গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫

রুখসানা কাজল

কাঙ্গাল কাকু

                    কোন এক ঘন বর্ষায় মার বকুনির হাত থেকে বাঁচতে রেন কোট পরেই আমরা  কাগজের নৌকা জলে ভাসাচ্ছিলাম । বৃষ্টি ভেঙ্গে অসময়ে এলো বাপি। আমরা তো মহাখুশি। বাপি মানেই স্বাধীনতা । মাকে এখন পাত্তা না দিলেও চলবে। রেনুদি চা  করতে উঠছিল। ঝলমলে মুখে মা  উঠতে গেলে বাপি মার হাত ধরে বসিয়ে দেয়, চা পরে খাবো। রেনু তুইও বোস। বাপির গলা ভাঙ্গা ভাঙ্গা , ফাঁকা, না বাজা শঙ্খের মত কেমন নিষ্প্রাণ ,ফাঁপা ,শুন্য শুন্য। নৌকা ভাসান খেলায় হাত ধরে টানতে গিয়ে থমকে দেখি গম্ভীর দুঃখ লেপা বাপির মুখ।
--কাঙ্গাল আজ খ্রীস্টান হয়ে গেল। 

                     ভারী বাতাস কেটে খুব নরম ভেজা সুরে মা নিজেই যেন নিজেকে শুনিয়ে বলল,  বেঁচে গেল ছেলেটা । অন্তত খেতে পরতে ত পারবে। রেনুদি কেঁদে উঠল ককিয়ে , আমাগের ধর্ম আর থাকল না গো কাকা। কি আশ্চর্য ! এই ত সেদিন রেনুদিরাও  খ্রীস্টান হয়ে গেছে । আত্মীয়রা একঘরে করেছে বলে আমাদের বাড়ির পেছনের খালি জায়গায় ঘর তুলে আশ্রয় দিয়েছে বাপি। রবিবার হলেই সাত সকালে গির্জায় ছোটে আর কিছু হলেই ঘন ঘন যীশুর কাছে ক্ষমা চায়। তবে এখন কান্না কেন? আমি বিস্মিত বিপন্ন । 
                       কাঙ্গাল কাকুকে চিনি। খুব খুব গরীব।  জামা নেই, জুতা নেই, ঘর নেই, মা বাবা কেউ নাই। এর বাড়ির ডাব পেড়ে, ড্রেন পরিষ্কার করে খেয়ে না খেয়ে আধমরা হয়ে বেঁচেছিল। কেউ কখনো ডেকে চারটে খেতে দেয়নি। মন্দিরের বারান্দার নীচে পড়ে থাকে। বারান্দায় পা রাখলেই চড় চাপড় খায়। অথচ বাবু, হানিফ, গোপাল, জগাইকাকুরা বারান্দায় ধুম আড্ডা দেয়। কাঙ্গালকাকু ওদের বিড়ি সিগারেট চা এনে দেয়।  
                        কোনো কোনো দিন বড় কালী মন্দিরের বারান্দায় মা মা করে মাথা ঠুকত আর কাঁদত । দাঠাকুর কঞ্চির লাঠি দিয়ে তাড়া করে আসত । বাপি দেখতে পেয়ে খুব বকে দিয়েছিল দাঠাকুরকে । সেই প্রথম বাপিকে চোখ গরম করতে দেখেছি। দাঠাকুর কাঙ্গালকাকুকে মন্দিরে ঠাই দিল ঠিকই কিন্তু সবার শেষে। গেল সরস্বতী পুজোয় হাত ভরে প্রসাদ দিয়েছিল আমরা মুসলিম তা জেনেও। কাঙ্গালকাকুকে দিয়েছিল সবার শেষে। আমাদের ফার্মেসির বারান্দায় প্রসাদ খুলে দেখি আমাদের চেয়ে কত কম ! ভাঙ্গা ভাঙ্গা সন্দেশ বাতাসা, তক্তির টুকরো, অল্প মুড়িমুড়কি, একটি কি দুটো নাড়ু। কেন গো কাকু? সাদা দাঁতে ঝিলিক হাসে কাকু,  আমি যে বেজাত গো মা জননী । বেজাত মানে কি গরীব ? সরু সরু হাত পা, পেট চাপা, ছেঁড়া পোশাক ক্ষয়া ক্ষয়া মানুষরা ? কাঙ্গালকাকু কি তবে আজ জাত পেল ?     
--বুঝলি রেনু, যে খেতে দেয় সেই ঈশ্বর ,আল্লাহ, ভগবান। তুই ত ভালোই জানিস। মা দাঁত কামড়ে হিসহিস করে।
                          যে খেতে দেয় সেই ঈশ্বর আল্লাহ ভগবান ? রেইন কোটের টুপী খুলে পড়ে গেছে। মাথা ভিজে যাচ্ছে অজস্র বৃষ্টিধারায়। ভাল করে রেনুদিকে দেখি। আমাদের তিনবেলা খেতে দেয় রেণুদি। বকেঝকে মাকেও মাঝে মাঝে লটকে  দেয়। বাপি তো আগেই সারেন্ডার করে নেয়। দুজনেই খুব ভালবাসে রেনুদিকে। তবে কি রেনুদি  আল্লাহ ঈশ্বর ভগবান ? ভিজে যাচ্ছি আর খাবি খাচ্ছি বিভ্রান্ত ভাবনায়। মানুষই ঈশ্বর তবে কেন আমরা মাথা ঠুকি মন্দির, মসজিদ গির্জায়? কেন হাত বাড়িয়ে দিই অসীম মহাশূন্যে ?