শ্রী বোতলানন্দ সরকার
ভাগ্যিস চোলাই মদের ঠেকটা কলেজপাড়ার পেছনেই ছিল, নইলে
যেতে হত পাক্কা এক মাইল দূরে । মেথর পট্টিতে । কলেজের পেছনেরমাঠ ধরে কিছুদূর এগোলেআলুথালু,উঁচুনিচু
পথ পড়বে-ঢেউয়ের মত । শক্ত পাহাড়ি মাটিতে বাঁধাই ।ভাঙা পাথর-কাঁকড় কামড়ানো ঘাস । ২পাশে
বন্য কাঁটাগাছ অসংখ্য । আকন পাতার ঝোপ কিছুদূর পরপর । আররাস্তার বাতাসে সেই
পাতাদের কচিগন্ধ । লোকজনের চলাচল কম । সচরাচর চোখে পরে-বাইসাইকেলে দুলতে দুলতে কেউ
যাচ্ছে কিংবা আসছে । এই পথ মাড়িয়ে মাঝে মধ্যে আমাদেরকে যেতে হয়েছে মেথর পট্টিতে । হেঁটেহেঁটে
। অবশ্য থানার বাবুরা যখন নিজেদের পকেট নিয়ে বেকায়দায় পরতো তখন । বউ-ছেলেমেয়ের
আবদার মেটাতে না পারলে সংসার টেকে? আহা, সংসারই যে স্বর্গ । আরপত্নী যেন স্বর্গরানি
। রানির আবদার মেটাতে সোজা চোলাই ঠেকে এসে হানা দিত ওরা । ঝানু ব্যবসায়ী মুকুন্দকাকা
যতই সদাটালরত অবস্থায় থাকতোনা কেন, কিভাবে যেন টের পেয়ে যেত-বাবুরা আসছে । কাকাও
একটা জিনিস ছিল বটে-নিমিষেই ঠেক খালি ! কেবল পড়ে থাকতো বাঁশ কাঠের মিশ্রনে তৈরি পুরাতন
বেঞ্চিগুলা আর হাড্ডিসার সাদানে ড়িটার নেশাখোর চাহনি ।
মেথর পট্টির ভেতরের রাস্তাগুলা সরু কিন্তু পরিচ্ছন্ন । দু পাশে খোঁয়াড়ের ভেতর কাদায় গড়ান খাচ্ছে মেটে শূকরের পাল-দেখতে দেখতে গিয়েছি । মাদীগুলার
পেছনে ছুটছে মর্দা শূকর আর বাচ্চাগুলা দল বেঁধে ঘোঁত ঘোঁত করছে-এইদৃশ্যওখানে নৈমিত্যিক
। বাতাসেকি দুর্গন্ধই নাছড়াতো মাইরি! তাও কাটিয়ে যেতাম আমরা, নাক চেপে । ভাবলে এখন
দম বন্ধ হয়ে আসে । সবই শালা ঐবোতলের জন্য । শুনেছি কলেজপাড়ার ঠেকটা এখনো আছে । মুকুন্দকাকা
নাকি দেহ রেখেছে বছর কয়েক আগে । তার ছেলেটা ঠেক সামলাচ্ছে । আমরাই কেবল চলে এসেছি
ওখান থেকে ।
তা কম করে হলেও ১০ বছর তো হবেই । বোতলের সাথে তেমন যোগাযোগ
নেই । দেখা হয় মাঝে মাঝে । দূর থেকে হাত নাড়াই কখনো । ব্যস্ততা থাকলে এড়িয়ে যাই । এখন
ভিন্নপাড়ায় থাকি । আগে ছিলাম একই পাড়ায় । পাশাপাশি বাড়িতে । তখন কি পিরিতিই না ছিল
আমাদের ? গলায় গলায় ভাব । সবাই বলতো মানিকজোড় । ওর নেশা না কাঁটা পর্যন্ত বসে
থাকতাম ঠেকে । তারপর একসাথে বাড়ি ফেরা । সেসন্ধ্যে পর্যন্ত বসে থাকতো কলেজ মাঠে । আমি
ফুটবল নিয়ে দৌড়াতাম । খেলেটেলে একসাথে ফিরতাম । দুই বাড়িতে মুহুর্মুহু খবর চালাচালি
চলত যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা বাড়িঢুকছি । কখনো আমার ছোট বোনটা দৌড়ে যেত ওর বাড়ি,
কখনো ওর ছোট বোনটা আসত আমাদের বাড়িতে । কারন একটাই, দুজনই মায়েদের একমাত্র ছেলে
কিনা !
বোতল আমার বন্ধু । ভালো নাম শ্রী নিত্যানন্দ সরকার ।
আনন্দ নামে ডাকতাম । রেগে গেলে কেবল নিত্যা । হারিয়ে গেল কলেজে উঠে নিত্যা ও আনন্দ-দুটোই
। অতি মাত্রায় তরল গ্রহণে । ৩৩০-এর ছোট বোতল তো সেই স্কুল লাইফেই একটানে খতম করে
দিত । কলেজে উঠে ৭৫০-এর শেষ ফোটাটাও জিহ্বায় ঢেলেছে সজ্ঞানে । শালা, দিব্যি টেনে
গেছে । পেটানো শরীর-যা গেলতো সব সয়ে যেত।টলতো নাএকদম । ৩/৪ পেগ মেরেই সাথীরা উল্টে
পড়ে গেছে । মুখে কথার খৈ ফুটছে । অশ্লীল-অশ্রাব্য গালাগাল বেরোচ্ছে । কে কার সাথে
প্রেমে মজেছে, কে কার কাছে ছ্যাকা খেয়েছে, কে কখন কোন মেয়ের মাই টিপে দিয়েছে মেলায়-বিশাল
ফিরিস্তি টানছে । কিন্তু বোতল ঠিক আছে । ওদের পাশে বসে আমি ছোলাকাবলির চাট আর
কোল্ড ড্রিংকস মেরে যাচ্ছি । আর শুনে যাচ্ছি ওদের কথা । পরে কাজে লাগাবো । সুযোগে আমাকেও
কি ছাড়ে শালারা !
সেই আনন্দ মানে নিত্যানন্দ বিয়ে করে বছর সাতেক হল । এক মাঘের
শুরুতে । নেমন্তন্ন করতে বাড়ি এসেছিল নিজেই । আমি সেদিন কাজে ছিলাম । ফিরে এসে শুনেছি
। যেতে পারিনি ওর বিয়েতে । সরকারী চাকুরীজীবী মানুষ আমি । ছুটি ছাটার একটা বিষয়
থাকে । অবশ্য এক আধ দিন অফিস কামাই কোন ব্যাপার না । বড় অফিসে ছোট চাকুরের এই এক
সুবিধে । যখন তখন যে কোন ছুতোয় ছুট দেয়া যায় । জ্বর সর্দিকাশি-একটা কিছু বলে
অজুহাত দাঁড় করানো যায় । তাছাড়া শ’য়ে শ’য়ে কর্মচারী । কে কার খোঁজ রাখে । কেউ আঙুল
দিয়ে টুকে না দিলেই হল । কিন্তু দেয় কেউ কেউ । এই দেয়াটা জাতের স্বভাব ।
সবকিছু উপেক্ষা করে সেদিন অফিস কামাই দিতেও পারতাম । বাল্য
বন্ধুর বিয়ে বলে কথা ! কিন্তু দেইনি ইচ্ছে করেই । কারণও আছে একটা । বিয়ের ঠিক আগেরদিন
বিকেলে আমার সাথে দেখা হয় আনন্দের । বাজার হয়ে চলে এসেছি বাড়িরকাছাকাছি । হঠাতসামনে
পড়ে যাই । আমি অফিস ফেরত আর আনন্দবাজার মুখী । হাই হ্যালোতে পাশ কাটালাম একজন আরেক
জনকে । একটি বারের জন্যও আমাকে বিয়েতে যাবার কথাটা বলার প্রয়োজন মনে করেনি সে ।
এরপর আমি কোন মুখে যাই ! না, যাইনি বিয়েতে ।
ভেবেছিলাম পরে দেখা টেখা হলে হয়তো জিজ্ঞেস করবে-কেন
বিয়েতে গেলাম না । আমিও একটা কিছু বাহানা বানিয়ে শুনিয়ে দেব । গুড়েবালি । বিয়ের
মাস ছ’য়েকের মধ্যেই দেখা হয়েছে একাধিকবার । টুকটাক কথাবার্তাও হয়েছে । প্রতিবারই ভিন্ন
প্রসঙ্গ ।
গত সপ্তাহে হঠাত ফোন পেলাম, মইন আসছে কোলকাতায় ।
মইনুদ্দিন শেখ । আমাদের কলেজ বন্ধু । আমার আর আনন্দের সাথেই ভাবটা ছিল গভীর । থাকতো
কলেজপাড়াতেই । মুকুন্দ কাকার ঠেকে যেতে হত ওরঘর পেরিয়ে । আমরা পড়ে থাকতাম মইনের
ওখানেই-সময়ে অসময়ে । তাস পেটানো চলতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা । আর পাতার বিড়ি ঠোঁটে বিরতিহীন
। নিভে যেত একটু পরই । আগুন ধরে রাখার জন্য চোখঠোঁট কাঁপিয়ে যে উল্টো টানটা দিতে
হতো, ফুসফুস ফুটো হয়ে যাবার জোগাড় । চাইতাম গুডলিফ কিংবা চারমিনার ধরাতে । কিন্তু
পয়সা পাব কোথায় ? বাবার পকেট মারতে গিয়ে দেখতাম-বোনটা আগেই সে কম্ম খতম করে রেখে
গেছে । বাবা তক্কে তক্কে ছিলেন । যেই পকেটে হাত পুড়েছি-অমনি ধরা । খালি হাত
বেরিয়েছে পকেট থেকে । কিন্তু বাবার বদ্ধ ধারণা আমিই নিয়মিত এই কাজ করি । বাবা
শঙ্কিত হন আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ।একমাত্র ছেলে। বড় হয়ে পকেট মার না হয়ে হবেটা কি
শুনি-বাবার হুঙ্কারে মা বেড়িয়ে আসতেন রান্না ফেলে । মলমের কৌটা হাতে । জানতেন
লাগবে । নাড়ির টান যে ! একটানা চলতো বেত্রাঘাত । বাবাকে আটকানোর সাধ্য মায়ের ছিল
না । কেবল দমে ভাটা পড়লেই ক্ষেমা দিতেন । মা শুধু দাঁড়িয়ে দেখতেন । কখন মলম লাগাতে
হবে-সময় গুনতেন । মা কি ভেতরে ভেতরে গুমরে কাঁদতেনও ? হয়তো বা । জিজ্ঞেস করিনি
কোনদিন ।
মইন বনগাঁ ঢুকেইফোন করেছিল । বলেছি সোজা চলে আসতে আমার
এখানে । বাবা-মা স্বর্গবাসী । ছোট্ট ৩ কামরার একখানা বাড়িতে থাকি । সামনে পেছনে
কিছুটা খোলা জায়গা । বউ আর ১ মেয়ে । দিব্যি চলে যাচ্ছে । অতিথি মানেই দেবতা-আমি
উসখুস করলেও বউ দিব্যজ্ঞানে বিশ্বাস করে ।তখন বউয়ের খুশি এই ৩ কামরার বাড়িতে ধরে
না । আমি বাঁধা দেই না । এমনিতেই শ্বশুর বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ নেই। জাতের কেস । আমাকে
ভালোবেসে তাদের মেয়ে নাকি জাত খুইয়েছে । বউও যোগাযোগ ছেড়ে দিয়েছে । ফুললি সেক্রিফাইস
। মেয়েটা মাঝে মাঝে বায়না ধরে । টিকতে না পেরে পাঠাই । ওই বাড়িতে ঢুকি না আমি, দূরে
দাঁড়িয়ে থাকি । মেয়েটা গেটের ভেতরেপা দিলে তবেই ফিরে আসি । ওরাও এমুখো হয় না খুব
একটা । বোনের বিয়ে দিয়েছি । বছরে ১ বার আসেই । স্বামী-সন্তান নিয়ে । আর তেমন কারো
সাথে যোগাযোগ নেই ।
বউ মইনকে আগে দেখেনি । শুনেছে আমার কাছে । বহুবার ।দূর
দেশের অতিথি । আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখতে চায়নি । মইন আসে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে । ওর
মেয়েটা বছর পাঁচেকের । আমারটা আটে পড়েছে । আমি আর মইন আপ্লুত হই পরস্পরকে পেয়ে । অনেকদিনের
জমে থাকা কথাগুলা আবেগ মথিত অশ্রু হয়ে ঝরে । একটু থিতু হয়ে মেয়েরা মেতে উঠে খেলায়
। আর ওদের মায়েরা সুখ-দুঃখের সাতকাহন নিয়ে বসে পৈঠাতে ।
আমরা যখন বেরোই বিকেল তখন ।
সৌম্য সাদেক জয়ন্ত রৌদ্র পানু-আরো কে কে যেন ছিল আমাদের
তখনকার দলে ?আমার মনে নেই সব । কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই তো, তাই নামগুলাও স্মৃতি
থেকে হারিয়ে গেছে । অথচ মইনের দিব্যি মনে আছে। যাদের নাম নিল-ওরা সবাই আমাদের
কাছের বন্ধু ছিল । একসাথে কত আড্ডা-কত বাউয়ালি করেছি ?তাদের অনেকেরই সাথে এক শহরে
বাসছিল আমাদের কিংবা পাশাপাশি । এখনো কি আছে ওরা ? যোগাযোগ নেই একদম । মইনটা হরবোলার
মত বলে যাচ্ছে অতীত । বোতলের প্রসঙ্গ আসতেই চোখমুখ কেমন ঝলকে উঠলো মইনের । আমি মনে
মনে বলি-বন্ধু, এত খুশির কিছু নেই । দেখা হলে ঠিক টের পেয়ে যাবে ।
- হ্যাঁ রে পাপন,
বোতলের খবরটবর কিছু জানিস ?
- মাঝে মাঝে দেখা হয় । তবে কথা হয় না খুব একটা ।
- দেখা হয় কিন্তু কথা হয় না-এর মানে কি রে?
-ব্যস্ততা বুঝলি ব্যস্ততা !এই সংসারটংসার নিয়ে সময় পাই আর
কোথায়?
- তাই বলে দেখা হবে কিন্তু কথা হবে না-এটা হয় নাকি?
- হয়, এ সংসারে অনেক কিছুই হয় । তুই বুঝবি না ।
- না তা আমি বুঝবো কিভাবে-আমার তো সংসার টংসার কিচ্ছু নেই
।
- আহা রেগে গেলি নাকি ?
- বাদ দে । এবার বলতো মালটা থাকে কোথায় ?
- ঘোষপাড়া ।
- চল । আজ ওই দিকটা মেরে আসি ।
আজ না গেলেই নয়? ফেরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করি । মইন
এমনভাবে তাকায় যেন কোন অন্যায় কথা বলে ফেললাম । আসলে আমাদের ফেলে আসা সময়ের দহরম-মহরম
সম্পর্কটা মইন জানতো তো, তাই এই প্রতিক্রিয়া । আমি অবাক হই না ।
বলতো, তোদের মাঝে কি কোন...?
না না, তেমন কিছু না-শেষ করতে দেই না ওর কথা । কেড়ে নেই
। মইন চুপমেরে যায় । হাঁটতে থাকি । কাছেই হাইওয়ে । ধাবাগুলা দেখা যাচ্ছে । শ্রীহীন
। পাল্টে গেছে সব । রাতের মত জমজমাট নয় এখন । মাল বোঝাই ট্রাকগুলা দাঁড়িয়ে আছে
রাস্তার কিনারে । শোনা যাচ্ছে চলমান লরির গর্জন । বাতাসে ভর করে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্রশব্দ
। ফাঁড়ি রাস্তাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে । সন্ধ্যাও নামছে ঘন হয়ে । ২পাশে জঙ্গল । বিরাট
বিরাট অচেনা গাছ থেকে হিম অথচদম বন্ধ করা বন্যঘ্রাণ ভেসে আসছে । শুনেছি প্রায়ই ডাকাতি
হয় এদিকটায় । আগের চেয়ে উৎপাতটা এখন নাকি বেশি । তাড়াহুড়ো করে জায়গাটা পেরোই ।
ঘোষপাড়ায় পোঁছাই । ততক্ষণে দিনের শেষ আলোটুকু ঘুমিয়ে
গেছে রাত্রির কোলে । রাস্তার লাইটগুলা সোডিয়াম আভা ছড়াচ্ছে । দূর থেকে বোতলকে
দেখিক্যাশ আগলাচ্ছে । মইনকে বলে দেই-বোতল কিন্তু পুরুপুরি হারিয়ে গেছে । সাথে আনন্দ
এবং নিত্য-দুটোই । কেবলশ্রী নিত্যানন্দ সরকার সগর্বে এবং বহাল তবিয়তে টিকে আছে ।
মইন মুচকি হাসে । অশনি কিছু ঘটতে যাচ্ছে-হাসি দেখে বুঝতে পারি ।
কিরে বোতল ? কেমন আছিস ?
নিত্যানন্দ সরকার ঘুরে তাকায় । স্পষ্ট বিরক্তি চোখেমুখে
। মনে হয় চিনতে পারেনি । আমি এগিয়ে যাই ।
- চিনতে পেরেছ নিত্য ? এ মইন-আজ সকালে এসেছে বাংলাদেশ
থেকে ।
- চেনা চেনা লাগছিল । তা কেমন আছোমইন ? অনেক দিন পর দেখা
।
-ভালো আছি । তুই ?
- ভেতরে এসে বোস-এ যেন কেবলি ভদ্রতা । আমরা বসি । বসে
থাকি । এক ঘণ্টা তো হবেই । এর ভেতর নিত্যার একটা কথাও না । এবার উঠা দরকার ।
- তুই মনে হয় খুব ব্যস্ত । আমরা যাই রে-মইন দাঁড়াতে
দাঁড়াতে বলে আর আমি হাঁটা দেই ।
- যাবি । ঠিক আছে । আবার আসিস কিন্তু । একসাথে বসে চা
খাওয়া যাবে ।
- হা আসব । শুধু চা কেন বোতলও মারা যাবে ।
মইনের কথায় আমি অতি কষ্টে হাসি চেপে রাখি । দেখি শালা নিত্যা
রাগে গজগজ করছে । কাস্টমারগুলা কৌতূহলে তাকাচ্ছে । বেটার প্রেস্টিজ ইস্যু । রাস্তায়
নেমেই অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ি আমরা । আহা কি আনন্দ ।‘বোতলানন্দ ।’
মইন চমকে জিজ্ঞেস করে, কি বললি?
- বললাম বোতলানন্দ, কেন?
- যা তা একটা শব্দ বললি মাইরি !
বেশঅনেকটা সরে এসেছি নিত্যার দোকান থেকে । খুব চেঁচিয়ে
চেঁচিয়ে শালাকে খিস্তি মারতে ইচ্ছে করছে । বয়স হয়েছে, রাস্তায় বাওয়ালিকরলে লোকে
পাগল ভাববে । তবুও কয়েকবার চেঁচিয়ে বলে ফেললাম-নিত্যানন্দ বোতলানন্দ নিত্যানন্দ
বোতলানন্দ । সাথে মইনও গলা জুড়ল ।
নির্ঘাত নিত্যা শুনতে পেয়েছে । আমার গলার স্বরতো ভালো
করেই চেনে সে । ভাবছি, যেটুকু হাই/হ্যালো সম্পর্ক ছিল-এবার তাও গেল ।
মইনুদ্দিন শেখ ৭ দিন ছিল কোলকাতায় । শ্রী নিত্যানন্দ
সরকার যেদিন রাতে মইনের খোঁজে আমার বাড়ি আসে সেদিন সকালে ওরা দেশের উদ্দেশ্যে
রওয়ানা দেয় ।অবশ্য আরো ১দিন পরে যাবার কথা ছিল । কি কারনে যেন আগেই চলে যেতে হয় । দেখা
হয়নি। নিত্য অনেকক্ষণ বসেছিল ড্রয়িং রোমে । আমিও বসে ছিলাম-একটু দূরত্ব রেখে। কোন
কথা বলতে পারিনি আমরা । দীর্ঘ দিনের অনভ্যেস, সহজ হতে না পারার জড়তা, কিছুটা
অভিমান তো ছিলই-দুদিক থেকে ।
নিত্য হঠাত আমার পাশে এসে বসে । আমার হাত চেপে ধরে হুহু
করে কেঁদে উঠে । অপ্রস্তুত আমি-কি করবো ভেবে পাইনি । আর কি বলেইবা সান্ত্বনা দেয়া
যায়-আমার জানা নেই । টের পাই অনেক দিনের জমানো অভিমান আমারো বুক মুচড়ে আসতে চাইছে
। গলায় কফের মত প্যাঁচ খেয়ে খেয়ে যেন আটকে আটকে যাচ্ছে । চোখে ঝাপসা দেখি ।
-আমাকে ক্ষমা করে দে ভাই । গত পরশু বিকেলে আমার ওখানে
গিয়েছিল মইন । অনেক কথা হয়েছে । কিভাবে কিভাবে যে আমাদের বন্ধুত্বটা হালকা হয়ে গেল
একদম বুঝতে পারিনি ।
আমি অবাক হই ওর কথায় । মইন তো আমাকে কিছুই বলেনি ? এক
হাতে আমার হাতধরে রেখে চোখ মুছে নিত্য । আর এতেই আমিও ভুলে যেতে থাকি অতীত ।
-আমারও কি কম দোষ রে ? আমাকেও ক্ষমা করে দিস-ওকে বসতে
বলে ভেতর ঘরে পা বাড়াই ।
মদ ছেড়েছি অনেক দিন । হুইস্কির একটা বোতল এখনো রাখা আছে
তাকে । ওটা নামাই । ২টা গ্লাস নিয়ে বউ হাজির হয় । বরফ কুচি আসে, চাট আসে । বোতলের
চোখ চিকচিক করে । ২ প্যাগ মেরে আমি ক্ষেমা দেই । শালা টেনে যায় । অনেকদিন পর বন্ধুকে
ফিরে পাই। মইনের উদ্দেশ্যে একটা ধন্যবাদ ছুড়ে দেই ।
-আনন্দ, তোর নামটা কিন্তু চেঞ্জ হল আবারো ।
-আর ক’বার ? তা নতুন নাম কি দিলি ?
- আমি দেইনি । মইন দিয়েছে-শ্রী বোতলানন্দ সরকার ।