ছোটবেলা
থেকেই আমার
পশুপাখির ওপর
একটা কৌতুহল, ভালবাসা
ও ভাললাগা আছে। পাখি পোষা
আমার কপালে
নেই, কিন্তু কুকুর, খরগোশ, গিনিপিগ, সাদা
ইঁদুর, কী না
বাড়িতে এনে
যত্ন করে
পুষেছি? তাদের সুবিধা-অসুবিধার
দিকে লক্ষ্যও
রেখেছি। একবার
একটা পায়রার
নখ বড় হয়ে
গেছে মনে
করে ব্লেড
দিয়ে নখ
কেটে দিয়ে, বাবার
কাছে প্রহারও
খেয়েছি। পায়রাটার
পা থেকে রক্ত
বেরতে শুরু
করে আর
বন্ধ হয়
না। কয়েকবার
কাঠ বিড়ালীও
পুষেছি। এই
জীবটা খুব
পোষ মানে। সারাদিন গাছে
গাছে ঘুরে
ফিরে, সন্ধ্যায় ঠিক
ঘরে ফিরে
আসে। কাঠ
বিড়ালী আমার খুব
পছন্দের জীব
হলেও, বিড়াল আমি
মোটেই সহ্য
করতে পারি
না। অথচ
এই জীবটা থেকে
কিছুতেই যেন
আমার মুক্তি
নেই। আদর
করে আবার
তাকে মার্জার
বলা হয়। এই মার্জারের
কাছ থেকে
একটু মার্জিত
ব্যবহার আমি
আশা করেছিলাম। কিন্তু সারা
জীবন বার
বার, পদে পদে, আমায়
সমস্যায় ফেলার
জন্যই যেন
ঈশ্বর বিড়াল
সৃষ্টি করেছেন। বেছে বেছে
এমন বাড়িতে
নতুন কুটুম্বিতা
করার ব্যবস্থা
করেছেন যে, ও
বাড়ির গৃহকর্তা
বিড়াল এক
মেরুতে থাকলে, তিনি
অন্য মেরুতে
বাসা পরিবর্তন
করতেও রাজী। লোকে বলে
ঈশ্বর যা
করেন, মঙ্গলের জন্যই
করেন। তা
তো তারা বলবেই, তাদের
বা ঈশ্বরকে তো
আর আমার মতো
বিড়াল নিয়ে
সমস্যায় পড়তে
হয় নি। এতে আমার
বা বিড়াল, কারো
কোন মঙ্গল
হয়েছে বলে
তো মনে হয়
না।
তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। আমার ভাই আমার থেকে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট। একটা দোতলা বাড়ির উপর তলায় ভাড়া থাকি। বাড়ির সামনে রাস্তা। রাস্তার পরেই একটা ছোট ডোবা। তাতে জল নেই বললেই চলে। শুধু পাঁক, আর তা থেকে বড় বড় কচুরিপানা আর কচু গাছ মাথা তুলে রয়েছে। বাড়ির পিছনে একটা মাঠ। এখনও বাড়ি তৈরী হয় নি তাই ফাঁকা।
একদিন
বিকালে দু’জনে
নেড়া ছাদে
উঠে দেখি, একটা
রোগাপটকা বিড়াল, ছাদে
মম্ভবত হাওয়া
খেতে এসেছে। তাকে ধরে
ভাইকে আমার
জীব জগৎ
সম্বন্ধে জ্ঞানের
পরিচয় দেবার
জন্য বললাম, “জানিস, বিড়ালকে
যত ওপর থেকেই
ফেলে দেওয়া
হোক না
কেন, ওদের কোন
ক্ষতি হয়
না”।
“তাই? কেন”?
“এদের পায়ের
তলায় স্পঞ্জের
মতো প্যাড
আছে, তাই দিয়ে
এরা ঠিক
দাঁড়িয়ে পড়ে। এদের একটুও
লাগে না”।
“কই
দেখি”।
ভাই
আমার হাত থেকে
বিড়ালটা নিয়ে, তার
পা গুলো ভাল
করে পরীক্ষা
করে দেখলো, আর
তারপর হঠাৎই
কিছু বোঝার
আগে, ঢিল ছোঁড়ার
মতো বিড়ালটাকে
তিনতলা উচু
থেকে পিছনের
মাঠে ছুঁড়ে
ফেলে দিল।
প্রায়
পাঁচতলা উচ্চতায়, শুন্যে
পাক খেতে
খেতে, অনেক দুরে
মাঠটার শেষ
প্রান্তে গিয়ে, বিড়ালটা
মাটিতে আছাড়
খেল। ভাই
আমার বিদ্যার
দৌড় দেখার
জন্যই বোধহয়, কিছুক্ষণ
অপেক্ষা করে
রইলো। কিন্তু
বিড়ালটা আমাকে
নিতান্ত বোকা
প্রতিপন্ন করে, চুপচাপ
মাঠে শুয়ে
থাকলো।
একছুটে
দু’জনে মাঠে
গিয়ে তাকে
তুলে দেখি, আধমরা
হয়ে নেতিয়ে
পড়েছে। হাড়গোড়
ভেঙ্গেছে কী
না বোঝা গেল
না। তবে
সেটাকে দাঁড়
করাতে গিয়ে
দেখলাম, তার আকৃতিগত
কিছু পরিবর্তন
হয়েছে। বাধ্য
হয়ে তাকে
নিয়ে ফিরে
আসার সময়, মাঠের
পাশের বাড়ির
শোভনাদির মা, আমাদের
তিরস্কার করতে
শুরু করলেন।
“ছি, ছি, ছি, তোরা
কী রে? তোদের
কী লেখাপড়া, খেলাধুলা
বলে কিছু
নেই? একটা নিরীহ
বিড়ালকে ছাদ
থেকে ছুঁড়ে ফেলে
মেরে ফেললি? জানিস, বিড়াল
মা ষষ্ঠীর বাহন? বিড়াল
কেউ মারে? ওটা
মরে গেলে, ওর
ওজনের সোনা
কিম্বা নুন
দিতে হয়
জানিস কী? তোদের
কপালে অনেক
দুঃখ আছে। তোদের লজ্জা
করে না? ভাবিস
না বামুনের ছেলে
বলে পার
পেয়ে যাবি”।
তিনি
মাঠের পাশে, বাড়ির
বারান্দায় বসে, মেয়ের
চুল বাঁধতে
বাঁধতে, দৃশ্যটা দেখেছেন। কাজেই কথা
না বাড়িয়ে, আধমরা
বিড়াল নিয়ে
ছাদে ফিরে
এলাম। ভাই
খুব ভয়
পেয়ে জিজ্ঞাসা
করলো— “এখন কী
হবে”?
“বিড়ালটা
বাঁচবে না
রে। তুই
ওভাবে ছুঁড়ে
ফেললি কেন”?
“বাঃ!
তুই তো
বললি বিড়ালকে
ওপর থেকে
ফেললে কিছু
হয় না”।
“তাই বলে
এই ভাবে? এটা
বাঁচবে না। শুধু শুধু
কষ্ট পাচ্ছে। যতক্ষণ বেঁচে
থাকবে, ততক্ষণ কষ্ট
পাবে। তার
থেকে এটার
মরে যাওয়াই
ভাল”।
“কিন্তু
বিড়াল যে
মা যষ্ঠীর বাহন”?
“একজন লোকের
আর ক’টা
বাহন লাগে? সারা
দেশে হাজার
হাজার বিড়াল
আছে। বিড়ালের
কী অভাব আছে”?
তাড়াতাড়ি
মেরে ফেলার
ব্যবস্থাও ঈশ্বর
হাতের কাছেই
করে রেখেছেন। রাস্তার
সামনে কচুরিপানা
ও কচু গাছে
ভরা ডোবাটায়
ওটাকে ছুঁড়ে
ফেলে দিলাম। মূহুর্তের
মধ্যে বিড়ালটা
গিয়ে ডোবায়
ঢুকে গেল।
“রাঙাদা, বিড়াল
মারলে বিড়ালের
ওজনের সমান
সোনা অথবা
নুন দিতে
হয় বললো, কিন্তু
অত সোনা কোথায়
পাব? তার থেকে
নুন দিবি”?
“অত
নুনই বা
পাবি কোথায়”?
“কেন? বটুবাবুর
দোকান থেকে
নিয়ে আসবো”।
বটুবাবুর দোকান থেকে মাসকাবারী মুদিখানার মাল আনা হয়। আমরাই মাল আনতে যাই। পরে মাসের শেষে বাবা সারা মাসের মালের দাম মিটিয়ে দিয়ে আসেন। কাজেই নুন নিয়ে আসায় কোন সমস্যা হবে না। তবে একসাথে অত নুন নিলে, সেই বা কী ভাববে।
“নুন
না হয় দিলি, কিন্তু
বিড়ালটার ওজন
কত জানবি কী
করে? আর নুনটাই
বা কাকে দিবি”?
“সাত তাড়াতাড়ি
ওজন না
করে, ওটাকে ডোবায়
ফেলতেই বা
গেলি কেন? কাকে
নুন দিতে
হয়, শোভনাদির মার
কাছ থেকে
জেনে আসবো”?
“পাগল
হয়েছিস? ও সবের
দরকার নেই”।
দিন কাটতে লাগলো। বিড়ালটার কথা বা নুন দেবার কথা ক্রমশঃ ভুলে গেলাম। আজ ভাবি, মেয়ের বিয়েতে সামান্য আট-দশ ভড়ি সোনা কিনতে, আমার তিন ইঞ্চির জিভ বেড়ে সাত ইঞ্চি হয়ে গেছে, আর সেদিন আমরা একটা আস্ত বিড়ালের ওজনের সমান সোনা
কেনার স্বপ্ন
দেখছিলাম।
বেশ কয়েক বছর পরে, ঐ বাড়ি ছেড়ে আমরা অন্য জায়গায় একটা দোতলার ওপর বাড়ি ভাড়া নিলাম। বেশ খোলা মেলা তিনটে ঘর। সামনে রেলের ঝিল। এখানে বাবার একজন ভাল বন্ধুও জুটে গেলেন। মনজিত বাবু, লাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানীতে কাজ করতেন। প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এসে, বাবার সাথে গল্প করেন, চা খান।
কিছুদিন পরেই বুঝলাম বাড়িটার সব ভাল, অসুবিধা শুধু একটাই, বিড়ালের উপদ্রব। রোজ রাতে একটা বিড়াল জানালা দিয়ে এসে, কী কী রান্না হয়েছে দেখে, ও সুযোগ পেলেই চেখে যেতে শুরু করে। অনেক রকম ভাবে তাকে ধরবার চেষ্টা করে বিফল হয়ে, শেষে মোক্ষম ব্যবস্থা নেওয়া হ’ল।
আমাদের
ফ্ল্যাটটার মাঝখানে
একটা ছোট
ডাইনিং স্পেশ
মতো। তার
দক্ষিনে পাশাপাশি
দুটো ঘর। পুর্বে আর
একটা ঘর। উত্তরে বাইরে
যাবার দরজা
ও পাশে বাথরুম। পশ্চিমে রান্নাঘর। রোজ গভীর
রাতে বাবার
ঘরের পশ্চিমের
জানালা দিয়ে
বাবু আসতেন, রান্নাঘরে
গিয়ে কিছু
পেলে, খাওয়া দাওয়া
সেরে, একই পথে
ফিরে যেতেন। ধরবার চেষ্টা
করলে, কোন না
কোন খোলা
জানালা দিয়ে, স্বচ্ছন্দে
বাসায় ফিরতেন।
একদিন রান্নাঘরের জানালা বন্ধ করে দরজাটা খুলে রাখলাম। রান্নাঘরের বিপরীতে আমার ও ভাইয়ের ঘরে, ভাই আমার-ই পরিকল্পনা মাফিক দরজা ভেজিয়ে, আলো নিভিয়ে, তার আগমনের অপেক্ষায়। দক্ষিনের ঘর দুটোর একটায় দরজা বন্ধ করে দেওয়া হ’ল। অপর ঘরটা বাবার ঘর। সেটার জানালাগুলো খুলে রেখে, দরজার পিছনে মাথা থেকে পা পর্যন্ত শাড়ি চাপা দিয়ে, জানালার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে, আমি প্রহরারত। অনেক রাত, মশার উৎপাতও যথেষ্ট, তবু নড়াচড়া না করে, চুপ করে দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। উদ্দেশ্য একটাই, বিড়ালটা পশ্চিমের জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে, আমার সামনে দিয়ে ডাইনিং স্পেশে গেলেই দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া, আর তারপর বদ্ধ ডাইনিং স্পেশে তার ভবলীলা সাঙ্গ করা। সেইমতো প্রায় পনের-কুড়ি মিনিট দরজার পিছনে শাড়ি চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, আর মাঝে মাঝে এক পা দিয়ে অন্য পায়ের মশা কামড়ানো জায়গাগুলো চুলকে যাচ্ছি। তার দেখা নেই।
ওদিকে ভাইও
অধৈর্য হয়ে
যাচ্ছে। এই
ভাবে আরও
বেশ কিছুক্ষণ
কাটার পর, ধপ্
করে একটা
শব্দ। বাবাজী
আলসে দিয়ে
এসে জানালায়
দাঁড়িয়েছেন। ভয় হচ্ছে
ভাই যদি
এখন কোন
প্রশ্ন করে
বসে বা
আলো জ্বালে, তাহলেই
উনি কেটে
পড়বেন।
আরও
কিছুক্ষণ একই
জায়গায়, একই পোজে
দাঁড়িয়ে থাকতে
দেখে মনে
হ’ল, কিছু সন্দেহ
করেছে। যাহোক্, একটু
পরেই জানালা
থেকে নেমে
এসে দরজাটার
ঠিক মাঝখানে
দাঁড়ালো। দেহের
অর্ধেক ঘরে, অর্ধেক
ডাইনিং স্পেশে। এই অবস্থায়
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে
থাকলো, নড়েও না। অথচ আর
একটু এগিয়ে
গেলেই, দরজাটা বন্ধ
করে দিতে
পারি। কিন্তু
বাবুর ভীষ্মের
প্রতিজ্ঞা, এখানেই দাঁড়িয়ে
থাকবেন। একবার
ভাবলাম দরজার
পিছন থেকে
বাঁ পা
টা বাড়িয়ে, এক
কিকে ওটাকে
ডাইনিং স্পেশে
পাঠিয়ে, দরজা বন্ধ
করে দি। কিন্তু সামান্য
আওয়াজ হলেও
পাছে কেটে
পড়ে, তাই চুপ
করে অপেক্ষা
করছি। শেষে
আস্তে আস্তে
ডাইনিং স্পেশে
অভ্যাস মতো
এগিয়ে যেতেই, দরজা
বন্ধ করে
ভাইকে ডাকলাম।
ততক্ষণে
তিনি বুঝে
গেছেন যে, আজ
তিনি ফাঁদে
পড়েছেন। ঘুঘু
দেখার বা
খাবার সৌভাগ্য
তার হয়েছে
কী না জানি
না, তবে আমার
সৌজন্যে, আজ তার
ফাঁদ দেখার
সুযোগ মিলেছে ।
এবার
শুরু হ’ল
তার সহবত
শিক্ষার অনুষ্ঠান। বেশ কিছুক্ষণ
ডাইনিং স্পেশে
দাপাদাপি করে, রান্না
ঘরের উননের
নীচের দিকের
গর্তে ঢুকে
পড়ে, নিজেকে বাঁচাবার
চেষ্টা করলো। জায়গাটা তখনও
বেশ উত্তপ্ত, তবু
সে ওখানেই ঢুকে
ডাকতে শুরু
করলো।
ঘুম
ভেঙ্গে যাওয়ায়, বাবা
অনেকক্ষণ থেকে
বিড়ালটাকে ছেড়ে
দেবার কথা
বলেও, কোন কাজ
না হওয়ায়, উঠে
এসে সাঁড়াশি
দিয়ে বিড়ালটার
ঘাড়ের কাছটা
ধরে নিয়ে
গিয়ে, জানালা দিয়ে
তাকে আমাদের
হাত থেকে
মুক্ত করলেন। এর পিছনে
তাঁর অবশ্য
একটা গোপন
স্বার্থ ছিল। বিড়ালটা তাঁর
বন্ধু, মনজিত বাবুর।
এরপর বেশ কিছুদিন বিড়ালটার আসা বন্ধ হলেও, আবার একদিন সব অভিমান ভূলে, তিনি নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু করলেন।
এর
অনেক বছর
পর আমি একটা
বাড়ি কিনে, স্ত্রী
কন্যাকে নিয়ে
বসবাস করতে
শুরু করলাম। তখন আমি
বর্দ্ধমান জেলার
শেষ প্রান্তে, বিহারের
বর্ডারে কর্মরত। বাড়িতে স্ত্রী, মেয়েকে
নিয়ে থাকে। মেয়ে তখন
নবম শ্রেণীর
ছাত্রী। আমি
শনিবার রাতে
বাড়ি আসি, রবিবার
রাতে ফিরে
যাই।
আমি
বাড়িটা কিনে
এসেছি খবর
পেয়েই, একটা বিড়াল
নিত্য আসা
যাওয়া শুরু
করে দিল। বিড়ালটাকে
দেখতে ভারী
অদ্ভুত। সাদা
রঙের
ওপর কালো
ছোপ। কিন্তু
তার আসল
সৌন্দর্য ছিল
তার চোখ
দু’টোয়। একটা চোখ
আকাশের মতো
নীল, অপর চোখটা
সমুদ্রের মতো
সবুজ।
বাড়িটার
চারপাশে পাঁচিল
দিয়ে ঘেরা । ডাইনিং স্পেশের
দক্ষিণে রাস্তার
দিকে একটা
ঘর, এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে
আর একটা ঘর। পূর্বে, রান্নার
জায়গা। চারিদিকে
বড় বড় অনেকগুলো
জানালা ।
রবিবার
বাজার থেকে
মাছ এনে
বেছে পরিস্কার
করে ফ্রিজে
রাখার দায়িত্বটা
আমারই ছিল । রান্নার খোলা
জায়গাটায়, জানালার পাশে
সিঙ্ক-এ
মাছ পরিস্কার
করার সময়, জানালার
বাইরে পাঁচিলের
ওপর বিড়ালটা
ঠিক এসে
বসতো। সময়
জ্ঞান দেখে
মনে হ’ত
পায়ে ঘড়ি
(রিস্ট্ ওয়াচ?) বাঁধা
আছে। আমি
মাছের মুড়োর
অংশ বা
তেল ইত্যাদি
জানালা দিয়ে
ছুঁড়ে দিতাম। হাতে করে
দিলে বা
জানালার উপর
রাখলে, পাঁচিল থেকে
লাফ দিয়ে
এসে জানালায়
বসে, হাত থেকে
নিয়েও খেত। আর এইভাবে
বোধহয় একটু
বেশীই প্রশ্রয়
দেওয়া হয়ে
গেছিলো। আমার
গৃহকত্রী বারণ
করলেও, কেন জানি
না, আমি দিতাম।
কিছুদিন পর থেকে শনিবার রাতে বাড়ি ফিরে শুনতাম, রাতে জানালা দিয়ে এসে এটা ওটা খেয়ে গেছে, এবং যথারীতি তার নিশিভ্রমণের জন্য আমাকেই দায়ী করা হ’ত। আমার প্রশ্রয়েই নাকি তার এত সাহস ও বাড়বাড়ন্ত।
দু’চারটে
শনিবার রাতে
ঘুমের মধ্যে
বাসন ফেলার
শব্দে ঘুম
থেকে উঠে
দেখি, দুধের পাত্র
ফেলে দিয়েছে, চাপা
দেওয়া রান্নাকরা
খাবারে মুখ
দিয়েছে। আলো
জ্বালার সঙ্গে
সঙ্গে, আমার ঘরের
জানালা দিয়ে
বেড়িয়ে যেত।
একদিন আমার সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। আলো না জ্বেলে ডাইনিং স্পেশে এসে, আলো জ্বেলে খুব দু’চার ঘা দিয়ে দিলাম। কোঁকাতে কোঁকাতে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে, জানালা দিয়ে চলে গেল। ভাবলাম আপদ বিদায় হ’ল, আর বোধহয় নৈশ অভিযানে এ মুখো হবে না। কিন্তু বিড়াল যে কত নির্লজ্জ, তখনও জানতাম না। এর পরেও তিনি আসতেন, অবশ্য বেশ কিছুদিন পর থেকে। তবে এবার তিনি তার ফিঁয়াশেকে, বডিগার্ড হিসাবে সঙ্গে নিয়ে আসতে শুরু করলেন। ফলে অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে গেল।
একদিন আমার অতিপ্রিয় সরষে ইলিশ রান্না হয়েছে। ভাল ইলিশের তখন অসম্ভব দাম। তবু রসনার তাড়নায় কিনে এনেছি। সারা সপ্তাহ আমার খাওয়ার কষ্টে কাটে বলে, শ্রীমতী আমার জন্য বেশ বড় বড় তিন টুকরো মাছ নিয়েছেন। অন্যান্য রবিবারের মতো দেরী না করে, বারটার মধ্যে স্নানঘরে গিয়ে, গলা ছেড়ে বেশ কয়েকটা বাথরুম সংগীত গেয়ে, স্নান সেরে খুশী খুশী মেজাজে বার হয়েই, গৃহিণীর হাঁড়ির মতো মুখ দেখলাম। ব্যাপার কী বোঝার আগেই দৃষ্টি গেল রান্নার জায়গার জানালার বাইরে পাঁচিলে। বিড়ালটা চোখ বুজে বসে আছে।
“শুনছো, বিড়ালটা
ছয় টুকরো ইলিশ
মাছের একটা
থেকে খানিকটা
খেয়ে, আমাকে দেখে
জানালা দিয়ে
লাফিয়ে পাঁচিলে
গিয়ে বসেছে। কী করি
বলতো? ঐ মাছটা
ফেলে দিয়ে
বাকীগুলো রেখে
দেব”?
“দুর, তাই
কেউ রাখে”?
“অনেক
দাম তো, ফেলে
দিতে গায়ে
লাগছে”।
“কী
করা যাবে
বল”?
“আরও বেশী
করে প্রশ্রয়
দাও” বলে গট্
গট্ করে
এগিয়ে গিয়ে, মাছ
সমেত পাত্রটা
বাসন মাজার
জায়গায় শব্দ
করে নামিয়ে রাখলো।
খিদেয়
পেটে আগুন
জ্বলছিল। খাবারের
অভাবে, বিড়ালের স্বভাবে, পেটের
আগুন মাথায়
উঠে জ্বলতে
শুরু করলো। ঘর থেকে
উইপোকা মারার
“টাটাফেন” এর
কৌটটা নিয়ে
এলাম। সমস্ত
কীটনাশকে লেখা
থাকে বাচ্ছার
হাত থেকে
দুরে রাখুন। এতে লেখা
আছে ব্যবহারের
পরে পাত্রটা
পুড়িয়ে ফেলুন।
বেশ খানিকটা কীটনাশক একটা পাত্রে ঢেলে, একটু মাছের ঝাল ও বেশ খানিকটা মাছ দিয়ে মেখে নিলাম। এবার পাত্রটা জানালায় রেখে, “আঃ আঃ” করে ডাকতেই মুখপোড়া এক লাফে জানালায় এসে বসলো। পাত্রটা সামনে রাখতেই, দু-চারবার পাত্রের কাছে মুখ নিয়ে গিয়েও, মুখ সরিয়ে নিল। বুঝলাম তীব্র গন্ধের জন্য মুখ দিচ্ছে না। আরও খানিকটা ঝাল, খানিকটা মাছ মিশিয়ে দেওয়ায়, সে অল্প একটু খেল। আর তারপরেই মুখ সরিয়ে এক লাফে পাঁচিলে ফিরে গিয়ে, ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ করে, হাঁচিও নয়, কাশিও নয় গোছের আওয়াজ করতে শুরু করলো। ভাবলাম এবার নিশ্চই দেহ রাখবে। কিন্তু সে সব কিছুই হ’ল না। শুধু আমার দিকে— “তোর মনে এই ছিল?” গোছের একটা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, ধীরে ধীরে চলে গেল।
রোজ
রোজ পকেটের
পয়সা খরচ
করে এস.টি.ডি.
কল্ করে, বিড়ালের
আসা যাওয়ার
খোঁজ নিতে
শুরু করলাম। নাঃ, তিনি
আর আসেন
নি। তাকে বাড়ির
আশেপাশে দেখাও
যায় নি। মনে মনে
নিজের বুদ্ধির
তারিফ করতে
করতে, আর গুন
গুন করে
গানের সুর
ভাঁজতে ভাঁজতে, শনিবার
বাড়িমুখো হলাম। দীর্ঘ এক
সপ্তাহ পর, স্ত্রী
কন্যার মুখ
দেখতে কোন
পুরুষ না
চায়?
বাড়ি
ফিরে কলিং
বেল টিপে, কদম
তলার কৃষ্ণের
পা বেঁকিয়ে দাঁড়ানোর
ভঙ্গিমায়, অপেক্ষা করতে
লাগলাম। ভাবলাম
দরজা খুলে
হাসিমুখে, “হাই ডার্লিং”গোছের
কিছু বলবে। দীর্ঘ সাতদিন
পরে দেখা। আমার বুদ্ধি-ই
তাকে গৃহ
শান্তি ফিরিয়ে
দিয়েছে।
দরজা খুলেই
গৃহিনী হাসি
মুখে বললো— “শুনছো, বিড়ালটা
আজ আবার এসে
দুধ খেয়ে
গেছে”।
সারা
সপ্তাহ ধরে, বাড়ি
ফিরে মা
মেয়েকে নিয়ে
কী কী প্রোগ্রাম করা
যায় ভেবে
ভেবে এসে, এই
দুঃসংবাদ শুনে
মাথায় যেন
আকাশ ভেঙ্গে
পড়লো। আগের
ছকা সমস্ত
পরিকল্পনা বাতিল
করে, চট্ জলদি
নতুন প্রোগ্রাম
স্থির করে
ফেললাম। আর
সেটা অবশ্যই
আগামীকাল ফিরে
যাবার আগে
বিড়ালটাকে মা
ষষ্ঠীর কাছে
ফেরৎ পাঠানো। সে, যে
ভাবেই হোক।
সারাদিনের
পরিশ্রম, ট্রেন জার্নি
ইত্যাদি কারণে, বেশ
ক্লান্ত হয়ে
পড়েছিলাম। রাতে
শোবার আগে
সমস্ত দরজা
জানালা বন্ধ
করে, শুধু আমার
ঘরের জানালা
ও দরজা খুলে
রাখলাম। ঐ
জানালা দিয়েই
তিনি নৈশ
অভিযানে আসা
পছন্দ করেন। স্ত্রী, কন্যা, রাতদুপুরে
আমার বাড়াবাড়ি
দেখে বিরক্ত
হ’ল।
“এই
গরমে দরজা জানালা
বন্ধ করে
শোয়া যায়”?
“প্রয়োজনে
মানুষকে অনেক
কিছুই করতে
হয়, ফুল স্পীডে
ফ্যান খুলে
শোও”।
না
ঘুমিয়ে জানালার
দিকে তীক্ষ্ণ
দৃষ্টি রেখে
অন্ধকারে শুয়ে
আছি। ডাইনিং
স্পেশে মজবুত
লাঠিটাও জায়গা
মতো রাখা
আছে। অপেক্ষা
করে করে, ক্লান্তিতে
কখন ঘুমিয়ে
পড়েছি। হঠাৎ
বাসন নাড়ার
শব্দে ঘুম
ভেঙ্গে গেল। আর ঘুম
ভাঙ্গতেই একটা
তীব্র ঝাঁঝালো
বিশ্রী গন্ধে, গা
গুলিয়ে উঠলো। উঠে বসে
দেখলাম তিনি
শুধু এসেছেন
তাই নয়, আমার
বিছানার এক
কোণে ছোট
বাইরেও করেছেন।
শব্দ
না করে জানালাটা
বন্ধ করে, ডাইনিং
স্পেশে এসে
ঘরের দরজাটা
বন্ধ করে
দিলাম। ব্যাস্, এবার
আর ডাইনিং স্পেশের
বাইরে যাবার
কোন উপায়
নেই। এবার
শুধু ডুয়েল
লড়াই। আলো
জ্বেলেই দেখি, রান্নার
জায়গায় প্রেমিক
প্রেমিকার যুগল
মুর্তি।
ভূত
দেখার মতো
অবাক হয়ে
দু’জনে ভাঙ্গা
গলায় ডাকতে
ডাকতে, ডাইনিং স্পেশ-ময়
ছোটাছুটি শুরু
করে দিল। আমিও এলোপাতাড়ি
লাঠিচার্জ শুরু
করলাম। পায়ের
কাছ দিয়ে
দু’জনের ছোটাছুটিতে
বিপদ আছে
বুঝে, দরজাটা একটু
ফাঁক করে
ঘরে গিয়ে, ঘরের
জানালাটা খুলে
দিলাম। ফিরে
এসে দরজাটা
একটু ফাঁক
করতেই, একটা ছুটে
ঘরে ঢুকে
জানালা দিয়ে
পালিয়ে গেল। “য পলয়তে
স জীবতি” যে
বিড়ালদের ক্ষেত্রেও
প্রযোজ্য বোঝা গেল। প্রেমিকার
চেয়ে নিজের
জীবন যে
অনেক বেশী
ভালবাসার জিনিস, নিজে
পালিয়ে গিয়ে, হুলোটা
তার শ্রীমতীকে
বুঝিয়ে দিয়ে
গেল।
অগত্যা নিজেই
নিজেকে বাঁচাতে
হবে, এ জগতে
কেউ কারোর
নয় গোছের ভাবনা
চিন্তা করে, বিড়ালটা
এক ছুটে দেওয়াল
বেয়ে কী
ভাবে যেন
এগজষ্ট্ ফ্যান
পর্যন্ত উঠে, পাখা
ধরে ঝুলতে
লাগলো। ব্যাপারটা
এত দ্রুত ঘটে
গেল যে, কী
ভাবে সে
মসৃণ দেওয়াল
বেয়ে ওখানে
উঠলো বুঝতে
পারলাম না।
লাঠি হাতে ছুটে গিয়ে তার পিঠে সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঘা বসিয়ে দিলাম। ওপর থেকে সজোরে নীচে সাজানো বাসনপত্রের ওপর পড়ে, গভীর রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে, সে পালাবার অন্য পথ খুঁজতে শুরু করলো। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক ঘা তার পিঠে পড়েছে।
গ্যাস
ওভেনের ঠিক
ওপরে, একদম ছাদের
নীচে, একটা লফ্ট্
এর মতো তাক
আছে । সেখানে
দরজা না
থাকায়, একটা লম্বা
কাপড়, পর্দার মতো
টাঙ্গানো থাকতো। বিড়ালটা একই
কায়দায় আবার
ছুটে গিয়ে, লাফিয়ে
গ্যাস ওভেনের
ওপর উঠে, লাফ
দিয়ে কী
ভাবে অনেক
ওপরের পর্দাটা
আঁকড়ে ধরলো। কিন্তু পর্দার
দড়ি ছিঁড়ে
গ্যাস ওভেনের
ওপর পড়ায়, কী
ভাবে যেন
পর্দাটা তার
শরীরে জড়িয়ে
গেল। অনেকটা
এগরোলের মতো। সেই সুযোগে
আমি আমার
হাতের, থুড়ি লাঠির
সুখ করে
নিলাম। শেষে
মেয়ের অনুরোধে
তাকে ছেড়ে
দিয়ে, দরজা খুলে
দিলাম। অদ্ভুত
একটা শব্দ
করতে করতে, সে
খোলা জানালা
দিয়ে চলে
গেল।
দিন দশেক বিশ্রাম নিয়ে, আবার সে নিয়মিত আসতে শুরু করলো। রবিবার আমার মাছ বাছার সময় আসে, রাতে আমি থাকলেও আসে, না থাকলেও আসে। আবার চুরি, আবার দুধের পাত্র ফেলা, আবার খাবারে মুখ দেওয়া।
এক রবিবার মাছ বাছার সময় বিড়ালটা পাঁচিলে বসে আছে, হঠাৎ মনে হল, আজ যে ভাবে হোক ওকে ধরে, থলেতে পুরে, সন্ধ্যাবেলা ফিরে যাবার সময় ট্রেনে ছেড়ে দেব। সেইমতো একটা হাত দুয়েকের বেশ শক্ত দড়ির একদিকে, নাটা মল্লিকের ফাঁসির দড়ির ফাঁসের মতো তৈরী করে, অপর প্রান্ত জানালার গ্রীলে বেঁধে দিলাম। এবার মাছের কানকো, তেল ইত্যাদি অংশ, এবং আজই তার এ বাড়িতে শেষ দিন ভেবে, এক টুকরো মাছ নিয়ে, “আঃ আঃ” করে আদুরে গলায় তাকে ডাকলাম। ভেবেছিলাম আমার কাছাকাছি সে হয়তো এ জীবনে আর আসবে না। কিন্তু এক মিনিট সময় নষ্ট না করে, পাঁচিল থেকে এক লাফে জানালায় চলে এল। আমি খাবারটা জানালায় রাখতেই, সে মাথা নীচু করে খেতে শুরু করলো। আমিও তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদরের ভান করলাম। আমার ব্যবহারে অবাক হয়ে, সে একবার মাথা উচু করে আমায় দেখে নিয়ে, আবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো। আরও একটু খাবার দিয়ে, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে দড়ির ফাঁসটা তার গলায় পড়িয়ে দিয়ে, কিছু বোঝার আগেই, সজোরে একটা ধাক্কা। জানালা থেকে পড়ে গিয়ে, সে দড়ির ফাঁসে ঝুলতে লাগলো। থলে নিয়ে বাড়ির বাইরে তার কাছে যাবার আগেই, বার কতক ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ আওয়াজ করে, এক ঝটকায় দড়ি ছিঁড়ে চলে গেল।
এর
পরেও বকলেসের
মতো দড়ি
গলায়, সে আসা
যাওয়া করতে
লাগলো। বিড়ালের
বোধহয় সত্যিই
ন’টা জীবন। কাজেই তার
চিন্তা মাথা
থেকে দুর
করতে চেষ্টা
করলাম। সে
অত্যাচার চালিয়ে
যেতে লাগলো। কিন্তু মা
ষষ্ঠী যার
সহায়, সে তো
বিপক্ষকে অসহায়
অবস্থায় ফেলবেই। কাজেই মাঝে
মাঝে এ
ভাবেই চোর-পুলিশ
খেলা চলতে
লাগলো।
এ ভাবে অনেক দিন কেটে গেছে। এক শনিবার অফিস থেকে ফিরে এসে শুনলাম সেই সুসংবাদ। এত বড় পৃথিবীর সব জায়গা ছেড়ে, আমার দশ বাই বার বেডরুমের খাটের তলা তার সব থেকে পছন্দ, এবং সেখানেই সে তিনটি সন্তান প্রসব করেছে। ভেবে অবাক হলাম যে, সব থেকে বিপৎসংকুল জায়গা তার কাছে সব থেকে নিরাপদ মনে হ’ল কী ভাবে।
আমার গৃহিণীর
হাবভাব দেখে
মনে হ’ল, তিনি
যেন আজই
নার্সিং হোম
থেকে নবজাতক
নাতি ও
মেয়েকে নিয়ে
বাসায় ফিরেছেন। মাথায় রক্ত
চড়ে গেল। বাচ্ছাগুলোকে
বাড়ির বাইরে
বার করে
দেব বলে, খাটের
নীচে উকি
মেরে দেখলাম, একটা
ভাঁজ করা
কাপড়ের ওপর
তিনি বাচ্ছাকাচ্ছা নিয়ে, পরম
আরামে চোখ
বুজে শুয়ে
আছেন।
আমার স্ত্রী মিনতি করতে শুরু করলো— “এখনও চোখ ফোটেনি, দুধ ছাড়েনি, ওদের বাইরে ফেলে দিও না। একটু বড় হলে যা হয় করো”। এখানেই শেষ নয়, তিনি আবার বাটি করে দুধ এনে খাটের তলায় দিলেন, তার পুষ্টির জন্য। আমাকে দু’হাতের মধ্যে দেখেও বিড়ালটা ঊঠলো না, বা পালাবার চেষ্টা পর্যন্ত করলো না।
একটু পরে, আমি
সোফায় বসে
আছি, গরু ছাগল
যেভাবে তাদের
গা চুলকাবার
জন্য দেওয়ালে
গা ঘষে হাঁটে, বিড়ালটাও
সেই ভাবে
তার
শরীর ও
লেজ আমার
পায়ে ঘষে
চলে গেল। যেন ব্যাঙ্গ
করে বলে
গেল— “কী রে, কী
রকম দিলাম? ক্ষমতা
থাকলে কিছু
করে দেখা”।
সে তো
ব্যাঙ্গ করবেই। চোখের সামনেই
তো দেখতে পাচ্ছে, পতি
সেবার থেকে, তার
সেবা করাটা
কত জরুরী বলে
বাড়ির মালকিন
মনে করছে।
কয়েকদিন পর
থেকে বাচ্ছাগুলো
খাটের তলা
থেকে বেরিয়ে
পড়তে শুরু
করলো। বোধহয়
তখনও দৃষ্টি
শক্তি হয়
নি। তিনি
অবশ্য মাঝে
মাঝে খাটের তলা
থেকে এসে, মুখে
করে বাচ্ছাদের
স্বস্থানে রেখে
আসছেন।
বারবার এ
ঘর ও ঘর
বাচ্ছাগুলো চলে
যাওয়ায়, এক রবিবার
সকালে বাজার
যাবার সময়, তাদের
সিঁড়ির তলায়
রেখে দিয়ে
গেলাম। ভেবেছিলাম
বিপদের আশঙ্কা
করে, সে নিশ্চই
বাচ্ছাদের নিয়ে
অন্যত্র চলে
যাবে। বাজার
থেকে ফিরে
এসে দেখি, বাচ্ছাগুলোর
সাথে খাটের
নীচে সে
দিব্বি শুয়ে
আছে।
এর পরের
রবিবার থলে
করে নিয়ে
গিয়ে, একটা ব্যাঙ্কের
গেটের সামনে
বাচ্ছাগুলোকে রেখে
এলাম। বড়
রাস্তার পাশে
ব্যাঙ্ক, অনেক লোকের
আনাগোনা। কারোর
না কারোর পছন্দ
হলে নিয়ে
যাবেই।
বাড়ির চারপাশে বিড়ালটা কয়েকদিন কান্নাকাটি করে বেড়ালো। তারপর আবার সব আগের মতো। এবার যেন তার মধ্যে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা দেখা দিল। চুরির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। রাতে আসা, খাবারে মুখ দেওয়া, বাসন-কোসন ফেলা, নিয়মিত চলতে লাগলো। তবে দিনের বেলা আসা প্রায় বন্ধই করে দিল।
শেষে একদিন আবার সুযোগ এল। বাড়ির পিছন দিকের পাঁচিলে তিনি শুয়ে আছেন। পিছন দিকের পাঁচিলটা বেশ উঁচু। এবার আরও শক্ত দড়ির ফাঁস করে আগের বারের কায়দায় মাছ নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই সে উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু হাতে মাছের টুকরো দেখেই বোধহয় পালালো না। দড়ির এক প্রান্ত সুপারী গাছের বেশ উঁচুতে বেঁধে, মাছ দেবার অছিলায় তার গলায় অপর প্রান্তের ফাঁস পরিয়ে দিলাম। ধাক্কা দিয়ে পাঁচিল থেকে ফেলে দিতেই, সে দড়ির ফাঁসে ঝুলতে শুরু করলো। চোখ দুটো যেন বেড়িয়ে আসছে। মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ বার করতে করতে, ক্রমে স্থির হয়ে গেল।
কাছে গিয়ে দেখি তখনও দেহে প্রাণ আছে। গাছ থেকে দড়ি খুলে তাকে নিয়ে এসে বাড়ির পিছনের জলের রিজার্ভারের ওপর শুইয়ে দিলাম। নড়াচড়া করছে না। কোন শব্দও করছে না। মৃদু নিশ্বাস পড়ছে বলে মনে হ’ল। ঐ অবস্থায় তাকে রেখে দিলাম। বাঁচবে বলে মনে হয় না।
ছাদ থেকে
মেয়ে ঘটনাটা
দেখছিল। আমাদের
ঠিক পিছনের
বাড়ির গৌতমও
গোটা ব্যাপারটা
লক্ষ্য করেছে। সে আমার
মেয়েকে বললো
ও ভাবে কিছু
হবে না, বিড়ালটা
আবার আসবে। বাবাকে বল্
ওর গায়ে জল
ঢেলে দিতে, ওরা
জলকে সব
থেকে ভয়
পায়। ওর
কথা শুনে, আমার
মেয়ে ছাদের
রিজার্ভার থেকে
এক মগ জল
নিয়ে ওপর
থেকে বিড়ালটার
গায়ে ফেললো।
কিছু বোঝার
আগেই, সে এক
লাফে দড়ি
সমেত পালিয়ে
গিয়ে সবাইকে
অবাক করে
দিল। মাঝ
থেকে সপ্তাহে
একটা মাত্র
ছুটির দিনের
সকালটা নষ্ট
করলাম।
এরপর থেকে
তাকে বাড়ির
আশেপাশে দেখা
গেলেও, বাড়িতে ঢুকতে
দেখিনি। দড়ি
গলায় ঘুরে
বেড়াতে দেখলেই
আতঙ্ক হ’ত, আবার
না আসা শুরু
করে।
এরপর বেশ কিছুদিন তাকে আর কোথাও দেখা গেল না। ভাবলাম হয়তো অভিমানে সংসার ছেড়ে কাশীবাসী হয়েছে। জীবনের শেষ ক’টা দিন নিরামিষাশী হয়ে, কাশী বাস করে পূণ্যলাভ করছে।
একদিন আমাদের
সামনের বাড়ির
লাল্টু এসে
খবর দিল, একটা
কুকুর বিড়ালটাকে
কামড়ে মেরে
ফেলেছে। সে
নিজে যখন
বিড়ালটার মৃতদেহ
সনাক্ত করেছে, তখন
খবরটা নির্ভূল।
যাহোক্, তাকে আর
কোনদিন এ
বাড়িতে আসতে
দেখিনি। খবরটা
শুনে মেয়ে
শুধু বললো— “যার
কেউ নেই, তার
কুকুর আছে”।