অ্যাজলানের টূমস্টোন
দেখতে
দেখতে হ্যালোইন পর্ব ফিরে এলো আবার। এরকম তেরোটি পর্ব সে পার করেছে এইদেশে। তেরোটি বছর জীবনের অনেকখানি সময়। তেরো বছরে নানান চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে তাকে। তেরো বছরে তার নিজের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। পৃথিবীজুড়ে বহু পটপরিবর্তন হয়েছে, নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে সে রওনা হয় এরিকের বাসার দিকে, পদব্রজে। একাকী হাঁটতে তার ভালো লাগে। কিছু কিছু মজ্জাগত অভ্যাস মানুষের থেকে যায় আজীবন‒যেমন একা একা পথ চলা এবং স্মৃতিচারণ করা।
বছর
ঘুরে হ্যালোইন উৎসব ফিরে এলে তার একটা কথা মনে পড়ে: ‘অরেঞ্জ ইজ দ্যা কালার অভ হ্যালোইন।’কথাটা বলেছিল এক কানাডিয়, হ্যালোইন উৎসব পালনকালে এবং সেটা বাংলাদেশে থাকতেই। কানাডিয় সিডায় একসময় এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ট্রেনিং নিয়েছিল সে। সেই সুবাদে সিডার কানাডিয় কর্মকর্তাদের হ্যালোইন উৎসবে দাওয়াত পেয়েছিল। সেখানে নানা কিম্ভূত আয়োজন-উপকরণে কমলার আধিক্য দেখে তার জানতে ইচ্ছে করছিল যে, চৌদিকে এত কমলা রং কেন? মিষ্টি দেখতে একটি মেয়ে হেদার তখন কথাটা বলেছিল।
হেদার আজ পৃথিবীতে নেই, সে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল তেরো বছর আগে। মেয়েটি আদতে দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা ছিল। বহুবছর আগে তার বাবা-মা কানাডায় অভিবাসী হয়। কিশোরী হেদার লম্বা সময় পার করে ভ্যাঙ্কুভারে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নেয়। চাকরির সুবাদে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ায়। একবার সে জন্মভূমির টানে পাড়ি দেয় ডারবানে, যে ভূমি তাকে জন্ম দেয়, সেই ভূমিই তাকে উদরস্থ করে ফেলে। যৌবনের মধুর সময়টাতে হেদার বিদায় জানায় পৃথিবীকে।
স্মৃতিরা এসে ভিড় জমায় মনের আয়নায়।
প্রথম স্ত্রীর সাথে ফই’স লেকে ঘুরে বেড়ানো, কক্সবাজার সৈকতে অবাধ সন্তরণ এবং কাঠমাণ্ডুতে হানিমুন যাপনের কথা মনে পড়ে। কেন এমন হয়? কেন শৈশবের বন্ধু রাজু এত তড়িঘড়ি করে চলে গেল না ফেরার দেশে! অতীতের তুচ্ছ ঘটনা আর গুরুত্বহীন মানুষও মনের মাঝে উঁকি দিয়ে যেতে লাগল।
সে
হ্যালোইন উৎসবে যোগ দিতে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। ইচ্ছে করেই গাড়ি নেয়নি। ডাক্তার হাঁটতে বলেছে। ঘাম ঝরানো দৌড়াবার কথা বলেছে। দৌড় বা জগিংকে কোনোকালেই আয়ত্ত করতে পারেনি সে; হাঁটাচরার অভ্যাস কম ছিল। ইদানিং হাঁটছে, যদি রোগটা সারিয়ে তোলা যায় আর সাড়ে তিনহাত মাপের কুঠুরি থেকে কিছুটা দূরত্বে থাকা যায়, সেই প্রত্যাশায়। প্রেসারের রোগ ছিল আগে থেকেই, ইদানিং কোলেস্টেরলের সমস্যাও বেড়ে গেছে।
বন্ধু
এরিকের বাসায় হ্যালোইন উৎসব। বাসাটা হেঁটে যাবার জন্য কিঞ্চিৎ দূরে‒কক্সওয়েল অ্যাভেনিউতে। তার বাসা কক্সওয়েলে হলেও এরিকের বাসা থেকে একটু দূরেই। দূরত্ব ও ঠাণ্ডা চলনসই হওয়ায়
সে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। হাঁটার মধ্যে বাড়তি আনন্দও লাভ হতে পারে। বিকেলেই সে রওনা হলো এরিকের বাড়ির উদ্দেশে। এরিক ওর কলিগ ও বন্ধু। ওর সাথে স্ট্র্যাথমোর এনভায়রনমেন্টে চাকরি করে। উদার ও ফুর্তিবাজ মানুষ।
তেরো
বছর আগে, পুবে কক্সওয়েলের আগের স্টেশন মেইন স্ট্রিটে উঠেছিল সে, একটা বেইসমেন্ট ভাড়া করে থাকত। কলুর বলদের মতো খাটত রেস্তরাঁয়। কোনো বন্ধুবান্ধব ছিলনা, ছিলনা কোনো আত্মীয়। একাকী, নিঃসঙ্গ জীবন। বউ নেই, সন্তান নেই। সে ছিল মমির মতো বিবর্ণ ও বোধহীন।
দেশে
থাকতে তার বউ ছিল। কিন্তু পরিণয় পর্বের শুরু থেকেই পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গির আকাশপাতাল পার্থক্যে আর মানসিকতার গড়মিলে সংসার টেকেনি। দু’জনার অনেকদিনের জমানো বিবমিষা চরমে উঠেছিল, পরিণতিতে পৃথিবীতে আগমনের আগেই নিষ্পাপ শিশুর চিরবিদায়ের মতো একটা সংসার মিশে গেল ধূলায়।
তারপর দুইবছর বাউণ্ডুলে জীবনযাপন করার পর ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করে উত্তীর্ণ হয়ে এইদেশে আসে সে। আগমনের
প্রথম তিনবছর কাটে মানিয়ে নিতে এবং কাজ পেতে। রেস্তরাঁয় কম বেতন পেলেও একা মানুষ হওয়ায় আর কম ভাড়ায় থাকার সুবাদে মাসকাবার টাকা জমছিল। একটা সময় সে রেস্তরাঁর কাজটাকে পার্টটাইম করে ভর্তি হয়ে যায় এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোর্সে। কোর্স শেষ করে সে চাকরি পায়নি সাথে সাথে। কিন্তু বসেও থাকেনি। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ভলান্টারি সার্ভিস দিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে লাগল। কিছুদিন জোর প্রচেষ্টার পর স্ট্র্যাথমোরের মতো বড়সড় কোম্পানিতে চাকরি হয়ে যায় অবশেষে।
সে
যখন চাকরি করে টাকা জমিয়ে চলছিল তখন এক বাঙালি বন্ধু তাকে পাত্রীর সন্ধান দিল। সেই মহিলা একজন টিচার, মানে এদেশিয় টিচার। বাপ-মা সহ এইদেশে বাস করছে। মহিলার আধাআধি বিয়ে হয়েছিল। বাগদান হবার পর জানা যায়, গ্রোসারি স্টোর মালিক পাত্রের বাংলাদেশে স্ত্রী-সন্তান আছে। বিয়ে ভেঙে দেয় পাত্রীপক্ষ। পিছুটান ঝেড়ে ফেলে মহিলা চালিয়ে যায় পড়াশোনা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এইদেশের টিচারের স্বীকৃতি পেল সেই নারী।
বিয়ে
সম্পন্ন
করে একেবারে নিজের কেনা বাড়িতে উঠল নবদম্পতি। মেইন স্ট্রিটে তার ভিনদেশিয় জীবন ও জীবিকা শুরু হলেও উডবাইন-কক্সওয়েল এলাকাতেই তার কর্মপরিধি ও গতায়ত সীমিত ছিল। তাই সে কক্সওয়েল এলাকাতেই বাড়ি কিনল, এলাকাটাতে পরিচিতির গণ্ডিও বৃদ্ধি পেয়ে চলছিল। সেলিনা ওরফে জুঁই পছন্দ করল বাড়িটা। তারপর দু’জনের মিলিত রোজগারে সংসারটা তরতর করে এগিয়ে গেল। দু’টি সন্তান হলো তাদের। দু’টিই ছেলে। একজনের বয়স নয়, অন্য জনের সাত।
হ্যালোইন উদযাপনের কারণে কিনা কে জানে, রাস্তাঘাট ফাঁকা।
সুনসান। এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দুইপাশের বাড়িঘর কমতে লাগল। একটা ঢাল বেয়ে সে নেমে গেল। নজরে পড়ল গ্রিনউড সিনিয়র সেন্টার। আগে তো কখনও দেখেনি এমন সেন্টার! মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল সে চিন্তাটা। আগে দেখতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। কানাডা অতিকায় দেশ, টরোন্টো বিরাটাকার শহর, তাতে অসংখ্য এলাকা, শতসহস্র রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, গাড়ি, মানুষ। কয়টা সে চিনে রাখবে?
সে
হাঁটতে লাগল ঢাল বেয়ে। দুইপাশের উঁচু ঝোপঝাড়ের ভেতর অর্ধেক শরীর ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৈদ্যুতিক খুঁটি।
একটা
ব্রিজ পেরিয়ে তার মনে হলো, এরিকের বাড়ির দিকে আসতে তো কোনো ব্রিজ পড়েনা! ব্রিজটার দুইপাশে রেলিংঘেঁষে মানুষ চলাচলের পথ আর মধ্যিখানে গাড়ির রাস্তা। সড়াৎ সড়াৎ করে গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে। ব্রিজটা উঁচুতে, নিচে তাকিয়ে সে দেখল খালের মতো একটা জলাধার। তার দুইপাশে অসংখ্য বাড়িঘর। ওপর থেকে বিশাল কোনো শিল্প প্ল্যান্টের অসংখ্য ব্লকের মতো লাগছে। সে ভাবল, আজ বোধহয় মনের ভুলে অন্য দিক দিয়ে চলে এসেছে। সিদ্ধান্ত নেয় সে, ব্রিজ পার হয়েই অগ্রসর হবে। হয়তো সামনের কোনো একটা রাস্তা বন্ধুর বাড়ির দিকে গেছে। সে তরতরিয়ে নেমে গেল ব্রিজ দিয়ে। দেখল একটা বড় রাস্তা সামনে, কোথায় গেছে কে জানে। এক জঙ্গুলে স্থানে এসে সে ফের ব্রিজে উঠে যাবার কথা ভাবল। তাহলে কি সে মোনার্ক পার্কে চলে এলো? কিন্তু জায়গাটা তো তার চেনা মোনার্ক পার্কের মতো মনে হচ্ছেনা। এইসময় নজরে এলো বস্তুটা‒একটা ঢালুমতো স্থানে, পাশে বয়ে যাচ্ছে টানা অগভীর জলধারা। পাখির ডাক ভেসে আসছে। আশপাশের গাছের শাখায় ব্যস্তসমস্ত ছুটাছুটি করছে কালো ও ধূসর বর্ণের কাঠবেড়ালি।
বস্তুটা একটা সমাধি-ফলক।
এখানে সমাধিশিলা কেন? কার সমাধি? জায়গাটা তো সমাধিক্ষেত্র বলে মনে হচ্ছেনা। আশেপাশে তাকাল সে। দূরে, বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে বাড়িঘর উঁকি দিচ্ছে। না, একটাই সমাধি। কোনো কবরস্থান নয়। মাত্র একটা সমাধি?
রাস্তার দিক থেকে আড়াআড়ি নেমে সমাধির কাছে এলো সে।
দেখল, নাম লেখা‒অ্যাজলান। কে এই অ্যাজলান? তার অন্তিম শয়ন এখানে কেন? তার মনে হলো, দুনিয়াটা বুঝি অন্তহীন রহস্যের নিরাকার জাল।
বুকের
ভেতরে বেদনার নীল ঢেউ বয়ে গেল। সে ঘুরে দাঁড়ায়। সিদ্ধান্ত নেয়, যে পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে যাবে। সে আবার ব্রিজে উঠল। বিপরীত দিক থেকে এক মাঝবয়সী শাদা দম্পতি আসছিল। তাদেরকে ইশারা করে থামিয়ে পুরুষটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি বলতে পারো, ওই যে ওখানে কবরটি আছে, সেটা এখানে এমন জায়গায় কেন? আই মীন, মাত্র একটাই কবর কেন এখানে?’ লোকটা ওর দিকে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর অবজ্ঞা ও বিরক্তিমাখা হাসি দিল। বলল, ‘হ্যালোইনের সন্ধ্যায় তুমি এখানে কেন? মনে হয় গলা পর্যন্ত টেনেছ?’ হা-হা-হা। লোকটির হাসি থামতেই চায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসল লোকটা, তারপর যেতে যেতে হাসতে লাগল। এরপর উচ্চহাসিতে যোগ দিল মহিলাটিও।
ব্রিজে উঠে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে সে কিছুটা বিশ্রাম নিল।
মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় সেই দম্পতির বিদঘুটে কটাকট হাসি। এতবছর ধরে এদেশে আছে, কিন্তু এই শাদাগুলোকে আজও চিনতে পারলনা। অনেককিছুই তো অজানা; জানার সুযোগ হয়নি জীবনসংগ্রামে লিপ্ত থাকায়। এসব ভেবে মনটা কুঁকড়ে গেল। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, ব্রিজের নিচের জলধারায় সূর্যের লালচে আভা। সূর্যটা বোধহয় ঘন বৃক্ষরাজির আড়ালে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। সে হাঁটতে লাগল আবার।
আজ
সব গড়বড় হয়ে গেছে। বয়সের ছাপ? নাকি জীবনের অনেক তিক্ততা তাকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকার কোনো গহবরের দিকে? সে যখন গ্রিনউড সিনিয়রস সেন্টারটা দেখল, তখন তার বুঝা উচিৎ ছিল যে সে ঠিক ডিরেকশনে যাচ্ছেনা। কক্সওয়েলের শেষপ্রান্ত ছাড়িয়ে সে গ্রিনউডে পড়েছে কিন্তু সে আনমনা ছিল। এমনকি কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে তা-ও মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।
মনে
হলো একটা ক্যাব ডাকা উচিৎ। পথ হারিয়ে ফেলেছে সে, সুতরাং হেঁটে এখন এরিকের বাড়িতে যাওয়ার প্রয়াস মানে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজা। একটা ক্যাব এগিয়ে আসছিল। ইশারা করতেই সাইডওয়াক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল ক্যাব। শেতাঙ্গ ট্যাক্সিচালক, দেখতে মোমের মতো শাদা ও বিবর্ণ। চোখ দু’টো ঘোলাটে, মৃতের মতো চাহনি। ড্রাইভার বলল, ‘কোথায় যাবে?’
সে
বলল, ‘কক্সওয়েল অ্যাভেনিউ,’ তারপর বাড়ির নাম্বারটাও বলল। গাড়ি চলতে শুরু করল। তার ভেতরে অস্বস্তির স্রোত বইছিল, সেটা কাটাতে ড্রাইভারের সাথে আলাপ
শুরু
করল সে‒
‘তুমি বর্ন ক্যানেডিয়ান নাকি ইমিগ্র্যান্ট?’
‘ইমিগ্র্যান্ট। আমি আদতে সার্বিয়ান। ২০০১ সালে এদেশে আসি।’
‘স্থানীয়?
মানে আশেপাশের এলাকার লোক?’
‘না তো! কেন?’
‘না, থাক।’
‘তোমাকে কেমন ভূতুড়ে মনে হচ্ছে, তুমি কি কোনো কারণে ডিস্টার্বড?’ ড্রাইভার যান্ত্রিক স্বরে বলল। এরকম প্রশ্নে সে ঘাবড়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারলনা। বলল, ‘না, না ডিস্টার্বড হবো কেন?’ ড্রাইভার একথায় এমনভাবে হাসল যে তার কাছে মনে হলো, উত্তরটা ড্রাইভারের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সে তখন বলল, ‘না, মানে ওই যে ব্রিজটা ছেড়ে এলাম, সেটার কাছে একটা টূমস্টোন.. সেখানে মাত্র একটা কবর কেন? কার কবর?’
‘টূমস্টোন! আমি বলতে পারবনা। এরকম কোনো টূমস্টোনের কথা আমার জানা নেই। আচ্ছা, কক্সওয়েল অ্যাভেনিউ তো কাছেই। তুমি ক্যাব নিলে কেন?’ ড্রাইভার জানতে চাইল।
‘আমার এক বন্ধুর বাসায় হ্যালোইন উদযাপন করার কথা। অনেক আগেই পৌঁছাতে বলেছিল। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।’
‘কী বললে! হ্যালোইন উদযাপন? জানো আমার মা তিনবছর, না না‒আজকেরটা নিয়ে চার বছর আগে, হ্যালোইনের রাতে মারা যায়,’ড্রাইভার একহাতে বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকল। ‘মা স্কিটসৌফ্রেনিয়া রোগে ভুগছিল। মা’র মৃত্যুটা ছিল পেইনফুল ও বীভৎস। হ্যালোইনের রাতে নরকের প্রেতেরা নেমে আসে মর্ত্যে।’ ড্রাইভার আবার বলল, ‘তুমি তো এসে গেছ। নামবে, নাকি আরো যাবে!’
‘না, না!’ সে আঁতকে উঠে বলল, ‘ধন্যবাদ। মিটারে কত উঠেছে?’
‘ভাড়া লাগবেনা। ফ্রি রাইড।’
‘কিন্তু কেন!’ কথাটা বলার আগেই সার্বিয় ক্যাব ড্রাইভার সাঁ করে গাড়ি টেনে মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল। সেদিকে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকল সে কিছুক্ষণ।
তারপর
সে কম্পিত পদক্ষেপে ঢুকল এরিকের বাড়িতে। ঢুকে মনে হলো আগে কখনও আসেনি সে এবাড়িতে। গেইটে, ছোটো বারান্দায় জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন সাজানো। বড় বড় জলজ্যান্ত কুমড়ো বিভিন্নভাবে কার্ভিং করে তাকে পৈশাচিক আদল দেয়া হয়েছে। কুমড়োগুলোর ভেতরে ছোটো ছোটো বাল্ব জ্বালিয়ে রহস্যময়-ভয়ঙ্কর আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে। এরকম ছোটো বড় বহু কুমড়ো এবং বারান্দায় ঝুলানো সত্যিকারের মনুষ্য করোটি যেন নরকের আসর সাজিয়ে বসেছে।
বন্ধুর সাথে সে একঘন্টা কাটাল।
ওর আনমনা ভাব লক্ষ করে আগেভাগেই ওকে বিদেয় জানাল এরিক। বাইরে বের হয়ে সে ভাবল‒কেমন অস্বভাবী রাত!
রাত
বেড়ে গেছে, ঠাণ্ডা বাড়ছে। বাসস্টপে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে সে। বাস আসতে দেরি করছে। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা ঘটনা মনে পড়ল। সে একবার টেইলর ক্রিক পার্কে বেড়াতে গিয়েছিল। পার্কটার ধরন আদিম প্রকৃতির। কোনো যত্নআত্তি হয়না পার্কটার। আবহ বুনো প্রকৃতির। বিশালাকার সব বৃক্ষ, ঘন জঙ্গল আর নালা। সেই পার্কে একবার একাকী ঘুরে বের হবার সময় একটুকরো সবুজ ঘাসের বুকে সে দেখতে পায় একটা অ্যাপিটাফ। পার্কে এরকম ছন্নছাড়া অ্যাপিটাফ কেন! সে বিবরণ পড়েছিল‒বয়স, সেক্স, জন্ম ও মৃত্যু সাল ইত্যাদি। নাম ছিল রকেট। হতভাগা রকেট ছিল একটি কুকুর। তার মানে অ্যাজলানও একটি কুকুর!
টেইলর
ক্রিক পার্কের সেই অ্যাপিটাফের কথা এতক্ষণ পড়ে মনে পড়ল কেন? দিনের অনেকটা সময় সে হাঁটার মধ্যে ছিল। হাঁটতে হাঁটতে অজস্র স্মৃতি রোমন্থন করেছিল। তাই হাঁটবার কষ্টটুকু যেমন অনুভব করেনি, তেমনি কখন কক্ষচ্যুত কোনো গ্রহের মতো চলছিল, টের পায়নি। স্মৃতিগুলো...অজস্র, দূর অতীতের...। অজর আদিম স্মৃতির মাঝে সাম্প্রতিক স্মৃতিগুলো ফিরে আসার পথ করে নিতে পারেনি।
বাস
চলে এলো। সে উঠে পড়ে বাসে। এইসময় সেলফোন বাজল‒জুঁই ফোন করেছে। ‘তুমি কোথায় সাদী? রাত তো অনেক হলো।’সে বলল, ‘আমি আসছি। পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। এসে তোমাকে সবটা বলব।... না, না। এরিকের বাসা থেকে সেই কখন বেরিয়ে গেছি।... এখন বাসে। রাখি।’
নিজ
বাড়ির কাঠের ফটক পার হয়ে সে দেখল, আঙিনাভর্তি কেবল কুমড়ো আর কুমড়ো‒যেন একেকটা শয়তানের প্রতিমূর্তি। কোনো কোনোটির মুখ আবার দেখতে খেতের কাকতাড়ুয়ার মতো। চৌকাঠে পা দেবার আগে তিনধাপের সিঁড়ির দুইপাশের জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন থেকে হলুদ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সে প্রায় গুঙিয়ে উঠল‒‘এইসব কোথা থেকে এলো! কে করেছে!’
‘কে আবার? তোমার গুণধর দুই পুত্ররত্ন।’ জুঁই বলল। কখন এসে যেন ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল জুঁই।
সে
মূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ভৌতিক বস্তুগুলোর দিকে।
( হ্যালোইন (ইংরেজি: Halloween) উত্তর আমেরিকায় পালিত এক উৎসব প্রতিবছর ৩১ অক্টোবর পালিত হয় হ্যালোইন উৎসবেপালিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে ভূতের ট্যুর, বনফায়ার, আজব পোশাকের পার্টি, আধিভৌতিকস্থান ভ্রমণ, ভয়ের চলচ্চিত্র দেখা, প্রভৃতি ।)