ছিন্নপত্রের পরে
নদীর চারদিকটা কেমন নীরবতায় ঘেরা
ছিল ! নীরবতা নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল কৃপা'র ! পুরো নাম কৃপা দয়াল
চক্রবর্তী !একটা পাল তোলা নৌকা আস্তে আস্তে ভেসে আসছিল পাড়ের দিকে...যিশুর মনে কি
একটা বোধ নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল !
অনেকদিন থেকেই এরকম একটা ইচ্ছার
ভাবময় পরিবেশ মনের ভেতরে ছিল! সেই কলেজ জীবন থেকে ..যখন 'ছিন্নপত্র ' নিয়ে অনেক আলোচনা ব্যাখা
এমন কি বিতর্কের শেষ অবধি থাকত না তনয়ার সঙ্গে ! হাঁ... পুরো নাম তনয়া বৃন্দাবন
জুতশী ! কল্পনা ফিরে পেতে ভালো লাগছিল যিশুর ! জ্যোত্স্না জমেছিল নদীর শরীরে
....আত্রেয়ী সৈকতে স্বপ্নের মতো শুয়ে ছিল জ্যোত্স্না বালুচর কে সঙ্গ করে! দুরে
পানসি গুলো কেমন বোকা শালিকের মতো জ্যোত্স্নায় শুধু শুধু ভিজে একসা হচ্ছিল !
একটা নিরেট সৌন্দর্যের ভিতর
দাঁড়িয়ে যিশু ভাবলো একাকিত্বের এই সুন্দর মহিমার কাছে সে যেন নিতান্ত শিশু
....ভাবলেশহীন এক মুহর্ত মাত্র !
তিন বছরের কলেজ জীবনটাকে চার বছরে
শেষ করেছিল যিশু !কোনো এক ছাত্র সংসদ কে ভালোবেসে মেয়াদটাকে আরো এক বছর বাড়িয়ে
দিয়েছিল একবার পরীক্ষা না দিয়ে ! আর এই একবছর মেয়াদ বাড়ানোর গড়ার দিকে যে জন্ম
নিয়েছিল যিশুর মনে...সে হলো তনয়া জুতশী !
তনয়া এসেছিল উত্তর প্রদেশের লক্নো
শহর থেকে তার বাবার বছর বছর বদলীর চাকরির সুবাদে !অবাঙালি ! কিন্তু কলেজে বাঙালিরা
হার মেনে ছিল অবাঙালির বাঙালিত্বের মহিমা দেখে ! অমন সুন্দর ভালো বাংলা ভাষা কখনো
কখনো অলংকৃত শব্দের ব্যবহার যে সে কোথায় শিখেছিল..যিশুর বোধগম্য হতো না ! সবাই
জিগ্যেস করলে ..সে শুধু হাসতো !
তনয়া যেন একেবারে তনয়া'ই ছিল ! উজ্জলতার বিরূপ ছিল সে ! নিতান্ত সাদামাটায় আচ্ছাদিত করে
রাখত নিজেকে! কিন্তু ডায়াস লেকচার দেবার সময় এই মেয়ে যেন ভিন্ন কোনো মহীয়সী তে
রুপান্তরিত হতো ! বলার গভীরতা এতো স্থির হতো যেখানে শ্রোতা যেন মন্ত্র খুগ্ধ হয়ে
থাকত !কিন্তু বক্তৃতায় যা পরিপূর্ণতা দরকার সেটা পরে শিখেছিল যিশুর কাছে ! প্রথম
প্রথম তনয়া তার মানবিক অনুকম্পায় বলে যেত যেখানে তার আবেগ স্থান পেত বেশি...যুক্তি'র ব্যাপারটা একটু কম হতো ! আবেগের ব্যাপারটা যিশু অস্বীকার করে
কোনদিন...কারণ কলেজ ইলেকসনে এটার একটা আলাদা মূল্যবোধ জমা হয় ! তবু লেকচার যে শুধু
আবেগ নয় এটা অসম্ভব রকম বিশ্বাস করতো যিশু !
তনয়া যে কেন যিশুর এতো কাছে এসেছিল,যিশুকে সে কৈফিয়াত কখনো দেয় নি সে ! একবার ছিন্নপত্র'র উপরে যিশুকে কিছু পোস্টার সেশন করে অনুচিন্তা ব্যাখা করার ভার
পড়েছিলো ! একটা চালেঞ্জ ছিল বিশেষত: ভীষণ নরম হৃদয়ের কোন থেকে তনয়ার প্রতি ! এই
চালেঞ্জটা সে যিশুর অন্তর দ্বন্দ থেকে নয় বরং চালেঞ্জটা নিজের মনের সঙ্গে নিয়েছিল
একটা সাদামাটা মেয়ের ভেতরে আরো সাদামাটা ভাবে তার অহংকারকে কুন্ঠিত ভাবে প্রথিত
করার দরুন আবেগে ! কিন্তু কেন জানি যিশু সেদিন কোথায় হারিয়ে গেল...একগাদা বিদগ্ধ
জনের মাঝে যিশু প্রায় প্রশ্নবানে নাজেহাল হতে দেখে তনয়া বিনীত অভিভাদনে ডায়াসে
যিশুর সঙ্গে কন্ঠস্বর মিলিয়ে দিয়েছিল সমস্ত প্রশ্ন বানের উত্তর দেবার !
সভা শেষে মঞ্চের পেছনে যিশুর সেই
হতবাক প্রশ্ন ..." কেন এসেছিলে আমাকে সাহায্য করতে ? যিশুর অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে তনয়া
বলেছিল..."শ্রদ্ধা টা কেড়ে নেবার দায়িত্ব তো তোমাকে আমি দেয় নি জেসাস ( যিশু
কে জেসাস করে'ই ডাকত তনয়া) ! ওটাকে আমি
নিজের আত্মগোপনে তিল তিল করে বড় করেছি ! সে ঘরে কেউ অনধিকার প্রবেশে বাসনা করুক
আমার বিনত মন ঠিক সময় দেয় না ! জোর করে যদি কেউ সেই ঘরে যায় টা হোল মানসিক
কস্তবধের পরিমাপটা অনুধাবনে আমার আত্মিক মনকে মেরে ফেলবার জন্য তার কাছে গরল
প্রার্থনা করি !
স্টেজের আলো আধারিতে যিশু আর তনয়া
অনেকটা সময় কাছে দাঁড়িয়ে ! কোনো কথা নেই কারো মুখে ! যিশু নিশ্চুপ হয়ে থাকা তনয়ার
হাত আলতো করে ধরে মৃদু চাপ দিতে তনয়া যেন থর থর করে কেঁপে উঠলো ! কাছে টেনে নিল
তনয়াকে..তার চুলের মিষ্টি গন্ধ চিনিয়ে দিছিল যিশুকে বারবার এই সেই তার তনয়া...যার
সমীপে সমস্ত অহংকার ডুবিয়ে দিতে চায় সে !
-আমায় তুমি ভালবাস তনয়া
....যিশু হঠাত জিগ্যেস করে !
তনয়া উত্তর দেয় নি কিছু..শুধু
যিশুকে আরো ঘন হয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ! তার চোখে জল... অন্ধকারে যিশু দেখতে পেল
না !
সমুদ্রের মতো একরাশ কালো লম্বিত
গন্ধ চুলের আঁধারে সেই ক্ষনিক হারিয়ে যাওয়ার বেদনায় এখনো কুন্ঠিত হয়ে পরে যিশু !
তনয়ার এই প্রস্ফুটিত উন্মোচন
ভালবাসার পাহাড় সেখানেই তৈরী হয়েছিল !
এর মাঝে আরো কয়েকটা বছর কেটে গেছে
! ইউনিভারসিটি শেষ করে যিশু ফিরে এসেছিল নিজের শহরে....তনয়ার সেবার ফাইনাল বি.এ. !
ইউনিভারসিটির দিন গুলো যিশু নিজেকে সমস্ত দিক থেকে গুটিয়ে নিয়েছিল আর তার সুফল্
কারণে রেসাল্ট তা খুব ভালো হয়েছিল যিশুর !
যিশুর আজ মনে পড়ে..তনয়াকে একদিন
কাছে টেনে আবার জিগ্যেস করেছিল......
-কি ভাবছ তনয়া !
আত্রেয়ী নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল তনয়া
নিরুত্তর ! বাঁশের সাকো পারাপারের মাঝি পয়সা নেয়া লোকজনদের কাছ থেকে ...দিনের শেষে
এক গাদা লোকের ওই বাঁশের সাকো ঘরে ফেরার তাগাদা ! কয়েকজন মহিলা বিপরীত দিক থেকে
অসভ্য যুবকের ছোঁয়া বাচাবার তাগিদে সাকোর একদিক ঘেষে শরীর বাঁচিয়ে চলে আসা...তারপর
মহিলাদের মুখ ঝামটা ছেলে গুলোর প্রতি....তনয়া সেই সব'ই দেখছিল একমনে.... কোনো উত্তর না দিয়ে..!
যিশুর ভয়টা ক্রমশ একটা দীর্ঘ আকার
ধারণ করে ছিল !তনয়ার এই নিরুত্তর সঙ্গলাভ তার একটা মানসিক কান্নার আকার ধারণ করে
ছিল মনে ! নি:সঙ্গ নয় অথচ এই নিরুত্তাপ সঙ্গলাভের পরিনাম দিন দিন যিশুকে কেমন
উদাসীন করে তুলেছিল ! সেই প্রাচীরের ওপার থেকে তনয়া একদিন বলেছিল...
- তুমি জানো না জেসাস..আমি
ভীষণ নির্লজ্জ ভাবে জানি..আমার ভেতরে এক চাঁপা অহংকার কাজ করে ! অহংকার আমাদের
বংশের রক্তে ! তোমার দোষ নেই জেসাস ! আমি তোমার আন্তরিক বন্ধু..ছোট তোমার চাইতে!
একটা কথা বলি তোমায় .....বেশিদিন নিজেকে খোলা রেখো না !
যিশু বেশ অবাক হলো !
- কেন তনয়া এমন বলছ কেন !
-জেসাস ..আমার বাবাকে দেখে
এই কথায় মনে হয়েছে !মানুষ বড় জটিল এক আবাসিক আয়েসী প্রাণী ! তার ভাবনা কখন কোথায়
কোন আবেগে কেঁপে উঠবে নিজেই জানে না ! আসে পাশে লক্ষ প্রলোভনের তরঙ্গ নেচে চলেছে!
কখন কোন বাতাসে সে তরী ভাসবে কেউ জানে না ! আর উন্মত্ত সেই পালের বাতাসে আদর্শের
সেই সৌখিন পেয়ালা যে কখন ভাঙবে ...তার বেশি সময় লাগে না !
যিশু আবার অবাক হোল..এ কোন তনয়া কে
দেখছে সে....এতদিন মিশে তার গভীরতার বিন্দু মাত্র তের পাই নি সে..আর সে কিনা তার
উপরে টেক্কা দিতে গিয়েছিল ! যিশু কে চুপ হয়ে যেতে দেখে তনয়া হাসে !
-জেসাস ..আমি শুধু এইটুকুই
তোমাকে বলে রাখি !জানো মেয়েরাও ভালো বাসতে পারে ! হয়ত সে ভালবাসার মূল্যায়ন সব সময়
হয় না জীবনে... বংশগত বা মর্যাদা গত কারণে !
তনয়া চলে গেল আবার সেই এলাহাবাদে
তার বাবার চাকরির সুবাদে !
অবাঙালি তনয়া বাঙালির দোহাই দিয়ে
ফেলে রেখে গেল যিশুকে ভালবাসার সেই বাতাসী হৃদয়ে আত্রেয়ী সৈকতে !
নিজের শহরে কলেজের চাকরিতে যিশুর
তনয়া হীন উদাসীনতায় সাহিত্যের ক্লাসে বেশ প্রভাব পরে ! প্রিয় শিক্ষকের ভূমিকায়
যিশু এখন নিমিত্ত পূরুষ মাত্র ! দিন যাপনের গ্লানিতে জ্যোত্স্নায় আত্রেয়ী সৈকতে
এসে বসে নি:সঙ্গ নিস্তব্ধতায় নিদারুন সৌন্দর্য্য বোধ উপলব্ধি করে ! জ্যোত্স্নায়
ভেজা পানসি গুলোকে নিয়ে খেলা করে বিভিন্ন জ্যামিতিক অঙ্কনে ! মাঝে মাঝ্র কয়েকটা
সারমেয় তাদের বিনীত প্রার্থনা জানায় যিশুকে প্রভুত্বের সংবর্ধনায় ! কিন্তু তাদের
ভবিষ্যত প্রভুর উদাসীনতায় তারাও সেই সারমেয় বিরক্তিতে লেজ নাড়িয়ে দুরে সরে যায় !
এই নিরেট নি:স্তব্ধতায় ভেতরে যিশু
দাঁড়িয়ে দেখে.... আত্রেয়ী ঠিক বয়ে চলেছে সশব্দ গতিতে অথচ তার গতি কেউ শুনতে পায়
না কোনদিন !