আমি তাকে
প্রথম দেখি বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলায় একটা বইয়ের স্টলে। সে একটা বইয়ের পাতায় চোখ রেখে একমনে পড়ছিল। কাছে যেতেই আমার চোখ পড়ে বইটির পাতার শেষ অংশের ’পর । আমিও তো এই বইটাই খুঁজছি ! বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরালেই আমার চোখ পড়ে মেয়েটির মুখের ‘পর। মুখটি খুবই সুন্দর । পরনে সিল্কের নীল শাড়ি, গায়ে টকটকে গাঢ় লাল ভেলভেটের ব্লাউজ । ব্লাউজের হাতা দুটো কনুই পর্য্ন্ত ।
একবার দেখেই
বুঝতে পারলাম মেয়েটি নজর কাড়ার মত সুন্দরী। বুকস্টলের ছেলেটি কাছে এগিয়ে গিয়ে কাঙ্খিত বইটি চাইলে ছেলেটি বলল,“ একটাই
বই আছে, তাতো
ওই আপার হাতে।” সে আমাকে কথাটা বলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ আপা
ওটা কি নেবেন? না
নিলে এদিকে দেন।” ছেলেটির কথা যেন মেযেটির কানেই গেল না। একজনকে বঞ্চিত করে কোন কিছু দখল করার ইচ্ছে আমার কোন কালেই ছিল না। তাই বুকস্টলের ছেলেটিকে কিছু না বলেই ওখান থেকে পাশের স্টলের দিকে হাঁটা দিলাম।
পাশের কয়েকটা স্টলে বইটি খুঁজে না পেয়ে ভাবলাম, যাকগে নেট থেকে ডাউনলোড করে নিলেই হবে । হলে ফিরে নাটকের রিহার্সেলের কথা মনে পড়ায় বইটির কথা মন থেকে উবে গেল । নাটকের সংলাপ
মুখস্ত করাই এখন আমার আসল কাজ । পরশু ফাইনাল রিয়ার্সেল । রাফাত ভাই বারবার বলেছেন সংলাপ মুখস্ত করতে । সংলাপ মুখস্ত করায় ব্যস্ত থাকায় আমি পরের দু’দিন রুমের বাইরে পা বাড়াতে পারলাম না ।
ফাইনাল রিয়ার্সেলের দিনটা এগিয়ে এল । আমি সকাল সকাল ভার্সিটির নাট্যকলা বিল্ডিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । রিহার্সেলের পর একদিন সময় পাওয়া যাবে ভেবে স্বস্তিবোধ করলাম । ভার্সিটির নাট্য সপ্তাহের প্রথম রাতে রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ অভিনীত হরে। কঙ্কনা দেবযানী আর আমি কচ সাজব । নাটক পরিচালনায় রাফাত ভাইয়ের নামডাক আছে । আমি ওখানে পৌঁছানোর আগেই রাফাত ভাই পৌঁছে গেছেন । আমার ভাল লাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না । কঙ্কনা ওখানে তখনো না পৌঁছায় রাপাত ভাই অস্বস্তিতে আছেন, আমি তার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম। রাফাত ভাই ও আমি দু’জনেই ভাবছিলাম
কঙ্কনা কেন আসছে না। রাপাত ভাইয়ের ভাবনার সঙ্গে আমার ভাবনার তফাত অবশ্যই আছে । কঙ্কনার মুখটা আমার মনের কোণে ভেসে উঠল। কঙ্কনা মুখটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে পরশুদিন মেলায় দেখা মেয়েটার মুখ আমার মনের পর্দার কেন যেন দেখা দিল। ভাবলাম, মেয়েটির মুখ কী কঙ্কনার মুখের মতো ? মন বলল, মেয়েটি দেখতে হয়তো কঙ্কনার মতো, নয়তো কঙ্কনার চেয়েও সুন্দরী
। রাফাত ভাইয়ের উচ্চকন্ঠ কানে আসায় চিন্তায় ছেদ পড়ল। ‘ বাচ্চু তোমাকে পই পই করে বলেছিলাম কঙ্কনাকে না নিয়ে সোহেলিকে নিতে। কিন্তু তুমি গো ধরলে কঙ্কনাকে নিতেই হবে এখন সামলাও-----” আমি রাফাত ভাইয়ের কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলাম,“ ওই
যে কঙ্কনা আসছে। সত্যি সত্যি কঙ্কনা রিয়র্সেল রুমের দিকে এগিয়ে আসছে, কঙ্কনার
সঙ্গে ও আবার কে
,ওই মেয়েটি কি আমার চেনা ? আমি
মনে মনে ভাবলাম রাফাত ভাই ও হয়তো ওই
মেযেটির কথাই ভাবছেন। কঙ্কনা দেরিতে আসায় তিনি তার উপর রেগে আছেন , তা রাফাত ভােইয়ের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে।
রাফাত ভাই
কিন্তু কঙ্কনার ’পর শেষ পর্য্ন্ত রেগে থাকতে পারেন না। কঙ্কানার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এমন ও সামনে এলে
রাগী লোকের মুখেও হাসি ফোটে। কঙ্কনা এগিয়ে এসে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “ রাফাত
ভাই, নিশ্চয়ই
আমার ’পর রেগে আছেন, আর
রেগে থাকারই কথা। তবে আমার কথা শুনলে আমার ‘পর রেগে থাকতে পারবেন না।” রাফাত ভাই ওকে থামিয়ে দিয়ে তার কাছে জানতে চাইলেন কী ঘটেছিল তার। কঙ্কনা কী জবাব দিল তা আমার কানে গেল না। কারণ তখন আমার মনটা কঙ্কনা সঙ্গে আসা মেয়েটার দিকে, আমার
মনে হল, এই মেয়েটিকে কী গত পরশু বইয়ের স্টলে দেখেছিলাম। আমি ভেবে পাচ্ছি না সেই মেয়েটি কীভাবে এখানে আসবে? পরে
কঙ্কনা রাফাত ভাইকে কী বলছে তা শোনার জন্য কান পাতলাম। তার কথা শুনে তাজ্জব! মেয়েটি কঙ্কনার কাজিন , মামাতো বোন। মেযেটির নাম তিথি। আমি ভাবলাম, বাঁচা
গেছে, মেয়েটি
আমাকে চিনতে পারেনি। ও’দিন মেয়েটি যে ভাবে মুখ গুজে বইটি পড়ছিল তাতে সে আমাকে দেখবার কথা নয়। রাফাত ভাইয়ের সঙ্গে কঙ্কনার কথা বলার মাঝে ওই মেমেয়েটির সঙ্গে আমার চোখচোখি হল। কোন মেয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেবে আমি কখনো ভাবতেই পারিনে, কারণ
আমার চেহারায় এধরনের পরুষালি মোহনীয়তা আছে। এজন্যই আমার বন্ধুরা আমাকে রমনীমোহন বলে ডেকে মজা পায়। সেদিন মেযেটির সঙ্গে আমার কোন কথা হল না।
মেয়েটির সঙ্গে
আমার আলাপ হল অভাবিত রূপেই বলতে হয় । ‘ বিদায় অভিশাপ ‘ অভিনয়ের শেষে গ্রীনরুমের দরজায় তিথিকে ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবলাম, মেযেটি
নিম্চয়ই তার কাজিন কঙ্কনাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছে। পরমূহুর্তেই মেয়েটির কথায় আমার ভুল ভাঙ্গল।
“ অসাধারণ অভিনয়ের
জন্য কনগ্রাচুলেশন!” আমার হাতে ফুলের তোড়া ধরিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলল। আমি এমনটা ভাবিনি। কঙ্কনা এখানে নেই ভেবে আমি স্বস্তিবোধ করলাম। আমি জানি, আমার
প্রতি কঙ্কনার একটা সফ্ট কর্ণার আছে। কঙ্কনার কাজিন তিথি আমাকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানানোকে কি কঙ্কনা ভাল চোখে দেখবে? এখানে
বলতে দ্বিধা নেই আমারও কঙ্কনাকে ভাল লাগে।
তিথি আমাকে একা পেয়ে অনেক কথাই বলল। তার কথা বলার ধরন দেখে আমি বুঝলাম, মেয়েটি সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে, কথা বলার সময় ওর গালে টোল পড়ে। এ জন্যে হয়তো কথা বলার সময় ওকে সুন্দর দেখায়। কঙ্কনা কিন্তু তিথি নামের
কাজিনটির মতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে না। ও যা বলার
তা এক নিশ্বাসে বলে ফেলে।
“শান্তিনিকেতনে
আমিও কয়েকবার দেবযানী সেজেছি। প্রত্যেকবারই দিব্যজোতি কচ এর ভূমিকায় ছিল। আপনার অভিনয়----” মেয়েটিকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম,“ আমার
অভিনয় নিশ্চয়ই তার মতো হয়নি।” “ বলেন কী আপনার কাছে দিব্য! মেয়েটি উচ্ছসিত ভঙ্গিতে বলে উঠল। তার উচ্ছাস আমাকে মুগ্ধ করল। ওর কথা থেকে জানতে পারলাম, সে
শান্তিনিকেতনের নাট্যকলার ছাত্রী, এবার
ফাইনাল ইয়ার চলছে। আমার মোবাইল ফোনের নম্বরটা আমার কাছে থেকে জেনে নিয়ে সে আমাকে একটি মিসড কল দিয়ে তার নম্বরটা আমাকে জানিয়ে দিল।
সেদিনের পর তিথির সাথে আমার আবার দেখা হল আজিজ সুপার মার্কেটের উপরতলার ‘ প্রথমা
বুকস্টলে। কঙ্কনা ওখানে এসেছে। কঙ্কনা সামনের দিকে কাউন্টার বই খুঁজছিল। সেদিন কঙ্কনার সাথে আমার কথা হলেও ওর কাজিন তিথির সাথে আমার কোন হল না।
সেদিন রাতেই আমি তিথির ফেন পেলাম। সে অভিযোগের সাথে সুরে প্রশ্ন করল,“ কেন আপনি আমার সাথে প্রথমা বুকস্টলে কথা বললেন নি? কঙ্কনাআপা
বই দেখতে ব্যস্ত ছিল। সে সময় আমার সাথে কথা বলতে পারতেন।” কেন আমি আগ বাড়িতে তার সাথে আলাপ করি নি তা আমি মেয়েটিকে কীভাবে বুঝাব। কঙ্কনার সামনে
কোনক্রমেই তার কাজিনের সঙ্গে কথা বলা ঠিক হত না, মেয়েটি
যাই মনে করুক না কেন।
আমি তার
কথার জবাব দিতে ইতস্তত করলে মেয়েটি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলল,“ কাল
তো আপনার সঙ্গে হবে না। কাল আবার কঙ্কনা আপার সঙ্গে সপিং এ যেতে হবে।
তবে পরশু বিকেলে আমরা কি একান্তে কেথায়ও মিলিত হতে পারি না?” নয়
ছয় করে তার প্রস্তাব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে শেষে একটু ভেবে বললাম, “ শ্রীমঙ্গল
থেকে বেড়াতে আসা তিথিকে কি আপনার কঙ্কনা আপা কিংবা আপার মা একা আপনাকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেবে?” “ তাহলে
কঙ্কনা আপাদের বাড়িতেই আসেন, জমিয়ে
গল্প করা যাবে।” তিথি আমার কথার পৃষ্ঠে জবাব দিল। আমি কী বলব তা ভেবে না পেয়ে বলে ফেললাম,“ আপনার
কঙ্কনা আপা না বললে আমি কেমন করে তাদের বাড়িতে যাই?” “ তা
বেশ আমার কথা আপনি যখন আসবেন না, তখন কঙ্কনা আপা দিয়েই আপনাকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। দেখব তখন আপনি
না এসে থাকেন কী করে।” আমি তার কথার জবাবে বললাম,“ আপনার
কঙ্কনা আপা এখন আমাকে তাদের বাড়িতে যেতে বলবেন না।” ‘ ঠিক আছে,কঙ্কনা
আপাকে বলেই দেখি না কেন “ তিথি এই বলে ফোন কেটে দিল।
কঙ্কনার আমন্ত্রণ
ছাড়াই হর হামেশাই বিকেলের
দিকে কঙ্কনাদের বাড়িতে যেতাম। আমি গেল কঙ্কনার মা খুশি হতেন। কঙ্কনা খুশি হত কিনা তা নাইবা বললাম। কঙ্কনার মায়ের কথাবার্তায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম তার মনে আমার ও কঙ্কনাকে ঘিরে
একটা সুপ্ত বাসনা আছে।
“তুমি
এমন হয়ে যাবে আমি সেদিনই বুঝেছিলাম। তোমাকে কি দাওয়াত করে আনতে হবে?” কঙ্কনা
একটু উষ্মার সঙ্গেই আমাকে প্রশ্ন করল।“ কোন দিন বুঝেছিলে?” আমি
তার প্রশ্নে জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করলাম। “ ন্যাকামি করো না আমার সুন্দরী বোনকে মজেছো সে দিন থেকেই। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তিন দিন তুমি আমাকে ফোন কর না, অথচ তিথির সাথে তুমি সারাক্ষণই কথা বলছ। আমি কিছু বুঝি না তা ভাবলে কীভাবে” আমি
আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করলে ক্ঙ্কনা একটু গড়া সুরে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলল, “ আজ
বিকেলে আমাদের এখানে এস, সামনা
সামনি বসে তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করব্ ” আমি কিছু বলার আগেই ও লাইন কেটে
দিল।
আমি কঙ্কনাকে
ভাল করেই চিনি , ও কিছু বলতে
রাখডাক করে না। কথা বলার সময় ওর গালে তিথির মতো টোল না পড়লেও কঙ্কনা কিন্তু কম সুন্দরী না! আমি ভাবলাম, এখন
তিথিকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ, তিথিকে
ভাল লাগলেও। আমার ফোনটা বেজে উঠল। আমি যা ভেবেছি তাই, তিথির
ফোন!“ এবার আসছেন তো?” তিথি
মিষ্টি গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করল।“ দু:খিত ,আমার মায়ের শরীর ভাল না, এইমাত্র
খবর পেলাম। আমি এখনই দেশের বাড়ি ভোলা রওনা হচ্ছি।” আমি বানিয়ে তিথিকে বললাম। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে তিথির বিষণ্ন কন্ঠ ভেসে এল।
তারপর দু’বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। আমি কিন্তু দেবযানীর সাথে কচ এর মতো আচরণ করিনি। কঙ্কনা ও আমি এক বছর ঘর করছি। এখনো আমরা কচ ও দেবযানীর ভূমিকায় অভিনয় করি ঢাকার বেইলী রোড়ের নাটক পাড়ার মঞ্চে।