গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৪

শুভ্র নীল


ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম  

সকাল বেলা অফিসে বসে অন্যান্য দিনের মত আলাপ করছিল সবাই। এমন সময় একটা লোককে দরজার সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখে ওসি ডাক দিল-
- এই আপনি কাকে চান? কিছু বলবেন?
একটু সাপোর্ট পেয়ে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকা লোকটা রুমে ঢুকলো। ওসি বললেন-
- আপনি?! আবার কোন সমস্যা?
- হ স্যার। আমারে বাঁচান, খুব অত্যাচার করতে আছে।
- আহা! কি করবেন এখন? ধমকিয়ে দিবো আবার?
- না, এইভাবে আর না। এভাবে কিছুদিন চুপ থাইক্কা আবার শুরু করে। আমি আর পারিনা স্যার। আমি মামলা করুম। হেরে জেলে ঢোকান স্যার।

একথা বলেই লোকটি কেঁদে দিল। পৌঢ়ত্ব ভর করা ঘোলা চোখে কষ্টের অশ্রু গড়িয়ে বেরিয়ে আসল। গায়ে পুরাতন পাঞ্জাবি, পরনে পুরাতন লুঙ্গি আর চেহারায় বয়সের দারিদ্র্যের ছাপ, ধূলোমাখা খালি পা... সবমিলিয়ে এক অসহায় বাবার প্রতিরূপ ফুটে উঠেছে। জীবনের নিষ্ঠুরতা আজ তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করছে। যিনি সারাজীবন শুধু কষ্টই করেছেন, সংগ্রাম করেছেন হয়তো সন্তানদের সুখী করতে। বিনিময়ে তিনি পাচ্ছেন সন্তানের নির্যাতন। কি জীবনের প্রাপ্তি না নির্মম পরিনতি!? ওসি বললেন -
-
তাহলে মামলাই করেন। আমি ডিউটি অফিসারকে বলে দিচ্ছি।
- হেয় আমারে মারে স্যার। খানা-দানাতো ঠিকমতন দেয়ই না, আরো এদিক-সেদিক হলেই হাত তোলে। আমি কিতা করতাম, স্যার। এক্কেরে তিতা অইয়া গেছি।

ওসি ডিউটি অফিসারকে ডেকে মামলা রেকর্ড করতে বললেল। লোকটিও সালাম দিয়ে চলে গেল। তদন্তকারী অফিসার পরবর্তীতে আসামীকে এরেস্ট করল এবং কোর্টে চালান করল। মামলাটি কোর্টে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কিছুদিন পর আরেক সকালে সেই লোকটি আবারো হাজির হল। ভয়, দ্বিধা আর অনুশোচনা মাখা কন্ঠে অফিসে ঢুকে ওসিকে বললেন -
-
আসসালামুআলাইকুম স্যার। একটা কথা কইতাম। কিছু মনে কইরবেননি?
- ওয়ালাইকুম... আসেন, আসেন। বলেন কি অবস্থা?
অনুশোচনা আর বিষাদে ভরা ধীর গলায় বললেন -
- পোলাডারে ছাইড়া দেয়ার ব্যবস্থা করন যায়না স্যার? খুব একটা শান্তি পাই না স্যার।
বলতেই বলতেই চক্ষু টলমল করছিল তাঁর। ওসিসহ সবাই অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাঁকিয়ে আছে। তাঁর আবেগটাও যেন সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল। ওসি নিচু গলায় বললেন -
-  এখন কি করতে চান বলেন তো?
-
মন রে বুঝাইতাম পারিনা, স্যার। হাজার হোক পোলাতো। হেতেরে ধইরা আননের পর থেইকা, মনডায় কেমন কেমন জানি করতাছে। কিচ্ছু ভাল্লাগে না? স্যার আমি মামলাডা উডাই ফেলতে চাই। তে আস্তে আস্তে ঠিক অইয়া যাইবো।
- আচ্ছা, বুঝলাম। না হয় হল। কিন্তু যে ছেলের নামে মামলা হল, পুলিশ ধরল, কোর্টে নিল্‌, সে ছেলে ফিরে আসলে আপনার উপর আরো বেশি অত্যাচার করবে নাতো?

ক্ষণিক নীরবতায় মাথা নত হয়ে আসে তাঁর। যেন সমূহ বিপদকে মাথা পেতে নেওয়ার প্রস্তুতি। এরপর নীরবতা ভেঙে মৃদুস্বরে বলতে লাগল -
- তাও ভালো। এখ্খন যে শাস্তিডা পাইতাছি তার থেইকা এইডাই ভালো। তে একটু ভালা চললেই ভালা। ভালা অইলেই ভালা।

সেদিন যে পোশাকটা পরে এসেছিলেন লোকটা। আজও সে একই পোশাক- পাঞ্জাবি-লুঙ্গি, খালি পা, খোঁচা খোঁচা পাকা দাঁড়ি, এলোমেলো পাকাচুল। নির্মমতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও, অযত্ন-অবহেলা আর অজানা ভয়ে থেকেও মহান পিতৃত্বের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সবার সামনে। বাবা কি জিনিস যার আছে সে অনেক সময় বুঝতে পারেনা। যার নেই সেই বুঝে। এই হতভাগা ছেলেটিও বুঝবে। বাবাকে জমি-টাকা এইসবের জন্য নির্যাতন করতেও তাঁর বিবেকে বাঁধে না। ওসি বললেন -
-  ঠিক আছে, তাই হোক। আপনি কোর্টে যান। কিন্তু, আপনার জন্য আমার চিন্তাও হচ্ছে।
-
না না স্যার। আমার লাইগ্গা চিন্তা কইরেন না। আমি একটা পথ কইরা রাখছি। দূর থেইক্কা হেগো সুখ দেখলেই আমার সুখ। সব দিয়া যামু। আমার আর কি! আল্লায় কোনদিন তালাইশ কইরা নিয়া যায় কে জানে! নাতিডা আমার লাইগ্গা জান স্যার। ওর লাইগ্গা খারাপ লাইগবো খুব। পোলার বউডা আমারে দেকতেই পারেনা। ওখানেই চইল্লা যামু।
- কিন্তু , কই যাবেন আপনি? এখন তো আপনার অনেক যত্ন দরকার।
- কি একটা হোম না কি জানি কয় বুড়া মাইনষের লাইগ্গা। ঐখানে আরো অনেক বুড়ারাই নাকি যত্নে আছে।

বুঝতে বাকি ছিলনা, তিনি বৃদ্ধাশ্রমের কথাই বলছেন। যে শব্দটি একসময়  এদেশে একেবারেই অপরিচিত ছিল আজ তা সুপরিচিত সাধারণ। দিন দিন বাড়ছে এর সংখ্যা আর এগুলোর সদস্য সংখ্যা। আমরা কোথায় যাচ্ছি?! যাঁদের জন্য আমরা এই পৃথিবীতে, এই আমাদের এতকিছু, যাঁরা তাঁদের সর্বস্ব বিলিয়ে দেন আমাদের জন্য, সেই মহাদেবতারাই হয়ে উঠেন বোঝা, অবাঞ্চিত। কালের কি নির্মম পরিহাস! এইরকম কিছু কুলাঙ্গার যেমন তাঁদের মা-বাবার যত্ন নেন না শেষ বয়সে। তেমনি কিছু দেবতুল্য মানুষ তাঁদের যত্নের ব্যবস্থা করেন, আশ্রয় নিশ্চিত করেন। তা না হলে হয়তো পাপের পাহাড় বড় হতে হতে একসময় মহাবিস্ফোরণ ঘটত। অসহায় সে বাবার স্থলও হয় সে বৃদ্ধাশ্রমই। মা নাকি না আগেই স্বর্গে চলে গেছেন। না হলে হয়তো তাঁকেও এই বৃদ্ধাশ্রমেই আসতে হতো। বাবা হয়তো দূর থেকেই সন্তানের কল্যাণ কামনা করেন আর প্রতিক্ষায় আছেন প্রিয় স্ত্রীর কাছে স্বর্গে চলে যাওয়ার জন্য। এই ঠুনকো, নিষ্ঠুর দুনিয়ায় দেনা-পাওনার আর কোন হিসাব যে বাকি নেই!!