গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪

তাপসকিরণ রায়



অভিনয়

কাট্, চীৎকার করলেন ছবির পরিচালক। আজের মত শুটিং শেষ বলেই বোধহয় সাধারণ থেকে একটু জোরেই কাট্, শব্দটা তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো  
শুটিং শেষ হল। উজ্জ্বল আলোকমালা নিভে গেল। ধীরেন বাবু চুপ চাপ গিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন। একটা স্থির অবস্থা তাঁকে যেন চেপে ধরে আছে। 
--কি অনেকক্ষণ তো শুটিং শেষ হল। এখনও বসে আছেন কেন, ধীরেন বাবু ? পরিচালক যাবার আগে জিগ্যেস করলেন।
--হ্যাঁ, অনেক কষ্টে ধীরেন বাবুর মুখ থেকে শব্দটা বের হল মনে হল। তাঁর শরীরটা ভালো লাগছিল না। মনের মাঝে সেই দুঃখ ভাবটা যেন এখনও চেপে আছে। কোন মানে হয় ! অভিনয় তো অভিনয়ই হয় তবু মেয়েটা তার মারা, গেল। যদিও ছবিতে। অভিনয়ে । 
--না ধীরেন বাবু, আরও ভেঙে পড়তে হবে আপনাকে--নিজের মেয়ে মারা গেলে বাবার কতটা দুঃখ হতে পারে ভাবুন তো ? পরিচালক বলে ছিলেন। 
আরও একবার, দুবার ব্যর্থ হয়ে, অবশেষে সত্যি তিনি দেখিয়ে দিলেন মেয়ের মৃত্যুতে এক বাবার যথাযথ অভিনয়। ধীরেন বাবু নিজের মেয়ের কথা ভেবে নিয়ে ছিলেন, তারপর মৃত্যুর কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাস্তবিক হতবাক ও বিহ্বল হয়ে পড়ে ছিলেন। একদম স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠে ছিল সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণার ছবি। আর সে ছবির মাঝে তাঁর চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠেছিল--গ্লিসারিন বিনা চোখের জল চকচক হয়ে ফুটে উঠেছিল। 
এক সময় দৃশ্য শেষ হল। তিনি ধীরে ধীরে উঠে এসে একটা চেয়ারে বসলেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একটু আগের অভিনয়ের মৃত মেয়েটি। তার মুখ থেকেও দুঃখের কাল ছায়া তখনও সরেনি মনে হচ্ছিল । অভিনয় যাঁরা করেন, তাঁদের নিজের অভিনীত চরিত্র নিয়ে অনেক ভাবতে হয়। চরিত্রগুলির ভেতরে যত বেশী প্রবেশ করা যায় তত বেশী সার্থক অভিনয় বেরিয়ে আসে। কিন্তু সে সার্থক অভিনয়ের চরিত্রে ঢুকে যাওয়া । তখন আর শুধু মাত্র অভিনয় হয়েই থাকে না, অভিনেতার মানসিক, শারীরিক ক্ষতি ততটাই হয়ে যায় যতটা বাস্তব জীবনে হয় । 
--ধীরেন বাবু ! ধীরেন বাবু !! আলোকসজ্জার পরেশ বাবু ধাক্কা দিলেন ধীরেন বাবুর পিঠে। 
--এ্যাঁ ! ধীরেন বাবু যেন অন্যলোক থেকে ফিরে এলেন। সবাই তো চলে গেছে, আমিও সেটের লাইট নিভিয়ে বেরুচ্ছি, আপনার শরীর ভালো তো ?
কথা বলতে ইচ্ছে হল না ধীরেন বাবুর। তিনি কোন মত দাঁড়িয়ে টলতে টলতে শুটিং ফ্লোরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন।