ডাস্টবিন
মাস ছয়েক হল পিয়ালী পেয়িং গেস্ট হিসেবে যাদবপুরের এই বাড়িটায় থাকতে
শুরু করেছে। বাড়িটা স্বপন ধর বলে এক ভদ্রলোকের। কলেজের কাছে কোথাও পেল না, বাধ্য হয়ে এখানেই থাকতে হচ্ছে। একটু দূর হয় বটে কলেজটা
কিন্তু থাকার ব্যবস্থা ভালো, খাবারদাবারও
ভালোই দেয়। ওর বন্ধুরা অন্যত্র এই টাকায় যেভাবে থাকে তার থেকে ও অনেক ভালো আছে।
পিয়ালীর সঙ্গে আরো একটি মেয়ে থাকে, গার্গী, সেও নতুন কলেজে ঢুকেছে। স্বপন ধর আর তাঁর স্ত্রী
মীনাক্ষী মানুষ ভালো, পেয়িং গেস্টদের যত্নেই
রাখেন। কিন্তু এত ভালোর মধ্যেও একটু অসুবিধে আছে। সেটার কারণ স্বপনের আশীতিপর মা
সুরবালা দেবী। তাঁর কারণে শুধু যে পিয়ালী, গার্গী
বিরক্ত তা নয়,
স্বপন, মীনাক্ষী, তাঁদের
স্কুল পড়ুয়া মেয়ে রিনি এমন কী দুজন গৃহ পরিচারিকা কমলা আর ভবানীও তিতি বিরক্ত হয়ে
যায়। সুরবালার বয়স আশী পেরোল কী হবে, তিনি
এখনও যথেষ্ট ফিট। খটখট করে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, একতলা, দোতলা
করছে, তিনতলায় ঠাকুরঘরে পুজো করতে যাচ্ছেন। সরু পাড় সাদা কাপড়
পরা, মাথার পেছনে ডালের বড়ির মতো একটা খোঁপা বাঁধা, সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা আর হাতে জপের মালার পুঁটলি
নেওয়া এই মহিলার সামনে পড়লেই পিয়ালীরা দুই বন্ধু আঁতকে ওঠে।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে সুরবালার কড়া নজর। এতটাই যে
সেটা প্রায় বাতিকের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। ঘরের মেঝেতে এক টুকরো কাগজ পড়ে থাকলেও
তাঁর মনে হয় ঘরটা ডাস্টবিনের সমতুল্য হয়ে গেছে। অতএব সকালবেলা পুজো শেষ হবার পর
তাঁর প্রধাণ কাজই হচ্ছে ঘুরে ঘুরে সারা বাড়ি পরিদর্শন করা। একটু এদিক ওদিক কিছু
দেখলেই খ্যানখ্যানে গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন, “চতুর্দিকে
আবর্জনা, বাড়ি তো নয়, যেন
ডাস্টবিন!”
দিনের মধ্যে অন্তত বার কয়েক তিনি এরকম “ডাস্টবিন,ডাস্টবিন” বলে চেঁচান। পিয়ালী যেদিন এখানে প্রথম এসেছিল, তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছিল। ও ওর জিনিসপত্র, বই, খাতা
বার করে রাখছিল এমন সময় আচমকা “ডাস্টবিন,ডাস্টবিন!” এতটাই
চমকে গেছিল ও যে হাত থেকে বইই পড়ে গেছিল। এখন অবশ্য এতে অভ্যস্ত। সুরবালার চেঁচানি
শুরু হলে ও আর গার্গী হাসে।
এদিকে কমলা গজগজ করে, “তোমরা
হাসছ আর এদিকে ঠাকুমা আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে! কতবার যে বাড়িঘর ঝাঁট দেব!”
নীচের তলার একপাশে ভাড়াটে আছে। তারা সামনের এক চিলতে জায়গাটা নোংরা
করে রাখে। এ নিয়ে নিত্য অশান্তি।
কমলা ওখানে একটা ঢাকাওয়ালা বিন বসিয়ে বলল, “এই দেখো ঠাকুমা ডাস্টবিন বসিয়ে দিয়েছি। কাকু ভাড়াটেদের
বলে দিয়েছে সব নোংরা এর মধ্যে ফেলতে। তুমি আর চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে না বলে
দিচ্ছি। দেখো কী সুন্দর লাল টুকটুকে ডাস্টবিন।”
ঠাকুমা নাক সিঁটকে বললেন, “ডাস্টবিন
বসিয়ে আর কী হবে মা? গোটা বাড়িটাকেই তো তোমরা
ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছ! আর এত আহ্লাদেরই বা কী আছে? লাল টুকটুকে হোক আর যাই হোক ডাস্টবিনই তো! ভেতর তো নোংরায় ভর্তি।
ডাস্টবিনের আবার লাল টুকটুকে!”
কমলা আরো রেগে গেল, বলল, “সে যাই হোক, তুমি
তো আর দেখতে পাচ্ছ না ভেতরে কী আছে। সক্কালবেলা ডাস্টবিন ডাস্টবিন করে চেঁচিয়ে
আমার মেজাজ খারাপ করবে না বলে দিচ্ছি। কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যাব, তখন বুঝবে ঠ্যালা!”
শেষ পর্যন্ত বোধহয় কমলার শাসানিতেই সুরবালা চুপ করেন। “স্পেশিমেন বটে একখানা ঠাকুমা! উফ! এই বয়েসেও এত
চেঁচামিচি করার এনার্জি যে কী করে পায় জানি না। আমি একবার আমার বন্ধুদের বলেছিলাম
ঠাকুমার কথা,
সবাই তো শুনে হাঁ,” গার্গী বলল।
পিয়ালী ব্যাগ গুছোচ্ছিল, তিন
দিনের ছুটি আছে,
বাড়ি যাবে, বলল, “আমার
বন্ধুরাও ঠাকুমার গল্প শোনার জন্যে ব্যস্ত। যাক বাড়ি যাচ্ছি, এই ক’দিন
অন্তত আর ‘ডাস্টবিন,ডাস্টবিন’ শুনতে হবে না। চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে মালা জপতে জপতে
বুড়ি কীরকম তাকায় দেখেছিস? মনে হয় যেন ভস্ম করে দেবে!
কী জপ করে বল তো সারাদিন? ডাস্টবিন, ডাস্টবিন?”
দুই বন্ধুতে হেসে উঠল।
পিয়ালীর ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছিল, ও ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে, “চলি
রে” বলে বেরিয়ে গেল।
“আমিও
যাব, লাইব্রেরিতে কাজ আছে, সেটা সেরেই বেরিয়ে যাব। ততক্ষণ ঠাকুমার সামনে না পড়লেই হল,” বলল গার্গী।
ছুটি পেলেই পিয়ালী বাড়ি ছোটে, সে
একদিনের জন্যে হলেও। বাড়ির আকর্ষণ পিয়ালীর কাছে এখনও এতটুকু কমে নি। ব্যারাকপুরে
পিয়ালীদের পুরোনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হয়েছে। পিয়ালীর বাবার সব ভাই বোনেদেরই সেখানে
ফ্ল্যাট আছে। শুধু তিন পিসি ছাড়া আর সবাই থাকেনও ওখানে। কাজেই অনেকে মিলে জমজমাট
ব্যাপার। তাছাড়া ছোটো কাকার নতুন বিয়ে হয়েছে। ছোটো কাকা ভাইবোনেদের মধ্যে সবচেয়ে
ছোটো, বরাবরই ভাইপো ভাইঝিদের খুব প্রিয়। ছোটো কাকীমাও
অল্পদিনের মধ্যেই এদের বন্ধু হয়ে গেছে।
বাড়ি ফিরে ব্যাগ রেখেই পিয়ালী দৌড়ল মেজ জেঠুর ফ্ল্যাটে, মিমিদির সঙ্গে দেখা করতে। মিমি পিয়ালীর থেকে পাঁচ বছরের
বড়ো, জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। হাঁটুর তলা থেকে পাদুটো
এতই সরু, এতই লিকলিকে যে দেহের ভার বহন করতে তা সম্পূর্ণ অক্ষম।
চলাফেরা করতে তাই হুইলচেয়ারই ভরসা। কিন্তু মিমির মানসিক কোনো জড়তা নেই, মনের দিক থেকে সে আর পাঁচটা মানুষের মতোই সুস্থ। নিজের
আগ্রহে, বাবা মা আর সকলের উদ্যমে সে পড়াশোনাও করেছে। তবে তার
সবচেয়ে ভালো লাগার জিনিস হচ্ছে ছবি আঁকা। ছবি আঁকতে ভালোবাসে, আঁকেও খুব ভালো। যেহেতু তার বাইরে বেরোন কম, তাই বাড়ির সবাই তাকে যথাসাধ্য সঙ্গ দিতে চেষ্টা করে।
বিশেষত পিয়ালী তো মিমির প্রিয় বন্ধুই বলা যায়। পিয়ালী পড়াশোনার জন্যে কলকাতায় থাকা
শুরু করলে তার অভাব ছোটো কাকীমা অনেকটাই পূরণ করেছে।
“কী রে
তোর ঠাকুমা কেমন আছে?” পিয়ালী
ঘরে ঢুকতেই মিমির জিজ্ঞাসা।
“আমি
কোথায় ভাবলাম ক’দিন ঠাকুমার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচি আর তুই ঢুকতে না
ঢুকতেই ঠাকুমার নাম করছিস মিমিদি!” বলল
পিয়ালী।
“যাঃ
ওরকম বলতে নেই। আমাদের ঠাকুমা তো সেই কবেই মারা গেছেন, আমরা ছোটো থাকতেই, ভালো
করে মনেই পড়ে না। তুই তো তবু আরেকজন ঠাকুমা পেয়েছিস। আমার তো তোকে হিংসে হয় পিয়া।”
“তাই
বুঝি? চল তোকে নিয়ে যাই। একবার সামনেসামনি দেখলেই এত ভালোবাসা
চটকে যাবে বুঝলি! আমার তো মনে হয় আমি ঘুমের মধ্যেও শুনি ডাস্টবিন, ডাস্টবিন!”
“হ্যাঁরে, বুড়ির এখনও এত ক্ষমতা? সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে চেঁচামেচি করে না তোরা অল্পেই অস্থির হোস?” পিয়ালী মেজ জেঠিমা জিজ্ঞেস করলেন।
“না গো
ঠাকুমা সাংঘাতিক স্ট্রং। চারবার ওপর নীচ করলে তোমাদের হাঁটু ব্যথা করবে, কিন্তু ঠাকুমার চারবার কেন চল্লিশবার করলেও কিছু হবে
না। ঘুম থেকে উঠে সোজা তিনতলায় যায় পুজো করতে। সেখান থেকে নেমে জলখাবার খেয়ে
একতলায় যায়। সেখানে একপ্রস্থ চেঁচামিচির পর আবার দোতলায় আসে। দতলায় চেঁচামিচি
মিটলে তিনি ডাইনিং স্পেসে বসে চারদিকে নজর রাখেন। কোনো কাজকর্ম নেই, সারাদিন এই করছে। কখন যে টুক করে একতলায় নেমে যাচ্ছে কী
তিনতলায় উঠে যাচ্ছে কেউ বুঝতে পারে না। বোঝে যখন ঠাকুমা চেঁচাতে শুরু করে।”
“যাই
বলো, তোমার ঠাকুমা কিন্তু দর্শনীয় পিয়া। একদিন বরং এখানে
নেমতন্ন করে নিয়ে আসতে পারো, আমরাও
আলাপ করি,”
পিয়ালীর ছোটো কাকীমা বলল। পিয়ালীর
আসার খবর পেয়ে সেও চলে এসে আড্ডায় যোগ দিতে।
“রক্ষে
করো! ঠাকুমাকে দেখো নি তাই বলছ, দেখলে
আর দ্বিতীয়বার সামনে পড়তে চাইতে না। আমরা তো ঘুম থেকে উঠেই ভগবানকে ডাকি কলেজ
যাবার আগে যেন ঠাকুমার সামনে পড়তে না হয়! ঠাকুমার নিজের নাতনি কী বলে জানো? বলে, ‘ঠাকুমার
নাম সুরবালা কিন্তু ঠাকুমা সব সময়ে বেসুরে বাজে!’ তাহলেই বোঝো!” পিয়ালী
হেসে উঠল।
“বলা
যায় না, আমাদের ছোটো কাকীমাকে দেখলে হয়তো ঠাকুমা সুরে বাজবে। এত
সুন্দর মুখের সামনেও কী আর ওরকম চেঁচাবে?” বলল
মিমি।
ছোটো কাকীমা ওর থেকে বেশী বড়ো নয়, নামেই কাকীমা, তাই এ
ধরণের কথাবার্তা অনায়াসে চলে।
“আহ
মিমি, খুব পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছ দেখছি! আমি কাকীমা হই
তোমাদের,” কপট রাগ দেখাল ছোটো কাকীমা।
“কিন্তু
শুনতে যে বেশ ভালো লাগছে সেটা তো অন্তত স্বীকার করো বাবা। মিছিমিছি আর রাগ দেখাতে
হবে না!” পিয়ালী হেসেই গড়িয়ে পড়ে।
এবার ছোটো কাকীমাও হেসে ফেলে। এদের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না, খুব ফাজিল এরা দুই বোন।
“যতই
ঠাট্টা ইয়ার্কি করো, ছোটো কাকীমা যে শুধু দেখতে
ভালো নয়, মেয়েটাও কত ভালো সেটাও বলো। মিমিকে কত সঙ্গ দেয়, কত গল্প করে ওর সঙ্গে,” মেজ জেঠিমা বললেন।
“তুই
যবে থেকে কলকাতায় থাকবি ঠিক করলি আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল রে পিয়া। খালি ভাবতাম
তোর মতো এত গল্প আমার সঙ্গে আর কে করবে! কিন্তু ছোটো কাকীমা কিছু বুঝতেই দিল না,” গাঢ় স্বরে বলল মিমি। আড্ডা জমে ওঠে, বিষয়
থেকে বিষয়ান্তরে গড়ায়।
তিনদিন যেন হুস করে কেটে গেল। পিয়ালী আবার যাদবপুরে ফিরে গেল। আবার
কলেজ, আবার পড়া, ঠাকুমার
চেঁচানি, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্পগুজব – সবই যথা নিয়মে চলতে লাগল। কিন্তু নিয়মের মাঝেই বেনিয়ম
অপেক্ষা করছিল। আপাত নিস্তরঙ্গ জীবনের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল উত্তাল তরঙ্গ। কিছুদিন
ধরেই শুনছিল মিমির শরীর ভালো যাচ্ছে না, খালি
জ্বর হচ্ছে,
সারতেই চাইছে না। হঠাৎ একদিন মার
ফোনে শুনল নানা পরীক্ষার পর ধরা পড়েছে ব্লাড ক্যানসার, নার্সিং হোমে ভর্তি মিমি। স্তব্ধ হয়ে গেল পিয়ালী।
মিমিদির ব্লাড ক্যান্সার! ওই হাসিখুশী মেয়েটার ভেতরে লুকিয়েছিল ওই মারণ রোগ! এক
ছুটে মিমির কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছিল পিয়ালীর। কিন্তু তখন স্টাডি লিভ পড়ব পড়ব
করছে। পরপর দুদিন দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্র্যাক্টিকাল আছে, কামাই করে যাবে না, তার
ওপর টিউশন। তাও পরের পরের দিন প্রাক্টিকাল শেষ করেই পিয়ালী বাড়ির দিকে রওনা দিল।
কিন্তু গিয়ে আর দেখা হল না মিমির সঙ্গে। তার কিছুক্ষণ আগেই সে চলে গেছে। হঠাৎ ধরা
পড়ল রোগ, হঠাৎই চলেও যাওয়া। কিছু করার কোনো সুযোগই দিল না।
নার্সিং হোমে গিয়ে দেখল শুয়ে আছে মিমি, শান্ত মুখ, কোনো
কষ্টের ছাপ নেই। পিয়ালী কাছে গিয়ে দাঁড়াল, “আর
একটুও অপেক্ষা করতে পারলি না মিমিদি? এত
তাড়া ছিল তোর?
আমাকে যে সারা জীবন আক্ষেপ করতে হবে!”
স্বাভাবিকভাবেই পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মেজ জেঠু, জেঠিমার একমাত্র সন্তান ছিল মিমি। হুইল চেয়ার নির্ভরতা
ছাড়া তার আর কোনো আস্বাভাবিকতা ছিল না। উপরন্তু তার উচ্ছল, হাসিখুশীর স্বভাবের জন্যে সে সবার অত্যন্ত প্রিয় ছিল।
ছোটো কাকীমাও খুব ভেঙে পড়েছে। পিয়ালীর অনুপস্থিতিতে সেই মিমির বন্ধু হয়ে উঠেছিল।
স্টাডি লিভ পড়ে গেলে পিয়ালী বাড়ি ফিরে এল। মাঝে মাঝে কলকাতায় যেত।
নেহাত পরীক্ষা সামনে, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে
হচ্ছে তাই রক্ষে। নইলে যেন বাড়িতে টেঁকাই মুশকিল হচ্ছে, মিমি নেই যে। ছোটো কাকীমারাও কলকাতায় চলে গেছে। কাকুর
যাতায়াত করতে অসুবিধে হচ্ছিল, রোজ
অনেক রাত হয়ে যাচ্ছিল ফিরতে ফিরতে। তারপর শোক এখনও কেউই কাটিয়ে উঠতে পারে নি। সব
মিলিয়ে এক বিষণ্ণ পরিবেশ। স্টাডি লিভ চলাকালীনই যাদবপুর থেকে ফোন এল মীনাক্ষীর।
সুরবালাও আর নেই। সেও হঠাৎ করেই। একদিন পুজো সেরে তিনতলা থেকে একতলায় নেমেছেন, কমলার সঙ্গে যথারীতি খিটিরমিটিরও করেছেন। তারপর জলখাবার
খেয়ে বলেছে শরীরটা ঠিক সুবিধের লাগছে না। প্রথমে কেউ কিছু বুঝতে পারে নি, বরং
স্বপন বলেছেন,
“শরীরের আর দোষ কী! রোজ রোজ
এত চিৎকার চেঁচামেচি! বয়সটা তো ভালোই হয়েছে নাকি!”
এরপরই সুরবালাকে শুয়ে পড়তে দেখে সন্দেহ হয়। ডাক্তারও ডাকা হয়।
কিন্তু তিনি এসে পৌঁছবার আগেই সব শেষ। বোধহয় ছেলের কথায় টনক নড়েছিল। বয়সটা অনেক
হয়ে গেছে সে খেয়াল হতেই কাউকে কিচ্ছু বুঝতে না দিয়ে দিব্যি খটখটিয়ে চলে গেলেন। ঠিক
যেরকমভাবে রোজ একতলা তিনতলা করে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন।
এত কম সময়ের ব্যব্ধানে দু দুটো মৃত্যু। মিমি তো অকালেই চলে গেছে।
ঠাকুমার যাওয়া সময়োচিত হলেও পিয়ালীর খারাপই লাগল। মনে হল বাড়িটা এবার নিস্তব্ধ হয়ে
যাবে।
পরীক্ষা হয়ে গেল, ছুটি
ফুরিয়ে গেল,
আবার ক্লাসও শুরু। পিয়ালীও আবার
যাদবপুরে। পরীক্ষার সময় এখানে ছিল ঠিকই কিন্তু তখন অতটা খেয়াল করে নি, এখন মনে হল সত্যিই বাড়িটা যেন বড়ো বেশী চুপচাপ। যখন তখন
সবাইকে চমকে দিয়ে খ্যানখ্যানে গলায় কেউ চেঁচিয়ে উঠছে না তার উপস্থিতি প্রবলভাবে
জানান দিয়ে। শুধু ডাইনিং স্পেসের দেওয়ালে ফ্রেম বন্দী সুরবালা সেইরকমই তীব্র
দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
সেদিন কলেজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছিল। দুপুরবেলাই দুই বন্ধু বাড়ি ফিরে
এসেছিল।
হঠাৎ গার্গী বলল, “খবরের
কাগজের সঙ্গে লিফলেট দিয়েছিল, সকালে
দেখছিলাম। কতগুলো বুটিক একসঙ্গে একটা এক্সিবিশন করছে। গত কাল থেকে শুরু হয়েছে। চল, ঘুরে আসি।”
গেল বিকেলে দুই বন্ধুতে এক্সিবিশন দেখতে। এ স্টল ও স্টল ঘুরতে
ঘুরতে হঠাৎ একটা স্টলে দেখল ছোটো কাকীমাকে। শিল্পী বুটিক। না এক্সিবিশন দেখতে নয়, বরং বুটিকের জিনিস অন্যদের দেখাতে ব্যস্ত।
পিয়ালী আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে গেল, “ছোটো
কাকীমা, তুমি এখানে! এই বুটিকে!”
ছোটো কাকীমা যেন একটু চমকাল, কিন্তু
সঙ্গে সঙ্গেই সামলে নিয়ে বলল, “ওমা
পিয়া! ঘুরতে এসেছ?”
“হ্যাঁ, কিন্তু তুমি এখানে! এটা তোমার বুটিক?”
“আমি
আর আমার এক বন্ধু মিলে খুলেছি।”
“বলো
নি তো কখনো। মাও তো জানে বলে মনে হয় না,” পিয়ালী
তখনো আশ্চর্য।
“না
বলি নি। নতুন খুলেছি, দেখি কীরকম চলে। তাছাড়া
ওখানকার পরিবেশও ঠিক উপযুক্ত নয় এখন। তুমি দেখো, আমি আসছি একটু।”
ছোটো কাকীমা পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ছোটো কাকীমাকে কীরকম অন্যরকম লাগল
পিয়ালীর। এ যেন সেই ছোট কাকীমা নয় যাকে ও চিনত। যাই হোক অপ্রস্তুত অবস্থা কাটাতে ও
বুটিকের জিনিসপত্র দেখতে লাগল। হঠাৎ ওকটা শাড়িতে চোখ আটকে গেল। শাড়িটা যেন ওর খুব
চেনা মনে হল। ভালো করে দেখতেই মনের মধ্যে টুকরো টুকরো কতগুলো ছবি ভেসে উঠল।
মিমি একমনে একটা ডিপ নীল রঙের সিল্কের শাড়ির ওপর ফেব্রিক করছে।
নীলের ওপর কমলা ঠোঁটে পদ্মকলি ধরা ধবধবে সাদা রাজহাঁসগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে
মিমির তুলির টানে। পিয়ালী চুপিচুপি ঘরে ঢুকে এসেছিল, মিমি বুঝতেও পারে নি। পিয়ালী মুগ্ধতা মাখানো ‘বাহ!’ শুনে
চমকে উঠেছিল। বলেছিল, “এই
পিয়া, তুই না বলে এ ঘরে ঢুকেছিস কেন রে? যা , যা, এখন এখান থেকে যা। এখন কিচ্ছু দেখতে পাবি না, দেখলেও ভুলে যা!”
মিমিকে যে সব সময় দেখাশোনা করত সেই রীতামাসি পাশেই দাঁড়িয়ে, মুখ টিপে হাসছে দু বোনের কাণ্ড দেখে।
মিমি চলে যাবার কয়েকদিন পরে এই রীতামাসিরই গজগজানি, “কেমন সব লোক এসেছিল বাপু সেদিন! মেয়েটা চলে গেল তার
জন্যে শোক নেই,
শাড়িদুটো চুরি করে নিয়ে গেল! কত
যত্ন করে করেছিল মিমি মা আর বোনের জন্যে, বলত, ‘এখন কাউকে দেখাবেও না, বলবেও না মা। আমি আগে দুটো শেষ করি।’ শেষ করেই তো বেচারী জ্বরে পড়ল, আর
উঠল না। শাড়িদুটো নিতে বাধল না একটু!”
কথাগুলো কানে এসেছিল পিয়ালীরও, কিন্তু
তখন সেদিকে মন দেবার মতো অবস্থা ছিল না। এখন সব বুঝতে পারছে। তার মানে ছোটো কাকীমা? যে মিমিদের বন্ধুর মতো হয়েগেছিল? সুন্দর তার মানে শুধু মুখটাই? নাকি মুখই নয় আদৌ, সুন্দর
একটা মুখোশ! পিয়ালীর মনে হল তার কানের কাছে খ্যানখ্যানে গলায় কে যেন বলে উঠল, “ডাস্টবিন, ডাস্টবিন!”