গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪

সাঈদা মিমি


ছায়া

'নিশি না পোহাতে তোমার অনল জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া'.. না, রবীন্দ্র সঙ্গীতে মন নেই শিখার প্রতিদিনের মত আজও এক বিরক্তিকর দুপুর এসেছে সেই ছেলেবেলা থেকেই দুপুরে ঘুম টুম হয় না তার বালিকা বয়সে ঘরের পেছনের সুপারি বাগানে দুপুরটা কাটতো, নিরীহ গাছগুলোর শরীরময় বিচিত্র সব চিত্রকর্ম ঘর - উঠান, চৌকি, রসুই - হাঁড়ি - পাতিল, খেঁজুর পাতার পাটি পেতে খাওয়ার দৃশ্য, পান চিবুতে চিবুতে বাবা মায়ের সচিত্র সংলাপ, পশ্চিম আঙিনায় তেতুল গাছের ডালে বাঁধা দোলনা, ওখানে সে দুলছে এমন ছবিও আছে| সন্ধ্যমালতির ঝাঁড়, ঘরের মুল দরোজার দুপাশে চারটে হৃষ্টপুষ্ট আনার গাছ, সারা ভিটের যত আম -জাম -খেঁজুর গাছ, মেহগণি, দেবদারু, রাজকড়ই, ভূতুড়ে শিমুল, দুহাতে জড়িয়ে রেখেছিলো যে কৃষ্ণচূঁড়াকে কিম্বা কত কসরত করে সুপারির বাকলে আঁকার দৃশ্য, কি নেই! জালালি কবুতর দের ঘর সংসার এমনকি পোষা বকরি পিনুর ছবিও

মা দুপুরে ঘুমানোর আয়োজন করে ডাকতেন, ' শিখা, ঘুমা , দেখবি দুপুরের ঘুম কি আরামের! আয় বেটি, আমার পাশে একটু ঘুমা ' শিখার দীর্ঘশ্বাস পড়ে নাহ, সে আজও বুঝলো না দুপুরের ঘুমটার আয়েশ কি! দুপুর মানেই কাজ শেষে একটু বিরতি, তারপর লম্বা সময় হাঁসফাঁস জুন জুলাইয়ের দুপুর হলে তো কথাই নেই, বিরক্তি তালুতে উঠে যায় বইগুলির কল্যাণে বাঁচোয়া নচেৎ সিনেমা কিংবা সিরিয়ালের নেশা হয়ে যেতে পারতো, হয় নি আচ্ছা কেন হয় নি? প্রতিবেশীদের বাসায় যাওয়া হয় না, সবাই চারদেয়ালের সভ্যতা মেইনটেইন করে কিন্তু আত্মীয় স্বজনের বাসায় গেলেও সে দেখে, সবাই মগ্ন নানা সিরিয়ালে অথবা সিরিয়ালের নায়িকাদের চেহারা সুরত পোষাকের গল্পে! কি জমানা আইলো? দাদির এই কথাগুলো মনে পড়ে যায় এই শিখা? উম... শিখা ঘুরে তাকায় এবং তার মনে পড়ে, ছেলেবেলার দুপুরে খোদাই কর্ম ভালো না লাগলে সে পুকুরঘাটে পা ছড়িয়ে মাছ ধরতে বসতো কিন্তু ডাকলো কে? সময়! তখুনি ফোনটা এলো

বন্ধু লিখনের ফোনশিখা, তোর লুবনা ইসলামের কথা মনে আছে?  একটা তিক্ত অনুভব শিখা কে আট বছর পিছনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় হিঁচড়ে শব্দটার প্রয়োগ কি ঠিক হলো? অসুবিধে কি? সাধারণত সব দিনে সে ভ্রমণেচ্ছু নয় শিখারা তখন অন্য পাড়ায় থাকতো, এই সময়ের মত না, সে প্রতিবেশীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো বাসায় আনাগোনা, নাস্তাপানি, আড্ডা ফাড্ডা নিকুঞ্জ নামের যে স্কুলটায় সে পড়াত, সেখানে ভর্তি হয়েছিলো লুবনা ইসলামের ছোট মেয়ে কিছুদিন পর শিখা আবিষ্কার করলো, কেউ মেশে না মেয়েটার সাথে, রীতিমত এড়িয়ে চলে ওকে আরো কিছুদিন পর জানলো, লুবনা ইসলাম উচু মাপের একজন কলগার্ল, তাই ওদের সাথে কেউ মেশে না শিখা আহত হলো কিন্তু ঘৃণা করতে পারলো না লুবনার মেয়ে তামান্নাকে সে আদর দিয়ে কাছাকাছি নিয়ে এলো নাইনে ভর্তি হয়েছে মেয়েটা, অনাদরে অভ্যস্ত আদরটা বুঝতে কষ্ট হলেও লুবনা ইসলাম ঠিকই জানতে পারলো জনৈক শিখা মিস তার মেয়েটির প্রতি স্নেহশীল এক রাতে শিখার বাসায় এলো লুবনা, বিষম সংকুচিত ছিলো সে এবং মলিন তার দুর্ধর্ষ রূপ মালিন্যকে ঢাকতে পারছিলো না

লুবনা  ইসলামের আদি নিবাস পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশে এসেছে বছর তের আগে প্রথম তারুণ্যে ঘর পালায় সন্তোষ চৌধুরীর হাত ধরে সন্তোষ সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের সন্তান, তার ওপর ঘরের বড় ছেলে সে তার পরিবারের পক্ষে এটা মানা সম্ভব ছিলো না, সম্ভব ছিলো না লুবনার পরিবারের পক্ষেও মেনে নেয়া এটাকে কি প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলা যায়? শিখার সেরকমই মনে হয়েছিলো নয়তো বাবা মায়ের সমস্ত সাধে চিতা জ্বালিয়ে সন্তোষ কেন লুবনার রূপের ফাঁদে পা দিলো! যেমন লুবনা ইসলামের বাবা মাও জানতো, লেখাপড়ার আবর্জনা চুলোয় পুড়িয়ে তাদের মেয়ে অনেক আগেই রূপ পসারিনী হয়ে গেছে, তবুও তারা সতর্ক হয়নি এবং এই জীবনের গল্পগুলি নোঙর ফেললো না তিন বছরের তামান্নাকে নিয়ে লুবনা আবারও ভাগলো পাশের বাড়ির সঙ্গীত শিক্ষক ইরফানের সাথে সন্তোষ তখন উদভ্রান্ত, সে যে লুবনাকে উন্মাদের মতই ভালোবাসতো! তা লুবনা যতই বরফহৃদয় হোক আর ওদের আদরের তামান্না! কিভাবে থাকবে সন্তোষ? এবার সত্যিই উন্মাদ হলো সে খবর পেয়ে ছুটে এলো সন্তোষের বাবা  মা সন্তানকে নিয়ে গেলো তাদের কাছে

ইরফান অল্পবয়েসী যুবক, প্রায় বেকার তবুও সমাজের কথার তোয়াক্কা না করে সে লুবনাকে বাপ মার বাসায় এনে তুললো রূপের মোহ বড় সাংঘাতিক ঘরে ইরফানের বড় ভাই, বিবাহযোগ্যা দুই বোন এই সেই কথার অপমান সয়েও লুবনাকে আগলে থাকলো ইরফান, তামান্নাকেও   কি হেতু একদিন ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা ছিলো ইরফানের, রাতের বাসটা মিস করলো সে বাসায় ফিরতে মাঝরাত, দরজা খুলেছে কাজের মেয়েটা, ক্লান্ত ইরফান কামরায় ঢুকে দেখে তামান্না ঘুম, লুবনা বিছানায় নেই বাথরুমে কিম্বা রান্নাঘর, বারান্দা! নেই! আছে| ইরফানের বড়ভাইয়ের কামরা থেকে চুপিসারে বেরুচ্ছে! হয়ে গেলো ইরফান, চমকে থতমত খেলো লুবনা এই তাহলে রূপ! এই রূপের মোহ! লুবনাকে পরিত্যাগ করলো ইরফান বৈবাহিক নিয়মের কথা বললে লুবনা তখনো সন্তোষের স্ত্রী, আইনগত ছাড়াছাড়ি হয়নি তাদের

লুবনা ফিরলো সন্তোষের কাছে কিন্তু সন্তোষ তখন বোধাতীত জগতের বাসিন্দা, নিরেট এক শিশু মনোচিকিৎসা চলছে তার সন্তোষের বাবা মা প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো তাকে একটা মিশ্র ভুলও করলো, সন্তানের আত্মজাকেও রাখলো না তারা তিনবছর এগারো মাস চারদিন পর বাবা মার কাছে ফিরলো লুবনা ততদিনে পরিস্থিতি আমুল বদলে গেছে লুবনার বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকে তার মা আর মেজ ভাইয়ের সঙ্গে বাবা ছোট ভাই ফেরার লুবনাকে কেউই রাখতে নারাজ, তার বিদ্যে নেই, কারো বাসায় কাজ করে খাওয়ার মুরোদ নেই, ব্যাবসা পাতি বোঝে না আসলেই বোঝে না! এই যে রূপের ব্যাবসা করেই তো সে খাচ্ছে! হাঁটুর বয়েসী একটা স্বামীও কিন্তু আছে তার, আসলে সেই মিডলম্যান; ওই দালাল আর কি! এসবই শিখা কে অকপটে বলেছে লুবনা, শিখা বলেছিলো তার স্বামীকে এই ঘটনার আরো অনেকদিন পর শিখা জানতে পেলো, তার স্বামী লুবনা ইসলামের বাঁধা কাস্টমার সেই যে বিবমিষা তৈরী হলো আজ অব্দি তার রেশ দুর হয়নি শিখা স্কুলের চাকরী ছাড়লো এলাকাও কেবল সন্তানদের মা হয়েই আরেক জীবনের পথে পা রাখলো

শিখা শুনছিস? লিখনের কথা ভেসে আসেশুনছি, কিন্তু লুবনার প্রসঙ্গ কেন? আমি কি তোদের কাছে অর্থহীন কাহিনী শোনার জন্য বসে আছি লজ্জিত হয় লিখন, তোকে আঘাত করার জন্য বলিনি, সয়্যার আজ লুবনা আর তামান্নাকে দেখলাম একজন বিদেশীর সাথে -তো? বিরক্ত হয়ে ওঠে শিখা - দেখলাম, সাদা চামড়ার লোকটির সাথে একটা ট্যাক্সি ক্যাবে উঠে তামান্না চলে গেলো হঠাৎ থমকে যায় শিখা, অনেক বছর আগের অসমাপ্ত একটা কান্না বুকে দলা পাকিয়ে ওঠে
অশালীন, অকার্যকর, অর্থহীন দুপুর শিখার ছেলেমেয়েগুলি তার মত হয়নি ওরা দুপুরে কিভাবে যেন আয়েশী ঢঙে ঘুমিয়ে পড়ে ওদের ঘুমন্ত মুখগুলি দেখতে দেখতে রবীন্দ্রসংগীতে মগ্ন হয় সে স্কুলের ঢের কাজ বাকী, রেজাল্ট শীট তৈরী করা হয়নি ধুত্তোর, ভাতঘুমের আনন্দটা বোঝা দরকার মায়ের ডাক টা কানে ভেসে আসে, শিখা……… বেটি….