আমি বললাম, গোরস্থানকে আমার ভয় করে বাবলু । এক পাশে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মাখনরঙা ফেনা আর অন্যপাশে শান্ত-স্বচ্ছ জলে জলপিপিদের নিঃশব্দ সাঁতারের এই যে সড়ক অথবা সড়কে দাঁড়িয়ে উত্তরে পুরো দৃষ্টিজুড়ে জল আর জল, বড় বড় ঢেউ শানানো তলোয়ারের বুকের মত ঝলকে ঝলকে নামছে উঠছে আর দক্ষিণে তোমাদের উপজেলা শহর, যেখান থেকে আমরা সড়কের এই মাথায় নামলাম, অন্য মাথায় গ্রাম আর এর আগেই তো তোমাদের এজমালি গোরস্থান। তোমার মুখে এই সব শুনতে শুনতে আমার তো আর চিনতে কষ্ট হয় না। দুপাশের বিশাল জলরাশির মাঝে এই সড়কটা সত্যি একরত্তি সবুজ সিঁথি। কদিন পরেই সড়কটা জলে ডুব দিলে ট্রলার তোমাদের ঘাটে যাবে, এ কথাও বলেছ। তুমি বললে, দুর, কি যে বল না। গোরস্থানকে কিসের ভয়? বললাম, ওখানে ভূত থাকে। তুমি হাসলে ঠাঠা। একটু কি লজ্জা পেলাম?ট্রলিব্যাগের হাতলটা বের করে সাবধানে টানতে টানতে তুমি হাঁটতে লাগলে আর আমি জল থেকে ফেরাতে পারি না চোখ। এখানে, এই জলঘেরা সড়কে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, দূরে আরো দূরে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসছে ফেনা। কোথাও কোন বসতি নেই, গাছগাছালি নেই। আমার মুগ্ধতা কাটে না, এই বুঝি হাওর? তুমি বললে, হ্যাঁ, এখন তো হাওর। কদিন পর জল নেমে গেলে এসব হয়ে যাবে ধানখেত। এই অথৈ সমুদ্রজলের চিহ্নও থাকবে না।
বললাম, তবে এত জল যায় কোথায়? তুমি আবার হাসলে।
আমি দূরে
আঙুল তাক করলাম, ঐ দেখ, কী সুন্দর একটা লঞ্চ! তুমি সবজান্তা, এটি মধ্যনগরের লঞ্চ। ভৈরব থেকে ছেড়ে এসেছে। পৌঁছতে
পৌঁছতে সকাল হয়ে যাবে। দুহাতে
তোমার বাহু চেপে বায়না করলাম, আমরা একদিন এই লঞ্চে উঠব। তুমি
হেসেই উত্তর দিলে, আচ্ছা উঠো। আমি
বললাম আর তুমি সাথে সাথে কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলে, এটি তোমার অভ্যাস, এই কারণেই মনে হলো আবার তোমার প্রেমে পড়লাম কিন্তু এই নির্জন সড়কে এর স্বীকারোক্তিটা আমি করব না। তার চেয়ে বরং তোমাদের গ্রামটা যে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এর কথা বলাই ভাল। এই প্রথম তোমার গ্রামে যাচ্ছি বলে, আমার ভেতরে যে উচ্ছ্বাস তা তোমাদের এই প্রায়ডুবন্ত সড়কের কামড়ে থাকা ফেনা, জলপিপিদের জলজ সংসার আর মধ্যনগরের লঞ্চ দেখেই দমে গেছে মনে করো না বরং আমি এই ভেবে বিস্মিত যে তুমি আমাকে যা যা বলেছ, আমার চোখে নানা সময় কল্পনায় যেসব ছবি তুলে ধরেছ সেসবের এমন হুবুহু মিল কী ভাবে হলো।
মনে আছে,
একবার ক্যাম্পাসের ঘাসে বসে চিত্রকল্প বানাতে বলেছিলাম? একটা খাতায় আমাদের শব্দবাক্য খেলাটা অনেক খেলেছি। আমি
লিখেছিলাম, সিঁথি। তুমি
এর পাশে লিখলে, দুপাশে ঢেউ খেলানো জলে তুলির সবুজ টান। এরপর, জল। তুমি এরপর লিখলে, ছলকে ওঠা ঢেউয়ের তোড়ে গর্ভবতী পাল। পাল কিন্তু আমি দেখলাম না। দেখলাম, বাতাসে পোড়া পেট্রলের ঘ্রাণ ওড়ানো ঘটঘটাঘট ট্রলার আর মধ্যনগরের একাকী আসমানী-সাদা লঞ্চ। অবশ্য জলের এই মাতমই আমাকে এমন মুগ্ধ করেছে, মনে হচ্ছে এখানে, এই জলের ওপর একটি ঘর এখুনি বানিয়ে ফেলি। একটা জলপিপি কি আমি হতে পারি না! অথবা উন্মত্ত
জল চষে বেড়ানো একটা এমন পর্যটক ঢেউ? তুমি আমার হাতে একটা চাপ দিলে। এ স্পর্শটা বড় চেনা। ব্যস্ত পথে হাঁটতে হাঁটতে তুমি এমন চাপ দাও। এর অর্থ, আমাকে
থামতে হবে। আমি তোমার স্পর্শ মত থামলাম।
তুমি বললে, এই আমাদের গোরস্থান।
খুব ঘন হয়ে
তোমার পাশে দাঁড়াতে গিয়ে খেয়াল করলাম, গ্রামের খুব কাছাকাছি আমরা ভিড়ে গেছি। গাছপালা আর বাড়িঘরের ফাঁক দিয়ে আমাদের দিকে কিছু মানুষ তাকিয়ে আছে। একটু দুরত্ব রেখে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে অনুসরণ করে গোরস্থানের দিকে তাকালাম। দেখলাম, ভয়ের তো কিছু নেই, জলবেষ্টিত ছোট্ট দ্বীপ এই গোরস্থান যেন সবুজ তাজা ঘাসের একটি টুপি পরে আছে। কেবল ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিশাল জামগাছ এর একলা পাহারাদার। একটা শালিক এর ডালবদল করে ডেকে উঠলো
। তুমি
আমাকে সতর্ক করলে, পিঁপড়া আছে দেখো। সঙ্গে সঙ্গে পায়ে আমি পিঁপড়ার শক্ত কামড় অনুভব করলাম। কালো পিঁপড়া কামড় দিয়ে আঙুলের ফাঁকে লেগে আছে। মাটিতে পা ঝারতে শব্দ করতেই তুমি বললে, আস্তে। পিঁপড়ার অবস্থান দেখে তুমি আমাকে একটু সরিয়ে এনে গোরস্থানের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে। আমি আরেকটি শালিক খুঁজছি। এক শালিকে আমার দীর্ঘদিনের অস্বস্তি। তোমার সাথে পরিচয়ের পর থেকে অন্য শালিক না দেখে ‘এক শালিকে’ আমি স্থানত্যাগ করি না। এই সড়কের পাশে দ্বীপসদৃশ গোরস্থানের একাকী পাহারাদার জামগাছের ডালে একলা শালিক আমাকে তাই ভীষণ অস্থিরতায় টানে। তন্নতন্ন করে পুরো গাছটি আমি নিরীক্ষণ করতে থাকি, এই বুঝি অন্য শালিকটি আরেকটি ডালে এসে বসলো...তুমি বললে, এই গোরস্থানের গর্তে আমি বেড়ে উঠেছি।
আমি তোমার
থেকে এক পা সরে
এসে ভয় আর বিস্ময়ে ত্বরিত প্রশ্ন করি, কী..? তুমি খুবই
সহজ ভাবে হাসিমুখে বললে, ভয় পেও না। শুধু আমি না, আমার চাচাত বোন সোহানা, যে এই জলের স্রোতে একদিন ভেসে গিয়েছিল, তারও বেড়ে ওঠা এই গোরস্থানেই। আমি শক্ত করে তোমার হাত চেপে ধরলাম। তুমি থামছ না, আমার মা আর চাচী, তারা এই গোরস্থানের গর্তে লুকিয়ে থেকে সারাদিন পার করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতো। যুদ্ধের শেষের মাসগুলোয় আম্মা আর চাচী.. আমি তোমাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, থাক থাক, মাগ্গো, কী অবিশ্বাস্য
! এই হলে
তুমি। কোনও ডরভয়
যাকে কখনোই ছোঁয় না ।
২.
বুঝি না,
তুমি এত নির্ভয়
কী ভাবে থাক। পিছনে দাঁড়িয়ে আছি বলে তোমার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু ওই মুখের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছা করেই আরেকটু যেন অবাক হতে চাই, আরেকটু বিস্ময়ের আতর আমি শুঁকতে চাই, এই জলময় হাওরাঞ্চলের আলোছায়ায় বড় হয়ে তুমি কী ভাবে আমাদের সবাইকে পেছনে ফেলে প্রথম হয়ে গেলে! তোমার ব্যাপারে আমাদের অনুমানটা ছিল মূলতঃ দ্বিধার। তুমি একই সাথে পড়ে থাকা শামুকের কঙ্কালের মত স্থির আবার হেসে উঠলে হয়ে ওঠো কড়ই গাছের একটি হাওয়া তাড়ানো ডাল। কড়ই গাছটা? হ্যাঁ, তোমার দিকে আমার মনযোগের
প্রথম দিনের
সাক্ষী কড়ই গাছটা তার পাতা দিয়ে তো আমাদের ক্লাশরুমের যে দিকটায়
তোমরা বসতে, বাতাস এলে এর পাশের জানালার ধুলো ঝেড়ে দিত
রোজই । আমি
তাকিয়ে থাকতাম । বন্ধুরা
পিঠে ঠেলা দিলে তড়িঘড়ি বলতাম, গাছটা কত উপরে উঠে গেছে দেখ....! তখনও আমার মনের ভাষা বোঝেনি কেউ কিংবা কিছু বলার তাড়ণায় যতটা অস্থির হয়ে ওঠা দরকার ততটা হইনি কিন্তু তোমার প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশের তীব্র ব্যাকুলতাটুকু থাকত যা তোমাকে বোঝাতে পারতাম না আর তুমিও শামুক একটা, কিছুতেই তাকাতে না। স্যারদের লেকচার এমন ভাবে মগজে রেকর্ড করতে যেন একটি ফ্রেমও ভুলবশতঃ কাটা না পড়ে। মনে
মনে কত যে বকেছি তোমাকে, আরে বুদ্ধু, এত বুঝে তুই করবিটা কী? বাংলাদেশ ব্যাংক চালাবি? একদিন কেউ একজন বলল, দেখদেখ, কড়ই গাছে একটা শালিক। ওরা
শালিক দেখুক তাতে আমার আপত্তি থাকার কথা নয় কিন্তু যে শালিক দেখতে তোমাদের জানালায় তাকাতে হয়, যে জানালায় তাকাতে তোমার মুখের দিকে অবধারিত চোখ চলে যায়, সে শালিক ওরা বারবার দেখুক এ আমি চাইব কেন ! বললাম,
ধুর, এটা কোন বিষয় হলো? একটা পাখি দেখালি তাও আবার শালিক, হুহ।
ইউনিভার্সিটিতে আরেকবার
আমার জেদ হলো । বছরের
মাঝখানে এক ম্যাডাম এলেন ক্লাশ নিতে। তিনি কি শুধুই ম্যাডাম ছিলেন? সদ্য বিবাহিতা রোবানা ম্যাডাম, কি আর বলব, তোমার নিশ্চয় মনে আছে, আরো মনে থাকার কথা তার আগুনমাখা রূপের কথা যা আমাদের ক্লাশটাকে একটি পরীস্থান বানিয়ে রাখতো। ছেলেরা তো মহাখুশি, ম্যাডামের দয়ায় ওরা মার্কস বেশি পাবে। খুশি আমরাও হয়েছিলাম কিন্তু তুমি বুদ্ধুর চিন্তায় আমার ঘুম যে পালাল, সে খেয়াল তো তোমার নেই। ম্যাডাম প্রতিদিন যথাসময় ক্লাশে আসতেন আর তুমি,
নির্লজ্জ বুদ্ধু তাঁর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে, তাকিয়েই থাকতে। আরে পাগল, তোর তো ম্যাডাম লাগে, নাকি ?
এই ভাবে
আমার দিন কোনও মতে কেটে গেলেও রাতগুলো ক্রমেই হতে থাকলো দীর্ঘ। এত দীর্ঘ যে, ক্লাশ শেষ করতে মন চাইত না। মনে হতো, রাতেও ক্লাশ হলে ভাল হয় কিন্তু হায়, তার তো আর সুযোগ নেই। যা হোক, রোবানা ম্যাডাম একদিন কী এক থিসিস করতে জার্মানী চলে গেলেন । আমার
স্বস্তি তবু এলো না । কালো
বোর্ড আর এর সামনে পায়চারি রত টিচারদের থেকে তোমার দৃষ্টি সরানো যায় না । এভাবেই
তুমি টানা দুবছর প্রথম হয়ে সবাইকে হতবাক করে দিলে ।
তোমার চেহারায়
বা স্বাস্থ্যে আকর্ষণ করার তেমন আহামরি কিছুই
নেই কিন্তু আমি নিবিড় ভাবে
লক্ষ করলাম, এত দিনে তোমার পোশাক, কথা বলার ধরণ, চলাফেরা আমূল পাল্টে ফেলেছ তুমি । ক্লাশের
বাইরে একটাই তোমার গন্তব্য, অবধারিত উপাসনালয়, লাইব্রেরি । ক্লাশশেষে তুমি ওখানে অসংখ্য বই এলোমেলো করে বুঁদ হয়ে থাক। কত কথা মনে পড়ে......।
একবার ফুটবল
খেলায় তুমি দারুণ খেললে। আমরা দল বেঁধে গেলাম দেখতে। শর্ট প্যান্টের বাইরে তোমার খোলা পা দেখে আমার কী যে শরম লাগে। তোমাদের পা এত সুন্দর হয়! তোমার
গোলে আমরা জিতে গেলে তোমার হঠাৎ কী হলো, গোলের আনন্দে তুমি, এই আলাভোলা বাবলু জার্সি খুলে শুন্যে ঘুরাতে ঘুরাতে মাঠে দিলে দৌড় আর তখনই তোমাকে প্রথম খালি গায়ে দেখি। শার্টের
নিচে যে শরীর বাস করে তার এমন মজবুত গাঁথুনি আমাকে, আজ স্বীকার করছি, সত্যিই প্রচণ্ড লোভী করে তোলে। আর তোমার দুয়েকটা পশমের বুক, যে বুকে আমার, আমার ভালবাসার, আমার প্রেমের, আমার আকাঙ্খার প্রথম স্পর্শ লেগেছে, কী যে অস্থির করে তুললো আমায়। এরপর থেকে আমার আর কিছুই স্বাভাবিক চলল না। পড়ার টেবিলে বসি, মনে হয় ছোটবেলার পুতুল আমাকে ডাকে। তুমুল আকর্ষণে দুহাতে বিষণ্নতা ঠেলে পুতুলের মুখ মনে করার চেষ্টা করি; কি আশ্চর্য! তোমার সেই মুখ ভেসে ওঠে। তোমার মুখ একটা স্বচ্ছ আয়নায় এমন ভাসান দেয়, আমার নড়নচড়ন দেয় একেবারে থামিয়ে। স্নানগরে স্নানে যাই। তোমার উদ্দাম বুকের কথা ভেবে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি আর কেঁপে উঠি, কি লজ্জা! আমি যত্নহাতে প্রসাধন নিই আর তোমাকে অকারণ ঈর্ষা করি, হেহ, কি আমার রূপকুমার গো, তোর বুকে তো পশমই নেই। তুই কী বুঝবি শয়তান ? তোর
জন্য ব্ল্যাকবোর্ডটাই সই। কি হাস্যকর, তাই না? লাইব্রেরির ছড়ানো বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকা তোমার সম্বন্ধে কতটা জানলাম আমরা ? অথচ সেই তুমি, যে আমাদের ফার্স্টবয়, যাকে তিনটা বছর ডিটেকটিভের মত আমি অনুসরণ করছি, সেই বাবলু, এক আগমনী সন্ধ্যায় সাগরকূলের খোলা বাতাস আর নরম সূর্যালোকে একবার আমাকে দেখলে আর আমার সমস্ত পৃথিবীটাকে নাড়িয়ে দিয়ে, এতদিনের প্রতীক্ষাকে গভীর সুখে ভাসিয়ে দিয়ে সেই প্রস্তাবটা করলে!
ঘটনাটা মনে কর বাবলু।
ঘটনাটা মনে কর বাবলু।
সেবার সবাই
মিলে ট্যুরে গেলাম সাগর দেখতে। সবাই যেখানে আনন্দে লাফাচ্ছে ঝাঁপাচ্ছে সেখানে তুমি কিনা দূরে ক্যানভাঁস নিয়ে বসে পড়লে! এই বুদ্ধু কি ছবিও আঁকে নাকি? আমি সেদিন জীবনের সেরা সুযোগটা নিলাম। ধীর পায়ে তোমার কাছে গিয়ে বললাম, আমার একটা ছবি আঁকবে? তুমি মাথা তুলে একটু হাসলে। আমার উদ্দেশে এই তোমার প্রথম হাসি। বললে, তাহলে এখানটায় বসো। আমি তোমার মুখোমুখি বসলাম, কোনও রকম দ্বিধা বা জড়তা না নিয়েই। তুমি একবার আমাকে দেখ আরেকবার আঁকবে কি আঁকবে না, শুন্যে পেন্সিল নাড়িয়ে কিছু বুঝতে পারছ কি পারছ না করতে করতে এক সময় আঁকতে শুরু করলে। আমি বসেই আছি, বসেই আছি, বসেই আছি। তোমার আঁকা আর শেষ হয় না। আর আমিও তোমার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাই, কালো বোর্ডটায় কীভাবে অপলক চেয়ে থাক, কীভাবে দেখ। তোমার দৃষ্টির গভীরে আমি যেতে চাই তা যত সময়ই লাগুক, এখানে আমার ক্লান্তি নেই, নেই তাড়াও। এমন সময় সম্ভবতঃ বাতাস একটু জোরে বইছিল, আমার মুখে বারবার এসে পড়ছিল অবাধ্য চুল, সমুদ্র চলে এলো আরো কাছে, তোমার পেছনে পশ্চিমাকাশ হয়ে গেল লাল, আমার চোখকে সে লাল কীভাবে স্পর্শ করেছিল জানি না কিন্তু তুমি এসব কিছুকে স্তব্ধ করে দিয়ে, আমার সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরিয়ে বললে, সুফি, তুমি আমায় বিয়ে করবে ? তোমার সেই
আহ্বান তো আমিই শুনেছি কিন্তু ওরা, আমার বন্ধুরা সবাই ভেজা লেপ্টানো কাপড়ে এসে আমাদের ঘেরাও দিয়ে দিল কেন! কিছু একটা মনে হয় রটেই গেল। দেখলাম, পশ্চিমের লাল ক্রমশঃ ডুবে যাচ্ছে জলে, আর সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়ছে লালাভ রঙধনু। ওরা হাত সোজা করে সূর্যহাতে দ্রুত ছবি তুলছে, তুললো আমাদেরও। যে সূর্যদেব সেদিন ডুবেছিলেন, তুমি বা আমি আমরা কখনোই কি ভেবেছিলাম, পরদিন হতে তিনি আমাদের রোজ এক সাথে আলো দেবেন, বৃক্ষতলে ছায়া দেবেন, আমাদের চিরদিনের আনন্দহাসির সাথী হবেন? বাবলু, শুনতে পাচ্ছ তুমি, বাবলু ?
৩.
একদিন তুমি
কীভাবে কীভাবে আমাদের বাসায় চলে এলে। পরীক্ষা শেষে
একলা বাসায় বিষণ্ন মনে দিন কাটছিল বলে বিনা চাওয়ায় তোমাকে দেখে আমার খুশিই হওয়ার কথা কিন্তু তার বদলে আমার বাসায় তোমাকে আকস্মিক আবিষ্কারে আমি থ বনে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচে তাকিয়ে দেখি, তুমি আর বাবা মুখোমুখি কথা বলছ। আমার কেন বিশ্বাস হবে বল, আমাদের এই প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ির বিদেশ থেকে আনা ঝাড়বাতি, এয়ারকুলারের ঠান্ডা
কিংবা বাথটাবে উষ্ণ জলের খবর তো তোমাকে কখেনোই দেয়া হয়নি। আমি যে বলিনি তার কারণটা সম্ভবত আমি চাইনি, আমার বাবার অর্জন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তোমাকে ঘাবড়ে দিক।
বাবাকে কী বলে মুগ্ধ করেছ জানি না। বাবার ডাকে আমি নাশতা নিয়ে নতমস্তকে নিচে যাই। যদিও তোমাকে দেখে আমি মুহূর্তে পাখির পালকের মত নির্ভার হয়েছি তবু মনে মনে তোমাকে বকব কিনা ভাবছিলাম, আমাকে না জানিয়ে আসার দরকারটা কী ছিল বীরপুরুষ ? বাবা রেগে গেলে যে আমিই দৌড়ে পালাই আর তুমি তো স্যান্ডেলও পরার সুযোগ পাবে না, বুদ্ধু কোথাকার ?
বাবাকে কী বলে মুগ্ধ করেছ জানি না। বাবার ডাকে আমি নাশতা নিয়ে নতমস্তকে নিচে যাই। যদিও তোমাকে দেখে আমি মুহূর্তে পাখির পালকের মত নির্ভার হয়েছি তবু মনে মনে তোমাকে বকব কিনা ভাবছিলাম, আমাকে না জানিয়ে আসার দরকারটা কী ছিল বীরপুরুষ ? বাবা রেগে গেলে যে আমিই দৌড়ে পালাই আর তুমি তো স্যান্ডেলও পরার সুযোগ পাবে না, বুদ্ধু কোথাকার ?
বাবা বললেন,
জান, বাবলু, সাহসীদের আমি পছন্দ করি। কিন্তু আফসোস, জীবনে একটিবার মাত্র সাহস দেখাবার সুযোগ পেয়েছিলাম, পারি নি । বাবা
যেহেতু এ প্রসঙ্গটি টেনে এনেছেন তখন বুঝতে পারি, বাবার কাছে তোমাকে নিয়ে ভয় করার আর কোন কারণ নেই । আমি
জানি এরপর বাবা কী বলবেন । যে আক্ষেপের কথা আমি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি তা তোমাকেও শুনতে হবে । তিনি
বললেন, কেন যে পারিনি সেটা ভাবলেই এখন নিজেকে এত তুচ্ছ লাগে । তুমি
জিভ দিয়ে ঠোঁটের চা চেটে খুবই সহজ ভাবে বললে, আমাকে কি বলা যায় ?
অবশ্যই বলা যায়, বলে বাবা বলেই ফেললেন, বড় লজ্জা বুঝেছ বাবলু, বড় লজ্জা ।
অবশ্যই বলা যায়, বলে বাবা বলেই ফেললেন, বড় লজ্জা বুঝেছ বাবলু, বড় লজ্জা ।
তখন আমার
পাট আর ধানের ব্যবসা । সুনামগঞ্জ থেকে কিনেছি তিন নৌকা ধান আর ময়মনসিংহ থেকে এক চালান পাট। ঘরের প্রতিও বিরাট টান। বন্ধুরা সবাই ইান্ডয়া চলে গেল। আমি পারলাম না। সত্যি, মৃত্যুকে খুব ভয় পেতাম। তুমি
বললে, অসুবিধা কী, আপনার বন্ধুরা আপনার প্রতিনিধিত্ব করেছে । বাবা
উত্তর দিলেন, তা বলেছ ঠিক কিন্তু দেশের সংকটে নিজেকে ব্যবহার না করা যে পাপ । যতদিনে
বুঝলাম ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, বলে বাবা থামলেন । আমি
জানি, বাবা এখন একটু কান্না দেবেন । কিন্তু
কেন জানি আজ কাঁদলেন না বরং বললেন, তবে যেহেতু আজ তোমাকে পেয়েছি, এখন আমার মনে শান্তি ফিরে আসবে। আমি খুবই খুশি হয়েছি, আমার মেয়ে একটি রত্ন পছন্দ করেছে। আমি কি আর তোমাদের সামনে থাকতে
পারি ?
অচেনা উত্তেজনায় সোফা ছেড়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে শুনি, বাবা বলছেন, তোমার আম্মাকে খবর পাঠাও । উনার
আপত্তি না থাকলে..... তোমার বাবা যে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা, কখন বললে বাবাকে? আর কী কী বলেছ জানি না কিন্তু এটুকু বুঝতে পেরেছি, বাবাকে এমন নির্ভার হতে আমি দেখিনি। তোমার সাথে বিয়ে না হলে আমি শক্ত হব ভেবেছিলাম কিন্তু এত সহজে বিনা রক্তপাতে আর আমাদের ভাবনা থেকেও দ্রুত সবকিছু হয়ে যাবে তা কি তুমি ভেবেছিলে বাবলু? বল না প্রিয় আমার ?
৪.
প্রথম পরীক্ষাতেই মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে গেলে তুমি । রোজ
নিয়ম করে অফিস করা, বাসায় ফিরে
আসায় যতি পড়েনি কোনদিন । আজ এই জোছনাভাসা রাতে একশ চার জ্বরের ঘোরে তুমি যে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছো, শিশুর মত কন্ঠে অসহায়ত্ব নিয়ে কোঁকাচ্ছ, তার একটা ব্যাখ্যা দিতে পারতাম যদি বেয়াড়া বৃষ্টি তোমায় ঘায়েল করতো, যদি বিষাক্ত ধুলো তোমার সর্দি আনতো । কিন্তু
আমি তো জানি এসবে কাহিল হবার লোক তুমি নও । যদি
ব্যথা পেতে, দূর্ঘটনায় পড়তে তবু মনকে বোঝাতে পারতাম যে কিছু একটা কারণে, যা মানুষের কাম্য নয়, তবু হয়েছে । জ্বর
এমন কোন ভীতিকর অসুখও নয় তবু তোমার মুখ দেখে ফাঁকে ফাঁকে যখন তুমি একটুআধটু কথা বলছো তখন বুঝতে পারি, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছে যা তুমি বলছ না বা বলতে পারছ না।
কিন্তু আমি
তো আর পারছি না বাবলু। তুমি তো জান, যতক্ষণ তুমি বাসায় থাক একটা মুহুর্ত আমরা আড়াল হই না, পরস্পরে একটা ইঞ্চি দূরত্ব আমরা রাখি না। আর তুমিও কখনো একটা দিনের জন্যও কি শীত কি গ্রীষ্ম আমাকে নিজের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছ, আমাকে এমন ভালবেসেছ, এমন হাসিখুশি থেকেছ যে দুদিনের জ্বর যতটা তোমাকে কাহিল করেছে সেই ব্যাধিটা আমাকেও না ধরলে, তোমার বেদনা আমাকেও ভোগ করার সুযোগ না দিলে আমার যে আর চলছে না। একেকটা
ঘণ্টা যায় আর স্মৃতি হাতড়াই। তোমার সাথে পরিচয়ের পর থেকে আমার পৃথিবীটা হয়ে উঠেছে শতভাগ সুখময়। এত সুখ, এত আনন্দ, স্পষ্ট করে বললে, নিবিষ্ট পাঠক বাবলু যখন আমাকে পাঠ করে, একনিষ্ঠ ভাবুক আমার স্বামী যখন আমার দিকে দৃষ্টি দেয়, বাবলু প্রিয় আমার, যখন তুমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাও, প্রতিটি অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে সশব্দ পাঠ কর আর আমি সুখের স্রোতস্বিনীতে ভেসে বেড়াই, এ এমন এক সুখ মনে হয়, মানবজন্ম না হলে মরেই যেতাম। তোমার প্রতিটি ডাকে ভেতরে আমার যে সঙ্গীত বেজে ওঠে, তোমার প্রতিটি আলিঙ্গন যেভাবে আমাকে মন্ত্রের মত চালিত করে, আমি বুঝতে পারি তোমার একাকী অসুস্থ মুখ বা তার কালো ছায়া আমাকে ক্রমশঃ অবশ করে দিচ্ছে। এভাবে আর কদিন গেলে বলে রাখলাম, আমি কিন্তু সত্যি মরে যাব বাবলু।
বিয়ের পর বাবা
তোমাকে কত কিছু
বললেন, দিতে চাইলেন।
তুমি শুধু বললে, আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দিন । সেই লক্ষে
টানাটুনির সংসারে একটু একটু
থালাবাটি কিনছি । বিছানায়
শুয়ে শুয়ে অনাগত সন্তানের গায়ে হাত রাখছি । তোমার
ছুটিতে চলে যাচ্ছি বাবার কাছে কিন্তু গত পরশুদিন হঠাৎ অসময়ে বাসায় এসে কাটা গাছের হেলে পড়ার মত জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে বিছানায় পড়ে গেলে। আমি তোমাকে ধরতে গেলে কোনমতে বললে, সুফি, তুমি আমাকে শুইয়ে দাও। এরপর
থেকে এই জ্বর। এমন শরীরকাঁপানো জ্বর, এই কমে তো এই তোমাকে কাঁপিয়ে দেয়। ওষুধ বা প্রার্থনা কোন দাওয়াতেই কাজ হচ্ছে না। রাত বাড়ে, আশেপাশের বাতি একএক করে নিভে যায়। আমি তোমার খোলা চোখের, প্রশান্ত হাসিমুখের অপেক্ষায় চেয়ে থাকি। মগে করে পানি আনি। একটু পরপর মগের পানিতেও জ্বর আসে। পানি বদলাতে বাথরুমে যেতেই হঠাৎ মনে হলো, একবার কি তুমি আমাকে ডাকলে! সুফি, সুফি.... ভুল শুনলাম না তো! দৌড়ে এসে দেখি, তুমি উঠে বসার জন্য কাঁৎ হয়ে আছ। আমি ব্যস্তভাবে বললাম, তোমাকে উঠতে হবে না। আমাকে বল, আমি দেখছি । তুমি
বললে, বমি করব সুফি....। আমি দৌড় দিলাম বাথরুমে। কয়েক সেকেন্ড দুরত্বের বালতিটা খালি করে আনতে আনতে তুমি ফ্লোর ভাসিয়ে দিলে। আমি তোমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি। বমি শেষ করে তুমি হাঁপাতে হাঁপাতে অপরাধীর মত যখন আমার দিকে তাকালে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম । তুমি
বললে, সরি সুফি। আমি বললাম, কোনও কথা নয়। একটু ধৈর্য ধরে শোও। আমি এক্ষুনি সব ঠিক করে দিচ্ছি। তোমার
খোলা চোখে কথা শোনার আনন্দে দ্রুত পরিষ্কারের কাজটা সেরে এসে দেখি, বমির ক্লান্তিতে আবার তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ । তবে
জ্বরটা নেমে গেছে।
আমি তোমার
বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠলাম। তুমি আমার কানের কাছে মুখ এনে বললে, সুফি, চাকরীটা আমি ছেড়ে দেব। আমি বললাম, তোমার মন না চাইলে ছেড়ে দেবে, অসুবিধা নেই। তুমি বললে, বাবার জমিতে কৃষিকাজ করব। তুমি আমার পাশে থাকবে না সুফি?আমি তোমার মুখটা স্পর্শ করলাম, ও কথা বলছ কেন ? তোমার যা মন চায় করবে, আমি তোমার সাথেই তো আছি । তুমি
এবার একটু উঠে বসতে চাইলে, ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট হওয়া ছেলে কৃষিকাজ করতে পারবে না, এমন তো কোন কথা নেই ? আমি সায় দিলাম, ঠিকইতো ।
তুমি এবার দৃঢ়ভাবে বললে, তবু আমি অন্যায় করব না। কিছুতেই না। মন্ত্রী মহোদয়ের প্রেসারেও না ।
তুমি এবার দৃঢ়ভাবে বললে, তবু আমি অন্যায় করব না। কিছুতেই না। মন্ত্রী মহোদয়ের প্রেসারেও না ।
আমি তোমাকে
গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরি, আমি কখনোই তোমার কথার দ্বিমত করিনি। এখনও করব না বাবলু। তুমি
এবার আমার পিঠে হাত রাখলে, তুমি খুব ভাল মেয়ে সুফি, অনেক ভাল মেয়ে। আমি তোমার বুকে মুখ গুঁজে দিয়েছি। জানালা ভেদ করে আসা জোছনাটা না হয় চোখে লাগে ।