গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৪

তাপসকিরণ রায়


রমাকান্ত নামা--কাঁচ ভাবনা 


কখন যেন রমাকান্তর ঘুমটা জেঁকে বসেছিল। স্ত্রী, শৈলবালার আঃ আঃ বেদনা সূচক আওয়াজে তিড়িং করে উঠে বসলেন বিছানায়। ভোরের আলোর আবছায়ায় দেখলেন, স্ত্রী তাঁর পা চেপে বসে ব্যথায় কাতরাচ্ছে ! 
--কি হল তোমার ?
--এটা তোমার কাজ ? ব্যথা ভুলে যেন স্ত্রীর পাল্টা আক্রমণ।
--কি ? অবাক হয়ে রমাকান্ত বলে উঠলেন। 
--তুমি গ্লাস ভেঙ্গেছ ?

হঠাৎ গত রাতের স্মৃতি জাগ্রত হয়ে গেল রমাকান্তর মনে। স্টুলের ওপর রাখা সেই জলের গ্লাস নিতে গিয়ে গ্লাসটা পড়ে গিয়েছিল আর ঝনন ঝনাৎ শব্দ করে ঘরের মেঝেতে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে ছিল কাঁচের টুকরো। সেই ভাঙ্গা গ্লাসের কাঁচের টুকরোতেই স্ত্রীর পা কেটেছে। 
--কি, কথা কানে গেল ?
রমাকান্ত তাড়াতাড়ি খাট থেকে নামতে গিয়ে প্রথম পা মেঝেতে রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘেঁচ, করে এক টুকরো কাঁচ পায়ে ঢুকে গেল। উঃ, আহ, করে তিনি গিয়ে পড়লেন একেবারে স্ত্রীর গা ঘেঁষে। 
--এটা কি হল ?

ব্যথার মধ্যে স্ত্রীর ধরনের প্রশ্ন রমাকান্তর মগজে ঢুকল না !
--বলি, গ্লাসটা ভেঙে রেখেছিলে কেন ?
--মানে...ইচ্ছে করে তো...ভয় ব্যথার গলা রমাকান্তর। 
--হ্যাঁ, ইচ্ছে করেই করেছ তুমি, আমি জানি--

বুঝতে পারলেন রমাকান্ত যতটা ভেবেছিলেন ততটা নয়, স্ত্রীর মেজাজ এখন মধ্যমায় আছে--তবে বোঝা যাচ্ছে না তার পারা ঊর্ধ্বগামী না নিম্নমুখী ! এবার রমাকান্তর চোখ গিয়ে পড়ল নিজের পায়ে ফুটে থাকা কাঁচের দিকে--ওরে বাবা, বেশ বড় টুকরো--তিনি হাতে ধরে একটানে বের করে ফেললেন কাঁচের টুকরো, বের করে চোখে পড়তেই আঁতকে উঠলেন, আরে এ যে গলগল করে রক্ত বেরোতে লেগেছে !
স্ত্রী শৈলবালার চোখে পড়তেই আঁতকে উঠল, কি ! এত রক্ত ! শৈলবালা খোঁড়াতে খোঁড়াতে তাড়াতাড়ি টেবিলের ড্রয়ারে রাখা ফাস্টএইডের বাক্স নিয়ে এলো। 
রমাকান্ত দেখলেন, স্ত্রী আজ তাঁর প্রতি অনেক সদয় হয়েছে--এমনটা বহুদিন হয় না--
--বাবা, অনেকটা কেটে গেছে গো তোমার !

গো !,এই গো, শব্দটা স্ত্রীর মুখে আজ প্রায় দশ বছর পরে শুনলেন রমাকান্ত। শৈলবালা তুলো দিয়ে চেপে ধরেছে ক্ষত স্থান--রমাকান্তর ব্যথার চে স্ত্রীর হেন শুশ্রূষা অনেক বেশী ভালো লাগছিল। আহা: এমনি যদি সারা জীবনটা হত--কিন্তু তিনি জানেন বাস্তবে এত সহজ সরল জীবন হবার নয়। ঘরের খাটা-খাটনির চাপে বৌটা তাঁর খেঁকিয়ে থাকে। শরীর, তার ওপর মনের দিক দিয়েও ধকল তো আর কম যায় না। রমাকান্তর কি ? মাথা গুঁজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকা। কি ? না,সাহিত্য চর্চায় ব্যস্ত !
খড়কুটো না নাড়ার হেন স্বামীকে কটা স্ত্রী আর সহ্য করতে পারে ! তবু ভালবাসা তলে তলে থাকে বৈ কি--তবে রমাকান্ত তার তল,অতল গভীরতা খুঁজে পান না বললেই চলে।

বয়সে সব করে। কচিকাঁচা ভাবনা শৈশবের ব্যাপার, বসন্ত যৌবনে সবাই ফুরফুরে বাতাসে ভাসে। নতুন বিয়ের পর রসে ডোবা গোপাল ভাঁড় সবাই হয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে বয়স শুকবার সঙ্গে সঙ্গে রসকষহীন শুধু ভাঁড়খান পড়ে থাকে। মত অবস্থাই এখন রমাকান্তর জীবনে চলছে ! 

বৌয়ের গোমড়া মুখ থেকে রাতের স্বপ্ন বরং ভালো। আর গলাবাজি তো আছেই। আরে নিরীহ গোবেচারা হয়ে রমাকান্ত আপন মনে পড়ে থাকেন--ওই কি বলে লেখাপত্তির নিয়ে--যদিও একেবারে শুদ্ধি লেখাপত্রী সাহিত্য চর্চায় সারা দিনটা কাটে কি করে ! তাই মাঝে মধ্যে সেই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে, খুলে বসেন। কিছু চিত্রবিচিত্রতা খুলে দেখা আর কি ! ক্ষণিকের জন্যে, ওই কি বলে, মনোরঞ্জন আর কি! তবে ওই তাকেতাকে থাকতে হয়--উঁকি মেরে বৌটা না দেখে ফেলে ! একটা বয়স ছিল যখন বউ, শৈলবালাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সব  রস-সম্ভার দৃশ্যাবলী দেখিয়েছেন। আজকাল সব বললে, ছ্যাঁৎ করে উঠবে ! ডায়লগ এমন ঝাড়বে যেন রমাকান্তই জগতে এক মাত্র চরিত্রহীন ব্যক্তি !

--এতক্ষণে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে ! ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি--এখন খাটে উঠে বিশ্রাম নাও গিয়ে , কিছুটা দরদ ভরা গলায় শৈলবালা বলে উঠলো।  
রমাকান্ত ভাবনার অন্যমনস্কতার মাঝে পতিসেবা অনেকখানি হয়ে গেছে দেখে ভাবে গদগদ স্ত্রীর গায়ে হাত রাখার চেষ্টা করলেন।

শৈলবালার মোলায়েম সুর বেজে উঠলো, কি ধরতে হবে তোমায় ?
স্ত্রীর হাতে খানিক ভর দিয়ে খাটে উঠে বসলেন তিনি। হঠাৎ মনে হল তাঁর, আরে, স্ত্রীর পায়েও কাঁচের টুকরো ফুটে ছিল না ! মনে পড়তেই তিনি বলে উঠলেন, আরে দেখি, তোমার পায়েও তো কাঁচ ফুটেছিল !
কিছু না--ছোট এক টুকরো ছিল, উঠিয়ে দিয়েছি--
--দেখি, কতটা কেটেছে--
--না, না, এখন আমায় যেতে হবেওদিকে অনেক কাজ কর্ম পড়ে আছে--
--আঃ আঃ, ইচ্ছাকৃত নিজের ব্যথার জানান দিলেন রমাকান্ত। 
--কি হল, শৈলবালা রমাকান্তর পাশে এসে দাঁড়ালো। 
--খুব ব্যথা গো !

স্ত্রী রমাকান্তর ব্যথা পায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ল। আর ওমনি রমাকান্ত স্ত্রীর পীঠে তাঁর একটা হাত রাখলেন। 
--সামান্য রক্ত বের হচ্ছেস্ত্রী সামান্য অমায়িক হল।
--একটু শোও না গো ! ব্যথাটা খুব টনটন করছেরমাকান্তর অনুনয় বিনয়।
এবার শৈলবালা সোজাসুজি রমাকান্তর চোখের দিকে তাকাল, চল্লিশটা বছরের এক সাথে থাকা রমাকান্তর হাবভাব ধরে নিতে তার দেরী হল না। 
--আমি কাজে যাচ্ছি--

রমাকান্ত মনে মনে একটু সাহস যুগিয়ে নিলেন। তিনি শৈলবালার কোমর জড়িয়ে ধরে আধো আধো বলে উঠলেন, তুমি আমায় কত দিন ভালবাসো না--
--এই না--দুরে সরো--আমার কাজ আছে--
স্ত্রীর ভাষায় কোথাও তো কোমলতার ছোঁয়া পেলেন রমাকান্ত। স্ত্রীর মুখটা টেনে নিয়ে তার গালে মুখে গোটা কয় চুম্বন সেঁটে দিলেন তিনি--
--বুড়ো ভামের রগড় দেখো--বলে ছিটকে বেরিয়ে গেল শৈলবালা। 
আজ দশ বছর পরে রমাকান্ত শৈলর ঠোঁটের কোণে সেই লাস্যময়ী হাসির আভা ফুটে উঠতে দেখলেন !