সন্ন্যাস ভুগোল (৬ষষ্ঠওশেষ পর্ব)
কিছু
কিছু সকাল
পটে আঁকা
ছবির মতো জেগে
ওঠে । আজ তেমনি
একটি দিন। আনন্দমোহন
কলেজে ভর্তি
হয়ে গতকাল নির্মাল্য
ময়মনসিংহ থেকে
ফিরেছে।কয়েকদিন
পর থেকে নির্মাল্যকে
পড়ালেখার জন্য ময়মনসিংহে
থাকতে হবে।ভাইবোন
দের ছেড়ে থাকতে
হবে ভাবলেই
তার কান্না পাচ্ছে
কিন্তু মার
ইচ্ছাপূরণকরতে তাকে
যে ডাক্তার হতে
হবে আর ডাক্তার
হতে গেলে
ভাইবোনদের ছেড়ে বাইরে
পড়তে যেতে
হবেই কিন্তু মার
শেষ কথাটাও
তাকে ভাবায় । এই
শোন।তোর
নাম কি
রে ? নির্মাল্যের ভাবনা
কেটে যায়
কিন্তু কন্ঠটা কোথা
থেকে এলো
বুঝতে না
পেরে সে
এদিক ওদিক তাকায়। এই
ছেলে এদিকে
দেখ। নির্মাল্য তাকায়
দেখে পর্দার
আড়ল থেকে তাকে
ডাকছে কেউ । নির্মাল্য এগিয়ে
যায়। ভেতরে
আয়। নির্মাল্য
ভেতরে ঢোকে। কি
নাম তোর ? নির্মাল্য
দত্ত। তুই
কি নরেন্দ্রবাবুর
ছেলে ? হ্যাঁ। নির্মাল্য কে
বসিয়ে রেখে
ফাতেমা বেগম রান্না
ঘরের দিকে
এগিয়ে গেলেন । এই বাড়ীটা
যে আমীর আলী
খান পাঠানের সেটা
নির্মাল্য জানে
তবে এর আগে
বাড়ীর ভেতর
ঘরে নির্মাল্যের কখনো
আসা হয়নি। পাঠান
চাচার সাথে মাঝেমধ্যে
কথাবার্তা হলেও চাচীকে
এর আগে সে
দেখেনি।চাচী
আজ কেন এভাবে
ডাকলেন তা
বুঝে ওঠার আগেই বাহারী
পিঠা নিয়ে
ফাতেমা বেগম হাজির
হলেন । এভাবে এখানে
দাঁড়িয়ে কি
ভাবছিলি মা
র কথা ? নির্মাল্য
চোখ তুলে ফাতেমা
বেগমকে একপলক দেখলো
পলকেই মাথাটা
নিচু করে ফেললো। ফাতেমা
বেগম নির্মাল্যের কাছে
এগিয়ে গেলেন
মাথায় হাত রেখে
চুলগুলো নাড়িয়ে
দিয়ে বললেন আমায়
মা ডাকবি?আমার
তো কোন ছেলে
নেই তুই
আমাদের ছেলে
হবি ? কি রে ? নির্মাল্যের থুতনি
ধরে মুখটা
তুলতেই ফাতেমা
বেগম দেখলেন নির্মাল্যের
দুচোখ বেয়ে
জল গড়াচ্ছে ।
আমীর
আলী খান
পাঠান বাড়ী
ফিরতেই বড় মেয়ে
নির্মাল্যের বাড়ীর ভেতরে
আসার গল্পটা
তুললো।মেয়ের
সব কথা শুনে
পাঠান সাহেব
যা বুঝলেন তাতে
না হেসে পারলেন
না। বাবা
মেয়ের কথা রান্না ঘরে
মৃদুস্বরে ভেসে
আসছিলো কিন্তু মেয়ের
নীচু গলা
কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছিলো
না । পাঠান সাহেবের হাসি
শুনে ফাতেমা
বিবি বেরিয়ে
এলেন রান্না ঘর
থেকে। -শোনো,শোনো
তোমার মেয়ে
কি বলছে। আম্মাকে
আচমকা দেখে
মেয়ে মুকুল
যেন চুপসে গেলো।সে
গিয়ে দাঁড়ালো
তারবাবার পিছনে । -কী
রে কী বলছিলি
রে তোর আব্বাকে? পাঠান
সাহেব তখনো
হাসচ্ছেন। তুমি
নাকি আজ নির্মাল্যকে
ঘরে ডেকে
এনে ছেলে
বানিয়েছো তোমার মেয়ের
সেটা পছন্দ
হয়নি। কেন
রে ঐ মা
মরা ছেলে
তোর কি
এমন ক্ষতি করেছে
যে তুই তোর
আব্বা আসতেই দরবার
খুলে বসেছিস ? মুকুল
কোন উত্তর
না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে পাশের
ঘরে ছুটে
গেলো।আম্মার আদর
ভালবাসা কমে
যাবার ভয়ে
তার চোখে গড়িয়ে
নামে জল।
অবসর
সময়টা ফাতেমা
বিবি বই পড়ে
নয়ত গান
শুনে কাটান
এটা তার বহুবছরের
অভ্যাস । আজ বইয়ের
পাতায় কিছুতেই মন
বসচ্ছে না
তার। থেকে
থেকেই নির্মাল্যের কথা
মনে হচ্ছে।কি
এক আবেগে যে
মা মরা ছেলেটা
কে হঠাত্ ছেলে
হতে বলেছে । ছেলেটা
কি কিছু মনে
করলো ? তাছাড়া সমাজ
কি দুই ধর্মের
এই সম্পর্ককে
মানবে? ফাতেমা খান
পাঠানের মনে
যদিও কুসংস্কার বা
ধর্মান্ধতার কোন জায়গা
নেই তাই
বলে এমনটি
ভাব্বার ও কারণ
নেই যে
তিনি ধর্মাচার
করেন না!পাঁচ
ওয়াক্ত নামাজ
রোজ সহ
যতটুকুসম্ভব প্রায়
সব ধর্মাচার
তিনি পালন করেন। কয়দিন
ধরেই পাঠান
সাহেব খেয়াল করছেন
ফাতেমা বিবি
কেমন জানি উদাস।সব
কিছু করছে
কিন্তু কোথাও যেন
ফাতেমা বিবি
নেই । জিজ্ঞাসা করতে
চেয়েও পাঠান
সাহেব চুপ করে
যান । বাড়ী থেকে
বেরিয়ে দত্তবাবুর
গদির দিকে হাঁটতে
থাকেন ।
পত্রিকা
নিয়ে মধুবাবা
বসে আছেন
দাওয়ায় । ফাল্গুনের মাঝামাঝি
চলে গেছে
বাতাসে এখন
উষ্ণতা জুড়ে
যাচ্ছে একটু
একটু করে।দূরের
পলাশ,শিমূল গাছগুলো
ফুলে ছেয়ে
আছে । শেষ পাতার
নীচে এক
কলামের একটি
শিরোনাম 'আজ বিশ্ব
নারী মুক্তি আন্দোলনের
সেই আগুনঝরা
দিনগুলো 'শিরোনামটিতে চোখ
বুলিয়ে মধুবাবা
আশ্রম থেকে
স্পষ্ট দেখতে
পাওয়া কৃষ্ণচূড়া
গাছটির দিকে
তাকালেন । পাতাহীন শুকনো
মনে হওয়া
সতেজ ডাল
নিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকা গাছটি
মাস খানিক
পড়েই সবুজে
জেগে উঠবে
তারপর থোকা
থোকা লালে । তখন
তার কত
কদর কত
জন মুগ্ধ হবে
কেউ ফুল
সমেত ডাল
ভাঙবে কেউ
গাছের নীচে
ছায়া চুরি
করে নিয়ে
বাঁশি বাজাবে
আর আজ কেউ
তাকে ফিরেও
দেখেনা । নিজের অজান্তে
একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলেন মধুবাবা । এই
দীর্ঘশ্বাস কি
কৃষ্ণচূড়ার নাকি
নারীর ? পত্রিকাটি ভাঁজ
করতে করতে
মধুবাবা ঘরে
ঢুকেন । এই বই
সেই বই
ঘেঁটে একটা
জীর্ণ মলাটের
বই হাতে অবোধ
শিশুর মতো
হাসতে হাসতে
যেখানে বসে
পত্রিকা পড়ছিলেন
সেখানে ফিরে
এসে বসেন ।
বইটি
চোখের সামনে
মেলে ধরতেই
চোখের তারায়
ভেসে উঠে
বড় বড় অক্ষরে
লেখা 'দেবদাসী'।মধুবাবা
পড়তে থাকেন
- 'নারী
ইতিহাসের অন্যতম
ঘৃণ্য ও
শোষিত শ্রেণীর
নাম দেবদাসী ! বৌদ্ধধর্মের
প্রভাব কমে
হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের
প্রসারের সঙ্গে
সঙ্গে এই
কুপ্রথা ভারতের
মন্দিরে মন্দিরে
ছড়িয়ে পড়ে,বিশেষ
করে বৌদ্ধমন্দিরগুলোতে,যেগুলো
এখন হিন্দুদের
পবিত্র পীঠস্থান
যেমন পুরীর
জগন্নাথদেবের মন্দির,তিরুপতির
বালাজী মন্দির
সহ আরো অনেক।দেবতার
পরিচারিকা এইসব
দেবদাসীদের এক
এক স্থানে এক
এক নাম ভারতীয়
শাস্ত্রীয় নৃত্যের
যেমন ! কেরলে দেবদাসীরা
মাহারি নামে
পরিচিত যেমন
ভারতী শাস্ত্রীয়
নৃত্যের অধিকাংশ
ফর্ম দক্ষিণ
ভারত থেকে
এসে পরিচিত
হয়েছে ভরতনাট্যম,কুচিপুড়ি,কথাকলি
নামে।তেমনি
তামিলনাড়ুতে দেবদাসীরা
পরিচিত তেবর্দিয়ার
নামে অন্ধ্রে
যোগিন,কর্ণাটকে যোগাতি
বা বাসবী । মহারাষ্ট্রে
মূরলী, যোগাতিন বা
আরাধনী, গোয়ায় ভবানী,পশ্চিম
উপকূলে কুড়িকার ।
বাসবী
শব্দটা এসেছে
বাসব থেকে,আর বাসব
মানে খোলা
ষাঁড় আর
বাসবী তার নারী
প্রতিমূর্তি!দেবদাসী
কখন সৃষ্টি হলো
তার ইতিহাস খুঁজতে
গিয়ে কেউ
কেউযুক্তি দেখিয়েছেন,হরপ্পায়
হাত ভর্তি গয়নাওলা
নৃত্যরতা নারীমূর্তি
যখন পাওয়া গেছে
ঐসময় নিশ্চয় দেবদাসী
প্রথা ছিল
কিন্তু ইতিহাস
এই তথ্য কে
সমর্থন করে না
কেননা মহেঞ্জোদরো
হরপ্পায় কোন মন্দির
বা একত্রে উপাসনা
করার কোন জায়গাই
পাওয়া যায়নি । বৈদিকযুগে
যৌনতা আজকের
দিনের মত ছিল
না,অগ্নিসাক্ষী করে
বিয়ের রীতিটি হয়ত
এই যুগে আগুনের সামনে
মিলনের প্রথা
থেকেই এসেছে । তখন
সম্ভবতঃ গণিকাবৃত্তির
প্রয়োজন ছিল না,সুতরাং
দেবদাসী প্রথা
এসেছে আরো
পরে। ঋগ্বেদে
অবিবাহিতার সন্তানের প্রসঙ্গ
থাকলেও মন্দিরে
পতিতাবৃত্তির কোন তথ্য
পাওয়া যায়
না! বৌদ্ধ
আমলে গণিকাশ্রেষ্ঠা
আম্রপালীরবিবরণ পাওয়া
যায়,কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে
গণিকাধ্যার কথা আছে,কিন্তু
দেবদাসী তুল্য
কোন কথা নেই । আল
বিরুনীর লেখা পড়তে
গেলে একটা
অন্যরকম দিকপাওয়া
যায় তিনি লিখেছেন,মন্দিরে
পুরোহিতরা এমনিতে
মেয়েদের নাচ গান
হয়ত পছন্দ
করতেন না । কিন্তু রাজারা এই
প্রথাকে ব্যবহার
করত উপঢৌকন হিসাবে । প্রথমত পুরোহিতরা
এই দেবদাসীদের
নিজেদের ব্যবহারে লাগাতে
পারবে যেমন খুশি,রাজা
এই ব্যাপারে
কোন নালিশ শুনবেন
না । দুই,এর ফলে
মন্দিরে পুজো
দিতে প্রজাদের একটা
অন্য আকর্ষণ আসবে । তারা
যা প্রণামী ফেলবে
তার একটা অংশ
রাজার । আর
এসব না পেলে
রাজ্যটা চলবে
কী করে? সামরিক
খরচ তো
দরকার ! আল বিরুনী
ঠিকই বুঝেছিলেন ।
দেবদাসীরা
শুধু নর্তকীই
রইল না,সবরকমের মনোরঞ্জনের
কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল।ভগবানের উদ্দেশ্যে
সমর্পিতা এইঅজুহাতে
রাজা তার
অনুগত রাজন্যবর্গ
ও মন্দিরের পুরোহিতকুলের ভোগ্যবস্তুতে
পরিনত হলো
দেবদাসী । ধর্মের নামে
এই ভোগে পিছিয়ে
নেই কেউই!মুসলমানদের
দরগাতেও অচ্ছুতি রূপে
দেবদাসীর মত
বিবি র উদয়
হল । যাদের কোরাণের সাথে
বিয়ে দিয়ে
বিবি করে
দেওয়া হয়, তার পরে
শুরু হয়ে
যায় তার
ওপর যৌনশোষণ । এই
বিবিদের নিয়ে
খোলা হত পতিতাপল্লী । মোঘল
আমলের এই বিবি
প্রথার ঘটা বেশি
দেখতে পাওয়া
যায় । আবুল ফজলের
আইন ইআকবরীতে
আছে, মাত্রারিক্ত সংখ্যায় বিবি
তৈরীর প্রচলন আটকাতে
দারোগা নিয়োগের
প্রয়োজন হত পতিতাপল্লীতে
যাকে বলা
হত শয়তানপুরী । জাহাঙ্গীর
ও শাহজাহানের আমলে
বিবি প্রথা
ও শয়তানপুরী
খুব বেড়ে যায় । মোগল সম্রাটরূপে
সবচেয়ে হীন বাদশা
ঔরঙ্গজেবকে বলা
হলেও ধর্মপরায়ণ এই
সম্রাটই হিন্দু
মন্দির ধ্বংসের পাশাপাশি
গণিকাবৃত্তি মোচনের ওপরেও
জোর দিয়েছিলেন ।