী সরজু আর বিরজু পাটোয়ারী। সরজু ভৈঁরোর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতো আর বাঁকে করে খেজুর রসের হাঁড়ি  বইতো। বিরজু খুব  একটা ভালো লোক ছিল না। মোষের মত শরীর। সারাদিন খেজুর রসে জ্বাল দিত আর খইনি ডলতো। খইনি মুখে নিয়ে পিরিচ পিরিচ করে এখান সেখান থুতু ফেলতো। ভৈঁরো এ নিয়ে বহুবার ধমকেও তার বদ অভ্যাস ছাড়াতে পারেনি। ভৈঁরো না থাকলে প্রায়ই পথচলতি সাঁওতাল মেয়ে পুরুষদের গ্যাঁজানো রস বা তাড়ি  বিক্রি করে পয়সা গ্যাঁড়াতো। ভৈঁরো কিন্তু গ্যাঁজানো তাড়ি বিক্রি করত না। বলত নেশা করা বা কাউকে নেশা ধরানো ভাল কাজ নয়। বজরংবলী পাপ দেয়।
আমরা যখন বড় হলাম তখন আর তাড়িবুড়োর কাছে চেয়ে খেজুর রস খেতাম না। প্রায়ই ভোরবেলায় বিপজ্জনক ভাবে খেজুর গাছে চড়ে চুরি করে খেতাম। বাঁধাধরা কয়েকটা গাছের উপরে এই অত্যাচার চলত প্রতিদিন। এই ব্যাপারটা বিরজু লক্ষ করেছিল।
এক দিন রস চুরি করে খাওয়ার পরেই বিপত্তি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভেদবমিতে আক্রান্ত হলাম। মাথা ঘুরতে শুরু করলো। তারপর কখন যেন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি।ঘটনা গ্রামে ছড়াতে বেশী সময় লাগেনি। বিকেলদিকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। গ্রামের লোকেরা চড়াও হল তাড়িবুড়োর ঝুপড়িতে।
ভৈঁরো সিং বলল, "বাবুলোগ আপ সব মেহেরবানী  করকে শুনিয়ে, আউর থোড়া রোকিয়ে। হম অভি গুনহাগারোকে পকড় তে হ্যাঁয়। ওহ লোগ এহি পর হ্যাঁয়। হম উনকো এইসা সাজা দেঙ্গে ওহ জিন্দেগী ভর ইয়াদ রাখখেগা।"  বলেই বিরজুর মাথার চুল ধরে  সবার সামনে টেনে দমাদ্দম ধোলাই শুরু করল। গঙ্গাফড়িং এর চেহারার যে এত শক্তি কেও ঠাহর করতে পারেনি। ফুঁসে উঠে চিৎকার করে বলতে শুরু করল,"শালে হারামজাদে তু নে রস মে কঙ্কড় মিলাই, কাল হামনে তুঝে দেখা তু কঙ্কড় পিষাই করতে থে বিহান মে। ভাবিয়েছিলম গাঁজার সাথে মিলিয়ে তুই খাবি। তা সেই কঙ্কড় খেজুর রসে মিলিয়ে দিলি? বেইমান কোথাকার।বচ্চেলোগ থোড়া সা গলতি করিয়েছে তো তুমাহারা ক্যায়া। ওরা হামার লেড়কা কি ভি আছে, বন্ধু ভি আছে।হম তো কভি ওনকো কুছ নাহি বোলা। শালে তেরা ঘর মে বালবচ্চা নহি হ্যায় ক্যায়া?" বলেই ছ্যাঁচড়ে চৌহদ্দির বাইরে এনে সবাইকে বলল," বাবুলোগ আপ সব ইনকো জুতি সে মারিয়ে, উসকে বাদ হম উনকো পুলিশকো হাওয়ালা কর দেঙ্গে।" মোষের মত চেহারার বিরজু  কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছিল। গ্রামের লোক আর ওকে পেটানোর বীরত্ব দেখায়নি।
ভৈঁরো বলতে লাগল,"শালে চোর ভি আছে, দেশ মে খানা নাহি মিলতা থা শালেকো, ঔর শাদি কর লি। তিন বচ্চে ভি পৈদা কর লি, উনকো বুঢঢি মা নে মুঝে বোলি, বেটে ইনকো লে যাও, থোড়া সবক শিখাও। কামধান্দা শিখাও। ই শালে কামধান্দা ছোড়কে রস মে জহর মিলাতে হ্যায়। হামারা বদনাম কর দিয়া। মারো শালেকো।
বিরজুর অবস্থা দেখে গ্রামের লোক বললো, "আর মেরো না ভৈরোঁ ও মরে যাবে। ওকে পুলিশে দেওয়ারও দরকার নেই। ও যা সবক শিখেছে তাই যথেষ্ট।"
ভৈরোঁ তার দিশি মচমচে জুতো দিয়ে বিরজুর মুখে সপাটে বসিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল," অভি নিকাল যা ইহাঁসে।"
নেতিয়ে যাওয়া শরীরটাকে কোনমতে টেনে হ্যাঁচড়ে বিরজু চলে গেল। তখনো ফুঁসছে ভৈরোঁ।  "বলেন বাবুসাব খাবার জিনিষে কেউ কখনো জহর মিলায়? হামি নেশার তাড়ি ভি বেচি না। রস পিও,গুড়কা মজা লো, আউর ক্যায়া। দো দিনকা জিন্দেগি খাও পিয়ো মৌজ করো। শালে রসিক না হোলে রসের মরিয়াদা বুঝবে কি কোরে? খালি মানুষের ক্ষতি কোরা আর চোরি কা ধান্দা। বিশওয়াস কোরেন বাবু হামি কোনদিন নেশা কোরি না, মানুষের সাথে ঝগড়া কোরি না। একজন প্রশ্ন করলো," তোমার বাড়িতে কে আছে ভৈরোঁ?"
---হামার পরিবার আছে। খেতি বাড়ি উনহোনে সাম্ভালতি হ্যায়। ও দুগগা আছে বাবুজি। দো হাত দিয়ে দশ হাতের কাম কোরে। এক লড়কি আউর এক লড়কা আছে হামার। লড়কি কো শাদি হুয়া এক ডাগদার কো সাথ। বজরংজীকে কৃপামে  লড়কা ছোটিমোটি নোকরি করতা হ্যায় পাটনা জিলা মে।  ডি এম না ক্যায়া নোকরি  করতা হ্যায়, হামকো মালুম নহি। বাড়ি  এলে খেতি বাড়ি ভি কোরে। কোদালি চালায়। ওহ তো বোলতে হ্যায় পিতাজি রস কা কাম ছোড় দো। আপ দোনো হি হামারা পাশ আ যাও।
---তা চলে যাও না ওর কাছে। ছেড়ে দাও না এসব কাজ।
---নহি বাবু উ হোবে নাই। বচপন সে হামি রসের কারোবার করছি। উস টাইম হামলোগ বহুৎ গরীব থা।পিতাজীকো মরনে কা বাদ হামারা কোই কাম ধান্দা নহি থা। লিখাই পঢ়াই ভি নহি হোলো। এই খেজুর গাছ একদিন হামাকে রোটি দিলো, কাপড়া দিলো, মকান ভি দিলো। খেজুর রসে মজিয়ে গেলাম। বজরংবলী কে কৃপা মে শাদী ভি হোলো। এক লেড়কা এক লেড়কী  হোলো। মকান হোল। এই খেজুর রসের কামাই সে লেড়কা লেড়কী কো পঢ়াই লিখাই হলো,ওরা মানুষ হোলো,শাদী হোলো। রস হামকে রসিক বানিয়েছে। জীবনের রসে জ্বাল দিয়ে দিয়েই তো গুড়ের মত মিঠা ইনশান বনতা হ্যায় বাবু। জানেন যো আদমির জীবনের রস তিতা আছে ও আদমি পাগলা হোয়। যো আদমির জীবনের রস ঝাল হোয় ও আদমি খুনি বদমাস হোয়, যো আদমির জীবনের রস খাট্টা মিঠা হোয় ও রাগী ভি হোয় আউর আচ্ছা ইনসান ভি হোয়। জিসকো জিন্দেগি কা রস মিঠা হোয় ও ইনসান বহত আচ্ছা হোয়। কিছু বুঝলেন বাবু!
এ খেজুর গাছ হামার ভগমান আছে। তো এই রসের কারোবার কেনো ছাড়বো বোলেন তো । জীবনে রস না থাকলে জীবন বাঁচে কি কোরে বাবু?