গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

তাপসকিরণ রায়


পাখিদির বিয়ে 


সত্যি একদিন পাখি দির বিয়ে হয়ে গেল। সেই বিশু গুণ্ডার সঙ্গেই--খবরটা শোনার পর থেকে কেন যেন রমাকান্ত মনে মনে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে ছিলেন। আর হবেই বা না কেন ? পাখি দির সঙ্গে তাঁর যে একটা কোনাচে সম্পর্ক ছিল। ডুব মারা আদি রসাত্মক ঘটনা না হলেও কিন্তু ওই অপরিণত বয়সে পাখিদি আর রমাকান্তর সম্পর্কর ছোঁয়াছুঁয়ির খেলাটা কম প্রভাবিত করেনি তাঁকে। 
পাখি রমার চাইতে অনেক বড়--রমার যখন তের, পাখির তখন ছাব্বিশ হবে। আর তা ছাড়া পাখি দির চেহারা যাচ্ছেতাই ছিল--যেমনি কালো, তেমনি মোটা। ওই বিশু গুণ্ডাদের দলই একদিন পাখির পথ আটকে বলে ছিল, মা কালী ! পেসাদ চাই...

মেয়েছেলের দল এমনি--পরনিন্দা পরচর্চায় একটু বেশী সরব। পাখিকে তারা মোষ চেহারার বলত। রমাকান্তর তা মোটেই ভালো লাগত না। হতে পারে পাখি দি তাঁর কালো, মোটা--কিন্তু তার শরীরের তেল-চকচক ভাবটার কথা তো কেউ বলে না ! রমাকান্তর কানে একদিন মা, ঠাকুমার কথাগুলি গিয়ে ছিল, তাঁরাই বলে ছিলেন, ওমন কালো ঢেপসি মোষ চেহারার মেয়েকে কে ঘরে তুলে নেবে ? কিন্তু এ হেন মেয়ের বিয়ে হবে, কথাটা বড় বিস্ময়ের ছিল। চারদিকে হওয়ার আগে আগে চাউর হয়ে গেল। পাড়ার সবচে মুখরোচক, অত্যাশ্চর্য খবর ছিল, পাখিদির বিয়ে !
রমাকান্ত নিজেই বুঝতে পারেন নি, তাঁর মন কেন এত ব্যথাতুর হয়ে উঠেছিল ! পাখির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুরুতে পিওর ছিল বটে--তারপর ওই ফিঙে  পাখি দেখার ব্যাপারটা সব কিছু কেমন যেন গোলমাল করে দিয়ে ছিল। 

একদিনের ঘটনা। সে দিন রমাকান্ত জানলা দিয়ে দেখেছিলেন, সেই ফিঙে পাখিটাকে, লেজ নাড়িয়ে নেচে নেচে শিস দিতে দেখে অভিভূত হয়ে ছিলেন। সেটা এক সময় ফুড়ুৎ করে উড়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তখন রমার বারো কি তের বছর বয়েস। তিনি জানলার পাল্লায় উঠে পাখির খোঁজ করছিলেন। আর ঠিক এমনি সময় পাখিদির আগমন। রমাকে দেখে পাখিদি বলে ছিল, পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে জানলায় উঠে কি করছিস রে তুই ?

রমাকান্ত তাঁর দেখা ফিঙে পাখির উড়ে যাবার কথা বলে ছিলেন। উত্সাহ নিয়ে পাখিদি জানলার কাছে এসে রমার গা ঘেঁষে ফিঙে দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু কোথায় সে ফিঙে পাখি ! ঠিক সে সময় লাল ফ্রক পরা একটা মেয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখে পাখিদি বলে উঠেছিল, ওই যে তোর পাখি যাচ্ছে ! পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে এ সব হচ্ছে ?

বেদম আপত্তি করে ছিলেন রমাকান্ত। তখন পাখি দির গালে লেগে ছিল দুষ্টু মিষ্টি একটা হাসি--কেন কে জানে ! সেটা বোঝা গেল যখন রমাকান্তর শরীর কেমন শিরশিরিয়ে উঠেছিল। পাখিদি তখন রমাকান্তর পাখিটা ধরে নিয়ে ছিল ! রমা কিছু বলতে পারেন নি--অন্তঃস্থলির অস্বস্তি ভাবের সঙ্গে কেমন একটা নেশা নেশা ভাবও জড়িয়ে গিয়েছিল। 

এ ঘটনা রমাকান্তকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। পাখি দির প্রতি আরও অনেকটা দুর্বলতা জন্ম নিয়ে ছিল। তারপর এমনি বড় কোন ঘটনা না ঘটলেও ছোটখাটো আদর চুম্বন ইত্যাদি প্রায়ই লেগে থাকত দুজনের ভেতর। পাখি দিই তাতে সক্রিয় থেকেছে বেশী। 

এ হেন পাখি দির বিয়ে। সকালে পাখি এসে নেমন্তন্ন করে গেল। কার্ড নেই, মুখে মুখে। বিশু গুণ্ডা নাকি বলেছে, কোন ঘটা না--মন্দির যাব--মালা বদলাব--আর মাথায় সিঁদুর ছোঁয়াবো--
পাখি বড় খুশি। তাঁর মত এবড়ো-খেবড়ো মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এটাই নাকি বেশী !
বিশু নাকি বলেছে, এত ঘটা করে কি হবে ? সব কিছু তো মনের ব্যাপার ! 
এরপর আর কিই বা বলার থাকতে পারে ? পাখিদি এসে বলে ছিল, রামু, তুই থাকবি আমার সাথে--মন্দিরে বিয়ের সময়। 
--আমি ? নিমরাজি রামু বলে উঠেছিলেন।
--এই তুই না আমার বন্ধু ? আমার সঙ্গে না হয় নিত বর হয়ে যাবি !
রমাকান্ত তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়েন। এ বয়সে নিত বর হওয়া যায় না--তিনি তা জানতেন। তবু ধোপে তাঁর আপত্তি টেকেনি। পাখিদি তাঁর গাল টিপে আদর করে দিয়ে ছিল, রমাকান্ত চুমু কাটতে গিয়েছিলেন--পাখি দি সেদিন প্রায় দৌড়ে দুরে সরে গিয়েছিল। 
--তা হলে আমি যাব না--অভিমান করে ছিলেন রমাকান্ত। 
পাখি হেসে বলে ছিল, তুই সব সময় আমায় পাবি রে ! গলা গলা একটা হাসি ধরা ছিল পাখির চোখে মুখে গালে। 
ব্যাস, ঠিক হয়ে গিয়েছিল, পাখি দির বিয়েতে রমাকান্ত যাবেন। যথাসময় হাজির হয়েছিলেন তিনি। সবাই তৈরি হয়ে ছিল, বিশুর দুই গুণ্ডা বন্ধু, সাগরেদরাও সেখানে ছিল। সবাই মিলে বেশ হৈ হল্লা চলছিল। এমনি সময় রমাকান্ত গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন। 
--এই আয় এ দিকে, পাখি ডাক দিয়ে ছিল।
পুরোহিতের সামনে পাখি আর বিশু দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনের হাতেই ফুল মালা, বিশুর এক হাতে ছোট্ট একটা সিঁদুরের কৌটোও হবে।
বিশু হেসে ছিল রমাকান্তকে দেখে। বিশুর বন্ধুরা বলে উঠেছিল, লে রে--তোর শালাবাবু এসে গ্যাছে !
মালাবদল হয়ে গেল--বিশু কৌটো খুলে সিঁদুরের মুঠো নিয়ে পাখির সিঁথি ও মাথায় ছড়িয়ে দিল। ব্যাস বিয়ে কমপ্লিট !
মিষ্টির প্যাকেট বের হল, সবাই মিষ্টি খেল। 
রমাকান্ত লক্ষ্য করছিলেন, পাখি দির মুখটা সেদিন খুব সুন্দর লাগছিল--মন্দিরের অস্পষ্ট আলোর লালিম আভা তার মুখমণ্ডল লাবণ্যে ভরিয়ে দিয়েছিল—যেন এক স্বর্গীয় আনন্দ তার চোখে মুখে প্রতিফলিত হচ্ছিল ! 

রমাকান্ত ফিরে আসছিলেন। চারদিকের ফাঁকা ফাঁকা ভাব তাঁকে অসহায় করে তুলেছিল। বুকের ভিতর কোথায় যেন একটা দুঃখ চড়মড়িয়ে উঠছিল। পাখি দির প্রতি তাঁর আকর্ষণ কতটা তার ব্যাখ্যা করা শক্ত হলেও একটা অন্তরটান তিনি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলেন। 
               .