গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

শৌনক দত্ত


সন্ন্যাস ভুগোল (৫ম পর্ব)

দত্তবাড়ীর গদিঘরে আজ কথার ঝড় উঠেছে মতিবাবু, কুল পুরোহিত,বীরু ডাক্তার আর আমির আলী খান পাঠানের মাঝে তুমুল আলোচনা চলছে সকাল থেকে। নরেন্দ্র বাবু ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে আলোচনায় যোগ দেন   তবে কান খাঁড়া করে তিনি সব শুনছেন  এক খরিদদার কিরণবালার খোঁজ করে তার মৃত্যুসংবাদ শুনে বিগত  দিনগুলোয় গদির সবাইকে প্রসাদ খাওয়ানোর স্মৃতি মন্থনের সুত্র ধরেই আলোচনা শুরু টুকটাক কথা তার পিঠে কথা বাড়তে বাড়তে কখন যে ইতিহাস জুড়ে বসেছে কেউ খেয়াল করেনি।অনেক কথার ভিড়ে নরেন্দ্রবাবু যখন বললেন 'ইতিহাসে পাওয়া যায় আর্যবর্ত থেকে বঙ্গদেশ এক হাজার বছর আলাদা ছিলো তাছাড়া সেই সময় মঙ্গোলীয় রক্তের মিশ্রন ঘটে এই বঙ্গদেশে এবং তখন চীনা,তিব্বতীয় ও  মঙ্গোলীয়রা প্রাগেজ্যোতিষপুর ও বঙ্গভূমির সাধারণ মানুষের সাথে মিশে প্রথমে বৌদ্ধ, পরে হিন্দু হয়ে থাকত মঙ্গোলীয়দের বলা হত কিরাত আর তাদের সন্তানসন্ততিই  পরে আখ্যা পায় কৈবর্ত বলে তবে এই কৈবর্ত কারা ?' মতিলালবাবু বেশ অনেকক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলেন তিনি নরেন্দ্রবাবুর কথার রেশ টেনে নিয়ে বললেন  'নরেন্দ্রবাবু, মহাভারতে বর্নিত  কিরাত-অর্জুন যুদ্ধের কথা পাওয়া যায় তবে নদীমাতৃক বাংলায় কাজকর্ম বলতে ছিল চাষবাস আর নদীতে মাছ ধরা সেই অনুযায়ী বোধ করি যারা হালচাষ করত তাদের নাম দেওয়া হলো কৈবর্ত, যারা মাছ ধরত তারা হল জেলে কৈবর্ত   নদীতে নৌকা নিয়ে এরা মাছ ধরতে যেত বলে এদের জাতের নাম হয়ে গেল মাল্লা অপভ্রংশে মালো   তবে বৌদ্ধ থেকে হিন্দু হওয়ার সময় এদের মধ্যে যারা একটু উন্নতি করলো,সেই সম্প্রদায়কে বলা হতে লাগলো নমশূদ্র মানে নামেই শূদ্র, বাকীরা চন্ডাল   সমাজের মাথারা যাদের অস্পৃশ্যই করে রেখেছিলো বৌদ্ধ থেকে হিন্দু হওয়ার সময় মানে বীরু ডাক্তারের প্রশ্নে মতিবাবু একটু থামলেন কর্তাবাবুর মুখে এতক্ষণ কুলীন ব্রাক্ষ্মণ,কুলীন কায়স্থ আর শাস্ত্রের খৈ ফুটছিলো।মতিবাবুর এই কথায় তিনিও বেশ কৌতুহল ভরে জিজ্ঞাসা করলেন এ কি বলছেন মতিবাবু বৌদ্ধ থেকে হিন্দু হয় কি করে আবার।মতিবাবু স্মিত হাসলেন। তারপর একটা পান সাজিয়ে মুখে দিয়ে বললেন কেন ভাই এটা কি আপনারা জানেন না যে  'শঙ্করাচার্য বা তার অনুগামীরা যখন অন্যান্যদের বোঝালেন যে গৌতম বুদ্ধ হিন্দু ভগবানেরই এক রূপ, উনি নতুন কিছু বলেননি,অহিংসা ফহিংসা সব উপনিষদে লেখা আছে তাই তোমরা নিজেদের বৌদ্ধ বৌদ্ধ বলে জাহির করো না, তোমরা আর আমরা একই, তখন সকলকেই হিন্দু করে নেয়ার একটা প্রবণতা দেখা দিল  যারা একটু একটু বুঝল তারা হয়ে গেলো শূদ্র আর যারা নিরক্ষর হওয়ায় কিছুই বুঝল না,তারা হয়ে গেল নমশূদ্র বা চন্ডাল '

নরেন্দ্র বাবু খরিদ্দারের কাছ থেকে টাকা নিতে নিতে প্রশ্ন করলেন, এসব কোন সময় ঘটেছে মতিবাবু উপেনবাবুকে এক গ্লাস জল দিতে বলে আবার কথায় ঢুকে গেলেন। ঠিকঠাক বলা মুশকিল দত্ত বাবু তবে বঙ্গদেশের পশ্চিমভাগে এসব ঘটেছে আনুমানিক গুপ্তরাজা সমুদ্রগুপ্তের আমলে বা তার কিছু পরে।তার আগে অবধি এখানে বৌদ্ধ  মতাবলম্বীদেরই বাসের প্রমাণ মেলে  পূর্বদিকে বোধ হয় আরো বেশি সময় চলেছিলো সম্ভবত পালরাজাদের আমল পর্যন্ত আপনারা তো জানেনই পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন পালদের প্রভাব কমে সেন বংশীয় রাজশাসনের প্রভাব বাড়তে থাকে যখন তখনই বর্ণহিন্দুদের প্রভাবে কিংবা অত্যাচারে বৌদ্ধধর্মেরও দাপট কমতে থাকে   তবে মুসলমান কবে এলো ? বীরু ডাক্তারের প্রশ্নে মতিবাবু থামলেন  কাঁসার গ্লাসটা হাতে ধরে বলেন এটা বোধ করি আমীর আলী সাহেব ভাল বলতে পারবেন আমীর আলী একটু হাসলেন,আপনার মতো তো মতিবাবু এত বিস্তৃত পড়াশোনা আমার নেই তবে যতটুকু  জানি তাতে বোধ করি খ্রীষ্টীয় দশম ও একাদশ শতাব্দীতে নীচবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচার খুব বেড়ে যায়, সম্ভবত এরাই সেই কৈর্বত- নমশূদ্র সম্প্রদায় তখন পশ্চিম এশিয়া থেকে সেই সময়ে বঙ্গভূমির পূর্বাঞ্চলে এসে হাজির হয় সুফি সাধকের একটি দল তারাই এই অঞ্চলের নিপীড়িত মানুষদের শোনায় নতুন আশার বাণী তাদের এই বাণী তখন নির্যাতিত কৈর্বত নমশূদ্র ও বৌদ্ধদের কাছে মনে হয় পরিত্রাণের পথ আর তাই রাতারাতি দলে দলে মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে  -আপনারা কি তখনই এসেছেন পাঠান সাহেব ? -না,পুরোহিত কর্তা আমরা এসেছি আরো পরে   সকালের সূর্য দুপুরের দিকে গড়াচ্ছে দেখে আলোচনা ক্ষ্যান্ত দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বীরু ডাক্তার ও মতিলাল বাবু মন না চাইলেও বিজয় কর্তা ও উঠে পরলেন।এক এক করে সবাই বেরিয়ে গেলো।দুপুরের নির্জনতা গদি ঘরেও

সন্ধ্যার কিছু আগে পশ্চিমের আকাশে গাঢ় লালে মেঘের চিত্রাবলি  মধুবাবা ধূনির পাশে বসে পড়ছেন। চ্যালারা সন্ধ্যারতির আয়োজনে ব্যস্ত। ভক্তদের কেউ এখনো আসেনি।ধূনির আঁচে চায়ের জল ফুটতে শুরু করলে মধুবাবা বই থেকে চোখ ফিরিয়ে ফুটন্ত জলে কিছু চা পাতা আর চিনি ছেড়ে দিয়ে গ্লাসে গুলমরিচ গুড়া আর বিটলবণ ছড়িয়ে লিকার ঢালেন   মধুবাবার এই চা সবার খুব প্রিয়  প্রথাগত লিকার চা থেকে এর স্বাদ ও খাদ্যগুণ আলাদা চ্যালাদের চায়েরগ্লাস দিয়ে নিজে কিছুটা চা গ্লাস থেকে একটা বাটিতে ঢেলে চুমুক দিতে দিতে মধুবাবা আবার পড়ায় ডুবে গেলেন   ভক্তরা আসতে শুরু করেছে।

সুভাষের পড়াশোনায় একদম মন নেই   স্কুল পালিয়ে  বন্ধুবান্ধব  নিয়ে  সে  শ্মশানে  গিয়ে  বসে থাকে এই  খবরটা  বেশ  কয়েকদিন  নরেন্দ্রবাবু  শুনেছেন কাউকে  কিছু বুঝতে  দেননি, সময়ের  প্রতীক্ষায়  আছেন   খবরটা  শোনার পর  থেকে  প্রায়ই  ওদের  স্কুল  শুরুর  পর  নরেন্দ্রবাবু  গদি থেকে  বেরিয়ে  স্কুলে  গিয়ে  খোঁজ  নিয়ে  আসেন আজ খোঁজ  নিতে  এসে  শুনলেন  টিফিন  ঘন্টার  পর  থেকে  সুভাষকে  পাওয়া  যাচ্ছেনা   খবরটা  শুনেই  তিনি  হাঁটতে  লাগলেন  শ্মশানের পথে রাস্তায়  সে  জিজ্ঞাসা  করে  বাবু কোথায়  যাচ্ছেন ? নরেন্দ্রবাবু  স্মিত হেসে  উত্তর  দেন  এই  তো  সামনে   দুপুরের  নির্জনতা  আর  শুনশান  শ্মশানে  এসে  যখন  নরেন্দ্রবাবু  পৌঁচ্ছালেন, পাশের  লাশকাটা  ঘর থেকে  তখন  মাতাল  রাজার  মাতাল  কন্ঠে  গান  ভেসে  আসছে । শ্মশানের  চারপাশটা  দেখলেন  নরেন্দ্রবাবু  সুভাষ কে  দেখতে  পেলেন না কোত্থাও মনের  ভেতরটা  নিজের অজান্তেই  হু হু  করে  উঠলো  সুভাষ  কি  তবে  রাজার সাথে ? ভাবনটা কে  নিজে  নিজেই  উড়িয়ে  দিলেন ন রেন্দ্রবাবু   মনকে  বোঝালেন  তার  সুভাষ  এই  বয়সে  এতটা  নীচে নামতে  পারে না   হাঁটতে  হাঁটতে  লাশকাটা  ঘরের  কাছে  এসেও  ঘুরে  দাঁড়ালেন  নরেন্দ্রবাবু  আর  তখনই  উনার চোখ পড়লো  মগড়া  নদীর পাড়ে ঢালু  পাড়ের ঘাসে  একটি ছেলে  আকাশের  দিকে মুখ করে  শুয়ে আছে দূর  থেকে  নরেন্দ্রবাবু  স্পষ্ট  বুঝতে  না  পারলেও  উনার  মনে হলো এই ছেলে তার সুভাষ ছাড়া কেউ ।

(আগামী সংখ্যায় শেষ পর্ব)

...