কোকিল ডেকেছিল
তারপর রোবানা ম্যাডাম বললেন, এই, তোদের কি সাহস আছে ?
কাজল লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল, কী সাহস?
তিনি বললেন, সাহস আছে কি না বল।
আমরা দুজনেই এ ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, সাহস আছে তো ম্যাডাম।
রোবানা ম্যাডাম পাখির পালক ঝারার মত পিছনের দিকে মাথাটা ঝাঁকিয়ে দু’হাতে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বললেন, তাহলে আমার জন্য সিগারেট নিয়ে আয়।
ম্যাডামের ঠোঁটে চাপা থাকা কালো রাবার বা গলাটা টান করে রাখার কারণেই হোক, মনে হলো আমরা কেউই কথাটা শুনতে পাই নি, এমন বিস্ময় নিয়ে কাজল প্রশ্ন করে, কী আনব?
ঠোঁটের রাবার চুলে পেঁচিয়ে, ডান হাতে ভি চিহ্ন করে, সিগারেটের জন্য আমরা, বখাটেরা, যে দুটো আঙুলের দু’পাশ সুখটানের প্রতিযোগিতায় অলরেডি অবশ করে দিয়েছি, সে দুটি আঙুল রোবানা ম্যাডাম তাঁর ঠোঁটে স্পর্শ করে, শুন্য থেকে মুখের ভেতরে অদ্ভুত শব্দ টেনে বললেন, সিগারেট বুঝিস না, সিগারেট, ফাইভ ফাইভ।
আমরা খুবই হতাশ হলাম। কাজল বললো, মেয়েরা আবার সিগারেট খায় নাকি?
ম্যাডাম তখন উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল থেকে একটি বই নিতে নিতে বললেন, তোরা খেতে পারলে আমার অসুবিধা কী?
ম্যাডামের এই অতর্কিত কাউন্টার এ্যাটাকে আমরা লজ্জায় পারি তো পালাই। তিনি বললেন, আর তোরা যে টিফিন পিরিয়ডে পাথরের চিপায় গিয়ে টানিস এর খবর কিন্তু আমার কাছে আছে।
এখানেই শেষ নয়, তিনি অপমান করতেও ছাড়লেন না, নাক টিপলে এখনো দুধ বের হবে, এই সব পোলাপান টানে বিড়ি। ভাগ, যা বলছি আন।
আমরা ছুটে গেলাম কবিরের দোকানে। কবির আমাদের দেখেই গলা বাঁকিয়ে বিকৃত মুখে ছুরি দিয়ে দুধের কৌটা ছিদ্র করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কাজল বলল, পাঁচটা বাংলা ফাইভ দাও বন্ধু।
হাতের তালুর বাড়িতে কৌটায় ছুরি ঢুকিয়ে কায়দা করে ঢাকনাটা কাটতে কাটতে নিচু মাথায় কবির বলে, তোরার কি শরম নাই? একটু আগে না কীড়া কাইটা গেলি আর কোনও দিন বাকি চাইবি না।
কবিরকে সত্যি ঘটনা বলার সুযোগ নেই। তবু বললাম, এটা ইমার্জেন্সি। মান সম্মানের ব্যাপার। না কইরো না বন্ধু।
ও তখন ক্যাশবাক্সের উপর থেকে বাকি-বিষয়ক বিজ্ঞাপনটি আমাদের সামনে, পাউরুটি রাখার একটি আঙটাতে ঝুলিয়ে চুড়ান্ত অপমান করে বললো, তোরার ইমার্জেন্সির মাইরে বাপ।
যদিও কাজল জানে, কবিরের সাথে ও হারে না। তবু গলা নরম করে বলে, কবির, বন্ধু, কালকের ভেতর যদি বাকির টাকা না দেই তাহলে আমি বিউটিকে ছেড়ে দেব।
এবার কবির অত্যন্ত বিস্ময়ে বলে, তোরার ঘটনাডা কী কতো। গোল্ডলিফ ছাইড়া ফাইভফাইভ ধরার বিষয়ডাও তো বুঝলাম না।
কাজল হার্ড-লাইনে যেতে চায়, ক্যাশে উঠে যাব কি না বল?
কবির হাল ছেড়ে দেয়, হ উইঠা যা। ক্যাশ তো তোরারই। এই বাগানবাড়ি তো তোরারোই তাল্লুক।
ওদের এই সব কথার পরের চিত্রনাট্য আমাদের খুবই চেনা। কবির গজগজ করে ক্যাশের ভেতর থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে কাজলের দিকে অনিচ্ছায় ছুঁড়ে দিয়ে বলবে, দুইটার বেশি নিস না। অল্প বয়সে কাশতে কাশতে মরবার বাউ লইছস।
কাজল সিগারেট পাঁচটাই নেবে আর কবির কেটলি নিয়ে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলবে, স্যারেরার কি চা লাগব নি?
আমরা না-না করব আর কবির একটি সরল হাসিতে দুটো কাপ দু’দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলবে, খা। নতুন পাত্তি দিছি, মজা পাইবি।
এই হলো কবির। তাকে নিয়ে সন্ধ্যার পর থেকে ঝিলের পাশে পরিত্যক্ত রেললাইনে যে মজমায় আমরা মেতে থাকি, তার কথা একটু পরে হবে।
হাতের তালুর বাড়িতে কৌটায় ছুরি ঢুকিয়ে কায়দা করে ঢাকনাটা কাটতে কাটতে নিচু মাথায় কবির বলে, তোরার কি শরম নাই? একটু আগে না কীড়া কাইটা গেলি আর কোনও দিন বাকি চাইবি না।
কবিরকে সত্যি ঘটনা বলার সুযোগ নেই। তবু বললাম, এটা ইমার্জেন্সি। মান সম্মানের ব্যাপার। না কইরো না বন্ধু।
ও তখন ক্যাশবাক্সের উপর থেকে বাকি-বিষয়ক বিজ্ঞাপনটি আমাদের সামনে, পাউরুটি রাখার একটি আঙটাতে ঝুলিয়ে চুড়ান্ত অপমান করে বললো, তোরার ইমার্জেন্সির মাইরে বাপ।
যদিও কাজল জানে, কবিরের সাথে ও হারে না। তবু গলা নরম করে বলে, কবির, বন্ধু, কালকের ভেতর যদি বাকির টাকা না দেই তাহলে আমি বিউটিকে ছেড়ে দেব।
এবার কবির অত্যন্ত বিস্ময়ে বলে, তোরার ঘটনাডা কী কতো। গোল্ডলিফ ছাইড়া ফাইভফাইভ ধরার বিষয়ডাও তো বুঝলাম না।
কাজল হার্ড-লাইনে যেতে চায়, ক্যাশে উঠে যাব কি না বল?
কবির হাল ছেড়ে দেয়, হ উইঠা যা। ক্যাশ তো তোরারই। এই বাগানবাড়ি তো তোরারোই তাল্লুক।
ওদের এই সব কথার পরের চিত্রনাট্য আমাদের খুবই চেনা। কবির গজগজ করে ক্যাশের ভেতর থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে কাজলের দিকে অনিচ্ছায় ছুঁড়ে দিয়ে বলবে, দুইটার বেশি নিস না। অল্প বয়সে কাশতে কাশতে মরবার বাউ লইছস।
কাজল সিগারেট পাঁচটাই নেবে আর কবির কেটলি নিয়ে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলবে, স্যারেরার কি চা লাগব নি?
আমরা না-না করব আর কবির একটি সরল হাসিতে দুটো কাপ দু’দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলবে, খা। নতুন পাত্তি দিছি, মজা পাইবি।
এই হলো কবির। তাকে নিয়ে সন্ধ্যার পর থেকে ঝিলের পাশে পরিত্যক্ত রেললাইনে যে মজমায় আমরা মেতে থাকি, তার কথা একটু পরে হবে।
রোবানা ম্যাডামরা থাকেন তিন তলায়। নিচতলায় চালের গোডাউন। দু’তলায় কাজলরা একাই ভাড়াটিয়া, আমি তাদের ননপেয়িং গেস্ট। চার তলার ছাদ করার পরপরই ম্যাডামের বাবা-মা দুজনই ভেলানগরে ট্রাকের সাথে ধাক্কা খান। একটি পা কেটে ফেলার পর মা বেঁচে গেলেও বাবা শেষ পর্যন্ত বাঁচেন নি। বাসায় এখন ম্যাডামের মা, তাঁর এক ছোট ভাই আর একটি ছোট কাজের ছেলে।
আমরা সিগারেট নিয়ে ম্যাডামদের ছাদে উঠে এলাম। তখন আষাঢ়ের আকাশে ফুটেছে তারা। তারা ফোটে ঝিলের পাশে পরিত্যক্ত রেল লাইনে নোঙর গাঁড়া লঞ্চেও। এই ছাদে দাঁড়িয়ে পুরো ভৈরব শহরটাকেই দেখা যায়। ঐ তো মেঘনার জলে টলটলায়মান নানা রঙের বাতির ছায়া। নদীর ওপর ইটরঙা ব্রীজ। ভৈরবপুরের উপর দিয়ে বাঁক খেয়ে সোজা স্টেশনের দিকে চলে গেছে চকচকা বুকের রেললাইন। আশুগঞ্জ থেকে কোন ট্রেন ছাড়লেই ঝমঝম নৃত্যে বেজে ওঠে ব্রীজ।
আমরা নদীর ওপারে আশুগঞ্জের দিকে তাকিয়ে আছি। আশুগঞ্জ মানে এর আগে ইটরঙা ব্রীজ, তার আগে ঝিলের এপাশে রেললাইন, ওপাশে বিউটিদের একতলা হলুদ বাড়ি। আসলে আমরা দুজনেই বিউটিদের জানালায় তাকিয়ে আছি। এই খোলা ছাদ থেকে এত দূরের জানালার ভেতরে কিছুই ঠাহর করা যাবে না। তবু এ সময়, রাত আটটায় বিউটিদের ও জানালা খুলে গেলে অন্ধকারে হলুদ আলোর একটি ফোকাস বেরিয়ে আসে। এই আলোর দিকে তাকিয়ে আমরা কত রাত যে দীর্ঘ করে ফিরেছি।
আর বিউটির বাবা, ফেরিঘাটে বিউটি রেস্টুরেন্টের মালিক আঃ লতিফ, যাকে কাজল খুন করতে চায়, তাঁর নামে ভেঙচি কেটে রোজ চিৎকার করে গালিতে গালিতে কবির তার পুরোটা লুঙ্গি বুকে তুলে অন্ধকারে বিউটিদের বাড়ির উদ্দেশে বিলের জলে পিশাব করতে করতে ‘তোর মুখে আমি মুতিও না’ বলে ফিরে আসে, সে কথাও পরে হবে।
আমরা সিগারেট নিয়ে ম্যাডামদের ছাদে উঠে এলাম। তখন আষাঢ়ের আকাশে ফুটেছে তারা। তারা ফোটে ঝিলের পাশে পরিত্যক্ত রেল লাইনে নোঙর গাঁড়া লঞ্চেও। এই ছাদে দাঁড়িয়ে পুরো ভৈরব শহরটাকেই দেখা যায়। ঐ তো মেঘনার জলে টলটলায়মান নানা রঙের বাতির ছায়া। নদীর ওপর ইটরঙা ব্রীজ। ভৈরবপুরের উপর দিয়ে বাঁক খেয়ে সোজা স্টেশনের দিকে চলে গেছে চকচকা বুকের রেললাইন। আশুগঞ্জ থেকে কোন ট্রেন ছাড়লেই ঝমঝম নৃত্যে বেজে ওঠে ব্রীজ।
আমরা নদীর ওপারে আশুগঞ্জের দিকে তাকিয়ে আছি। আশুগঞ্জ মানে এর আগে ইটরঙা ব্রীজ, তার আগে ঝিলের এপাশে রেললাইন, ওপাশে বিউটিদের একতলা হলুদ বাড়ি। আসলে আমরা দুজনেই বিউটিদের জানালায় তাকিয়ে আছি। এই খোলা ছাদ থেকে এত দূরের জানালার ভেতরে কিছুই ঠাহর করা যাবে না। তবু এ সময়, রাত আটটায় বিউটিদের ও জানালা খুলে গেলে অন্ধকারে হলুদ আলোর একটি ফোকাস বেরিয়ে আসে। এই আলোর দিকে তাকিয়ে আমরা কত রাত যে দীর্ঘ করে ফিরেছি।
আর বিউটির বাবা, ফেরিঘাটে বিউটি রেস্টুরেন্টের মালিক আঃ লতিফ, যাকে কাজল খুন করতে চায়, তাঁর নামে ভেঙচি কেটে রোজ চিৎকার করে গালিতে গালিতে কবির তার পুরোটা লুঙ্গি বুকে তুলে অন্ধকারে বিউটিদের বাড়ির উদ্দেশে বিলের জলে পিশাব করতে করতে ‘তোর মুখে আমি মুতিও না’ বলে ফিরে আসে, সে কথাও পরে হবে।
রোবানা ম্যাডাম একটু ইতস্ততঃ স্বরে বললেন, কাজটা খুব খারাপ হলো রে। তোরা ছোট মানুষ, আমার স্টুডেন্ট।
তিনি অভ্যাসী ধূমপায়ীদের মতই টানছেন। আমরা বুঝতে পারি, তিনি ধোঁয়ার স্বাদ নিতে শিখে ফেলেছেন। মেয়েমানুষদের জন্য এ এক বিশাল বিদ্যা! ছাদে পাতা থাকে চারটা চেয়ার। মাঝে মাঝে আমরা ফুঁ দিয়ে মেঝেতেও বসি। ম্যাডাম বললেন, ব্যাপারটা কিন্তু তোরা ভুলে যাবি। আর কাউকে বলিস না লক্ষীভাই।
তাঁর কণ্ঠে একটু কাতরতা ফুটলো কি? লক্ষ্য করলাম, কাজল এক দৃষ্টে বিউটিদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। নিদয়া বিউটি এখনো জানালা খোলে নি।
ম্যাডাম বললেন, তোরা এই বয়সে বিড়ি ধরলি ক্যান বল তো?
আমরা মাথা নিচু করে মোড়ায় বসে থাকি। বিউটির প্রতিনিয়ত অবহেলা সইতে না পেরে একদিন স্কুলে আসার পথে তীব্র সাহসীকতায় কাজল যে জোর করে ওর বুকে চাপানো বইয়ের ভাঁজে চিঠি পুরে দিতে চেয়েছিল আর বিউটি রাগে, ক্ষোভে, কান্নায় সবগুলো বই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অবুঝের মত তার বাপ, তার মতই কালো আঃ লতিফকে বলে দিল, তার পর থেকেই মুলতঃ কাজলের বদলে যাওয়া। সময়টা উনিশশ পঁচানব্বই।
বিউটির বাবা একটা ছোটলোক। কাউকে কিছু না বলে, বাড়িতে নালিশ না দিয়ে, হেডস্যারকে পাশ কাটিয়ে রেললাইনের দু’পাশে বড়বড় পাথরের ফাঁক দিয়ে যে সরু রাস্তাটায় আমরা লুকিয়ে সিগারেট খাই, এই খানে এসে কাজলকে পাকড়াও করে ফেলল। কাজলের তো ভয়ংকর রাগ আর সাহস। তখনই সে সরকারদলীয় ক্যাডারদের সাথে গভীর রাতে চিকা মারে, মাথায় পট্টি বেঁধে মিছিলে যায়।
সে বলেঃ আপনি কে? হাত ছাড়েন।
জনাব আঃ লতিফ কাজলকে একটা কষে থাপ্পর মেরে পাথরের উপর তাল সামলাবার সুযোগ না দিয়েই আবার ধরে আরেকটা থাপ্পর দিয়ে হুংকার ছেড়ে বললেন, আমি বিউটির আব্বা।
তিনি অভ্যাসী ধূমপায়ীদের মতই টানছেন। আমরা বুঝতে পারি, তিনি ধোঁয়ার স্বাদ নিতে শিখে ফেলেছেন। মেয়েমানুষদের জন্য এ এক বিশাল বিদ্যা! ছাদে পাতা থাকে চারটা চেয়ার। মাঝে মাঝে আমরা ফুঁ দিয়ে মেঝেতেও বসি। ম্যাডাম বললেন, ব্যাপারটা কিন্তু তোরা ভুলে যাবি। আর কাউকে বলিস না লক্ষীভাই।
তাঁর কণ্ঠে একটু কাতরতা ফুটলো কি? লক্ষ্য করলাম, কাজল এক দৃষ্টে বিউটিদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। নিদয়া বিউটি এখনো জানালা খোলে নি।
ম্যাডাম বললেন, তোরা এই বয়সে বিড়ি ধরলি ক্যান বল তো?
আমরা মাথা নিচু করে মোড়ায় বসে থাকি। বিউটির প্রতিনিয়ত অবহেলা সইতে না পেরে একদিন স্কুলে আসার পথে তীব্র সাহসীকতায় কাজল যে জোর করে ওর বুকে চাপানো বইয়ের ভাঁজে চিঠি পুরে দিতে চেয়েছিল আর বিউটি রাগে, ক্ষোভে, কান্নায় সবগুলো বই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অবুঝের মত তার বাপ, তার মতই কালো আঃ লতিফকে বলে দিল, তার পর থেকেই মুলতঃ কাজলের বদলে যাওয়া। সময়টা উনিশশ পঁচানব্বই।
বিউটির বাবা একটা ছোটলোক। কাউকে কিছু না বলে, বাড়িতে নালিশ না দিয়ে, হেডস্যারকে পাশ কাটিয়ে রেললাইনের দু’পাশে বড়বড় পাথরের ফাঁক দিয়ে যে সরু রাস্তাটায় আমরা লুকিয়ে সিগারেট খাই, এই খানে এসে কাজলকে পাকড়াও করে ফেলল। কাজলের তো ভয়ংকর রাগ আর সাহস। তখনই সে সরকারদলীয় ক্যাডারদের সাথে গভীর রাতে চিকা মারে, মাথায় পট্টি বেঁধে মিছিলে যায়।
সে বলেঃ আপনি কে? হাত ছাড়েন।
জনাব আঃ লতিফ কাজলকে একটা কষে থাপ্পর মেরে পাথরের উপর তাল সামলাবার সুযোগ না দিয়েই আবার ধরে আরেকটা থাপ্পর দিয়ে হুংকার ছেড়ে বললেন, আমি বিউটির আব্বা।
কাজল সেইদিন থেকে প্রচণ্ড অপমানবোধে আঃ লতিফ ওরফে কবিরের ভাষায় লইত্যে-ঢেঙ্গাকে হত্যার পরিকল্পনা করে আর তা না পারলেও লইত্যার হাতটা, হ্যাঁ, ডান হাতটা অন্ততঃ ভেঙ্গে দেয়ার চিন্তায় হাসফাস করে। রেললাইনের পাশে ঝিলের টলটল জলে পাথর ছোঁড়াছুড়ির এক সন্ধ্যায় কবিরের প্যাকেট থেকে টান দিয়ে সিগারেট বের করে ধরিয়ে করা ধূমপানের অভিষেকটা ভালই হলো। ওর দুঃখে একদিন টানতে শুরু করলাম আমিও।
ম্যাডাম বললেন, কিরে মুখ বন্ধ কেন? রোজ কয়টা খাস?
আমাদের বদঅভ্যাসের নেপথ্যের যে নায়িকা মানে বিউটি, গায়ের রঙ কিন্তু তার ফর্সা না, নিগ্রোদের মত কালোও না, তবে কালো আর এই কালো রূপ নিয়েই কাজলের মত একটা রাজপুত্তুরসদৃশ ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছে, এ কথা ম্যাডামকে বলা চলে? কাজল প্রায়ই বলে, আমাকে যে ওর ক্লাশের তিনটা মেয়ে লাভলেটার দিয়েছে, শালিকে একদিন জানিয়ে দেই, কী বল?
বিউটিকে নিয়ে কাজলের এই পত্র-প্রাপ্তির গৌরবে আমারও মনে হয়, তাই তো, এত ভাব নেয়ার কী হলো! কাজলের চোখ দিয়ে আমি তখন বিউটিকে দেখি আর আমাদের সকল আড্ডার সাক্ষী, গালাগালির সাক্ষী, দূরের মিটিমিটি জ্বলা তারা আর আশুগঞ্জের রঙিন আলোর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই, এত দেমাগ কেন তোমার?
কাজল, জনাব আঃ লতিফের কিছুই করতে পারে না। বিকেলে স্কুল ছুটির পর প্রায়ই সে দূর থেকে ফেরিঘাটে বিউটি রেস্টুরেন্টের উঁচু চেয়ারে বসা তাঁর কালো মোটকা বপুটা দেখে আর বলে, ঐ দেখ, পঁচা তেলে ভাজা মাছ খোলা রেখে দিয়েছে। বাসের যাত্রীদের তো এগুলো খেয়ে ডায়রিয়া হবে। এই শালারে তো এই জন্য আরো আগে মারা উচিত। হাত-পা আর চোখ বেঁধে মেঘনায় ফেলে দিতে পারলে আরো ভাল। মর শালা।
এই সব কথায় আঃ লতিফ অভিশপ্ত হন আর আমি বা কবির, দুজনের চোখেই তিনি হয়ে ওঠেন ঘৃণিত খলনায়ক। অবশ্য আমার কোন ব্যক্তিগত ক্রোধ বা দুঃখ ছিল না। দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের পরিচয়ে কালীপুরে লর্জিং থাকাকালে কাজলের বাসায় মাঝেমাঝে যাওয়াসূত্রে ওর মা মানে খালাম্মার সীমাহীন মায়ায় ওর বাসায় আমারও থাকা, বিনা মূল্যে খাওয়া। খালাম্মার ধারণা, আমার মত ভদ্র ছেলে বাসায় থাকলে কাজলের এই যে বখে যাওয়া, রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া বা অবাধ্যতার দুঃসাহস যদি কমে।
নারায়ণগঞ্জে একটি সাবান আর একটি আলকাতরার মিল করার কাজে প্রচণ্ড ব্যস্ত খালু সপ্তাহে একদিন বাসায় এলে তার বাচ্চারা মানে আমরা তাঁর কোটের ভেতর ঢুকে ওম নিতাম, যে কারণে খালাম্মা, পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল এই মানুষটা বাকি পাঁচদিন করা আমাদের নানা অত্যাচারের কোন নালিশই তাঁর কানে দিতে পারতেন না। খালাম্মার ধারণা আমি সত্য করতে পারি নি। বরং উল্টো নিজেই বিড়ি ধরেছি, বিউটির বাপকে গালি দিতে আমিও গলা নিচু করি না।
ম্যাডাম বললেন, কিরে মুখ বন্ধ কেন? রোজ কয়টা খাস?
আমাদের বদঅভ্যাসের নেপথ্যের যে নায়িকা মানে বিউটি, গায়ের রঙ কিন্তু তার ফর্সা না, নিগ্রোদের মত কালোও না, তবে কালো আর এই কালো রূপ নিয়েই কাজলের মত একটা রাজপুত্তুরসদৃশ ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছে, এ কথা ম্যাডামকে বলা চলে? কাজল প্রায়ই বলে, আমাকে যে ওর ক্লাশের তিনটা মেয়ে লাভলেটার দিয়েছে, শালিকে একদিন জানিয়ে দেই, কী বল?
বিউটিকে নিয়ে কাজলের এই পত্র-প্রাপ্তির গৌরবে আমারও মনে হয়, তাই তো, এত ভাব নেয়ার কী হলো! কাজলের চোখ দিয়ে আমি তখন বিউটিকে দেখি আর আমাদের সকল আড্ডার সাক্ষী, গালাগালির সাক্ষী, দূরের মিটিমিটি জ্বলা তারা আর আশুগঞ্জের রঙিন আলোর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই, এত দেমাগ কেন তোমার?
কাজল, জনাব আঃ লতিফের কিছুই করতে পারে না। বিকেলে স্কুল ছুটির পর প্রায়ই সে দূর থেকে ফেরিঘাটে বিউটি রেস্টুরেন্টের উঁচু চেয়ারে বসা তাঁর কালো মোটকা বপুটা দেখে আর বলে, ঐ দেখ, পঁচা তেলে ভাজা মাছ খোলা রেখে দিয়েছে। বাসের যাত্রীদের তো এগুলো খেয়ে ডায়রিয়া হবে। এই শালারে তো এই জন্য আরো আগে মারা উচিত। হাত-পা আর চোখ বেঁধে মেঘনায় ফেলে দিতে পারলে আরো ভাল। মর শালা।
এই সব কথায় আঃ লতিফ অভিশপ্ত হন আর আমি বা কবির, দুজনের চোখেই তিনি হয়ে ওঠেন ঘৃণিত খলনায়ক। অবশ্য আমার কোন ব্যক্তিগত ক্রোধ বা দুঃখ ছিল না। দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের পরিচয়ে কালীপুরে লর্জিং থাকাকালে কাজলের বাসায় মাঝেমাঝে যাওয়াসূত্রে ওর মা মানে খালাম্মার সীমাহীন মায়ায় ওর বাসায় আমারও থাকা, বিনা মূল্যে খাওয়া। খালাম্মার ধারণা, আমার মত ভদ্র ছেলে বাসায় থাকলে কাজলের এই যে বখে যাওয়া, রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া বা অবাধ্যতার দুঃসাহস যদি কমে।
নারায়ণগঞ্জে একটি সাবান আর একটি আলকাতরার মিল করার কাজে প্রচণ্ড ব্যস্ত খালু সপ্তাহে একদিন বাসায় এলে তার বাচ্চারা মানে আমরা তাঁর কোটের ভেতর ঢুকে ওম নিতাম, যে কারণে খালাম্মা, পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল এই মানুষটা বাকি পাঁচদিন করা আমাদের নানা অত্যাচারের কোন নালিশই তাঁর কানে দিতে পারতেন না। খালাম্মার ধারণা আমি সত্য করতে পারি নি। বরং উল্টো নিজেই বিড়ি ধরেছি, বিউটির বাপকে গালি দিতে আমিও গলা নিচু করি না।
আমাদের এইসব বেদনার আখ্যান রোবানা ম্যাডামকে বলা যাবে না। বরং আজকে এই তারাময় রাতে এই মাত্র যখন বিউটিদের জানালা থেকে হলুদ আলো ঠিকরে বেরিয়ে এলো, তখন বোধ করি আমার মত কাজলের মনেও একই প্রশ্ন পাঁক তুলছে, ম্যাডাম, আপনার ঘটনাটা কী!
আমাদের নিরবতা চারপাশের এই গাঁথুনীবিহীন অন্ধকার ছাদে দীর্ঘ হয়। ম্যাডামের হাতেও অনেকক্ষণ সিগারেটের প্যাকেট অলস শুয়ে আছে। ম্যাডামের চোখও ওই দিকে। বিউটিদের জানালায় আমাদের যে চোখ আটকে যায় তা কি তিনি বুঝে ফেললেন? তা না হলে তিনিও প্রতিদিন ওই দিকে মুখ করেই বা কেন বসে থাকবেন? তিনি নিরবতা ভাঙলেন, টেস্ট পরীক্ষা চলে এসেছে। যা, এখন পড়তে যা।
আমরা ‘জ্বি ম্যাডাম’ বলে নিচে নামার মুখে তিনি আবার মনে করিয়ে দিলেন, লক্ষী ভাই, কাউকে বলিস না। দোহাই লাগে।
রোবানা ম্যাডামের এই কাতরতায় আমার মায়া হয়। আমাদের বদলে উনিই এখন ধরা খাওয়ার ভয়ে ভীত! যদিও উনি জানেন, জীবনের চেয়েও বেশি আমরা তাঁকে ভালবাসি। বিউটির প্রতি কাজলের যে পরিমাণ ভালবাসা বা আমাদের ঘৃণা, তার থেকেও অনেক অনেক গুণ বেশি।
আমাদের নিরবতা চারপাশের এই গাঁথুনীবিহীন অন্ধকার ছাদে দীর্ঘ হয়। ম্যাডামের হাতেও অনেকক্ষণ সিগারেটের প্যাকেট অলস শুয়ে আছে। ম্যাডামের চোখও ওই দিকে। বিউটিদের জানালায় আমাদের যে চোখ আটকে যায় তা কি তিনি বুঝে ফেললেন? তা না হলে তিনিও প্রতিদিন ওই দিকে মুখ করেই বা কেন বসে থাকবেন? তিনি নিরবতা ভাঙলেন, টেস্ট পরীক্ষা চলে এসেছে। যা, এখন পড়তে যা।
আমরা ‘জ্বি ম্যাডাম’ বলে নিচে নামার মুখে তিনি আবার মনে করিয়ে দিলেন, লক্ষী ভাই, কাউকে বলিস না। দোহাই লাগে।
রোবানা ম্যাডামের এই কাতরতায় আমার মায়া হয়। আমাদের বদলে উনিই এখন ধরা খাওয়ার ভয়ে ভীত! যদিও উনি জানেন, জীবনের চেয়েও বেশি আমরা তাঁকে ভালবাসি। বিউটির প্রতি কাজলের যে পরিমাণ ভালবাসা বা আমাদের ঘৃণা, তার থেকেও অনেক অনেক গুণ বেশি।
তার পর থেকে আমাদের প্রাত্যহিক রুটিনে রোবানা ম্যাডামকে ট্রিপল ফাইভ মানে বাংলা ফাইভ সিগারেট এনে দেওয়াটাও যুক্ত হলো। এবং তাঁর সাথে আমাদের অবস্থানও যত দিন যায় ততই আরো আন্তরিক আরো দীর্ঘ হতে থাকে। ফাঁকে ফাঁকে আমরাও দম নিতে নিচে যাই কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তাঁর সামনে খাওয়ার কথা বলি না, তিনিও সৌজন্যবশতঃ সে প্রস্তাব দেন না! ছাদে কাটানো আমাদের এই বর্ধিত সময়ের কারণে কবির বড় একলায় পড়লো। সন্ধ্যার পর ছোটভাইকে দোকানে বসিয়ে কবির রেললাইনের ওপর পা ছড়িয়ে, পেছনে খাঁড়া রাখা একটি হাতে পুরো শরীর ভর দিয়ে লম্বা ফুঁয়ে ধোঁয়া ছাড়ে আর ‘ওই লইত্যে-ঢেঙ্গার মাইরে বাপ’ বলে চেঁচায়। চীৎকারটা মুলতঃ ওর অবস্থানের সিগন্যাল। আমরা বুঝতে পারি, ও আমাদের ডাকছে। কবিরের বাড়ি চণ্ডিবের। খালাম্মার মমতায় ছায়া সেও পায় রোজ। দুপুরে খালাম্মার সাথেই ওকে খেতে হয়। আমরা স্কুলে থাকি, খালাম্মা তাঁর ছেলে ছাড়া একলা খেতে বসেন না।
খালাম্মার এই মমতার প্রতিদান আমরা পরিশোধ করি কাজলের সাথে সমব্যথি হয়ে, জনাব আঃ লতিফকে গালাগাল করার মাধ্যমে। কাজটা রীতিমতো কবিরই ভাল করে। আনন্দটাও যেন ও নগদ উপভোগ করে। এখানে, এই ঝিলের পাশে, পরিত্যক্ত রেললাইনে বসে কাজলের আত্মাটা যেন রোজ ধারণ করে। সে কিন্তু নিজে কালো তবু বিউটিকে ‘ওই কাইল্যানি’ বলে চিৎকার করে ডাকে। ওর ডাক সত্যি সত্যি বিউটিদের বাড়ি পৌঁছালে হয়তো জনাব আঃ লতিফ, যিনি তার কন্ঠে লইত্যে-ঢেঙ্গা, তিনি এই অন্ধকারে তাকেও পাকড়াও করতো এবং নিশ্চিত বিলের জলে ফেলে চুবিয়ে মারতো। লইত্যে এমন বদ! ভাগ্য ভাল, তাদের কান ভোঁতা।
বিউটি আর ওর বাবা জনাব আঃ লতিফের সাথে এই যে আমাদের একতরফা প্রতিশোধ-প্রতিশোধ খেলা সে খবর রোবানা ম্যাডামের কানে যায় নি সত্য কিন্তু আমাদের পড়াশোনার দৈন্যতার খবর তাঁর কানে ঠিক ঠিক চলে গেলে তিনি একদিন আমাদের প্রায় বন্দি করে ফেললেন। আমাদের বইপত্র চলে গেল তাঁর বাসায়। খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া বাকি চব্বিশ ঘণ্টা স্কুল আর ম্যাডামের শাসানিতে আমাদের ব্যাপক লাভ হলো। মেট্রিক পরীক্ষাটা ভাল দিয়ে ফেললাম।
পরীক্ষার পর এক রাতে রোবানা ম্যাডাম সেই প্রশ্নটি আবার করলেন, তোদের সাহস আছে? আমাদের তখন সত্যিই অনেক সাহস। ফেরিঘাটের বিউটি রেস্টুরেন্টের মালিক আঃ লতিফ যে কুকুরের মাংসকে প্রতিদিন অন্য জায়েজ-মাংস বলে চালিয়ে দিচ্ছে, শতশত মানুষকে এই নিষিদ্ধ মাংস খাইয়ে পাগল বানাবার জন্য বিহারি বাবুর্চি রেখেছে সেটি প্রচারের জন্য অলরেডি আমরা প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। কবির লেগে আছে আরো জোরালো তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের কাজে।
আমরা বললাম, হ্যাঁ, সাহস আছে তো।
তিনি বললেন, আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি?
আমরা খুবই উৎসাহ নিয়ে বলি, কী কাজ?
তিনি কী একটু ভেবে আবার বললেন, না থাক, তোরা ছোটভাই।
এবার আমরা ম্যাডামকে ছাড়ি না, না-না বলতে হবে। কী বলতে চাইছিলেন বলুন।
তিনি বলতেই চান না। তবু আমাদের চাপেই হোক কিংবা বা তাঁর ভেতরে কথাটা আটকে রাখার অসামর্থেই হোক তিনি ‘একবার বাহ্মণবাড়িয়া যেতে পারবি’ বলে মুখ ঢেকে হোহো করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মাথার দুপাশ থেকে তাঁর চুল এসে হাতও ঢেকে দিলে আমরা ম্যাডামের মুখটা আর দেখতে পাই না। কিন্তু তিনি কাঁদছেন। শিশুর মত শরীর কাঁপিয়ে আসা এ কান্না আমাদের হতবিহ্বল করে দেয়। ভিজে আসতে চায় আমাদেরও অবাক চোখ।
আমরা বললাম, হ্যাঁ, সাহস আছে তো।
তিনি বললেন, আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি?
আমরা খুবই উৎসাহ নিয়ে বলি, কী কাজ?
তিনি কী একটু ভেবে আবার বললেন, না থাক, তোরা ছোটভাই।
এবার আমরা ম্যাডামকে ছাড়ি না, না-না বলতে হবে। কী বলতে চাইছিলেন বলুন।
তিনি বলতেই চান না। তবু আমাদের চাপেই হোক কিংবা বা তাঁর ভেতরে কথাটা আটকে রাখার অসামর্থেই হোক তিনি ‘একবার বাহ্মণবাড়িয়া যেতে পারবি’ বলে মুখ ঢেকে হোহো করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মাথার দুপাশ থেকে তাঁর চুল এসে হাতও ঢেকে দিলে আমরা ম্যাডামের মুখটা আর দেখতে পাই না। কিন্তু তিনি কাঁদছেন। শিশুর মত শরীর কাঁপিয়ে আসা এ কান্না আমাদের হতবিহ্বল করে দেয়। ভিজে আসতে চায় আমাদেরও অবাক চোখ।
কি জানি, মানুষের দুঃখে আকাশ বা এর ঘূর্ণায়মান মেঘের সখ্যতাটা কোথায়। যদি সখ্যতা থেকেই থাকে, যদি মেঘ বা মেঘবতী আকাশ সৃষ্টিশীল হয়, তখনই মনে হয় বৃষ্টিটা আসে, এই যেমন এখন, আশেপাশের টিনের চাল বড় বড় বৃষ্টির দানায় ঝমঝম করতে শুরু করেছে। এ এমন বৃষ্টি, বাইরের নিরবতা ভেঙ্গে ভেতরটাকে ভীষণ স্তব্ধ করে দিতে বুঝি জুড়ি নেই।
আমি ম্যাডামের একটি বাহু সাহস করে ছুঁয়ে বললাম, কাঁদছেন কেন ম্যাডাম?
তিনি তখন মাথা তুলে আমার ওই হাতটি তাঁর দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরে, কপাল ঠেকিয়ে আরো জোরে কেঁদে উঠলেন, বাবলুরে.....
ম্যাডামের এই করুণ কান্নায় আমারো কান্না আসে কিন্তু টের পাই, আমার হাত তাঁর হাতের মুঠোয় উষ্ণ হয়ে উঠছে, কী নরম আর কোমল তাঁর হাত!
কাজল জোর দিয়ে বলল, কী হয়েছে বলুন। আপনার জন্য আমরা সবকিছু করতে পারি, এমন কি সিগারেটও ছেড়ে দিতে পারি।
তিনি তখন চোখ মুছলেন, শব্দ করে নাক টানলেন, নারে, তোদের আমি জোর করব না। ওটা ভাল না। যখন বুঝবি নিজেই ছেড়ে দিবি। আমি জানি, তোরা খুব ভাল ছেলে। তবে কি জানিস, ভাল ছেলেরা বড় নিষ্ঠুর হয়।
আমি বললাম, কী হয়েছে বলুন না।
তিনি কাজলকে বললেন, তুই আরো কাছে এসে বোস।
আমরা দুজনই মোড়া টেনে ম্যাডামের প্রায় গা ছুঁয়ে বসি। এই সংকটেও আমরা অনুভব করলাম, একটা মধুর ঘ্রাণ আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। নাক টেনে যখন তিনি মাথাটা এক পাশে ঝাড়া দেন তখন ঘ্রাণটা আরো প্রবল হয়। তখন অচেনা লজ্জায় লম্বা করে শ্বাস নিতে পারি না।
আমি ম্যাডামের একটি বাহু সাহস করে ছুঁয়ে বললাম, কাঁদছেন কেন ম্যাডাম?
তিনি তখন মাথা তুলে আমার ওই হাতটি তাঁর দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরে, কপাল ঠেকিয়ে আরো জোরে কেঁদে উঠলেন, বাবলুরে.....
ম্যাডামের এই করুণ কান্নায় আমারো কান্না আসে কিন্তু টের পাই, আমার হাত তাঁর হাতের মুঠোয় উষ্ণ হয়ে উঠছে, কী নরম আর কোমল তাঁর হাত!
কাজল জোর দিয়ে বলল, কী হয়েছে বলুন। আপনার জন্য আমরা সবকিছু করতে পারি, এমন কি সিগারেটও ছেড়ে দিতে পারি।
তিনি তখন চোখ মুছলেন, শব্দ করে নাক টানলেন, নারে, তোদের আমি জোর করব না। ওটা ভাল না। যখন বুঝবি নিজেই ছেড়ে দিবি। আমি জানি, তোরা খুব ভাল ছেলে। তবে কি জানিস, ভাল ছেলেরা বড় নিষ্ঠুর হয়।
আমি বললাম, কী হয়েছে বলুন না।
তিনি কাজলকে বললেন, তুই আরো কাছে এসে বোস।
আমরা দুজনই মোড়া টেনে ম্যাডামের প্রায় গা ছুঁয়ে বসি। এই সংকটেও আমরা অনুভব করলাম, একটা মধুর ঘ্রাণ আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। নাক টেনে যখন তিনি মাথাটা এক পাশে ঝাড়া দেন তখন ঘ্রাণটা আরো প্রবল হয়। তখন অচেনা লজ্জায় লম্বা করে শ্বাস নিতে পারি না।
২.
আমাদের কাজটা খুব সোজা। ব্রাহ্মনবাড়িয়া স্টেশনের কাছেই কোথাও একটি আবাসিক হোটেল আছে, নাম ‘অবকাশ’, এর ম্যানেজার, যে কালো লিকলিকে আর যার বাম কানের লতিটা একটু কাটা, তাকে খুঁজে বের করে তার হাতে ম্যাডামের একটি চিঠি পৌঁছে দেয়া।
কাজল তার সংকল্পে একটি তৃপ্তিকর বিকল্প পেল। সে ঘোষণা দিল, বিউটির বাবাকে চৌদ্দ শিকে ঢোকাতে না পারলেও,জনাব আঃ লতিফের ডান হাতটা বড় ভাইদের রামদায়ে কেটে নিতে না পারলেও, আরেক কালো পাষাণ, যে আমাদের ম্যাডামের ভালবাসা উপেক্ষা করে গেছে, যে খুব ভাল ছেলে, যার জন্য ঊনত্রিশ বছরের এক রাধা বৃষ্টি সাক্ষী রেখে মুখ ঢেকে কাঁদে, তাকে শুধু চিঠি দেয়া নয়, তাঁকে প্রয়োজনে জোর করে ধরে নিয়ে আসা হবে, এনি হাউ। দিস ইজ ফাইনাল।
আমাদের কাজটা খুব সোজা। ব্রাহ্মনবাড়িয়া স্টেশনের কাছেই কোথাও একটি আবাসিক হোটেল আছে, নাম ‘অবকাশ’, এর ম্যানেজার, যে কালো লিকলিকে আর যার বাম কানের লতিটা একটু কাটা, তাকে খুঁজে বের করে তার হাতে ম্যাডামের একটি চিঠি পৌঁছে দেয়া।
কাজল তার সংকল্পে একটি তৃপ্তিকর বিকল্প পেল। সে ঘোষণা দিল, বিউটির বাবাকে চৌদ্দ শিকে ঢোকাতে না পারলেও,জনাব আঃ লতিফের ডান হাতটা বড় ভাইদের রামদায়ে কেটে নিতে না পারলেও, আরেক কালো পাষাণ, যে আমাদের ম্যাডামের ভালবাসা উপেক্ষা করে গেছে, যে খুব ভাল ছেলে, যার জন্য ঊনত্রিশ বছরের এক রাধা বৃষ্টি সাক্ষী রেখে মুখ ঢেকে কাঁদে, তাকে শুধু চিঠি দেয়া নয়, তাঁকে প্রয়োজনে জোর করে ধরে নিয়ে আসা হবে, এনি হাউ। দিস ইজ ফাইনাল।
যেদিন সকালে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া
রওয়ানা দেব তার আগের রাতে কবিরের গালাগালটা একটু বাড়ল। কাজল বলল, তোকে তো কেউ কিছু করেনি। তুই এত বকছিস কেন?
কবির হকচকিয়ে যায়, তাই তো! একটু থেমে সে আবার বলে, কিন্তু এই কাইল্যানি তোরে কষ্ট দিতেছে ক্যান?
কাজল বলল, আমি বিউটির জন্য আর কষ্ট পাব না। ওকে ভুলে গেছি।
কবির লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, সত্যি কইতাছস দোস্ত? বলেই সে যেন সহস্র বছরের জমানো কষ্ট থেকে মুক্তির আনন্দে ‘ওই লইত্যে-ঢেঙ্গার মাইরে বাপ, তোর মুখে আমি আসলেই মুতি না’ বলে লুঙ্গি উপরে তোলে ছরছরছর শব্দে ঝিলের জল গরম করে দিয়ে বলে, যা যা যা, লইত্যে-ঢেঙ্গার ঘাটে যা।
কবির হকচকিয়ে যায়, তাই তো! একটু থেমে সে আবার বলে, কিন্তু এই কাইল্যানি তোরে কষ্ট দিতেছে ক্যান?
কাজল বলল, আমি বিউটির জন্য আর কষ্ট পাব না। ওকে ভুলে গেছি।
কবির লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, সত্যি কইতাছস দোস্ত? বলেই সে যেন সহস্র বছরের জমানো কষ্ট থেকে মুক্তির আনন্দে ‘ওই লইত্যে-ঢেঙ্গার মাইরে বাপ, তোর মুখে আমি আসলেই মুতি না’ বলে লুঙ্গি উপরে তোলে ছরছরছর শব্দে ঝিলের জল গরম করে দিয়ে বলে, যা যা যা, লইত্যে-ঢেঙ্গার ঘাটে যা।
আমি ওপরের রেললাইনে তাকিয়ে আছি। ব্রিজে ট্রেন পড়ার ঝমঝম শব্দটা কানে আসছে। ট্রেনটা কোথাকার, সিলেট না চিটাগাং? যেখান থেকেই আসুক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন বা এর আশেপাশের সকল স্থাপনা কাঁপিয়ে এসেছে নিশ্চয়। রোবানা ম্যাডাম তাঁর কোন রাজকুমারের আশায় রোজ এই ব্রিজে পড়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকতো তা এখন আমরা জানি। শুধু জানি না, ওই লতি কাটা রাজকুমারটিকে ঠিক কী অবস্থায় আমরা আবিষ্কার করব। কিন্তু আমার প্রার্থনাটা
এরই মধ্যে ঠিক করে ফেলেছি। আমি ওই ভাল লোকটাকে জোড় হাত করে বলব, একবার ফিরে দেখুন, তাঁর সংস্পর্শে এই বখাটেদের চুরুটের নেশা ভাঙলে আপনার অভিমানও ভাঙবে জনাব। আপনার রাধা বড় ভাল মেয়ে।
নরম আর মায়াভরা দুটো হাতের কথা তো আর বলা যাবে না।