গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪

ডঃ সুজাতা ঘোষ


ক্ষমতা


সমস্ত কাজ শেষ, এবারে নিশ্চিন্তে ঘুমতে পারি ........................
বালিশটা আঁকড়ে ওপাশ ঘুরে দুবার গাল ঘসে শান্তির শ্বাস ফেলে আর একটু জোড়ে জড়িয়ে ধরল বালিশটাকেপায়ের নিচের নরম কম্বলটা আলতো করে পায়ের পাতায় মুড়িয়ে সত্যিই শান্তির ঘুম ঘুমানোর চেষ্টা করল সুচিস্মিতা

চাঁদটা সারা আকাশ জুড়ে হাসছে , মেঘটা বারে বারে চুল এলিয়ে গা ঘেঁষে ভেসে চলেছে ............... কার দৃষ্টি এখনও অমন করে পরে আছে নিষ্পাপ মুখের উপরে? নিষ্পাপ, হ্যাঁ, নিষ্পাপই বটেদেখে মোটেই বোঝার উপায় নেই যে, এই মেয়েই সাংঘাতিক কাজ করতে পারেকালো মেঘটা বারবার এসে ঢেকে দিচ্ছে চাঁদের হাসিকি চায় ? হয়তো চাইছে হাসিটা টেনে খুলে নিতে। 
ঘুম ভেঙে গেল সুচিস্মিতারধড়পড় করে উঠে বসল বিছানায়ঘামাচ্ছে, ভয়ে বুকের ওঠানামা ওর নিয়ন্ত্রনের বাইরেকি যে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখল! আস্তে আস্তে ঘুম কাটছে আর মাথাটা ধরছেহাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে জলের গ্লাসটা টেনে নিয়ে মুখের সামনে ধরল কাঁপা হাতেশান্ত করার চেষ্টা করছে নিজেকে আর ধীরে ধীরে মনকে বোঝাচ্ছে যা করেছে তা করা উচিৎ ছিল, তাই করেছে
ভোরের সূর্য মনকে হয়তো বেশী আনন্দ দেয় রাতের চাঁদের থেকে, হয়তো বাঁচার ইচ্ছা আরও প্রকট করে তোলে ...........................। আজ থেকেই অফিসের পুরোপুরি দায়িত্ব নিতে হবে সুচিস্মিতাকেসকাল হতেই নিজেকে যত্ন সহকারে পরিপূর্ন রূপে সাজিয়ে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদের উপযোগী করে তুলে রওনা দিলেন অফিসের দিকেবাড়িতে ছেলে মেয়ের দেখা শোনার দায়িত্ব আপাতত আয়ার হাতেইকিছু করার নেইমনে মনে বেশ বুঝতে পারছে যে একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ, হয়তো জীবনে প্রথম এত বড় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে চাইছে, সেজন্যই ভগবানের নাম নিয়ে মনকে শক্ত করে কাজের সমস্ত দায়িত্ব তুলে নিল নিজের কাঁধেপ্রথমেই নিজের কেবিনে না ঢুকে আগে বেশ একটা মন্ত্রীদের মত পরিদর্শন করে নিল চারপাশ, সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চাইল তার অস্তিত্ব, তারপর বসল নিজের সিংহাসনেহ্যাঁ, এটা সিংহাসনইঅনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে এই সিংহাসনে পৌছবার জন্যদিনের পর দিন অনেক, অনে্অনেক পরিকল্পনা করতে হয়েছে এই সিংহাসনটাতে পাকাপাকি বসবার জন্য
নরম গদিতে বসে আস্তে আস্তে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে মেলে দিল চেয়ারেআঃ কি ভীষণ আরাম; চোখ দুটো বুজে আসছেপুরনো ছবিগুলো মানুষ ভুলতে চাইলেও ভোলা সহজ হয়ে ওঠে না কখনো কখনোছেলে মেয়ে দুটো বড় ছোট, কি একটু বেশী তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে ..............., 
এই ক্ষমতার লোভ কোন সময় মানে না, সম্পর্ক মানে না ..............., ওফ, ওই জানে, প্রতিনিয়ত নিজের মনের সাথে কতটা লড়াই করতে হয়েছে দিনের পর দিনএত সহজ ছিল না এভাবে কম্পানীর নাম পাল্টে তার চেয়ার পার্সেনের গদিতে বসা
সারাদিনের ক্লান্তির পর রাতটুকুই মনে হয় যেন সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুছেলে মেয়েরা ঘুমিয়ে আছে পাশের ঘরেসুচিস্মিতা ওদের গুড নাইট কিস করে নিজের ঘরে এসে হালকা নীল আলোটা জ্বালিয়ে হাউস কোটটা খুলে জানলাটা মেলে দিল পুরটা দুহাত বাড়িয়েচাঁদটা হাসছে আবারওর মিষ্টি আলো এসে ছড়িয়ে পড়ল সুচিস্মিতার গলা বেয়ে বুকেনা, কেউ নেই পিছন থেকে এসে আচমকা জড়িয়ে ধরে গালে গাল ছুঁয়ে দাঁড়াবার
বড্ড একা লাগছে এই মুহুর্তেযেদিন নতুন বউ হয়ে এসেছিল বড়িতে বা তারও অনেক আগে যখন সুমনের বাইকে বসে দুজনে এক হয়ে ঘুড়ে বেড়াত তখনও হয়তো জানত না যে কোন একদিন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে চাঁদনী রাতে নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ মনেএকটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল বহু আনন্দের নীচে চাপা পড়ে যাওয়া কালের গভীর তল থেকে
বিছানায় নিজের শরীরটা মেলে দিয়ে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, এখন অনেক দায়িত্বছেলে মেয়েকে বড় করতে হবে, নিজের ক্ষমতা বিস্তার করে আরও অনেক ওপরে উঠতে হবেএখন সময় নয় পুরনকে নিয়ে ভাববারসুচিস্মিতা ঘুমানোর চেষ্টা করল সযত্নে

পর্ব

প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেছে, সুচিস্মিতার কাজকর্ম সুদূরপ্রসারী, বিশ্বের প্রায় আশি শতাংশ দেশে ব্যাবসা ছড়িয়ে আছে  একরকম মনোপলিও বলা যেতে পারে হয়তো নিজেও ভাবেনি যে, এত অল্প সময়ে আলেকজান্ডারের মত বিশ্ব জয় করে ফেলবেছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে, বিদেশে মানুষ হয়েছে, তাই বিশেষ সময় দিতে হয় নি ওদের জন্যনিজের একান্ত ইচ্ছাকে ভর করে ডানা মেলে উড়ে বেড়িয়েছে দিক দিগন্ত
প্রতি বছর ঘটা করে শ্বশুর , শ্বাশুরি আর স্বামীর মৃত্যু বার্ষিকী পালন করে সমস্ত শাখা-প্রশাখায়সমস্ত কর্মচারী বিশেষ কিছু উপহারও পেয়ে থাকে এই দিনগুলিতে, যার ফলে বেশ আনন্দিত হয়শুচিস্মিতারও কিছুটা আত্মশান্তি ঘটেআকাশে ঘন লাল জমাট বাঁধা মেঘ দেখলে যেমন ভালো লাগে তেমন ভয়ও হয়এই বুঝি লালটা কালো হয়ে নেমে আসবে ঝুপ করে মাটিতে
মেয়ে ফোন করে জানিয়েছে এবারে সে দেশে ফিরে মায়ের কাছেই থাকবে, আর তাঁর কাঁধের সমস্ত ভার নিজের কাঁধে তুলে নেবেছেলে অবশ্য এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘমায় না নিজের পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি নিয়েই ব্যাস্তদেশে ফেরার ইচ্ছাও প্রকাশ করে নাএকদিকে বাঁচোয়া, যত বেশী কাছে আসে তত বেশী ভয় হয় সুচিস্মিতারমনে হয় এই বুঝি টেনে ফেলবে ন্যানোর উপর লাগানো ঢাকনার মতমেয়ের ফোন পাওয়া অবধি একটা অজানা ভয় ঘুরে বেড়াচ্ছে মনটার চারপাশে

আজ রবিবারএকটু দেরীতেই ঘুম থেকে উঠেছে সেকাজের লোক চা টা দিয়ে যেতে ছাদের উপর নরম ঘাসে মোড়া গালিচার উপর পা পেতে আরাম কেদারায় শরীরটা এলিয়ে দিল সুচিহ্যাঁ, এখন বহু বছর হোল এই নামে আর কেউ ডাকে না তাকেঅনেকবারই সুমনের সাথে একান্তে বসে দুজনে চায়ের আড্ডা জমিয়েছে এখানে, কখনো বা চা ছাড়াই শুধু আড্ডাসুমন ওকে ভালোবেসেই সুচি বলেই ডাকতওর নিজেকে অ্যালিস বলে মনে হত এই ছাঁদ বাগানে
শেষবার সুমনকে এই চেয়ারেই ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলতখন অবশ্য সুচিস্মিতা বাপের বাড়িতেতারপর তো কত ঝড় ঝাঁপটা হয়ে গেলপুলিশ, কোর্ট, বাড়ির চাকরদের নিয়েও টানাটানিএভাবে কতগুলো বছর কেটে গেল তাঁর কোন হিসাব নেইহঠাৎই সেদিন সুচিস্মিতার কি দয়া হোল কে জানে, যে ভদ্রলোককে সন্দেহ বশত এত বছর জেলে আটকে থাকতে হোল, তাকে হঠাৎই ছেড়ে দিল সমস্ত কেস তুলে নিয়ে

এই ভাবমূর্তি দেখে অনেকেই পিছনে নানা আলোচনা শুরু করেছেবলাই বাহুল্য সবই মুখরোচ্ব, তবে সামনে কিছু বলার ক্ষমতা কাররই নেইচেয়ার পার্সেন বলে কথা, কার ঘারে কটা মুণ্ডু আছে? তাছাড়া প্রমাণই বা কি? তাই শত প্রশ্ন সত্বেও সব চুপ
মেয়ে অবশ্য খবরটা পেয়ে অনেক প্রশ্ন করে মাকেকোন রকমে মেয়েকে বুঝিয়ে চুপ করালেও এখানে যদি পাকাপাকি ভাবে চলে আসে তখন বেশ মুশকিলেই পড়তে হবে তাকে সেটা ভালোমতই বুঝতে পারছেমেয়ের স্বভাবটা ঠিক তাঁর নিজের মতনই, তাইতো এত ভয় সুচিস্মিতার

র্ব  -

পাশের ঘরে মেয়ে শুয়ে আছেএইর মূহুর্তে তাঁকে প্রতিপক্ষ ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না সুচিস্মিতারএত পরিকল্পনা, এত কঠোর পরিশ্রম আর শেষ পর্যন্ত যদি সমস্ত কিছু ছেড়ে দিতে হয় মেয়ের হাতে, তাহলে এর চেয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা হতে পারে না তাঁর জীবনে
আজ চাঁদটা নেই কেন? আকাশের রং ঠিক কি? অন্ধকারে কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আকাশটাকে  -
                                    তাঁরারা হাসছে খুনসুটি
                                    যেন কালো গালিচায় রুপোর ফুল
                                    চারিধার নিস্তব্ধ, অনেক নাজান শব্দ
                                    ভয়ঙ্কর এই রাতে কে এল নিশ্চুপ
                                    সঙ্গীহীন, সুচিস্মিতার অন্তরের একান্ত কোন

আজ ঘুম আসছে না কেন? শরীরটা কেমন হাঁসফাঁশ করছে দেহ থেকে দেহ খুলে ভূমিতে মিলিয়ে দেওয়ার জন্যবহুযুগ কেটে গেছে, সুমন পাশে নেইকোথাও নেইশুধু আছে স্মৃতি রোমন্থনসুচিস্মিতা কোনদিনও হয়তো স্বীকার করতে পারবে না যে, সে এক হত্যাকারীহ্যাঁ, সত্যিই তাইকিন্তু কেন হোল এমন! দুজনে মিলেমিশেই তো ঘর বুন্তে শুরু করেছিল একদিন, কোন এক মধুর মূহুর্তেতাহলে কেন হল এমন? অন্য এক নাড়ীই কি এর কারন? সত্যিই যদি সেদিন না জানত যে, অন্য কোন কামিনী সুমনের জীবনে আছে, তবে কি এই দুঃসাহস দেখাতে পারত? নাকি ক্ষমতার লোভকে আরও বেশী করে হাওয়া দেওয়ার জন্যই সে বেঁছে নিয়েছিল ছোট্ট একটু অজুহাত? ছোট্ট হ্যাঁ, কারন পুরুষদের এতি একটি সহজাত চরিত্রতাঁরা অতি সহজেই বড় বেশী দুর্বল হয়ে পড়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতিতখন তাঁরা প্রায় ভুলতে বসে সমস্ত সমাজ, কর্তব্য, করনীয়

সুচিস্মিতা কি সত্যিই ক্ষমা করে দিতে পারত না তাকে একটি বারের মত? হয়তো অন্যদের মত চেষ্টা করলে সেও পারতোকিন্তু না, সে সেটাকেই তাঁর অস্ত্র হিসাবে তুলে নিয়েছিল হাতেএতগুলো বছর পরে ঠিক মনে করতে পারে না সময় কোন অনুভূতি কাজ করেছিল, স্বামীর ভালোবাসা ভাগ হয়ে যাওয়া নাকি শ্বশুরের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যে নিজের ক্ষমতা বিস্তার!
সুমনের সাথে শেষ বিবাহবার্ষীকি ঠিক কেমন ছিল? যখন খোলাখুলি ভাবে নিজের দ্বিচারিতা অকপটে সুমন বলতে পেরেছিল সুচিস্মিতার চোখে চোখ রেখে বিনা দ্বিধা লজ্জায়! সম্পত্তির ভাগ নিয়ে টানা পোড়েন আর তচনচ হয়ে যাওয়া পুরনো সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো সুখের সংসার এই ছিল তাদের সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি

ভূমিকম্প আসলে সবাইকে মরতে হবে এর কি মানে আছে? সুচিস্মিতা মরে নিসে নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল সেদিনযথেষ্ট শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতি, সুন্দরী, কেন হার মানবে সুমনের দ্বিতীয়ার সামনে? হার মানেনি সেধীর, স্থির, শান্ত করে তুলেছিল নিজেকেকাজে লাগিয়েছিল নিজের বুদ্ধিকেধীরে ধীরে পথ চলতে শুরু করেছিল একাকীত্বকে সঙ্গী করেএই সুন্দর আর ভয়ঙ্কর পৃথিবীতে নিজের সাম্রাজ্য তৈরি করতেই হবে তা সে জানতক্ষমতা দখলের লড়াইতে একচুল জায়গাও সে ছাড়বে না ছলে, বলে, কৌশলেহ্যাঁ, কৌশলে এই শব্দটাই সে বেঁছে নিয়েছিলতাই সে আজও সমান মর্যাদায় শ্রদ্ধনীয়া সকলের কাছে

র্ব -

এখন প্রায় নব্বই ছুঁই ছুঁইবয়সের ভাঁড়ে দেহ ঝুঁকে এসেছে মাটির কাছাকাছিবাইরে খুব একটা বেড় হয় না সুচিস্মিতানিজের সিংহাসন দান করেছে মেয়েকেনাহলে নব্বইয়ের শুভ জন্মদিনটা তাকে জেলেই কাটাতে হতএখন সঙ্গী বলতে সুমনের ছবিখানিছাঁদ বাগানে ইজিচেয়ারে নিজের শরীরটা আলতো করে এলিয়ে দিল সুচিস্মিতাবুকে চাপা আছে ছবি আর তাঁর ভালোবাসার স্মৃতিচাঁদটা ঠিক যেন আকাশের বাঁদিকের কোণায় হাসছেনরম হলুদ আলো এসে পড়েছে বুকে আর গলায়সুচিস্মিতা শ্বাস নিচ্ছে ধীরে, খুব ধীরেচোখদুটো বুজে আসছে, এবারে হয়তো সময় হয়েছে আবার নতুন করে তাঁর হাত ধরে পথ চলারচাঁদটা ঢেকে যাচ্ছে মেঘের আবছায়ায়