গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৪

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী



কোন এক গাঁয়ের বামুন

            পাড়াগাঁর রাস্তা। বর্ষা ফুরিয়েছে। শীত এলো বলে। রাস্তার এঁটেল মাটি শুকিয়ে শক্ত। ধুলো উড়তে বাকি আছে। দুর্গাপূজা শেষ। শিউলির গন্ধ যাই যাই করেও যায়নি এখনও। ভালুকখুন্যার ডাঙায় রিফিউজিরা এসে কয়েক বছর ছিল। তারা চলে গেছে। যাওয়ার আগে দুর্গা মায়ের পূজাটি বামুনদের মাথায় চাপিয়ে দিয়ে গেছে। ওই পর্যন্তই। নইলে মকর সংক্রান্তিই বছরের প্রধান পরব। আশপাশের সব গাঁয়ে  নিচু জাতের লোক। হাড়ি, বাগদি, খয়রা, কাহার। এই গাঁয়েই কেবল বামুনদের বাস। এমন বামুন যাদের পরনের কাপড়ের থেকে পৈতার ওজন বেশি। পরবে-পার্বণে আটহাতি ধুতি কোমরে উঠলেও বছরের বেশির ভাগ তাদের নিম্নাঙ্গে জ্যালজ্যালে গামছা আর ঊর্ধ্বাঙ্গে সাদা থেকে কালো হয়ে যাওয়া পুরুষ্টু পৈতা। শীতকালে বাড়তি বোঝা খদ্দরের চাদর। পড়শিদের মতোই বামুনরা সংক্রান্তির ভোরে মকরস্নান সেরে নতুন জামাকাপড় পরে। বাসি পিঠের ভোজে নতুন বছরের আপ্যায়ন হয়। পার্বণী দেওয়া-থোওয়া সব এই দিনেই। তবে আসল দাপট মনসাপূজা আর ঝাঁপানের। তখন ঢাকের তালে তালে ধুনোর মালসা মাথায় নাচতে নাচতে একই সঙ্গে বামুন বাগদি ছেলের ওপর বিষহরীর ভর হয়।

            কোনও এক কালে এই বামুনদের এক পূর্বপুরুষ উড়িষ্যা থেকে এসে শিলাই নদীর ধারে মন্দির পত্তন করে সেখানে রাম সীতা লক্ষ্মণ হনুমানের মূর্তি স্থাপন করেছিলেন সেই মন্দির এবং গুটি পাঁচেক মৌজা সবই শ্রীরামচন্দ্রের সম্পত্তি। তাঁর জমিতেই এদের চাষবাস আর সেই ফসলেই পালা করে প্রতিদিন রঘুনাথজীর ভোগ চড়ানো আর নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তি লজ্জা নিবারণ। কালে কালে আইন বদলেছে, জমি কমেছে; লোক বেড়েছে, ফসল কমেছে। তবুও সুখেই কাটছিল জীবন, মাথা-ব্যথার বিশেষ কারণ ঘটেনি। রিফিউজিরা এসে রামচন্দ্রের দুর্গার অকাল বোধনের গল্প শুনিয়ে মায়ের পূজার বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিল মাথায়। বছর বছর আশি টাকার ধাক্কা! মেড় গড়তে গোপাল ছুতোরকেই দিতে হয় তিরিশ টাকা। বহুদূর পথ হেঁটে সে ঠাকুর গড়তে আসে। গড়ায় খরচ আছে। খড়-বাঁশ-কাঠ গাঁয়েই অঢেল। কিন্তু সূতলি দড়ি, খড়িমাটি, রং আর গর্জন তেলে বিশ টাকা খরচ হয়ে যায়। দশটি টাকা না থাকলে সে খাবে কী! বহুদিন আঁটকুড়ো ছিল গোপাল ছুতোর। যে বছর এই গাঁয়ে প্রথম মেড় গড়ল তার পরের বছরেই তার বউ ব্যাটাছেলে বিয়োল। দুগ্গা মায়ের দয়া! নইলে এই মাগ্গির বাজারে কেনই বা সে কষ্ট করে এতদূরে আসবে ঠাকুর গড়তে? সে তো ঠিকই। তার জন্যে গোপালকে বামুনরা সমীহ করে, ভালোও বাসে। তবুও বামুনরা ভাদ্র মাস পড়লেই টাকা জোগাড়ের চিন্তায় বছর আর পূজা হবে নাবলে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। আবার গোপাল ছুতোর এসে পড়লেই মুরুব্বিরা দশ নয়া, কুড়ি নয়া, সিকি, আধুলি জোগাড় করতে উঠে পড়ে লাগেন ফুটো পয়সা-আনি-দুয়ানি তখনও বাজারে সচল। নয়া পয়সার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের জটিল হিসাব নিয়ে মানুষ হিমশিম খায়। তবুও নয়া-পুরানোর সহাবস্থানে টাকার সংস্থান হতে থাকে। ঠাকুর একমেটে থেকে দুমেটে, দুমেটে থেকে চারমেটের দিকে এগোতে থাকেন। পূজা মিটে যায়। মাঠের ধানগাছে দুধ আসে। তার হেফাজতে আর পোড়ো জমিতে গরু-কাড়া চরাতে চরাতে, চুটি টানতে টানতে তাস খেলা কিংবা ইংরেজ রাজত্বের গল্পগুজব করতে করতে বামুনদের দিন কাটে।   

            এই সময় একদিন চকচকে সাইকেল চেপে সাদা ধপধপে জামা-প্যান্টলুন পরে সার্কেল অফিসার এলেন বামুনদের গাঁয়ে। গাঁয়ের লোক নদী-পুকুর-কুয়োর জল খায়। খেয়ে পেটের অসুখ হয়। সেজন্যে সরকার ঠিক করেছে বামুনদের গাঁয়ে টিউকল বসানো হবে। লোহার পাইপ মাটি ফুটো করে পাতালে ঢুকে যাবে। পাতালের জল নাকি অতি শুদ্ধ। টিউকলের হাতলে চাপ দিলেই সেই শুদ্ধ জল কলের মুখ থেকে ভকভক করে বেরোতে থাকবে। দুর্গামণ্ডপের মাটির মেঝেয় মুরুব্বিরা তালাই পেতে বসে। একমাত্র চেয়ারে অফিসার। তাঁর সাইকেলটি মণ্ডপের একপাশে দাঁড় করানো। ছেলেপুলেরা তো বটেই, বড়রাও বিস্মিত চোখে সাইকেলটিকে ঘিরে ভিড় করেছে। সেই তুলনায় অফিসারের সামনে শ্রোতার সংখ্যা নগণ্য। যারা আছে তাদের মনোযোগ তাঁর কথার দিকে যত না, তার চেয়ে ঢের বেশি তাঁর পোশাক আর প্যান্টলুনের পা-দুটিকে গোড়ালির সঙ্গে সেঁটে রাখা স্টিলের গোল ক্লিপ দুটির দিকে।

            আরও দু-চারটে গাঁয়ে কল বসবে। কোথাও কোন আপত্তি নেই। বামুনদের বক্তব্য - টিউকলে চামড়ার ওয়াসার থাকে, মন্দিরের পুজারির কাছে তারা শুনেছে। ওই কলের জল খেলে তাদের জাত নষ্ট হবেই। বুড়ো মুরুব্বি বললেন, -- সরকার যদি টিউকল কইরত্যে চায় করুক। আমরা গরিব বামুন, আমাদের খ্যামতা নাই আটকাই। কিন্তুক টিউকলের জল আমরা খাব নাই আজ্ঞ্যা। আমাদেগরু-কাড়ারা খায় খাবেক। আমাদেখাবার জলের অভাব নাই কুয়া আছে, বাঁধ আছে, নদী আছে। পেটের অসুকের কথা যদি বলেন আজ্ঞ্যা পেট থাইকল্যেই অসুক হবেক। কখনো সাইরব্যেক, কখনো সাইরব্যেক নাই। লিয়ে আমরা ভাবি নাই। সেটা দেখার জন্যে রঘুনাজ্জী আছেন।   

            এর ওপর আর কোন কথা চলে না। সার্কেল অফিসার মণ্ডপ থেকে উঠে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। সিগারেটের টিন থেকে একটি সিগারেট বের করে ধরালেন। দু-এক টান দিয়েছেন কি দেননি, পেছনে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ। চমকে উঠে পেছনে তাকিয়েই অফিসারের আক্কেল গুড়ুম! কুচকুচে কালো বিশাল এক মোষ, তার পাকানো শিং আর লাল চোখ নিয়ে এগিয়ে আসছে। পড়িমরি করে দৌড় লাগালেন তিনি সামনের দিকে। জ্বলন্ত সিগারেট হাতে তিনি যত দৌড়ন, মোষও তত দৌড়ায়; পেছনে তার ফোঁস ফোঁস আওয়াজ আর বন্ধ হয় না। অফিসারের আত্মারাম ধুকপুক করতে করতে খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়! কুড়ি-একুশ বছরের তামাটে রঙের লেংটি পরা এক বামুন ছেলে পেছন থেকে ছুটতে ছুটতে মোষকে টপকে অফিসারের পাশে। --‘আপনার সিক্রেটটা দ্যান আজ্ঞ্যা দ্যান আজ্ঞ্যা –‘ বলতে বলতে তাঁর পাশে পাশে ছুটতে থাকে সে। অফিসার তখন কিছু শুনতে পাচ্ছেন না, শুনতে পেলেও মানে বুঝতে পারছেন না। অগত্যা বামুনছা তাঁর হাত থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিয়েই ঘুরে দাঁড়াল। ফোঁস ফোঁস আওয়াজটা বন্ধ হতেই অফিসার দম নেওয়ার জন্যে দাঁড়ালেন পরিস্থিতিটা বুঝে নিতে সন্তর্পণে পেছনে তাকালেন। তাকিয়েই তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! মোষটি দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার দুচোখ বোজা, মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। নাকের ফুটো দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসছে সিগারেটের ধোঁয়া। তাঁকে তাকাতে দেখে বামুনছা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল, -- কাড়াটার চুটির নেশা আজ্ঞ্যা। তামুকের গন্ধ পাল্যেই হইল্য পেছু লিবেক। দুটান না দিল্যে ছাইড়ব্যেক নাই

বেশিক্ষণ নেশা করার সুযোগ হল না বেচারার। তার মুখের লালায় সিগারেট ভিজে নেতিয়ে গেল। ছেলেটি অপরাধীর গলায় বলল, -- সিকরেট খাত্যে জানে নাই আজ্ঞ্যা। আমরা শাল পাতায় তামুক মুড়্যে চুটি টানি

এক লাফে তার কাড়ার পিঠে উঠে বসল বামুনছা। পায়ের গোড়ালি দিয়ে তার পেটে ধাক্কা মারতে মারতে বলল, -- চুটি দুব কত টাইনত্যে পারুস দেইখব --