আমার বিয়ের প্রথম দিনটির কথা আমার আজো মনে আছে। সেটা
সবারই থাকে। কিন্তু আমার কাছে আমার দিনটিই সেরা, আলাদা করে মনে রাখার মতো। বলছিলাম একটা প্রেমের গল্প— প্রিয় পাঠক, আমার
স্পষ্ট মনে আছে—
সে দিন ছিল শুক্রবার। আমি, বাবা
আর বড় চাচা—
আমরা এই তিনজন মিলে বহুকষ্টে রাত
প্রায় নয়টার দিকে শিলাদের বাসা খুঁজে পেতে সক্ষম হই। আমার বড় চাচা একটু ক্ষ্যাপাটে
স্বভাবের। বাসায় ঢুকেই তিনি — এত
ঘিঞ্জি গলির ভেতর বাসা কেন, এত ব্যাকওয়ার্ডে বাসা থাকলে
তো খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপ লাগবে— ইত্যাদি
কথা বড় গলায় ব'লে ব'লে
সারা বাড়ি জুড়ে একটা হৈচৈ ফেলে দিলেন। তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে সোফায় গা এলিয়ে
দিলেন।
প্রায় পনেরো মিনিট পর শিলা এলো। ঘোমটা দেয়া। বড় চাচা তাকে বসতে
বললেন। ঘোমটা সরাতে বললেন। ইতস্তত হাতে শিলা ঘোমটা সরায়। প্রথমবারের মত শিলাকে
দেখে আমি রীতিমত টাশকি খেলাম। সত্যি বলছি এত রূপবতী মেয়ে আমি আগে দেখিনি। হ্যাবলার
মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। অবশ্য আমার ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে— এই ভয়ে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা গেলো না। বড় চাচা একের পর
এক প্রশ্ন করে চলেছেন। শিলা মিনমিন গলায় সেগুলোর উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ। এবার তবে ভালভাবে মেয়ে দেখার
পালা। শিলাকে হাঁটতে বলা হলো, চুল
দেখাতে বলা হলো। বিভিন্ন ভাবে কয়েকবার শিলাকে দেখার পর বড় চাচা আমার দিকে তাকালেন।
আমি একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে ফিসফিস করে বললাম— এভাবে এত দেখার কী আছে? মেয়ে
আমার পছন্দ হয়েছে। শুনে বড় চাচা দাঁড়িয়ে গেলেন। জোর গলায় প্রায় চেঁচিয়ে বললেন— আলহামদুলিল্লাহ, মেয়ে
আমাদের পছন্দ হয়েছে, আজই বিয়ে হবে। বড় চাচার এই
আকস্মিক ঘোষণায় মেয়েপক্ষ প্রথমে একটু অবাক হলেও পরক্ষণে খুশি মনেই বিয়ের আয়োজন
শুরু করে দিল। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় বিয়ের ক্ষেত্রে পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে মেয়েদের
মতামতের কোনো মূল্য ছিল না। এমনকি এই আমার ক্ষেত্রে— শিলা আমাকে দেখেওনি, অথচ
আমাদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তো
রাত দুইটার দিকে আমাদের বিয়ে পড়ানো হলো। অতঃপর আমাদের দু'জন কে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়া হলো।
প্রিয় পাঠক,
এইক্ষণে আমার ব্যাপারে কিছু বলার
প্রয়োজন বোধ করছি ।
আমি দেখতে ভাল নই। ভাল নই বললে কিছুটা কমই বলা হয়— আসলে আমাকে দেখলে রীতিমত ভয় লাগে। আমার গায়ের রঙ কালো।
দীর্ঘদিন ব্যবহারের পর পাতিলের নিচের অংশ যেমন কালো হয় — তেমন কালো। কালো হলেও অনেকের চেহারা ভাল হয়, আমি সেরকমও নই। চোখ আর মুখের অনুপাত ঠিক নেই। চোখ দুটো
আকৃতিতে একটু বেশিই বড়। তাই হঠাৎ কেউ আমাকে দেখলে রীতিমত ভয় পেয়ে যায়। সুতরাং
আমাকে দেখে শিলার প্রতিক্রিয়া খুব যে ভাল হবে না— এটা আমি আগেই ধরে নিয়েছিলাম। একটা সংকোচ, দ্বিধা
আর খানিকটা ভয়কে সংগে নিয়ে যখন আমি শিলার পাশে বসলাম— ততক্ষণে প্রায় ভোর হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় আমি
বললাম — আজ প্রায় কয়েকবার তোমাকে বিভিন্নভাবে দেখেছি। তুমি
আমাকে একবারো দেখনি। এখন কি একটু দেখবে আমায়? আমার
কথা শুনে সে লাজুক ভঙ্গিতে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো। ঘরে শুধু একটা ডিম লাইটের
আলো। সেই আলোতে আমাকে আরো বেশি ভয়ংকর লাগছিল কি না জানি না— হঠাৎ দেখি শিলার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। এক্ষুণি বুঝি
চিৎকার দেবে। ধীরেধীরে তার চোখ নেমে এলো, তারপর
এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের দরজা দিয়ে বাগানের ভেতর চলে গেল। যাবেই তো। চেহারা
খারাপ হওয়াটা যে একটা অভিশাপ— সেটা
আমি একটা ছেলে হয়েও অনুভব করেছি। বুকে একটা বড় পাথর চেপে লালন করে যাচ্ছি এই আজন্ম
অভিশাপ। আয়নায় নিজেকে দেখলে রাগে আয়না ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করে। নিজেকে নিয়ে আমারই
যেখানে এত ঘৃণা—
সেখানে শিলা আমাকে ঘৃণা করবে এটাই
স্বাভাবিক। তাই আর ওর সামনে দাঁড়াতে
ইচ্ছে করছিল না। পা দুটোও যেন অবশ হয়ে এসেছে। ইচ্ছে করছিল পালিয়ে যাই, দূরে কোথাও, যেখানে
কেউ থাকবে না,
যেখানে এই কুৎসিত চেহারা দেখে
কাউকে পালাতে হবে না ।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। আর ঠিক তখনই আমার বিবেক যেন আমাকে
বলল— এত কাছে যেয়েও তুই তোর ভালবাসার কথাটা বলবি না? তুই দেখতে খারাপ— তাতে
কী, তোর ভালাবাসায় তো কোনো কালি নেই। আমি একটা যন্ত্রের মত বাগানের দিকে হাঁটা দিলাম। একটা
বেঞ্চের উপর বসে শিলা কাঁদছিল। আমি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। — আমি জানি আমাকে দেখে তুমি খুব হতাশ হয়েছ। কিন্তু
বিশ্বাস করো,
আমার চেহারাটাই শুধু খারাপ।
ভালবাসার জন্য যে বিশুদ্ধ হৃদয়ের প্রয়োজন— সেটা
আমার আছে। খুব বেশি না, আমাকে অল্প একটু ভালবেসো, দেখবে বিনিময়ে আমার কাছ থেকে ভালবাসার কোনো কমতি হবে
না।
কথাগুলো বলেই আমি বাচ্চা ছেলের মত
হু হু করে কেঁদে দিলাম। শিলা মাথা ঘুরিয়ে আমাকে একবার দেখল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম— সেই চাউনিতে কোনো ভয় নেই, ঘৃণা নেই— কেবল মায়া। সেদিন আমি আমার খারাপ চেহারা দিয়েই শিলাকে আমার মায়ার
জালে আবদ্ধ করতে সক্ষম হলাম। সেই মায়া তার আজও কাটেনি। আজো আমি একটু অসুস্থ হয়ে গেলে শিলা পেরেশান হয়ে পড়ে। আজো আমি অফিস
থেকে ফিরে এলে সে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে— আমার
জন্য কী আনলা?
আজো ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে চিৎকার
দিলে সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে— আমি
আছি তো তোমার পাশে।
নিজেকে নিয়ে আমার আর কোনো কমপ্লেক্স নেই কারণ শিলার
ভালবাসা আমাকে পূর্ণতা দিয়েছে। জীবনের অন্ধগলি আজ আলোয় আলোয় ছেয়ে গেছে। না মেলানো
সমীকরণগুলো যেন একের পর এক মিলে যাচ্ছে। একটা নতুন সকাল দেখার আশায় প্রতিরাতে আমি
ঘুমোতে যাই। প্রতি সকালে শিলার মায়াময় মুখটা দেখে আমার দিন শুরু হয়। সৃষ্টিকর্তার
কাছে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
লিখতে লিখতে বুঝতে পারছি বাইরের আকাশে ভোর লেগে গেছে।
টের পাচ্ছি আঙুলের ডগায় ঘুম এসে যাচ্ছে। শিলার ঘুমন্ত মুখ দেখার সুযোগটা মিস করতে
চাইনা।