গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৪

সাত্যকি দত্ত


মুক্তি


এক

সবেমাত্র ভোর হয়েছে ; বুধোর পুকুরের ধারে শাক তুলছিল কমলা । পর্যাপ্ত তোলা শেষ করে  হঠাৎ বাঁকা কোমর সোজা করতে গিয়া মাথাটা টলে যায় - কোনমতে লতা-পাতা আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলে নেয় সে । খানিকটা ধনুকের মতো হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে , বাঁ হাত দিয়ে কোমরটাকে যতটা সম্ভব সামনের দিকে ঠেলে দেয় - সাথে সাথে ...অ্যাা... করে মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে ককিয়ে ওঠে কমলা । দীর্ঘক্ষণ  ঢালু জমিতে নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে কোমর ধরেছিল তার , মুষড়ে পড়ে যাওয়ার বদলে কোনমতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়ে , একটি বার চোখ বোজে সে , মুহূর্তে জীবনে ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্র- বৃহৎ দুঃখ যন্ত্রণা অপ্রাপ্তি গুলি একজোটে জড়ো হয় বন্ধ চোখের নিখাদ আন্ধকারে ... ভয়ে বিস্ময়ে চোখ খোলে । ছলছল করে চোখ - ভ্রু কুঁচকে মুখের বিষণ্ণ ভাব টাকেও সামাল দিতে চেষ্টা করে  কমলা। 
অনেক কষ্টে রাস্তায় উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে কমলা । কিসের যেন একটা অজানা ব্যাথায় শরীরটা ভেঙে পড়তে চাইছে - পথের ধুলোও যেন তাকে টানছে সমস্ত শরীরটা তাতে মিশানোর জন্য । বুকের ব্যাথাটাও আবার উঠেছে এর মধ্যে । দু-পা হাঁটে কমলা । " বাপ রে মিত্তু জন্তনা " বলে রস্তাতেই বসে পড়ে ।

বিয়ের পর থেকে এতোগুলো দিন নিজেকে সামলে নিয়েছিলো সে , কিন্তু কালকে বুকের উপর সজোরে লাথিটা হয়তো মনের দিক থেকে সামলে নিলেও, তার শরীর মোটেই সইতে পারেনি । বমি হয়েছিল - রক্ত বমি । নিজের রক্ত দেখে হকচকিয়ে যায় কমলা - মনে মনে বলে ফেলেছিল , " একি , এখনও আমার রক্ত লাল রঙের যে ! "

কমলার বর মাদু মিত্তির - লাথি মেরে বেগতিক দেখে দুটো আঙটি আর তিনশো টাকা নিয়ে পালিয়েছিল । কমলার এ অবস্থায় খানিকটা খুশি যে সে হয় নি এমনটিও না ; তার যে অনেক দিনের সখ সে আবার বিয়ে করবে ।

অনেক রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে মৃত কমলাকে দেখতে এসে , যখন দেখে সে দিব্যি ছেলে-মেয়ে গুলোকে ঘুম পাড়িয়ে জল ঢালা ভাত নিয়ে বসেছে , মাথায় রক্ত উঠে যায় মাদুর । ছুটে এসে ভাতের থালা টেনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় - সারা বারন্দা উঠোনে ভাত ছড়িয়ে যায় । কমলার চুলের মুঠি ধরে বলে , " মাগী , বর ভাগিয়ে গিলতে লজ্জা করে না ? "

দুই

প্রচণ্ড এক মানসিক বলে চলতে থাকে কমলা ; রায় দের বাড়ির পিছনে এসে মনে হল তাদের বস্তির চির - পরিচিত মেয়ে- পুরুষের পিত্তি জ্বালানো কণ্ঠস্বরে কেউ ডাকছে তাকে , "আরে এ কমলা... " - থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে ফেরে সে ।

" তোর সোয়ামি তোরে দাক্তেছিল - সুনে আয় গে ... আরে শালা , কি শাক রে ও ?কতও তুলেচিস ... আর কি আছে দেকি.."ওই একই কণ্ঠস্বরে ককিয়ে বলে ঝানুদি ।কমলার হাতের থলিটার ভিতর উঁকি দেওয়ারও চেষ্টা করে ...
কমলা শুনেও যেন শোনে না ... একটা অজানা বিস্ময়ে ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁক করে তাকিয়ে থাকে ঝানুদির মুখের দিকে - কেন যে সে এমন তাকিয়ে আছে তাও সে বোঝে না । জ্ঞান হল সেই একই কণ্ঠস্বরেই চমকে উঠে - " বলি জা তারাতারি - ডারিয়ে থাক্লি ক্যান ? "
মাটির দিকে তাকিয়ে ডান হাতটা দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে আর বাঁ হাতটা দিয়ে কোমর ধরে যেতে যেতে কি ভেবে আবার দাঁড়ায় ঝানুদি । আঁচলটা ঘুরিয়ে বাঁ পাশ দিয়ে বুকের উপর ফেলা ছিল - সেটাকে আবার পিঠে ফেলে কমলার কাছে এসে একটু চাপা গলায় বলে , " এ শোন , কাল রাইতে চেসাছিলি ক্যান রে ? কাদসিলি নাকি রে ? হারামজাদাটা আবার তোরে মারিছে নাকি , সত্তি বল ... বামুন পাড়ার সমিতিতে জাবি একবার তালে ... " শেষ হয় না ঝানুদির কথা । কমলা এতক্ষণ এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল । হটাৎ হেসে ফেলে সে । কিন্তু হাসির ভিতর দু ফোঁটা জলও যে চোখের কোনায় চিকচিক করছিল আর গলাটাও ধরে এসেছিল তা হয়তো আর দেখিনি ঝানুদি ।
কমলা তাড়াতাড়ি বলে , " আমার মাথা ধরেছিল ... "

ঝানুদি , অ্যাঁ  বলে নিচের দিকে ল্যাপটানো শাড়িটাকে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত তুলে চলে যায় । মাথা ধরলে কেউ চিৎকার করে কাঁদে নাকি ? - সে কমলাও ভাল বোঝে না, ঝানুদিও না ।
মাদু লাথি মেরে চলে যাওয়ার পর ভাত রাঁধতে রাঁধতে মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছিল কমলা । কেঁদেছিল কাল সে ? তা এখন ভাবতেই কেমন যেন লজ্জা আর বিরক্তি লাগে তার । বড় ছেলেটা বেশ আসহ্যের সাথে মুখ ঝামটে বলেছিল " তুই শালা মরিস না কেন রে ? "তারপর হেড ফোনটা কানে গুঁজে দিয়েছিলো । ছোট ছেলে আর মেয়েটা বহুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে কমলার মুখের দিকে তাকিয়েছিল - মেয়েটি একটু ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে উঠছিল ।

মুখের দুটো ভাত টান মেরে ফেলে মাদু বিড়ি ধরিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় - বারান্দাতেই সারা রাত শুয়েছে কমলা - বুকটা মাঝে মাঝে খুব ব্যাথা করে উঠছিল - কেশে কেশে গলার শিরা ফুলে উঠেছে , তবুও একটু জলও সে সারা রাত পাইনি - ভোর হওয়ার অনেক আগেই সে বেড়িয়ে পড়ে । ঠিক ছিল যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাবে - কিন্তু পুকুর পাড়ের শাক তাকে আবার সাংসারের কথা ভাবিয়েছে - কাল মেয়েটা ভয়তে খালি কেঁপেছে , কিছুই মুখে তুলিনি - কি খাবে সে ঘুম থেকে উঠে-  না... যাওয়া তার আর হল না তাই ।

তিন

বাবুদের বাড়ি কাজ করতে ঢোকার মুখেই মোবাইলটা বেজে ওঠে । মোবাইলটা লাল রঙের রবার দিয়ে কোনোমতে আটকানো ছিল । থলির মধ্যে শাকের ভিতর থেকে অতিকষ্টে তোলার সময় রবার গেল ছিঁড়ে - পিছনের ঢাকনাটা ছাড়িয়ে গিয়ে পড়ে গেল - কোনোরকমে ফোনটা ধরে সে ।
মাদু ফোন করেছে ।

হ্যালো বলতে গিয়েও বলতে পারে না কমলা - ভাবে কেটে দিলাম না কেন ! মাদুই বলে , " তুমি বাড়ি আসবা একবার একন ? কুব দরকার ..."
তুমি বলে এই নরম সুরের কথার অর্থ কমলা বেশ ভালই বোঝে - তবুও একটু নরম কথায় বুকের ভিতরটা যেন হু হু করে ওঠে - কিসের যেন অজানা টান তাকে বাড়ির দিকেই এগিয়ে নিয়ে চলে -
বাড়ি ফেরে কমলা - মাদুর মুখমুখি হতেই ঘৃণাতে বুকটা রি রি করে ওঠে - নিজের উপর ভীষণ রাগ হয় তার - কেন আসলাম আমি ?
মাদুই শুরু করে , " আমারে তুই পঞ্চাশ টাকা ধার দিতে পারিস ?" একটু চুপ থেকে কমলার মুখের দিকে চেয়ে নিয়ে আবার বলে " হস্পিটালে ডাকটার সেদিন আমারে বলিচে আর বেশি দিন বাচব না রে ... আমায় রোগে ধরিচে  - এ কমলা ... টাকাটা দিবি ? "

বাঁচতে ! ... বাঁচতে তো কমলাও চায় , কিন্তু সে যে কাউকে বাঁচাতে পারে তা সে এই প্রথম জানলো । মাটির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নেয় কমলা ।

বছর দেড়েকের মেয়েটা হামাগুড়ি দিয়ে প্রায় বারান্দার ধার পর্যন্ত চলে এসেছে - দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে বেশ ঝাঁঝের সাথেই বলে , " কাল যে তিনশ টাকা নিয়ে ... " কথা জড়িয়ে যায় - ঢোঁক গিলে যতটা সম্ভব ভ্রু দুটোকে সাঙ্কুচিত করার চেষ্টা করে ।

মাদু এক মুহূর্ত দেরি না করেই বলে , " ক্যান রে , তুই যে সেদিন আমায় বল্লি , আমি যা চাইব তাই দিবি ! "

সেদিন ওপাড়ার বুনোর মা কমলাকে নেও দিঘির ঘাটে বলেছিল কি করে স্বামিকে তোয়াজ করতে হয় । কমলা সে দিন সন্ধ্যে বেলায় মাদুকে খুব নরম সুরে বলেছিল , " আমর একটু কথা রাখবে ? "মাদু তখন সবেমাত্র বিড়ি ধরিয়ে বসেছে । সে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি । কমলা তারপরও বলেছিল," আজ থেকে তুমি মদ ছেড়ে দাও, আমি তোমারে সব দেবো ।" মাদু একটু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে নেয় কমলার দিকে - তারপর হা হা করতে করতে জ্বলন্ত বিড়িটা শাড়ির আঁচলে চেপে ধরে - কমলা ছুটে পালিয়ে যায় - মাদু আরও প্রান খুলে হাসে ।
কমলা মেয়েকে কোলে তুলে দুধ খাওয়াতে থাকে - মাদুও টাকার লোভে বসে থাকে । যখন দেখল কমলা কোনও কথা না বলে নিজের মতো বেড়িয়ে যাচ্ছে - মাদু ফেটে পড়ে - চিৎকার করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে , " শালা , মরতি পারিস না টেরে নে " শব্দ গুলিকে কমলা শুনতে চায় না একেবারে - তাই সে একটু ছুটল প্রথমটা । ঘরের ভিতর মেয়েটা কেঁদে উঠল ভয়ে ।

চার

বাবুদের বাড়ির উপরের ঘর মুছতে মুছতে খাটের তলা থেকে শাড়ির বিজ্ঞাপনের একটি কাগজ কুড়িয়ে পায় কমলা। এক সুন্দরী মেয়ের ছবি । খুব মন দিয়ে ছবিটা দেখতে থাকে সে । হটাৎ কমলা যেন মনের কথাও কিসের যেন একটু শান্তি পায় , তা সে নিজেই ভালো বোঝে না ।
মডেলিং এর মেয়েটার ছবিটা দেখতে দেখতে নিজেও যেন ওর মত হয়ে গেল কমলা । মুখে যে কৃত্রিম হাসিরআভাস ছবি তোলার সময় আনতে হয়, তা এমনিই এসে যায় কমলার ঠোঁটে কমলার বয়স আসছে ভাদ্রে তিরিশ হবে । তিনটি ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েও তার শরীর এখনো বেশ আঁটসাঁট । গায়ের রঙ একটু শ্যামলা হলেও , মুখশ্রী বেশ উজ্জ্বল ।
হটাৎ হাতের ন্যাতাটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, কোমরে জড়ানো আঁচল খুলে পিঠে ফেলতে ফেলতে বুক ভরে শ্বাস নেয় - ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ানোর আগে ঘামে ভেজা মুখটা মুছে কপালের বিক্ষিপ্ত চুলগুলোকে ঠিক করে ।

এখন আয়নায় কমলা যাকে দেখছে সে কে ? প্রথমে কমলা সত্যিই চিনতে পারে না তাকে । কমলার চোকলা ওঠা ফাটা পা , হাতের ফ্যাকাসে আঙুল , চোখের কালি ... কিন্তু কই প্রতিবিম্বে এই সব কিছুই তো ধরা পরছে না - তার বদলে একটা বাচ্চা মেয়ে কাঁচের ওপারে তার সামনে দাঁড়িয়ে - একটু শ্যামলা গায়ের রঙ । মুখের গড়ন খুবই চেনা কমলার ।

হ্যাঁ হ্যাঁ - এবার ঠিক চিনতে পেরেছে - মেয়েটা তো সেই ছোট্ট বেলার কমলা ।
কমলার বাবা ব্যবসায়ী - বাড়ি সল্টলেকে । চার বছর বয়সে মা মারা যায় কি যেন এক অসুখে , তা আজ আর ভাল মনে নেই তার । বছর খানিকের ভিতরইবাবা আবার বিয়ে করে - আর কমলা হয় কাজের মেয়ে । কাজের মেয়ে কথাটা কমলা প্রথমে বুঝিনি - পরে কিভাবে জেনেছিল তার বাবা সকলের কাছে পরিচয় দিত ওই বলে । পনেরো বছরে বয়সেই তার বাবা বিয়ে দেয় মাদুর সাথে - মাদুর বাবা ওদের গাড়ি চালাত । আজ কমলা জানে ওর সৎ ভাইরা প্লেনে চড়ে ।
আয়নাতে নিজের কোনোএক হারানো অতীতের অলীক প্রতিমূর্তিতে এক অজানা শান্তি কমলার দুঃখী হৃদয়কে স্পর্শ করে নিশব্দে বারবার । কিন্তু হায়তার শরীরটাযেন কেমনকেমন করে - খিদেতে পেটটা মুষড়ে ওঠে ।

এতক্ষণ যখন অনেক দুঃখ - কষ্ট মনের অন্তরালে অবিশ্রান্ত ধারায় ঝরার আনুমতি দিয়েছে কোন প্রতিবাদ ছাড়া , তখনতো একটুও খিদে পায়নি তার ... তাহলে মনে সুখ আনলে সে সুখ কি প্রথমে খিদের দুয়ার দিয়েই প্রবেশ করে ? এসব জটিল কথা ভাল বোঝে না কমলা । আবার একটু ভেবে নেয় , হয়তো গরিবের সুখ একমাত্র 'পেটেই' । 

তাড়াতাড়ি ছবিটা ফেলে বালতি নিয়ে সিঁড়ি মুছতে মুছতে নিচে নামে কমলা ।বাড়ির ছেলেটা হটাৎ নিচু হওয়া কমলার দিকে চোখ পরতেই আড়াল হয়ে লক্ষ্য করছিল কমলাকে । কমলা বুঝেও না বোঝার ভঙ্গি করে কোনোমতে সামলে নেয় নিজেকে । মনে মনে ভাবে গরিবের কি লজ্জা তজ্জা থাকা উচিত !

বাসন মাঝতে মাঝতে গিন্নিকে বলে , " কাকিমা , এখন কটা বাজলো গো ? "
"কেন রে ? সিরিয়াল দেখবি নাকি ? এখন চালানো যাবে না । কাকু বকবেন । " বেশ ঝাঁঝের সাথেই গিন্নির উত্তর আসে ।
"না না , আজ ছেলের ইস্কুলে পরীক্ষা তো , তাই একটু সাথে যাব । একা একা আবার ... " শেষ হয়না কমলার কথা , গিন্নি এক ধরনের অদ্ভুদ অপার্থিব স্বরে ভেঙচি কেটে বলে ," আ হা হা ... মহারানী কটা রাজপুত্তুরের জন্ম দিয়েছেন শুনি ? সারাদিন রাজপুত্তুরা জানোয়ারগিরি করে বেড়াচ্ছে , কই তখন তো মহারানীর দেখার সময় হয় না ! "
"মা , তোমার কি কাজ শেষ হয়েছে ? আর কখন নিয়ে যাবে বলতো ? পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ! " উপর থেকে গিন্নির ছেলে চেঁচায় । গিন্নি শাক কাটছিল... " এই হল "বলে উঠতে উঠতে কমলার দৃষ্টিহীন চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ বেঁকিয়ে চলে যায় , সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আবার চেঁচিয়ে বলে , " মহারানী সময় এখন নটা পনেরো ... হে হে হে " এরই মধ্যে কমলার মোবাইল বেজে ওঠে । গিন্নিমা ততক্ষণে দুতলায় পৌঁছে গেছে , হিন্দি রিং টোন শুনে উঁ শব্দ করে হেসে ওঠে ।

মাদু ফোন করেছে । ধরবে কি ধরবে না বুঝে উঠতে পারেনা কমলা । অনেকটা পরে সবুজ বোতামটা টিপে কানে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে ।মাদুই ওপাশ থেকে চিৎকার করে বলে , " মাগী , তোর জন্যই চেলে গুলো খারাপ হচ্চে । বলেছে তোর কাচে যাছে  - কিন্তু হারান বলে জন্তুটা কালোদের পুকুরে মাছ ধরছে । বাড়ি ফের আজ শালা , তোর পেটে লাথি মারব । " লাইন ডিসকানেক্টের শব্দ হয় - কমলার কানে সে শব্দ খুব তীক্ষ্ণতার সাথে ধরা দেয় । সারা শরীরে থরথর করে বার দুয়েক কম্পন অনুভব করে সে । বিস্ময়ে বড় বড় চোখ দুটো লাল হয়ে ভিজে ওঠে । সামান্য ফাঁক করা ঠোঁটের নিচেটা মৃদু কাঁপে । নিঃশ্বাসও যে বেশ গভীর হয়ে পড়ে তাও বেশ অনুভব করে কমলা । ফোনটা এতক্ষনেও কান থেকে নামাতে পারিনি ।
" কি রে ? অমন করছিস কেন ? কে ফোন করেছিল ?" বাড়ির বড় মেয়ে বাগানে জল দিচ্ছিল , সেখান থেকেই কমলাকে বলে ।
"বর " কমলা বলে , নিজের গলাও যেন কেমন একটু আদ্ভুত লাগে তার । মেয়েটি আবার বলে , " তা , তোর চখ-মুখের ভাব এমন দেখাচ্ছে কেন রে ? শারীর খারাপ লাগছে ? "
এবার সত্যিই কেঁদে ফেলে কমলা - প্রথমটা বেশ চিৎকারের সাথে , তারপর ফুঁপিয়ে । গিন্নিমা তাড়াতাড়ি উপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিৎকার করে প্রশ্ন করে , " কি রে ? কি হল ?" ভেবেছিল কমলা পড়ে গিয়ে হাত পা কিছু একটা ভেঙ্গেছে - আজকাল আবার কাজের লোকের ইউনিয়ন হয়েছে নাকি , তাতে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা না ফেললে নিস্তার পাওয়া মুস্কিল ।

মাটিতে বসে পড়ে কমলা ... ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে শুরু করে , " বড় ছেলেটা বাপরে আমার কাচে আসবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ... সে এখন পুকুরে মাছ ধরলে কি সে দোষ আমার ... " একটু থেমে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নিল । তারপর একদমে " বর আমাকে বলেছে বাড়ি ফিরলে ... " বলে থেমে যায় , ভদ্রলোকের সামনে তো খারাপ উক্তি বলতে নেই - কোন এক সময় যেন তা ইস্কুলে শিখেছে কমলা । কিন্তু সে যে ঠিক কত বছর আগে শিখেছিল তা ঠিক আন্দাজ করতে পারেনা - আগের জন্মের কথা কি এইসব? তাও কল্পনা করতে একটুও বাঁধে না তার ।

আসলে জীবন যাদের সুখের - স্বাচ্ছন্দ্যের অর্থ যাদের পদলেহন করে চলে - জীবনের  বৈচিত্র্যতার দিক থেকে তারাই ভিখারি হয় । তারাই তাদের জীবনের সব হিসাব মিলাতে পারে । কিন্তু সমাজে যাদের জন্ম বিধাতার শক্তির বৃথা অপব্যয়ে , জীবনের নানা বৈচিত্র্যই তাদেরকেই রাজা করে । জীবনের সব বৈচিত্র্যতাই তাদের জীবনের হিসাব না মেলার একমাত্র ফলশ্রুতি ।
কাজ শেষ করে দৌড়ে বেড়িয়ে যায়। কাজের পর পাড়ায় যত কাজের লোক আছে সবাই বটগাছ তলায় এক জোট হয় , এইটাই নাকি কাজের লোকের ইউনিয়ন  । আজ আর সেখানে না গিয়ে , সকালের সেই নির্জন পুকুর ধারটিতে চলে আসে কমলা ।

পাঁচ

সকালে কমলা যখন এসেছিল জলটা তখন কেমন যেন কালচে ছিল , তাতে ভোরবেলার সূর্যের রাঙা আলো মিশে কি সুন্দরই না দেখাছিল । কি সব শাকের গন্ধ , গাছের গন্ধ , আরও কতও কি গন্ধ বাতাসকে ভারি করে তুলেছিল তখন । পাড়ের পলতেমাদার গাছের লাল ফুলে বা তিৎপল্লা লতার হলুদ ফুলে - যেন কোন মায়াবী রঙের খেলা চলছিল ।  ধারের জলের ভিতরে ডুব দেওয়া গাছ গুলি জলের কম্পনের সাথে কেমন করে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কাঁপছিল - তার সব তাই লক্ষ্য করেছিল কমলা । এক নির্জনতা অপর নির্জনতাকেও সাথি করে – নির্জনতা তো স্বার্থপর নয় । জড় আর জীব নির্জনতার বাঁধনে সবাই একই প্রবাহে ভাসে - ডোবে । তখন যে কি শান্তিপেয়েছিল - কি সুন্দরই না লেগেছিল তার - তা এখন অনুভব করে কমলা । অবাক ব্যাপার , এই যে ভাল লাগার গভীর প্রকাশ শাক তুলতে তুলতে কিন্তু তার কিছুই বঝেনি সে – এখন হৃদয়ে প্রভাতের সঞ্চিত ধনের রুপ-রস ধরা পরছে ধীরে ধীরে - যতই ধরা পরছে ততই নূতন করে সেই ধন পাওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে ।
এখন সে দেখে পুকুরের ওপাড়ের জমির নূতন ধান গুলিকে - কি অদ্ভুদ নরম সবুজ ধান - তা ওই নীল আকাশের সাথে খেলতে খেলতে যেন দিগন্তে হারিয়েছে । ধান খেতের ধারে ধরে সারি বেঁধে অনেক গুলি হাঁস নড়তে চড়তে এগিয়ে আসছে পুকুরের দিকে - সাদা , হলুদ , কালচে আরও কতো রঙ তাদের - সাদা রঙএরটিকেই বেশ ভাল লাগে কমলার - তার লাল ঠোঁট , সাদা পালক আর ওই যে ধানের সবুজ রঙ কি আপন ভাবে যেন খেলছে পস্পরের সাথে  - বিভোর হয়ে রঙের খেলা দেখে সে ।  হটাৎ কিসের যেন ডাকে আকাশের দিকে তাকায় - সারি সারি বক - কি সাদা তারা । আর ওই নীল আকাশের মাঝে যে সাদা সাদা গোলগাল মেঘগুলি সূর্য্যি ঠাকুরকে নিয়ে খেলা করছে তাদের দেখেই কমলার মনটা লাফিয়ে ওঠে । বিশ্ব - প্রকৃতি যেন আজ তাকে চুরি করবে বলে ঠিক করেছে  । সে নানা রূপে ধরা দেয় কমলার চোখে মুখে - সমস্ত শরীর জুড়ে ।এরমধ্যে কখন যেন কমলা জলে নেমে পড়েছে । জ্ঞান হল যখন আনন্দে জল ছিটাল - আর চোখেমুখে লাগল সে জল তখন । পুকুরের শালুক ফুল - পাতা তাকে যেন ডাকছে - সেই ডাকের সাথে কমলার যেন কতো কালের পরিচয় । প্রকৃতির সেই ডাককে অবজ্ঞা করা জীব জগতের অসাধ্য - এই ডাক খুব ভয়ংকর - যাকে একবার ডেকেছে তাকে তার সমস্ত রুপে-রসে-গন্ধে পাগল না করে সে ছাড়ে নি । বাঁধানো ঘাটের একটি একটি ধাপ  করে কমলা নেমে যেতে লাগল আরো গভীরতায় - সেই সবজে জল তার অঙ্গে- প্রত্যঙ্গে কিসের যেন মৃদু খেলা শুরু করেছে , তা কমলা ভালোই বুঝতে পারে । সবাই মিলে যেন তার শরীর থেকে সমস্ত দুঃখ গ্রহন করে তাকে এক অনির্বচনীয় প্রকৃতি প্রেমের অনুভূতি দেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর ।
কমলার মাথায় কি এক ইচ্ছা চেপে বসল - হাত পা ছুঁড়ে সারা পুকুরের জল তোলপাড় করল - আবার খুব করে সাঁতার কেটে নিলো খানিকটা। ছেলেমানুষের মত আরও কত কি যে নিজের অজান্তেই করতে লাগল তার আর হিসেব রইল না - প্রকৃতির কোলে যেন এক উন্মাদিনী বালিকা ।কে বলবে এ সেই কমলা যার বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা - এ সেই কমলা সে কাল থেকে কিছুই মুখে তোলেনি - এ সেই কমলা যে জীবনে সুখের মুখ দেখিনি - মা , বাবা , স্বামি কিছুই পাইনি ।
পাশ থেকে একটা শালুক ফুল ফস করে তুলে নেয় - কি সুন্দর ফুল - এটা কি সে খোঁপায় গুঁজবে ? জল সিক্ত পুষ্ট ঠোঁট দুটি থেকে হালকা হাসির সাথে বেড়িয়ে আসে " ইস " - আর মনে মনে ভাবে , " লজ্জা করে না বুঝি - রাস্তার পরপুরুষের সামনে মাথায় ফুল ? "
বেশ কিছু সময় পার হয়ে যায় - এবার কেমন যেন আর ভাল লাগে না কমলার - বুকটা থেকে থেকে হু হু করে উঠছে । ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসে - কাপড়ের নিচটা নিগড়ে নেয় ।

ছয়

ঘোষ বাড়ির পিছনে মাটির রাস্তায় কাকে যেন পড়ে থাকতে দেখে ছুটে আসে বিন্দার মা । প্রথমটায় নিজের শোনার মতো করেই বলে , " ও মা , এ যে আমাদের কমলা গো " তারপর চেঁচামেচি করে দু-চার জনকে ডাকে । তখনও কোন সাড় ছিল না কমলার - চোখ দুটো কেবলই কাঁপছিল ।
সকলে ধরাধরি করে বাড়ি দিয়ে আসে কমলাকে - চোখে মুখে জল দিয়ে অনেক কষ্টে চেতনা ফিরানো হয় । ফ্যাল ফ্যাল করে কেবল সবার মুখের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চায় খালি - তারপর সবার প্রশ্নে বলে , " শরীরটা ভাল যাচ্ছিলো না গো , হটাত চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল ... তারপর ... তারপর ... হুমম আর কিছু মনে করতে পারছি না । "
রতনের বউ কমলার বড় ছেলেকে বলে , " মা রে একটু চোকে চোকে রাখবি ... বেশি খটাখাটনি করতি দিস নে বাপ "

সকালের শাক গুলো কেমন ঝিমিয়ে সেই বারন্দাতেই পড়ে আছে - অনেক কষ্টে বিছানা ছাড়ে কমলা - শাক কুটতে বসে যায় - না হলে ছেলেপিলে গুলো খাবে কি ? বাইরে থেকে সবাই দেখবে কমলা কাজ করছে - কিন্তু কমলা নিজে জানে ভিতর ভিতর কমলা মরে গেছে - বাইরের কমলাটা খালি সাংসার আঁকড়ে পড়ে আছে ।

ছোট ছেলে - মেয়েটাকে খাইয়ে বড়টাকে ডাকে,আজএকটা থেকে ওর পরীক্ষা।
সে খাটে শুয়ে মোবাইলে সিনেমা দেখছে - উত্তর দেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করে না প্রথমটায় - কমলা খুব করে ডাকতে থাকলে হটাত চিৎকার করে বলে , " এই শালা কুকুরের মত চেচাছিস কেন ? তোর ওই সব বমি আমি খেতে পারব না ... মাংস রাদ আমার জন্যে ... "
মাংস ? কোথায় পাবে কমলা ? একটু চুপ করে কথা গুলো একটু সামলে নিয়ে কমলা বলে , "কেন ? রবিবারেই তো বিশুদার বাড়ি থেকে নিয়ে আসলাম । আমদের কি অতো পয়সা রে যে ... " শেষ হয় না কথা । ছেলে বিচ্ছিরি মুখ করে বলে , " কেন রে ? তোর মাংস রাদ না ... দিন দিন তো আমার মুখের গ্রাস গিলছিস আর মোটা হচ্চিস ... তোর মাংস ... " থেমে যায় ।
এতক্ষণ ভাত বাড়ছিল কমলা - এই কথায় হটাৎ যেন সে পাথর হয়ে যায় - পাথর হলেই মনে হয় ভাল হত - কিন্তু হায় তার বুকের মায়ার স্পন্দনটা যে সহজে পাথর হওয়ার নয় ।
ছেলের ভাত বেড়ে রেখে কমলা সেই সকাল বেলাকার পুকুরের ধারে চলে আসে - সে জানে মাদু আজ রাতের আগে আর ফিরবে না ।

একটা জিওল গাছের তলায় বসে পড়ে কমলা । সকালে যে কি শান্তি পেয়েছিল - কি আনন্দ হয়েছিল তখন যতখানি তার অনুভব করতে পেরেছিল - এখন এই ভগ্নতর হৃদয়ের সেই অনুভূতি গুলোই যেন বহুগুনে বর্ধিত হয়ে ধরা দিতে লাগল । ভাল লাগার ভিতরও সে অনুভব করে কিসের যেন কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে - একটা চাপা কান্না যেন সমস্ত শরীর দিয়ে ফেটে পড়তে চাইছে । এ যেন আঁধারে ক্ষণপ্রভার মতো - দুঃখে থাকতে থাকতে সে দুঃখ ধীরে ধীরে সহ্য সীমার ভিতর চলে আসে । কিন্তু , মাঝে যদি হটাৎ ক্ষণিকের সুখ প্রবেশ করে তাহলে চিরাচরিত দুঃখ গুলি মনকে প্রবল ভাবে আঘাত করে করে ক্ষত করে দেয়।

সকালের বিক্ষপ্ত নীল আকাশ আর নেই - শ্রাবণের আকাশ থরে থরে কালো মেঘে সাজানো । হাওয়া বইছে কোন সুদুরের বনস্পতি আর ধান খেত গুলির ভিতর দিয়ে - বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে কমলার । সোঁদা সোঁদা গন্ধ বাতাসে - শালিকেরা ঝগড়া করছে , খঞ্জনার নাচছে - টুনটুনির লাফালাফি করছে , মাছ গুলো একটু করে লাফিয়ে উঠছে , একটা কাক থেমে থেমে ডাকছে - এই সব নির্নিমেষ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে ।
অনেক সময় কেটে যায় - মশার কামড়ে ঘুম ভাঙ্গে কমলার । উঠে দেখে আলো প্রায় নিবে এসেছে -সন্ধ্যা এলো বোলে ।

ছেলেটার পরীক্ষা ছিল না আজ ? গিয়েছিল কি ? এই সব কথা মনে পড়তেই , কে যেন ফিসফিস করে তার কানে বলল , " ছেলে ? কি করে ছেলে হয় সে তোমার ? ছেলে কি মায়ের মাংস খেতে পারে ? "

সাত

ঠাকুরের সামনে আজ সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালে না কমলা । ঠাকুর জীবনে কোনোদিনই কিছুই দেয়নি তাকে । কমলাদের চাওয়া - পাওয়া খুব সঙ্কীর্ণ সীমার ভিতর আবদ্ধ - তাদের কাছে সুখ বলতে একমাত্র স্বামি - ছেলেমেয়েকে নিয়ে সুখে থাকা । যেন দুবেলা একটু ভাতে-ভাত জোটে । শাড়ি চাই না - গহনা চাই না - গাড়ি চাই না । এতটুকু অভাবও দূর করতে যখন বিধাতা অপারক তখন কেন কমলা এই ক্ষুদ্রের পদলেহন করে চলবে ? আজ বরং কমলা এই ভেবেই একটু খুশি হয় - যে সে নিজেই এত দিন ঠাকুরের উদর ভর্তি করেছে জল মিষ্টি দিয়ে । লক্ষ্মীর ঘট  টেনে আছাড় মারে - পয়সা গুলো ঝনঝন করে ছড়িয়ে পড়ে মেঝেতে । বেশিরভাগই অচল পয়সা - চালু পয়সা থাকার যা সম্ভাবনা ছিল - বড় ছেলেটা তা শেষ করেছে ।

আজ রাতে কমলার ঘরে চাল বাড়ন্ত - কেনার মতো টাকাও যে নেই ঘরে - কি খাবে আজ তারা ? টিনের পাত্রের ভিতর দু-চার মুঠো মুড়ি পায় - নরম বাসি মুড়ি । তাতে একটু জল আর চিনি মিশিয়ে ছোট ছেলে-মেয়ে দুটোকে খাওয়ায় ।

ছেলে-মেয়ে দুটো ঘুমিয়ে পড়ে - বড় ছেলেটা আজ নেশা করে ফিরেছে বুঝতে দেবে না বোলে আগেই কিছু না বলে ঘুমিয়েছে - বেশ বুঝতে পারে কমলা । সে আর খেতে উঠবে না ভেবে নিশ্চিন্ত হয় - আজ পরীক্ষা দিয়েছে কিনা তা জানারও রুচি হয় না ।

বারান্দায় শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল চিন্তা করতে শুরু করে কমলা - রবিবার আবার পলিও খাওয়ানোর তারিখ - ইস বুনোর মার ওলটা আজও কাটা হয়নি - মনসা বউ বলেছিল ভাদ্রে বাড়িতেএকটা পূজো দিতে তালে নাকি সব দুঃখ কেটে যাবে - অনেক ভোরে উঠেই জবা ফুল গুলো পেড়ে নিতে হবে তা না হলে গাছে আর একটিও থাকবে না - আরও কতো কিছু চিন্তা করল আধো জাগরণে তার বিষয় বস্তু কমলার নিজের কাছেই স্পষ্ট হল না ঠিক  - একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ল । ঘুমানোর ঠিক আগে তার একবার যেন মনে হয়েছিল , কেমন খিদে খিদে পাচ্ছে ; সেই রাক্ষস তাকে আর প্রশ্রয়দেয়নি কমলা ।  

আট

অনেক রাতে ঘুমের ঘোরেই পিঠে এক অমানুষিক যন্ত্রণা অনুভব করে ধরফরিয়ে উঠতে গিয়ে আচমকা টাল সামলাতে না পেরে বারান্দা থেকে উঠনে সপাটে পড়ে যায় । ইটের কোনায় লেগে - মাথা যায় ফেটে - গল গল করে রক্ত সারা মুখটাকে ভিজিয়ে দেয় । ঘটনাটা এত আকর্ষিক ঘটে যায় যে কমলা যন্ত্রণাতে কুঁকড়ে যাওয়ার বদলে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে -
মাদু বাড়ি ফিরেছে আকণ্ঠ মদ খেয়ে - বারন্দাতে কমলাকে ঘুমোতে দেখে দিয়েছে এক লাথি কমলার পিঠে ।

মাদুর দেহের উপরের অংশটা ভীষণ ভাবে টলতে থাকে - মুখে অশ্লীল ভাষা - একটা কথা বার বার বলতে থাকে , কমলা মরলে সে আবার বিয়ে করতে পারে – সঙ্গে বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি সব অঙ্গভঙ্গি ।
হটাৎ কি যে হল । কমলার সারা শরীর যেন জ্বলে উঠল - চোট পাওয়া বাঘিনীর মতো ছুটে গেল মাদুর দিকে - মারল এক ঠেলা - মাদু ছিটকে গিয়ে ভেজানো দরজার উপর পড়ল - দরজা খুলে গেল সশব্দে - মাদু মাটিতে পড়ে গ্যাঙাতে লাগল - মুখ দিয়ে গ্যাঁজালা বেরোচ্ছে - পেট ফুলে উঠছে ।
শব্দে বড় ছেলের ঘুম ভেঙে গেল - ব্যাপার বুজে সে চিৎকার করে উঠল - " বাপরে তুই খুন করবি ?" তারপর মাদুকে কোন রকমে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেল - চৌকাঠে লেগে কোমরটা হয়তো ভেঙ্গেছে ।

কমলা টলতে টলতে উঠনের তুলসী মঞ্চের পাশে এসে ধপাস করে বসে পড়ল - চোখের দৃষ্টি মৃত মানুষের মতো - বিদ্যুৎ চমকাল - ভীষণ শব্দে পৃথিবী কেঁপে উঠল - কমলা ক্ষণকালের জন্যও বিচলিত হল না - ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো - শ্রাবণের আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি । মাথা দিয়ে এখনো রক্ত গড়িয়ে পরছে - বৃষ্টি যেন সযত্নে সে রক্ত মুছে দিচ্ছে – বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন ভীষণ আপনজন হয়ে সারা শরীরে চুম্বনে চুম্বনে এক অপার্থিব সুখ দেওয়ার চেষ্টা করেই চলেছে...

                                                     
নয়

একটু ঘুমিয়েই পড়েছিল কমলা বা চেতনাই হারিয়ে থাকবে হয়তো - যখন উঠল বৃষ্টি থেমে গেছে - আকাশ একটু একটু ফর্সা হয়ে আসছে - শীত শীত করে কেমন - হটাত করে ভীষণ গা গুলিয়ে ওঠে - নর্দমাটার দিকে ছুটে যায় -
এই ভাব কমলার অজানা নয় - পেটে আবার "শত্তুর আসছে - মারে খাওয়া শত্তুর "
আকাশে বেশ একটা আলো আলো ভাব - সারা রাতের বৃষ্টিস্নাত আকাশ জুড়ে এখনো দুএকটি ক্লান্ত তারা এখানে ওখানে বিষণ্ণ চোখে চেয়ে আছে - রাঙা পথে ভোরের পথিকের ছাপ এখনো পরিনি - পাখিরা একটু আধটু অকারণ ডাকছে পরস্পরকে - ধানক্ষেত বৃষ্টির জলে হাবু ডুবু খাচ্ছে - দূরে একটা হালকা কুয়াশার চাদর- সমস্ত সংসার যেন মৃদু অথচ বিরামহীন এক গতিতে পরিণতি লাভ করছে - চারিদিকে থমথমে ভাব -
কিন্তু একি - প্রভাতের এই শান্ত সমাহিত ভাবকে ভেঙে কে ওই উন্মাদিনী ছুটে চলছে পায়ে জলের ছলাক ছলাক শব্দ করে - প্রভাতের ছবি যেন চমকে চমকে উঠছে সেই ছন্দে -
মুক্তি - হ্যাঁ মুক্তিই দেবে নিজেকে কমলা আজ - কে আছে এ জগতে যে মুক্তি থেকে আজ কমলাকে দূরে রাখতে পারে ? কমলার সংগ্রাম যেন অদৃষ্টের সাথে - সমস্ত জগৎসংসারের সাথে -যেন সমস্ত ঘৃণা সমস্ত রাগ পৃথিবীর বুকে প্রতিটি দৃঢ় পদক্ষেপের সাথে সাথে সে জানাতে থাকে -  মুষ্টি বদ্ধ হাত আকাশের দিকে মাঝে মাঝে ছুঁড়ে দিয়ে বাতাসকে যেন ছিন্নভিন্ন করে দেয় – কেন সে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত আজ ? কেন তার এত কষ্ট ? জগত কেন তাকে এমন করে বাঁচিয়ে রেখেছে ? সারা জগতের নিরুত্তর ছবিতে সে সামনে কেবল মুক্তিকেই দেখতে পায় – মুক্তি ?  মুক্তি কোথায় পাবে সে ? সে জানে মুক্তি আছে মৃত্যুতে - মুক্তি আছে ট্রেন লাইনে -
আর বেশি দেরি নেই - দূরত্ব যত কমে আসে ততই যেন আরও বেশি আরও বেশি বেগে দৌড়ায় সে - সেকেন্ড ট্রেন পাঁচটা দশে - আর পাঁচ - ছয় মিনিট হয়তো আছে - পাঁচ - ছয় মিনিট পরেই মুক্তি -
মুক্তি - মুক্তি - মুক্তি  এক অনির্বচনীয় আনন্দে নেচে ওঠে তার সব শরীর - আনন্দ মুক্তিতে - মুক্তি মৃত্যুতে -

সামনে মুক্তির স্থান এবার স্পষ্ট - আর মিনিট দুই - ওই তো ট্রেনের শব্দ - ট্রেন আসছে দূর্বার গতিতে- আরও জোড়ে আরও জোড়ে ছোটে কমলা -
"কমলা না? ছুটে কোথায় যাস ?" ডাক্তার বাবু চেঁচিয়ে বলে- তিনি সকালে হাঁটতে আসেন এই দিকটায় ।

কমলা ঘাড় ঘোরায় ডাক্তারের দিকে তবুও অঙ্গে অঙ্গে গতির রেশ- ডাক্তার বলে , " তোর মেয়ের পেটের অসুখের ওষুধ গুলো আনিয়ে রেখেছি - বেলা হলে নিয়ে যাস । তা এত সকালে এদিকে কোথায় চললি ? "


কমলার পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে বসে যায়- শরীর যেন পাথর হয়ে থমকে যায় - আর সে ছুটতে পারে না - পাশ দিয়ে ট্রেনটা হুড়মুড় করে চলে যায় - তার তীক্ষ্ণ বাঁশির শব্দ যেন কমলা কেই যেন ব্যঙ্গ করে - কমলা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থকে ।