গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৪

সাঈদা মিমি


আয়নার সামনে

আমার ঘুম আসে না, কাল ভাইয়ের ছেলেটাকে হাসতে হাসতে বললাম, আমাকে এখন পশ্চিমের দেশে চলে যেতে হবে, দুপুরে ঘুম আসে, আর রাতভর খুটুর খুটুর করি….. আমার আসলে কেউ নেই, একা একটা সমস্ত রাত সবাই ঘুমালে ডেভেলপারদের সুবিধা হয়, তারা তখন ইট-পাথরের ট্রাক গলিমুখে নিয়ে আসে, আর সেগুলো রাতভাঙা শব্দ তুলে ফেলতে থাকেইট, বালি, সুরকিআমি ঘুমের বড়ি খাই, তারপর সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি, ভুতুড়ে চোখভৌতিক অন্ধকারএকা বসে টিভি দেখা যেতে পারে, সেটাও অসহ্য, তারপর পশ্চিমের জানালায় বসি, যতদুর চোখ যাওয়ার পর দৃষ্টি সংকুচিত হয়ে আসে, তারও পরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করি, মুখোমুখি বাসার বারান্দায় কেউ একজন রোজ মদ্যপান করে, গেলাসে বরফ ফেলার শব্দ কানে আসে, দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়া, ভালো লাগে না

মুখোমুখি না তাকালেও চোখ যায়, ন্যাক্কারজনক, এখন এখান থেকে সরে যেতে হবে পুবের দিকটায়, একটা শিরিষ গাছ আছে; একটাই, কিভাবে যেন টিকে গেছে? ওর সাথে দুটো নিম আর একটা কিশোরী মেহেদি গাছ, নিম গাছের একটায় এক কাক পরিবারের বাসা, পাঁচটা ডিমের তিনটে ফুটেছিলো, মা কাকটা খাবার আনতে গেলে বাবা পাহাড়ার থাকতো, দুজনে মিলেমিশে দিব্যি উড়তে শেখালো বাচ্চাগুলিকে, একজন একদিন ডেকে উঠলো কুউউব্যাস, ব্যাপারটা টের পেয়েই দুই কাক মিলে দিলো ডানার ঝাপটা, কোকিল ছানাটা বিষম খেতে উড়তে শিখলো, কি আশ্চর্য, এই পোঁড়া নগরে কোকিল আসে! কয়েকদিন ডাক শুনেছি; একাকিত্বের হাহাকার, তারপর আর নেই, হয়তো কোন লবণদ্বীপের ঘ্রাণ পেয়ে উড়ালপথে ফিরে গেছে স্বজনদের কাছে, আমি অন্তত এরকম ইতিবাঁচক ভাবছি, একটা শিশুকোকিল উড়তে উড়তে দল খুঁজে পেলো!

আর একটু মুখ ঘোরালেই আটতলা বাড়িটা, লিফট আছে, বড়লোকেরা থাকে, সব ফ্ল্যাটেই এসি লাগানো, তিনতলার যে অংশটা দেখি সেটা একটা রান্নাঘর বোঝা যায়, একমাত্র ওই জানালাই খোলা থাকে, বাকি সব বন্ধ, অজ্ঞাত কারণে রাত ঘন হয়ে আসার পরেও ওই ঘরে আলো জ্বলে থাকে, মাঝে মাঝে বাসন ভাঙার শব্দ, গোঙানি, খিস্তিখেউর এবং একটা শিশুর অস্বাভাবিক কান্না কিংবা চিৎকারের শব্দ শোনা যায়! আমার তখন খুব ভয় করে, আমি ডিভান থেকে লাফ দিয়ে উঠি, এক্ষুনিএক্ষুনিএক্ষুনিবিড়বিড় করতে করতে বারান্দায় চলে যাই

এখানে আমার শখের গাছ, গোলাপ, টগর, বটলব্রাশ, বামন বাগানবিলাস
-কেমন আছো টগরসোনা?
-একদম পচা, আমাকে ভাওয়ালগড়ের নিবিড় থেকে তুলে আনলে কেন?
-ওখানে তুমি অনেক গাছের ভিড়ে ধুকছিলে
-আমরা ওভাবেই বাড়ি, প্রকৃতির ঘ্রাণ নিতে নিতে আমরা বাঁচি, অথবা মরি, আমাকে তুমি আনলে কেন? ফিরিয়ে দাওবাব্বাহ, এতো শক্তিবাবুর কবিতা আওরাচ্ছে! :কেমন আছো বাবা গোলাপ? সে কেবল ঘোৎ করে একটা শব্দ করে :এই যে বটলব্রাশ
-আমি ভালোই আছি
-আচ্ছা? খুশি হয়ে উঠি
-বাগানবিলাস সাহেবা, ফুল দাওনা কেন?
-আমাকে বড় ড্রামে বসিয়ে দে, সঙ্গে কানায় কানায় ভরা মাটি আর পানি, ফুল দেবো, পাষণ্ডি কোথাকার….. আমার খুব মন খারাপ হয়, এতটুকু জায়গায় এর চেয়ে বেশি কিছু ঢোকানো যাবে না।

নিজের কামরায় চলে আসি, সরিয়ে রাখা পর্দা, খোলা রাত্রি থেকে আসছে শুক্লপক্ষের আলো, বাচ্চাটা পাশ ফিরে শুলো, হাসছে, চোখের পাপড়ি কাঁপছে, স্বপ্ন দেখছে সে, হয়তো জীবনের শ্রেষ্ঠ কোনো স্বপ্ন! বাথরুম লাগোয়া আয়নায় দেখি, ক্লান্ত এবং লালচে কালিজমা চোখ, উত্তরের জানালায় বসি, এখানে কোনো মুখোমুখি ঘর নেই, আছে পথ, অসংখ্য বাহু ছড়ানো পথরতিক্লান্ত দম্পতির কাছে, বখাটেদের সিঁড়িঘরের পাশ দিয়ে, নিশিকুটুমের পালানোর ফন্দিতে, চৌকিদারের হুইসেলে পথ হাঁটছে !
- পথ, তুমি হাঁটো কেন?
 -সারাদিন তোমরা হেঁটেছো, এবার আমি হাঁটবো, আর সকাল আসতেই তোমাদের আয়ু কমে যাবে একদিন চমকে উঠি, আবারও ভয় লাগে,
-তোমার শেষ কোথায় পথ?
-যেখানে তোমার অন্তিম, সেখানেই আমার মাইলফলক
-তোমার সঙ্গী কই?
-আমি একা, আমি ঈশ্বরের মতন একা