গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

মনোজিৎ কুমার দাস


অনন্ত প্রতীক্ষা


       শহর থেকে দূরের এক অজপাড়া গ্রামের ছেলে পিয়াল। প্রাইমারী স্কুল পাশ করে গঞ্জের হাইস্কুলে ভর্তি হবার পর থেকেই পিয়ালের মনে ঢাকা শহরে যাওয়ার ইচ্ছেটা জাগতে থাকে।একমাত্র বোনের বিয়ে ঢাকা হওয়ায় পিয়ালের ইচ্ছেটা সত্যি সত্যি হতে দেরি হয় না । ঢাকা শহরের যাওয়া আসার মাঝ দিয়েই পিয়ালের মনে চাকরীবাকরী করে ঢাকা শহরে সুন্দর একটা সংসার পাতার ইচ্ছে তার মনের মধ্যে দানা বেঁধে উঠতে থাকে এক সময়।
      পিয়ালরা  দুভাই এক বোন  একমাত্র  বোন সোহা তার থেকে পাঁচ  বছরের বড়  ইন্টারমিডিয়েট  পাশ  করার  পর সোহার আরো  পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল।  দিনকাল  যা  পড়েছে  তাতে  পিয়ালের  বাবা  মা  তাদের  সোমত্ত  মেয়েকে লেখাপড়া  শেখাবার  জন্যে  শহরে  পাঠাতে  চায়নি

তার থেকে পাঁচ বছরের বড় বোনের পড়াশোনা বন্ধ হোক পিয়াল কখনোই প্রত্যাশা করেনি। সে ভাবতো বোনটা যদি তার চেয়ে ছোট হতো, আর সে যদি বোনের মতো বয়সী হতো তবে সে চাকরীবাকরী করে শহরে একটা বাসা নিয়ে বোনটাকে লেখাপড়া শেখাতো

  দিদির বিয়ের ব্যপারে বাবা মায়ের ইচ্ছেটাই সত্যি হলো পুরনো ঢাকার এক বনেদী পরিবারে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকুরে ছেলের সাথে সোহার বিয়ে ধুমধাম করে সুসম্পন্ন হলো। রাজন করিতকর্মা ছেলে রাজেনের বাবা মা সোহাকে তাদের পুত্রবধূ হিসাবে পছন্দ করতে দ্বিধা করেনি বোনের বিয়েতে পিয়ালের পুরোপুরি মত না থাকলেও ঢাকা শহরের বনেদী পরিবারের ভাল একটা ছেলের সাথে বোনের বিয়ে হওয়ায় শেষতক পিয়াল খুশি না হয়ে পারেনি

প্রথম থেকেই রাজন জামাইবাবুকে তার মনে ধরে বড় চাকুরে আর বনেদী ঘরের ছেলে হয়েও তার মনে কোনো রকম অহমিকা নেই। দিদির বিয়ের পর পরই পিয়ালের বার্ষিক পরীক্ষা, তাই দিদি জামাইবাবুর সাথে ঢাকা যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তা হয়ে উঠেনি বিয়ের পর রাজন জামাইবাবু দিদিকে জগন্নাথ কলেজে অনার্সে ভর্তি করে দেওয়ায় পিয়াল বেজায় খুশি হয়। পিয়ালের পরীক্ষার পর বড়দিনের ছুটিতে জামাইবাবু ও দিদি তাদের ওখানে বেড়াতে এলে পিয়ালের মনে আনন্দ আর ধরে না।

পিয়ালের মনে হয় তার দিদি এখনো কুসুমকে দুচোখে দেখতে পারে না কেন যে দিনি কুসুমকে পছন্দ করে না তা পিয়াল বুঝতে পারে না তাদের গ্রামের সরকাররা এক সময় বনেদী গৃহস্থ ছিল সে বাড়ির মেয়ে কুসুম

গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে কুসুম ও পিয়াল এক সাথেই পড়াশোনা করেছে। একই সাথে তারা দুজনই স্কুল ফাইনালও পাশ করেছে। প্রাইমারী স্কুলে পড়াশোনার কাল থেকে কুসুমের সাথে পিয়ালের ভাব। এখন পিয়াল আর কুসুম ছোটটি নেই। এখন কুসুম ইচ্ছে করলেই পিয়ালদের বাড়িতে আসতে পারে না। পিয়ালের মা কুসুমকে ছোটবেলা থেকেই স্নেহের চোখে আসছে। ছোটবেলায় কুসুম তাদের বাড়িতে না এলে পিয়ালের মা অস্থির হয়ে পড়তো। সে সময় থেকেই সোহা এটাকে ভাল চোখে দেখতো না। সে চায়নি তার মাযের স্নেহের ভাগ বসাক অন্য আর একটা মেয়ে । তাছাড়া গ্রামের দলাদলির কারণেও সোহা কুসুমকে ভাল চোখে দেখতো না বলে মনে করে পিয়াল।

 সোহার বিয়ের সময়  কুসুম  আর  পিযাল ক্লাস  এইটে পড়তো   সে সময থেকেই কুসুম ও পিয়ালের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক্ গাঢ় হয় তার আগে তারা এক সাথে ক্লাসমেটের মতোই পড়াশোনা করতো পিয়াল পড়াশোনায় বেশই ভাল পড়াশোনায় কুসুমও কিন্তু পিয়ালের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কুসুমের মায়াবী চোখদুটো পিয়ালের মনে ধরে। সত্যি কথা বলতে কী ক্লাস এইটের মাঝামাঝি সময় থেকে পিয়ালের মনের মধ্যে কুসুমের প্রতি কেন যেন এক ধরনের অব্যক্ত ভালোবাসার অনুরণন ঘটতে থাকে।
গ্রীষ্মের ছুটিতে কুসুম মামা বাড়ি যায়।  পিয়ালের মনটা উদাস উদাস লাগে। সে শূন্যতা অনুভব করে। সে সময় রাজন জামাইবাবুর বাবা তার ছেলের জন্যে সোহাদিকে দেখতে এসেছিলেন। সেদিন কেন সোহাদি কুসুমের কথা তার কাছে তুলেছিল তা পিয়াল বুঝে উঠতে পারে না। পিয়াল, কুসুম কোথায় রে? কয়দিন তো কুসুমকে দেখছি না।দিদি কথাটা তাকে বলে মায়ের দিকে তাকায়। কুসুমের খবর মাযের জানবার কথা নয়। গরমের ছুটিতে কুসুম মামা বাড়িতে গেছে , তা শুধুমাত্র পিয়ালই জানে। কেন যেন পিয়াল সেদিন কুসুমের খবর মা ও দিদিকে জানাতে লজ্জাবোধ করে। এক সময় পিয়াল ভাবে , সে এমনটাতো আগে কখনোই বোধ করেনি। তাদের সাথে যে কয়টি মেয়ে পড়াশোনা করে তাদের কথাবার্তা ও শরীর স্বাস্থ্যে পরিবর্ত্ন পিয়াল আগেই লক্ষ্য করেছে । পিয়াল নিজেও বুঝতেও পারে তার নিজের মন আর শরীর স্বাস্থ্যের বদল ঘটছে

এ্যানুয়াল পরীক্ষার আগে দিদির বিয়েতে ব্যস্ত থাকায় পিয়ালের পড়াশোনায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও সে বরাবরের মতো সেবারও প্রথম হয়। মেয়েদের মাঝে কুসুম প্রথম হওয়ায় পিয়ালের ভাল লাগে। ক্লাস নাইনে উঠে কুসুম মানবিক বিভাগে পড়তে চায়, পিয়ালের ইচ্ছেয় কুসুমকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে হয়।

স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার আগে কুসুমের ভাগ্যে দুর্যোগ নেমে আসে। সবল সুস্থ মানুষ কুসুমের বাবা। কখন যে তার শরীরে রোগ বাসা বেঁধে ছিল তা কেউ টের পায়নি। হঠাৎ একরাতে হার্ট্ অ্যাটাকে কুসুমের বাবা মারা যায়। ভাইবোনদের মাঝে কুসুমই বড় । কুসুমের মা চোঁখে আঁধার দেখে। বাড়ির সামান্য ভিটেমাটির আয়ের সাথে নিজের আয় ব্যয় মিলিয়ে কুসুমের বাবা সংসারটা চালাতো টেনেটুনে। বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় কুসুমের ভবিষ্যত আঁধারে ডুবে যায়। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার আগে কুসুমের বাবা মারা যাওয়ায় কুসুমকে সহানুভূতি জানানো ছাড়া পিয়ালের কিছু করার না থাকলেও সে কিন্তু পরীক্ষার বসবার জন্যে তাকে সাহস জোগায়।

পরীক্ষা দিয়ে পিয়াল ঢাকায় দিদির ওখানে যাওয়ায় বেশদিন কুসুমের সাথে তার দেখা নেই।  ঢাকা থেকে ফেরার পর সরকারদের পুকুর ঘাটে কুসুমের সাথে পিয়ালের দেখা। পিয়ালকে দেখে কুসুম কেঁদে ফেলে। কুসুমের জন্যে পিয়ালের কষ্ট লাগে। পিয়াল ভাবে, বিপদের দিনে কুসুমদের পাশে দাঁড়ানো তার উচিত ছিল । সে কুসুমের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সে  ভাবে, কী চেহারা হয়েছে কুসুমের ! এক সময় কুসুম পিয়ালের হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলে,“ কত স্বপ্ন , কত আশা ছিল পিয়াল। বাবার অকাল মৃত্যুতে আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।পিয়ালের মুখে কোন ভাষা নেই। আমি আশা করেছিলাম অন্য কেউ না আসলে তুই আমাদের বিপদে------পিয়ালের হাত ছেড়ে দিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে কুসুম বলল।
তুই আমাকে ক্ষমা করিস্ তোদের পাশে আমার দাঁড়ানো উচিত ছিল।পিয়াল জবাবে বলে। চোখের জল মুছে কুসুম মুচকি হেসে পিয়ালের দিকে তাকায়।
তুই এই কয়েকদিনে বড্ড রোগা হয়ে গেছিস, কুসুম!কুসুম পিয়ালের কথায় জবাব দেয় না।

তারপর দিনের পর দিন গড়িয়ে যায়। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পাশ করার পর  কুসুমের মা মেয়েকে  আর লেখাপড়া করাতে চায় না। মা তার মেয়ে কুসুমের বিয়ের কথা ভাবে। একদিন মা মেয়ের কাছে তার মনের কথা ব্যক্ত করে। মায়ের কথা শুনে কুসুম মাকে বলে,“ যে ভিটে বাড়িটুকু এখনো অবশিষ্ট আছে আমাকে বিয়ে দিতে তা শেষ হয়ে যাবে। জমিটুকু বিক্রি করে আমার বিয়ে দিলে তুমি ও ভাইবোনেরা কী খেয়ে বেঁচে থাকবে। আমি যদি তোমাদের ছেলে সন্তান হতাম তবে কি আমার বিয়ের জন্যে তোমাকে এমনটা ভাবতে হতো? আমি নিজেই সংসারের হাল ধরতাম।

পিয়াল ভাবতে পারেনি কুসুমের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। টাকা পয়সার অভাব থাকলেও বাড়ির ভাত খেয়ে গঞ্জের কলেজ থেকে কুসুম ইন্টারটা পাশ করতে পারবে। এমনটাই পিয়াল ভেবেছিল। কুসুম বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ওর মা পরিশেষে স্থির করে যত কষ্টই হোক ওর পড়াশোনাটা বন্ধ করা যাবে না। কলেজে ভর্তির ব্যাপারে মায়ের সিদ্ধান্তে কুসুম খুবই খুশি। এ খবরটা কুসুম পিয়ালকে না জানিয়ে থাকতে পারে না। এতে পিয়ালও খুশি হয়। কিন্তু তার সেই খুশি বেশি দিন স্থায়ী হয় না।

কুসুমের একমাত্র মামা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে । কুসুমের মামা তার মাকে চিঠি লিখে জানায় কুসুমের জন্যে সে একটা কাজের চেষ্টা করছে। ঢাকার আশেপাশে নতুন নতুন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী খুলছে। সে সহজেই কুসুমের একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে তাদের ফ্যাক্টরীর জেনারেল ম্যানেজারকে বলে।

দাদার চিঠি পেয়ে কুসুমের মা দ্বিধায় পড়ে। সোমত্ত মেয়েকে ঢাকার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করতে পাঠাতে তার মন সায় না দিলেও দাদার কথা ভেবে আশান্বিত হয়। সংসার চালাতে সে হিমশিম খাচ্ছে, তার উপর মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে তাকে আরো আর্থিক সংকট তো লেগেই আছে । এখন তো অনেক ছেলেমেয়েই তো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। মুন্সিপাড়ার শামীমের বোন লায়লা ক্লাস এইট পাশ করার আগেই ঢাকার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে আসছে। লায়লা কুসুমের সাথেই পড়তো। সে ভাবে, কুসুম তো অবুঝ মেয়ে না। ও যদি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করতে রাজি থাকে তবে দাদাকে কথা দিতে আমার কোন আপত্তি নেই। দেরি না করে মা কুসুমকে তার দাদার চিঠির বিষয়টা জানতে দেরি করে না।

কুসুম কখনো ভাবতেও পারেনি তাকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে চাকরী করতে ঢাকায় যেতে হবে। মা কুসুমকে বলে,“ বিষয়টা চিন্তা করে দেখ কী করবি, তোর মতে বাইরে আমি কিছু করতে চাই নে। কুসুম অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করে সে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করতে যাবে। তবে পিয়ালের কথা ভেবে তার মনটা অস্থির হয়। পিয়ালকে ঘিরে তার মনে একটা স্বপ্ন আছে, সেই স্বপ্নটা তার ভেঙে যাবে। তাদের পরিবারের দৈন্যদশা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে তাকে বাধ্য হয়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে চাকরী করতে ঢাকায় যেতে হয়।

ঢাকা যাওয়ার আগে কাচারী বাড়ির স্বর্ণচাপা গাছটার নিচে পিয়ালের সাথে কুসুমের দেখা হলেও সে পিয়ালকে কিছু বলতে পারে না। সে শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। পিয়াল কুসুমকে আশ্বাস দেয় ,“ তুই কাঁদিস না। আমি তোকে ভুলে যাব তুই ভাবলি কী করে ! তুই ঢাকায় থাকলেও আমি তোর সাথে যোগাযোগ রাখব।

পিয়াল সত্যি সত্যি কুসুমকে ভালো না বেসে থাকতে পারে না। সে নিয়মিত কুসুমের সাথে যোগাযোগ রাখে। ছুটিছাটায় কুসুম বাড়ি এলে পিয়ালের সাথে তার দেখা হয়। কিন্তু কুসুম ঢাকা যাবার পর প্রথম তার সঙ্গে পিয়ালের দেখা প্রায় আট মাস পরে। মাঝে দুবার কুসুম বাড়ি এলেও পিয়াল মামাবাড়ি থাকায় তার সাথে দেখা হয়নি। কুসুম সেবারও ভাবে, এবারও হয়তো পিয়ালের সাথে আমার দেখা হবে না। হঠাৎ করেই কুসুমের মনে পরে পুজোর মধ্যে তো পিয়ালের মামাবাড়ি থাকার কথা। লক্ষ্মীপুজোর আগে দিন সে বাড়ি ফিরবে, এমনটাই তো সে তাকে লিখেছিল। এবার সে পিয়ালের সাথে দেখা না করে ঢাকা ফিরবে না। সে তাদের ম্যানেজারকে অনুরোধ করে ছুটি বাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। লক্ষ্মীপুজোর দুদিন পরে তার ছুটি শেষ হবে। সে মনে স্বস্তি পায় ছুটিটা বাড়িয়ে না আনলে এবারও হয়তো পিয়ালের সাথে তার দেখা হতো না।

গতরাতে পিয়াল বাড়ি এসেছে জেনে কুসুম ভাবলো পিয়ালের সাথে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করার মানে হয় না। কুসুম তার মায়ের সাথে কথা বলে পিয়ালকে তাদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর দিন রাতে খাবার নিমন্ত্রণ করতে ভাইকে পাঠিয়ে মনে স্বস্তি পায়। কুসুমের মনটা আজ কেন যেন আনন্দে নেচে উঠে। প্রতিবারই তার মা লক্ষ্মীপুজোর আলপনা আঁকে। আর এবার কুসুম দুপুরের পর থেকেই নিজেই আলপনা আঁকতে শুরু করে আর গুনগুন করে গান গায়।

 আট মাসের মধ্যে  দুজনের চেহারা  শরীর  স্বাস্থ্যে ও কথাবার্তায় পরিবর্তন দেখে দুজনেই অবাক হয়। দীর্ঘদিন পরে পিয়াল কুসুমকে দেখে প্রায় যেন চিনতেই পারে না। বোশেখ মাসে কাচারী বাড়ির পুকুর ঘাটের পাশের স্বর্ণচাপা গাছের প্রস্ফুটিত স্বর্ণচাপার মতো গায়ের রঙ, ডাগর ডাগর দুটো চোখ, পুরুষ্ট শরীর স্বাস্থ্যের অধিকারী কুসুমকে দেখে পিয়ালের মনে হয় সত্যি সত্যি ও যেন প্রস্ফুটিত কুসুম। কুসুম, তুই এই কয়দিনের মাঝে এত বড় হয়ে গেছিস্!পিয়াল অবাক কন্ঠে কুসুমকে বলে।পিয়াল, তুই স্কুলে পড়া সেই ছোট্ট খোকাটিই রয়েছিস্, তাই না--- আয়নায় নিজেকে দেখি্‌স না বোধ হয়?” কুসুম কথা থামিয়ে একদৃষ্টে পিয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তুই আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখছিস্ এমন করে?” পিয়াল কুসুমকে জিজ্ঞেস করে।
কী দেখছি তুই নিজেরই আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করিস্, কচিখোকা আমার কিছুই বোঝে না!পিয়াল নিজেও বুঝতে পারে শুধুমাত্র কুসুমের শরীর স্বাস্থ্য আর চেহারারই বাড়বাড়ন্ত হয়নি, তার নিজের শরীর স্বাস্থ্য ও চেহারাও অনেক সুন্দর হয়েছে।
 “ একটা কথা তোকে জানানো হয়নি সেদিন রাজন জামাইবাবু আর সোহাদির সাথে একুশে বইমেলায় বাংলা একাডেমীতে দেখা। আমাকে পেয়ে তাদের যে কী আনন্দ! বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তারা নাছোড়বান্দা! সোহাদির ব্যবহারে আমি তো অবাক।

 পিয়াল তাদের ওখানে এলে কুসুম মাকে সোহাদির কথা বলে, “ মা, তুমি শুনে অবাক হবে যে সোহাদি আমাকে দুচোখে দেখতে পারতো না সেই সোহাদি আমাকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে নাছোড় বান্দা।কুসুমের কথা শুনে মা বলল,“ বিদেশ বিভূয়ে দেশের লোক সবাই আপনজন হয়ে যায়। তাছাড়া, আমাদের গ্রামের দলাদলি তো এখন আর নেই। তোকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলার মধ্যে আমি---মায়ের কথা শেষ করতে না দিয়ে কুসুম বলল,“ আমি একদিন সোহাদির বাড়িতে বেড়াতে যাব।

পিয়াল ইন্টার পাশ করে জগন্নাথ কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়। সে কলেজ হোস্টেলে থাকে। এদিকে কুসুমও ওপেন ইউনির্ভাসিটিতে থেকে আইএ পাশ করে। পিয়ালের দিদি সোহা এর মাঝেই অর্থনীতিতে মাস্টার্স্ পাশ করেছে। কুসুমের প্রতি সোহার মনোভাব বদলে যাওয়ায় কুসুম খুবই খুশি। ছুটিছাটায় কুসুম মাঝেমধ্যে সোহাদির বাসায় বেড়াতে আসে। কুসুম এলে পিয়ালের দিদি সোহা নিজেই পিয়ালকে টেলিফোন করে। সোহা কুসুমের কাজের খোঁজখবর নেয়।
কুসুম বলে,“ সোহাদি, আমি বি.এ. পাশ করলে ভাল একটা পোস্টে যেতে পারবো বলে আশা করছি।কুসুম, তুই কি সামনের বছরে পরীক্ষা দিবি?”

সময় বয়ে যায়, পিয়াল মাস্টার্স্ পাশ করে রাজন জামাইবাবুর কোম্পানীতে চাকরী পায়। এক শুক্রবারে কুসুম সোহাদের বাড়িতে এসে জানায় ঢাকার মীরপুর থেকে সাভারের একটা গার্মে্ন্টস একটা ভাল পোষ্টে জয়েন করবে আগামী সপ্তাহে। সোহা কুসুমকে বলে,“ ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কী দরকার ছিল।  বি.এ. পাশ করলে তোর জামাইবাবু তোকে তাদের কোম্পানী নিয়ে নেবে। কুসুম ঢাকা ছেড়ে সাভারে যাবার খবরে সবচেয়ে বেশি অখুশি হয় পিয়াল।
 পিয়াল কুসুমকে একা পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, “আমার থেকে দূরে থাকার জন্যে কি তোর সাভারে চাকরী নেওয়া?”                                               “ তুই এমনটা ভাবতে পারলি? এত বছর কাজ করেও প্রমোশন না পেয়ে এখন বায়িং ডিপার্টমেন্টের এ্যাসিটেন্ট ম্যানেজারের পোষ্ট পেয়েও দেওয়াটা কি ঠিক কাজ হবে? এতদিন তো মেয়েদের সাথে হোস্টেলে থাকলাম। এখন ভাবছি, ভাইটিকে এখানে ভর্তি করে মিরপুরে একটা বাসা নেব।
এখানে বাসা নিলে তোকে তো বাসে ডেইলি প্যাসেঞ্জারী করতে হবে।” 
কোম্পানী তাদের নিজস্ব গাড়িতে ট্রানসপ্রোটেশনের ব্যবস্থা করবে বলে অ্যাপন্টেমেন্ট লেটারে উল্লেখ করেছে।পিয়ালের কথার জবাবে কুসুম বলল।

কুসুম সাভারের নতুন ফ্যাক্টরিতে জয়েন করায় পিয়াল প্রথম দিকে অস্বস্তিবোধ করলেও পরে এক সময় তার অস্বস্তিটা কেটে যায়।কোম্পানীর কাজে মাঝেমধ্যে কুসুম ওদের গাড়িতে মতিঝিলের বায়িং অফিসে আসে। মতিঝিলে গেলে সে প্রায় প্রায়ই পিয়ালের সাথে তার দিলকুশার অফিসে দেখা করে। শত কাজে ব্যস্ত থাকলেও পিয়াল কাজ রেখে কুসুমকে নিয়ে ক্যান্টিনে যেতে দ্বিধা করে না। কুসুমের সাথে পিয়ালের অনেক কথা হয়। পিয়াল ভাবে, একদিন না একদিন কুসুম তাদের অফিসে জয়েন করতে পারবে রাজন জামাইবাবু যখন কথা দিয়েছেন। পিয়াল ও কুসুম স্বপ্ন দেখে ঘর বাঁধার। পিয়াল কুসুমকে বলে,“ আমাদের স্বপ্ন একদিন বাস্তবে পরিণত হবে। আমি সেই আশাতেই প্রহর গুনবো।

পিয়াল অ্যাসিডেন্টের খবরটা পায় লিফটে উঠবার মুখে। অফিসে ঢুকে টিভিতে খবর আর ছবি দেখে পিয়ালের মাথাটা ঘুরে যায়। এ বিল্ডিংই তো কুসুমদের  গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী ! দশটা বেজে দশ মিনিট। এগারোটা পর্যন্ত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে থাকার কথা। এগারোটার পর সে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী থেকে বেরিয়ে সোজা মতিঝিলের কাজ সেরে রাজন জামাইবাবুর অফিসে আসবার কথা আছে। রাজন জামাইবাবু অনেকদিন পরে দেশে ফিরেছেন।  কুসুমের সাথে তার অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা আছে। সেখানে পিয়ালও উপস্থিত থাকবে। মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে বের করে পিয়াল কুসুমকে ফোন করে, কিন্তু রিং হয়, কিন্তু ফোন রিসিভ না করায় পিয়ালের মনটা আতঙ্কিত হয়ে উঠে। এর মধ্যে জামাইবাবুর ফোন বেঁজে উঠে,“ পিয়াল, কুসুমদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী সাভারের  ধ্বসে গড়া নয়তলা বিল্ডিং এ না? কুসুমের খবর কী!
“  কুসুমের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী তো সাভারেই, ওকে এখন ফ্যাক্টরীতে থাকার কথা ওর ফোরন রিং হচ্ছে, কিন্তু ও ধরছে না।
পিয়াল জবাবে বলে। পার্কিং লটে চলে আয়, এখনই সাভার যেতে হবে।রাজন জামাইবাবু ফোনের ওপ্রান্ত থেকে বলে উঠেন। আমিন বাজার পার হবার পরই ভীষণ যানজট । ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর গাড়ির, প্রাইভেট কার সাভারের দিকে ছুটছে তো ছুটছেই। পিয়াল আবার কুসুমকে ফোন করে। কিন্তু ওপ্রান্ত থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায় না। তারা সাভারের ঘটনা স্থলে পৌছে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। হাইওয়ের পাশের নয়তলা বিল্ডিংটা ধ্বসে পড়ে দোতলার সাথে মিশে গেছে। চারদিকের ধ্বংসস্তূপের মাঝে মানুষের আহাজারি শোনা যাচ্ছে। হাইওয়ে বন্ধ। চারপাশে হাজার হাজার মানুষের ভিড় একের পর এক ফায়ার বিগ্রেড , পুলিশ, সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের গাড়ি ছুটে আসছে উদ্ধার কাজ চলছে তিনটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরী, ব্যাংক ও দোকানপাটের নয়তলা বিল্ডিংটার কয়েকতলায় তিন হাজারের বেশি নারী পুরুষ কাজ করে। বিল্ডিং এ ফাটল দেথা দেওয়া সত্ত্বেও গার্মেন্টস কর্মীদের কাজের জন্যে বিল্ডিং এ নাকি ঢোকানো হয়েছিল। উদ্ধার কর্মীরা একর পর এক লাশ ও আহতদের বের করে আনছে।

রাজন জামাইবাবুর সাথে পিয়াল ছুটে যায় এক একটা আহত মানুষের কাছে। ধ্বসে পড়া বিল্ডিং এর ভেতর থেকে বের করে আনা লাশের পাশেও ছুটে যেতে দেরি করে না তারা। কোথায়ও কুসুমকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউই তার খোঁজ দিতে পারে না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত হন্যে হয়ে একবারে হাসপাতালগুলোতে আর একবার ধ্বংসস্তূপের ভেতরে থেকে বের করা লাশের মধ্যে পিয়াল কুসুমকে খুঁজে ফেরে। দুসপ্তাহের বেশি সময় ধরে উদ্ধার কাজ চলছে। হাতপা কেটে আহতদেরকে জীবিত বের করা হয়েছে। হাজারের উপর লাশ ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের করা হয়েছে। আরো কত লাশ পচে গলে কংক্রিটের চাইয়ের সাথে মিশে গেছে।

পিয়াল এখনো আশা ছাড়েনি কুসুমকে খুঁজে পাবার। অনেকেই তাদের স্বজনদের আশা ছেড়ে দিলেও পিয়াল কুসুমকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে অনন্তকাল প্রতীক্ষা করবে বলে পিয়াল প্রতিজ্ঞা করে।