গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৪

মুস্তাইন সুজাত


শ্রী বোতলানন্দ সরকার

ভাগ্যিস চোলাই মদের ঠেকটা কলেজপাড়ার পেছনেই ছিল, নইলে যেতে হত পাক্কা এক মাইল দূরে । মেথর পট্টিতে । কলেজের পেছনেরমাঠ ধরে কিছুদূর এগোলেআলুথালু,উঁচুনিচু পথ পড়বে-ঢেউয়ের মত । শক্ত পাহাড়ি মাটিতে বাঁধাই ।ভাঙা পাথর-কাঁকড় কামড়ানো ঘাস । ২পাশে বন্য কাঁটাগাছ অসংখ্য । আকন পাতার ঝোপ কিছুদূর পরপর । আররাস্তার বাতাসে সেই পাতাদের কচিগন্ধ । লোকজনের চলাচল কম । সচরাচর চোখে পরে-বাইসাইকেলে দুলতে দুলতে কেউ যাচ্ছে কিংবা আসছে । এই পথ মাড়িয়ে মাঝে মধ্যে আমাদেরকে যেতে হয়েছে মেথর পট্টিতে । হেঁটেহেঁটে । অবশ্য থানার বাবুরা যখন নিজেদের পকেট নিয়ে বেকায়দায় পরতো তখন । বউ-ছেলেমেয়ের আবদার মেটাতে না পারলে সংসার টেকে? আহা, সংসারই যে স্বর্গ । আরপত্নী যেন স্বর্গরানি । রানির আবদার মেটাতে সোজা চোলাই ঠেকে এসে হানা দিত ওরা । ঝানু ব্যবসায়ী মুকুন্দকাকা যতই সদাটালরত অবস্থায় থাকতোনা কেন, কিভাবে যেন টের পেয়ে যেত-বাবুরা আসছে । কাকাও একটা জিনিস ছিল বটে-নিমিষেই ঠেক খালি ! কেবল পড়ে থাকতো বাঁশ কাঠের মিশ্রনে তৈরি পুরাতন বেঞ্চিগুলা আর হাড্ডিসার সাদানে ড়িটার নেশাখোর চাহনি ।

মেথর পট্টির ভেতরের রাস্তাগুলা সরু কিন্তু পরিচ্ছন্ন । দু পাশে খোঁয়াড়ের ভেতর কাদায় গড়ান খাচ্ছে মেটে শূকরের পাল-দেখতে দেখতে গিয়েছি । মাদীগুলার পেছনে ছুটছে মর্দা শূকর আর বাচ্চাগুলা দল বেঁধে ঘোঁত ঘোঁত করছে-এইদৃশ্যওখানে নৈমিত্যিক । বাতাসেকি দুর্গন্ধই নাছড়াতো মাইরি! তাও কাটিয়ে যেতাম আমরা, নাক চেপে । ভাবলে এখন দম বন্ধ হয়ে আসে । সবই শালা ঐবোতলের জন্য । শুনেছি কলেজপাড়ার ঠেকটা এখনো আছে । মুকুন্দকাকা নাকি দেহ রেখেছে বছর কয়েক আগে । তার ছেলেটা ঠেক সামলাচ্ছে । আমরাই কেবল চলে এসেছি ওখান থেকে ।

তা কম করে হলেও ১০ বছর তো হবেই । বোতলের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই । দেখা হয় মাঝে মাঝে । দূর থেকে হাত নাড়াই কখনো । ব্যস্ততা থাকলে এড়িয়ে যাই । এখন ভিন্নপাড়ায় থাকি । আগে ছিলাম একই পাড়ায় । পাশাপাশি বাড়িতে । তখন কি পিরিতিই না ছিল আমাদের ? গলায় গলায় ভাব । সবাই বলতো মানিকজোড় । ওর নেশা না কাঁটা পর্যন্ত বসে থাকতাম ঠেকে । তারপর একসাথে বাড়ি ফেরা । সেসন্ধ্যে পর্যন্ত বসে থাকতো কলেজ মাঠে । আমি ফুটবল নিয়ে দৌড়াতাম । খেলেটেলে একসাথে ফিরতাম । দুই বাড়িতে মুহুর্মুহু খবর চালাচালি চলত যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা বাড়িঢুকছি । কখনো আমার ছোট বোনটা দৌড়ে যেত ওর বাড়ি, কখনো ওর ছোট বোনটা আসত আমাদের বাড়িতে । কারন একটাই, দুজনই মায়েদের একমাত্র ছেলে কিনা !

বোতল আমার বন্ধু । ভালো নাম শ্রী নিত্যানন্দ সরকার । আনন্দ নামে ডাকতাম । রেগে গেলে কেবল নিত্যা । হারিয়ে গেল কলেজে উঠে নিত্যা ও আনন্দ-দুটোই । অতি মাত্রায় তরল গ্রহণে । ৩৩০-এর ছোট বোতল তো সেই স্কুল লাইফেই একটানে খতম করে দিত । কলেজে উঠে ৭৫০-এর শেষ ফোটাটাও জিহ্বায় ঢেলেছে সজ্ঞানে । শালা, দিব্যি টেনে গেছে । পেটানো শরীর-যা গেলতো সব সয়ে যেত।টলতো নাএকদম । ৩/৪ পেগ মেরেই সাথীরা উল্টে পড়ে গেছে । মুখে কথার খৈ ফুটছে । অশ্লীল-অশ্রাব্য গালাগাল বেরোচ্ছে । কে কার সাথে প্রেমে মজেছে, কে কার কাছে ছ্যাকা খেয়েছে, কে কখন কোন মেয়ের মাই টিপে দিয়েছে মেলায়-বিশাল ফিরিস্তি টানছে । কিন্তু বোতল ঠিক আছে । ওদের পাশে বসে আমি ছোলাকাবলির চাট আর কোল্ড ড্রিংকস মেরে যাচ্ছি । আর শুনে যাচ্ছি ওদের কথা । পরে কাজে লাগাবো । সুযোগে আমাকেও কি ছাড়ে শালারা !

সেই আনন্দ মানে নিত্যানন্দ বিয়ে করে বছর সাতেক হল । এক মাঘের শুরুতে । নেমন্তন্ন করতে বাড়ি এসেছিল নিজেই । আমি সেদিন কাজে ছিলাম । ফিরে এসে শুনেছি । যেতে পারিনি ওর বিয়েতে । সরকারী চাকুরীজীবী মানুষ আমি । ছুটি ছাটার একটা বিষয় থাকে । অবশ্য এক আধ দিন অফিস কামাই কোন ব্যাপার না । বড় অফিসে ছোট চাকুরের এই এক সুবিধে । যখন তখন যে কোন ছুতোয় ছুট দেয়া যায় । জ্বর সর্দিকাশি-একটা কিছু বলে অজুহাত দাঁড় করানো যায় । তাছাড়া শ’য়ে শ’য়ে কর্মচারী । কে কার খোঁজ রাখে । কেউ আঙুল দিয়ে টুকে না দিলেই হল । কিন্তু দেয় কেউ কেউ । এই দেয়াটা জাতের স্বভাব ।

সবকিছু উপেক্ষা করে সেদিন অফিস কামাই দিতেও পারতাম । বাল্য বন্ধুর বিয়ে বলে কথা ! কিন্তু দেইনি ইচ্ছে করেই । কারণও আছে একটা । বিয়ের ঠিক আগেরদিন বিকেলে আমার সাথে দেখা হয় আনন্দের । বাজার হয়ে চলে এসেছি বাড়িরকাছাকাছি । হঠাতসামনে পড়ে যাই । আমি অফিস ফেরত আর আনন্দবাজার মুখী । হাই হ্যালোতে পাশ কাটালাম একজন আরেক জনকে । একটি বারের জন্যও আমাকে বিয়েতে যাবার কথাটা বলার প্রয়োজন মনে করেনি সে । এরপর আমি কোন মুখে যাই ! না, যাইনি বিয়েতে ।

ভেবেছিলাম পরে দেখা টেখা হলে হয়তো জিজ্ঞেস করবে-কেন বিয়েতে গেলাম না । আমিও একটা কিছু বাহানা বানিয়ে শুনিয়ে দেব । গুড়েবালি । বিয়ের মাস ছ’য়েকের মধ্যেই দেখা হয়েছে একাধিকবার । টুকটাক কথাবার্তাও হয়েছে । প্রতিবারই ভিন্ন প্রসঙ্গ ।

গত সপ্তাহে হঠাত ফোন পেলাম, মইন আসছে কোলকাতায় । মইনুদ্দিন শেখ । আমাদের কলেজ বন্ধু । আমার আর আনন্দের সাথেই ভাবটা ছিল গভীর । থাকতো কলেজপাড়াতেই । মুকুন্দ কাকার ঠেকে যেতে হত ওরঘর পেরিয়ে । আমরা পড়ে থাকতাম মইনের ওখানেই-সময়ে অসময়ে । তাস পেটানো চলতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা । আর পাতার বিড়ি ঠোঁটে বিরতিহীন । নিভে যেত একটু পরই । আগুন ধরে রাখার জন্য চোখঠোঁট কাঁপিয়ে যে উল্টো টানটা দিতে হতো, ফুসফুস ফুটো হয়ে যাবার জোগাড় । চাইতাম গুডলিফ কিংবা চারমিনার ধরাতে । কিন্তু পয়সা পাব কোথায় ? বাবার পকেট মারতে গিয়ে দেখতাম-বোনটা আগেই সে কম্ম খতম করে রেখে গেছে । বাবা তক্কে তক্কে ছিলেন । যেই পকেটে হাত পুড়েছি-অমনি ধরা । খালি হাত বেরিয়েছে পকেট থেকে । কিন্তু বাবার বদ্ধ ধারণা আমিই নিয়মিত এই কাজ করি । বাবা শঙ্কিত হন আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ।একমাত্র ছেলে। বড় হয়ে পকেট মার না হয়ে হবেটা কি শুনি-বাবার হুঙ্কারে মা বেড়িয়ে আসতেন রান্না ফেলে । মলমের কৌটা হাতে । জানতেন লাগবে । নাড়ির টান যে ! একটানা চলতো বেত্রাঘাত । বাবাকে আটকানোর সাধ্য মায়ের ছিল না । কেবল দমে ভাটা পড়লেই ক্ষেমা দিতেন । মা শুধু দাঁড়িয়ে দেখতেন । কখন মলম লাগাতে হবে-সময় গুনতেন । মা কি ভেতরে ভেতরে গুমরে কাঁদতেনও ? হয়তো বা । জিজ্ঞেস করিনি কোনদিন ।

মইন বনগাঁ ঢুকেইফোন করেছিল । বলেছি সোজা চলে আসতে আমার এখানে । বাবা-মা স্বর্গবাসী । ছোট্ট ৩ কামরার একখানা বাড়িতে থাকি । সামনে পেছনে কিছুটা খোলা জায়গা । বউ আর ১ মেয়ে । দিব্যি চলে যাচ্ছে । অতিথি মানেই দেবতা-আমি উসখুস করলেও বউ দিব্যজ্ঞানে বিশ্বাস করে ।তখন বউয়ের খুশি এই ৩ কামরার বাড়িতে ধরে না । আমি বাঁধা দেই না । এমনিতেই শ্বশুর বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ নেই। জাতের কেস । আমাকে ভালোবেসে তাদের মেয়ে নাকি জাত খুইয়েছে । বউও যোগাযোগ ছেড়ে দিয়েছে । ফুললি সেক্রিফাইস । মেয়েটা মাঝে মাঝে বায়না ধরে । টিকতে না পেরে পাঠাই । ওই বাড়িতে ঢুকি না আমি, দূরে দাঁড়িয়ে থাকি । মেয়েটা গেটের ভেতরেপা দিলে তবেই ফিরে আসি । ওরাও এমুখো হয় না খুব একটা । বোনের বিয়ে দিয়েছি । বছরে ১ বার আসেই । স্বামী-সন্তান নিয়ে । আর তেমন কারো সাথে যোগাযোগ নেই ।

বউ মইনকে আগে দেখেনি । শুনেছে আমার কাছে । বহুবার ।দূর দেশের অতিথি । আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখতে চায়নি । মইন আসে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে । ওর মেয়েটা বছর পাঁচেকের । আমারটা আটে পড়েছে । আমি আর মইন আপ্লুত হই পরস্পরকে পেয়ে । অনেকদিনের জমে থাকা কথাগুলা আবেগ মথিত অশ্রু হয়ে ঝরে । একটু থিতু হয়ে মেয়েরা মেতে উঠে খেলায় । আর ওদের মায়েরা সুখ-দুঃখের সাতকাহন নিয়ে বসে পৈঠাতে ।

আমরা যখন বেরোই বিকেল তখন ।
সৌম্য সাদেক জয়ন্ত রৌদ্র পানু-আরো কে কে যেন ছিল আমাদের তখনকার দলে ?আমার মনে নেই সব । কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই তো, তাই নামগুলাও স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে । অথচ মইনের দিব্যি মনে আছে। যাদের নাম নিল-ওরা সবাই আমাদের কাছের বন্ধু ছিল । একসাথে কত আড্ডা-কত বাউয়ালি করেছি ?তাদের অনেকেরই সাথে এক শহরে বাসছিল আমাদের কিংবা পাশাপাশি । এখনো কি আছে ওরা ? যোগাযোগ নেই একদম । মইনটা হরবোলার মত বলে যাচ্ছে অতীত । বোতলের প্রসঙ্গ আসতেই চোখমুখ কেমন ঝলকে উঠলো মইনের । আমি মনে মনে বলি-বন্ধু, এত খুশির কিছু নেই । দেখা হলে ঠিক টের পেয়ে যাবে ।

- হ্যাঁ রে  পাপন, বোতলের খবরটবর কিছু জানিস ?
- মাঝে মাঝে দেখা হয় । তবে কথা হয় না খুব একটা ।
- দেখা হয় কিন্তু কথা হয় না-এর মানে কি রে?
-ব্যস্ততা বুঝলি ব্যস্ততা !এই সংসারটংসার নিয়ে সময় পাই আর কোথায়?
- তাই বলে দেখা হবে কিন্তু কথা হবে না-এটা হয় নাকি?
- হয়, এ সংসারে অনেক কিছুই হয় । তুই বুঝবি না ।
- না তা আমি বুঝবো কিভাবে-আমার তো সংসার টংসার কিচ্ছু নেই ।
- আহা রেগে গেলি নাকি ?
- বাদ দে । এবার বলতো মালটা থাকে কোথায় ?
- ঘোষপাড়া ।
- চল । আজ ওই দিকটা মেরে আসি ।
আজ না গেলেই নয়? ফেরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করি । মইন এমনভাবে তাকায় যেন কোন অন্যায় কথা বলে ফেললাম । আসলে আমাদের ফেলে আসা সময়ের দহরম-মহরম সম্পর্কটা মইন জানতো তো, তাই এই প্রতিক্রিয়া । আমি অবাক হই না ।
বলতো, তোদের মাঝে কি কোন...?

না না, তেমন কিছু না-শেষ করতে দেই না ওর কথা । কেড়ে নেই । মইন চুপমেরে যায় । হাঁটতে থাকি । কাছেই হাইওয়ে । ধাবাগুলা দেখা যাচ্ছে । শ্রীহীন । পাল্টে গেছে সব । রাতের মত জমজমাট নয় এখন । মাল বোঝাই ট্রাকগুলা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার কিনারে । শোনা যাচ্ছে চলমান লরির গর্জন । বাতাসে ভর করে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্রশব্দ । ফাঁড়ি রাস্তাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে । সন্ধ্যাও নামছে ঘন হয়ে । ২পাশে জঙ্গল । বিরাট বিরাট অচেনা গাছ থেকে হিম অথচদম বন্ধ করা বন্যঘ্রাণ ভেসে আসছে । শুনেছি প্রায়ই ডাকাতি হয় এদিকটায় । আগের চেয়ে উৎপাতটা এখন নাকি বেশি । তাড়াহুড়ো করে জায়গাটা পেরোই ।

ঘোষপাড়ায় পোঁছাই । ততক্ষণে দিনের শেষ আলোটুকু ঘুমিয়ে গেছে রাত্রির কোলে । রাস্তার লাইটগুলা সোডিয়াম আভা ছড়াচ্ছে । দূর থেকে বোতলকে দেখিক্যাশ আগলাচ্ছে । মইনকে বলে দেই-বোতল কিন্তু পুরুপুরি হারিয়ে গেছে । সাথে আনন্দ এবং নিত্য-দুটোই । কেবলশ্রী নিত্যানন্দ সরকার সগর্বে এবং বহাল তবিয়তে টিকে আছে । মইন মুচকি হাসে । অশনি কিছু ঘটতে যাচ্ছে-হাসি দেখে বুঝতে পারি ।
কিরে বোতল ? কেমন আছিস ?
নিত্যানন্দ সরকার ঘুরে তাকায় । স্পষ্ট বিরক্তি চোখেমুখে । মনে হয় চিনতে পারেনি । আমি এগিয়ে যাই ।
- চিনতে পেরেছ নিত্য ? এ মইন-আজ সকালে এসেছে বাংলাদেশ থেকে ।
- চেনা চেনা লাগছিল । তা কেমন আছোমইন ? অনেক দিন পর দেখা ।
-ভালো আছি । তুই ?
- ভেতরে এসে বোস-এ যেন কেবলি ভদ্রতা । আমরা বসি । বসে থাকি । এক ঘণ্টা তো হবেই । এর ভেতর নিত্যার একটা কথাও না । এবার উঠা দরকার ।
- তুই মনে হয় খুব ব্যস্ত । আমরা যাই রে-মইন দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে আর আমি হাঁটা দেই ।
- যাবি । ঠিক আছে । আবার আসিস কিন্তু । একসাথে বসে চা খাওয়া যাবে ।
- হা আসব । শুধু চা কেন বোতলও মারা যাবে ।
মইনের কথায় আমি অতি কষ্টে হাসি চেপে রাখি । দেখি শালা নিত্যা রাগে গজগজ করছে । কাস্টমারগুলা কৌতূহলে তাকাচ্ছে । বেটার প্রেস্টিজ ইস্যু । রাস্তায় নেমেই অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ি আমরা । আহা কি আনন্দ ।‘বোতলানন্দ ।’
মইন চমকে জিজ্ঞেস করে, কি বললি?
- বললাম বোতলানন্দ, কেন?
- যা তা একটা শব্দ বললি মাইরি !

বেশঅনেকটা সরে এসেছি নিত্যার দোকান থেকে । খুব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শালাকে খিস্তি মারতে ইচ্ছে করছে । বয়স হয়েছে, রাস্তায় বাওয়ালিকরলে লোকে পাগল ভাববে । তবুও কয়েকবার চেঁচিয়ে বলে ফেললাম-নিত্যানন্দ বোতলানন্দ নিত্যানন্দ বোতলানন্দ । সাথে মইনও গলা জুড়ল ।
নির্ঘাত নিত্যা শুনতে পেয়েছে । আমার গলার স্বরতো ভালো করেই চেনে সে । ভাবছি, যেটুকু হাই/হ্যালো সম্পর্ক ছিল-এবার তাও গেল ।

মইনুদ্দিন শেখ ৭ দিন ছিল কোলকাতায় । শ্রী নিত্যানন্দ সরকার যেদিন রাতে মইনের খোঁজে আমার বাড়ি আসে সেদিন সকালে ওরা দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় ।অবশ্য আরো ১দিন পরে যাবার কথা ছিল । কি কারনে যেন আগেই চলে যেতে হয় । দেখা হয়নি। নিত্য অনেকক্ষণ বসেছিল ড্রয়িং রোমে । আমিও বসে ছিলাম-একটু দূরত্ব রেখে। কোন কথা বলতে পারিনি আমরা । দীর্ঘ দিনের অনভ্যেস, সহজ হতে না পারার জড়তা, কিছুটা অভিমান তো ছিলই-দুদিক থেকে ।
নিত্য হঠাত আমার পাশে এসে বসে । আমার হাত চেপে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠে । অপ্রস্তুত আমি-কি করবো ভেবে পাইনি । আর কি বলেইবা সান্ত্বনা দেয়া যায়-আমার জানা নেই । টের পাই অনেক দিনের জমানো অভিমান আমারো বুক মুচড়ে আসতে চাইছে । গলায় কফের মত প্যাঁচ খেয়ে খেয়ে যেন আটকে আটকে যাচ্ছে । চোখে ঝাপসা দেখি ।

-আমাকে ক্ষমা করে দে ভাই । গত পরশু বিকেলে আমার ওখানে গিয়েছিল মইন । অনেক কথা হয়েছে । কিভাবে কিভাবে যে আমাদের বন্ধুত্বটা হালকা হয়ে গেল একদম বুঝতে পারিনি ।
আমি অবাক হই ওর কথায় । মইন তো আমাকে কিছুই বলেনি ? এক হাতে আমার হাতধরে রেখে চোখ মুছে নিত্য । আর এতেই আমিও ভুলে যেতে থাকি অতীত ।
-আমারও কি কম দোষ রে ? আমাকেও ক্ষমা করে দিস-ওকে বসতে বলে ভেতর ঘরে পা বাড়াই ।
মদ ছেড়েছি অনেক দিন । হুইস্কির একটা বোতল এখনো রাখা আছে তাকে । ওটা নামাই । ২টা গ্লাস নিয়ে বউ হাজির হয় । বরফ কুচি আসে, চাট আসে । বোতলের চোখ চিকচিক করে । ২ প্যাগ মেরে আমি ক্ষেমা দেই । শালা টেনে যায় । অনেকদিন পর বন্ধুকে ফিরে পাই। মইনের উদ্দেশ্যে একটা ধন্যবাদ ছুড়ে দেই ।
-আনন্দ, তোর নামটা কিন্তু চেঞ্জ হল আবারো ।
-আর ক’বার ? তা নতুন নাম কি দিলি ?
- আমি দেইনি । মইন দিয়েছে-শ্রী বোতলানন্দ সরকার ।


শালা,বলেই নিত্যানন্দ সরকার চোয়াল প্রশস্ত করে একটা হাসি দেয় । চোখের সামনে দেখতে পাই, নিত্য আনন্দ থেকে দূরে সরে যেতে যেতে কিংবা বোতলানন্দের সাথে মিশেতে মিশতে শ্রী বোতলানন্দ সরকার নাম ধারণ করে ।