পিতৃত্ব
“রোজ হেটে স্কুলে যেতে ভালো লাগে না,আমার বুঝি কষ্ট হয় না, তিন্নি, তুলি ও বৃষ্টিরা যখন রিক্সায় যেতে যেতে করুন চোখে আমার দিকে তাকায় তখন
যে কষ্ট লাগে, পায়ে হাটা তার কাছে কিছুই না, বাবা, তুমি এতো গরীব কেন”? বলে বাবার দিকে অনুযোগের চোখে তাকায় তিথী । তিথীর বাবা রজব আলী একটি
বেসরকারি অফিসে ক্লার্কের কাজ করেন । সামান্য বেতনের ছোট চাকরী করলেও তিনি
স্বপ্নময় মানুষ। নিজের অনেক স্বপ্নই বাস্তবতার যাঁতাকলে বেঘোরে মারা গেছে ।
পিতৃত্বের সহজাত চাওয়ায় তিনি সন্তানদের দিয়ে যেতে চান দারিদ্র্যের অভিশাপ মুক্ত
জীবন । নিম্ন আয়ের মানুষদের পক্ষে জীবনের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোই দায়, স্বপ্ন তাদের জন্য বাতুলতা মাত্র । কিন্তু এই
মানুষেরাই সমষ্টিগতভাবে পার্থিব স্বপ্নের বড় অংশটি হৃদয়ে লালন করেন, ফলাফল স্বপ্নভঙ্গের আজন্ম বেদনা । মধ্যবিত্তের
জীবন হল আড়াই হাত কাপড়ে তিন হাত শরীর ঢাকার প্রচেষ্টা, পা
ঢাকলে মাথা বেড়িয়ে যায় আর মাথা ঢাকলে পা । দুটি সন্তান তার, ছেলে বড়, ছোট মেয়ে তিথী, এবার প্রাইমারী পাশ করেছে, মফঃস্বলে কাছাকাছি
হাইস্কুল নাই বলে দুরের হাইস্কুলে ভর্তি করাতে হয়েছে । নতুন স্কুলে ভর্তি,ড্রেস,বই খাতা বাবদ অনেক খরচ হয়েছে তাই
মেয়ের প্রশ্নে হৃদয় ভাঙলেও সাধ্যে কুলিয়ে ওঠে না ।
“গরীব
কি কেউ ইচ্ছে করে হয় রে মা, এদেশে তো গরীব মানুষই বেশী,
অনেক ছেলেমেয়ে স্কুলেই যেতে পারছে না, সৃষ্টিকর্তা
অসীম দয়ালু, তিনি আমাদের সুযোগ দিয়েছেন কষ্ট করে ভাগ্য
তৈরি করার, কষ্ট না করে কেউ কখনো বড় হয়না,কষ্ট কর মা,নতুন স্কুলে ভর্তিতে অনেক খরচ হয়ে
গেছে, দেখি সামনে কিছু করতে পারি কি না” ।
“বাবা,তুমি সব সময়ে একই কথা বল,তুমি আমাদের একটুও
ভালোবাসো না”আবার অনুযোগের সুরে বাবার দিকে তাকায় তিথী।
মেয়ের কথার উত্তর দিতে পারেন না অসহায় বাবা, তিনি বলতে
পারতেন সীমিত আয়ের কথা, হাড়ভাঙা কষ্টের কথা, বাস্তবতার কথা কিন্তু দারিদ্র্য তার টুটি চেপে ধরে । এই অবুঝ মেয়ে এখনই
এসব বুঝবে না, তার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না । নিজের ছেলে
বেলার কথা মনে পড়ে, নিজের কৃষক বাবার কথা মনে পড়ে,
ছোট বেলায় সাইকেল কিনে দেবার বায়না ধরে যখন বাবার সাথে কথা বলা
বন্ধ করে দিয়েছিলেন বাবার তখনকার মুখটি মনে ভেসে ওঠে । বাবাকে আজ বড় আপন মনে হয় ।
এই কষ্ট বড় চেনা মনে হয় । উত্তরাধিকারের মত নিম্নবিত্তের এই অনুভবও মনে হয় বংশ
পরম্পরায় ফিরে ফিরে আসে ।