গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সাঈদা মিমি


বস্তিবাস (আগের সংখ্যার শেষ অংশ)

জুয়াঘর

গাফফার মোল্লা অতিরিক্ত ধুরন্ধর প্রকৃতির মানুষ, নিজের ঘরটা সে এমনভাবে বানিয়েছে যাতে বস্তির প্রতিটা কার্যকলাপ এখান থেকে চোখে পড়ে এই যেমন ঠিক উত্তর পশ্চিম কোনায় যে দুইটা ঘর, সারাদিনে প্রাণ ওখানে স্পন্দিত হয় না, ওগুলোর সাড়া পাওয়া যায় রাত এগারটার পর ; সেই সাড়া সোরগোল অন্যরকম, ওগুলোর নাম জুয়াঘর ওখানে বাতিগুলি রহস্যময়ভাবে জ্বলে, অনেক নিমগ্ন মুখ দেখতে পাওয়া যায়, কেউ উৎফুল্ল - কেউ হতাশ, কেউ বা ঘোরাক্রান্ত এই ঘরদুটিকে ঘিরে অনেক বানিজ্য, জুয়া - মাদক - দেহব্যাবসা মা প্রায়ই ভাবে এটা কি আইনের আওতামুক্ত জায়গা? প্রকাশ্যেই তো হচ্ছে  সব, পুলিশ আসে না তো কখনও! রানির মা কে ভয়ে ভয়ে বলেছিলোও একদিন সে হেসেই খুন, পুলিশ আইবো কেরে? হে গো টেকা দেওয়া অয় তার মানে ব্যাপারটা এই! মা আতংকিত থাকে, কেননা এইরকম একটা সময়ের মুখোমুখি সে হয়েছিলো, বলা যায় সময় তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো একটা কুখ্যাত দিনে যখন বশির সম্পূর্ণই ঝুঁকে পড়েছিলো মদ জুয়ায় হ্যাঁ, তার স্বামীটির নাম বশিরুল্লাহ, তার নাম কেকা

অভাবের দিন দানা বাঁধেনি তখন, বেশ চলে যেতো খেয়ে পড়ে, কিছু শখ মিটিয়ে, এমনকি হাতের বাড়তি টাকাগুলো চলে যেত বই কিনতে কেকা একটু হিসেবী হলে হয়তো স্বর্ণালংকার কিনে রাখতো কিন্তু দূর্বোধ্য ঈশ্বর তাকে বৈষয়িক জ্ঞানটা দেননি সম্ভবত একারণে বশিরের পরিবর্তনটা তার চোখে পড়লো দেরীতে আরো সম্পদশালী হওয়ার আশায় অথবা একজাতীয় ধনী গোষ্ঠীর মত জাতে ওঠার লোভেই হবে, বশির ঘন্টার পর ঘন্টা তাস পেটাতো একটা অভিজাত ক্লাবে, রাতে বাড়ি ফিরতো আকণ্ঠ মদ গিলে এই যে বল্গাহীন  এক ভালোবাসা নিয়ে কেকা বসে থাকছে সেটা তুচ্ছ, এই যখন রঙধনু জন্মালো তার পরেও পরিবর্তনটা এলো না সে তার ভরভরন্ত কোচিংয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়লো ছাত্রছাত্রীরা আসে, দীর্ঘ একটা সময় অপেক্ষা করে চলে যায় আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা কমতে শুরু করলো একটা অশান্তি আনুপাতিক হারে বাড়ছে কেকা বর্ধিষ্ণু পরিবারটির বড় বৌ, তার শ্বাশুড়ি কিংবা দুই দেবর যাদের একজন ইতিমধ্যে বিয়ে করে এখানেই থাকছে, সবারই কেন্দ্রবিন্দু কেকা, সে সবার দোষ দায়ের ইজারা নিয়ে বসে আছে যখন সব ভেঙে পড়ছিলো একে একে, বিক্রি করা হচ্ছিলো ঘরের যত আসবাব, তখন স্বজনেরা পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়েছে তারপর কেকার বিশাল বইয়ের সম্ভারটিতে হাত পড়লো, সেদিন কেকা সন্তান হারানোর যন্ত্রণার মত কেঁদেছিলো, এখনো কাঁদে সে একবার পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, এই সংসার পরিত্যাগ করবে, পারেনি, সাপটে ওর পা ধরে বসেছিলো বশির, ‘সবাই চলে গেছে কেকা, তুমি যেও না,  আরেকটা সূযোগ.. দয়া করো,  আর একটা …’

রানির মার ঘর থেকে কুৎসিত গালির শব্দ ভেসে আসছে, ‘বাইর তুই ভাতার খাগি, অন্য লাং ধরগা...' কেকা কি কানে আঙুল দেবে? কি লাভ, এসব এখন রোজ হচ্ছে, গাফফার মোল্লার দ্বিতীয় পক্ষ আসার পর থেকেই মহিলাও সমান তেজে চেচাচ্ছে, ‘তুই বাইর ব্যাজগাওয়ের চুন্নি, আমি আমার মরদের বাইত আইছি, তরে চিনি আমি ,জুয়াগরের মাসি না তুই! তর নাগরগো ডাইক্কা আনুম?' অসহনীয় অবস্থা, বেধরক চুলোচুলি, গাফফার মোল্লার হুংকার, মারপিটের আওয়াজ এই ক্লান্ত দুপুরে মা বেটি চোখটা বুজতে পারে না, বাচ্চাটা চীৎকার করে কান্না জুড়ে দেয় অসহায় মা শিশুটিকে কোলে নিয়ে রুমে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে

অনেকদিন পর শহরের পথে হাঁটছে কেকা, কোলে রঙধনু, মেয়েটার পায়ের ক্ষতটা পুরোপুরি সারেনি কেকার ভালো লাগছে হাঁটতে, শীত শীত দুপুরটা মোলায়েম আগে সে হুটহাট বেরিয়ে পড়তো, এমনি এমনিই হাঁটতো অথবা একটা রিকশা নিয়ে উদ্দ্যেশ্যহীন ঘোরাঘুরি এখন রিকসা নেয়া যাবে না, অকারণ বেরিয়ে যাবে দরকারি কটা টাকা কেকার ভালো লাগছে বস্তির ঘুপসি থেকে বেরিয়ে, বড় রাস্তা তারপর আবাসিক এলাকার সুনসান পথ, আকাশ ছুঁতে চাওয়া বাড়িগুলির অন্য জীবন হঠাৎ কেকা থমকায়, হাবিব ভাই না! যে একটা কালো ম্যুরোনো গাড়ী থেকে নামছে! হ্যাঁ তাইতো, কিন্তু এই জম্পেশ স্যুট বুটে তাকে অন্যরকম লাগছে! কেকা একে চিনতে পারছে না, সে দূর্ধর্ষ ছাত্রনেতা হাবিব হাওলাদার কে চিনতো, বস্তি থেকে উঠে আসা এক নিবেদিত প্রাণ শ্রেণি সংগ্রামী, একদিন কেকা কে বলেছিলো পুঁজিবাদের ঝাণ্ডাধারী

ফিরতে সন্ধ্যা নেমে গেলো, বাচ্চাটা ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমে হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেরী, তার প্রায় রাজসিক বাড়ীর ড্রয়িংরুমে বসে খুবই অস্বস্তি হয়েছিলো কেকার কে যেন দয়া করে নিয়ে এসেছিলো চা বিস্কুট হাবিব ভাইয়ের বৌ ওর সাথে পরিচিত হয়ে একটা চর্চিত দেখনহাসি দিয়ে বিদায় নিলেন, কি এক সভা রয়েছে তার কেকা ফিরছে একরাশ তিক্ততা নিয়ে তার মাথায় শ্রেণী সংগ্রাম, প্রলেতারিয়েত, শ্রমিক বিপ্লব, কার্ল মার্কস, লেনিন, ডাস ক্যাপিটাল সব একসাথে ভজঘট পাকিয়ে গেছে কিন্তু বস্তির এই সরু গলিটায় এত পুলিশ কেন! রানির বাপের কোমরে দড়ি, রানির মায়ের কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়ছিলো তার আগেই সাদা পোষাকের ডি বি পুলিশ কষে এক চড় বসিয়ে দিলো কেকার হৃদযন্ত্রে হাতুরি পেটাচ্ছে কেউ বস্তির জুয়াঘরের কীর্তি ফাঁস হয়ে গেছে, গোয়েন্দা পুলিশ রানির বাবা মা কে ধরে নিয়ে গেলো, এর সাথে জড়িত আরো কয়েকজনকেও
বেঁচে থাকার সংজ্ঞা
 কেকা বিস্মিত, বিস্ময় তার নিজের ভিতরের পরিবর্তনকে ইঙ্গিত করছে বস্তির পরিবেশ এখন থমথমে এমন নয় যে পুলিশ এখানে গ্রহান্তরের আগন্তুক বরং উল্টাই, পুলিশি ঝামেলা এখানে নিত্যকার তবুও সারা বস্তিতেই এক অদ্ভুত নীরবতা সাত সকালের হাউকাউ নেই, সরু গলিটায় বসে ওর মাথার উকুন বাছতে বাছতে আড্ডা জমে না কেকার মনে হয় কিছু একটার স্পন্দন থেমে গেছে কি বিস্ময়! যখন প্রতিমুহূর্ত সে প্রার্থনা করছে এই পুতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে মুক্তির, তখন এই বিচ্ছিন্ন অনুভব তাকে কেন তাড়িত করছে? রানি প্রতিদিন কান্নাকাটি করছে, অসহায় এক অবস্থা কেকা আরো বিস্মিত হয় রানির সৎমায়ের আচরণে সে ভেবেছিলো এই সুযোগে মহিলা সর্বেসর্বা হয়ে উঠবে কিন্তু দেখা যাচ্ছে মহিলা আশ্চর্য মায়ায় পরিবারটিকে সামলাচ্ছে

লোকজন আসছে রোজই বশিরের কাছে,  শিক্ষিত মানুষের পরামর্শ নিতে কিভাবে উকিল ধরতে হবে, কেস কোর্টে ওঠার আগেই জামিনের ব্যাবস্থা করা দরকার, এইসব চলছিলো কিংবা রানির কান্না অথবা রানির সৎমায়ের নীরবতা, ভাবনারা এগোয় না কাল গার্মেন্টস শ্রমিকেরা পথে নেমে এসেছিলো, দখল করেছিলো বড় রাস্তার ওভারব্রীজ,  তিনঘন্টা আটকে ছিলো সব যানবাহন, মালিকপক্ষ দুই মাসের বেতন আটকে রেখেছে পথে আধলা ইটের ছড়াছড়ি, কিছু জখম মানুষ,গাড়ির ভাঙ্গা কাঁচ ছড়ানো রাজপথ এর নাম কি বিপ্লব? সেদিন হাবিব ভাইয়ের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিলো কেকার হাবিব ভাই এখন একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কর্ণধার! হতেই পারে…… ‘হাবিব ভাই একদিন আপনি আমার হাতে একটা বই তুলে দিয়েছিলেন মনে পড়ে? যে গল্পের শেষ নেই নিশ্চই নিশ্চই, তুমি রাশিয়ার শ্রমিক বিপ্লবের ইতিহাসটা জানো, একটা দুঃশাসনের রাজনীতি……’থামেন হাবিব ভাই, আমি বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিয়ে কথা বলছি আপনার শ্রমিকরা কি ন্যায্য পাওনা পায় আপনাদের কাছ থেকে?’  দেখো কেকা, বিষয়টা তুমি বুঝবা না, এই দেশের শ্রমিক শ্রেণির মানুষগুলা একেকটা মস্ত ঘোড়েল, আমাকে বুঝতে হয় কাকে কতটা প্রশ্রয় দেয়া যাবে কিভাবে বলছেন? আপনি কি ওদের কাতারে কোনদিন ছিলেন না! হট্টগোলে ঘোর ভাঙ্গে, কেস কোর্টে উঠেছে রানির মায়ের জামিন হয়েছে, গাফফার মোল্লার তিন মাসের জেল আর একলাখ টাকা জরিমানা

এরকম হয়! কেকা ভাবে, রানির মায়েদের সম্পর্ক এখন আশ্চর্য ভালো দুজনে একসাথে বসে গল্পসল্প করে, ‘ বু, তুমি এতনা ধুমসি কেরে? রানির বাপেতো চ্যাপ্টা অইয়া যাইবো গা!’… ‘চুপ কর মাগি, বেশী কইরা খা, গতর দেখলে তো মনে অয় বাতাসেই লরতাছস…’ কেকা ভাবে, তবে কি পথের কাঁটাটা রানির বাপই ছিলো? তিনমাস পরে গাফফার মোল্লা ফিরে এলে কি এই চিত্রটা থাকবে? বশির জানিয়েছে, বস্তিবাসের সময়কাল আর বেশিদিনের নয় তবে কি তারাও হাবিব ভাইয়ের মত পাতি বুর্জোয়াদের পথে হাঁটছে? মাথাটা চিড়বিড় করে ওঠে কেকার, সেদিন সে একরকম হামলে পড়েছিলো হাবিবের ওপর, -আপনি মিলন দাকে হত্যা করিয়েছিলেন না? -আমি! আমি কেন করাবো? মিলন পার্টির সাথে বেঈমানি করে আণ্ডারগ্রাউণ্ডে চলে গেলো, আমাদের গোপন দলিল দস্তাবেজ তুলে দিলো শত্রুদের হাতে পার্টি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই হয়েছে -কে পার্টি? আপনি তো সেকেণ্ডম্যান ছিলেন আপনি জানতেন আমি আপনাকে উপেক্ষা করেছিলাম মিলনদার কারণে, আপনি জানতেন মিলনদাকে আমি ভালোবাসতাম, আপনাকে সে পীরের মত মানতো, আপনার কথায় সে আণ্ডারগ্রাউণ্ডে চলে যায় আমাকে উপেক্ষা করে আপনি তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন ষড়যন্ত্র করে একটা ক্রোধ কেকার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিলো, যেমন ফেটে পড়েছিলো হাবিব, মুখ সামলাইয়া কথা বলো, বিপ্লবীর প্রেম হইলো দেশ, নারী না। -কোন কিতাবে লেখা আছে? আপনাদের মত পাতি বুর্জোয়াদের মেনিফেস্টোতে? শ্রেণিসংগ্রামীদের কাতারে বসে কারখানার মালিক হলেন কিভাবে? আপনার তো শ্রমিক ইউনিয়নের লীডার হওয়ার কথা! হাবিব তেতে ওঠে, পুঁজিবাদের পতাকা নিয়া হেঁটেছো, তোমরা কি বুঝবা শোষিতদের কষ্ট?
বিকারগ্রস্থের মত হেসে ওঠে কেকা, আপনি বোঝেন? আমি সব জানি, গরীবদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যে সমিতি খুলেছিলেন, সেই সমিতির লাখ লাখ টাকা মেরে দিয়ে আজ আপনার এত ব্যাবসাপাতি আর জৌলুস পর্যায়ে ক্রোধে উম্মত্ত হাবিব উঠে দাঁড়ায়, উঠে দাঁড়ায় কেকাও আমি আপনাদের মত লীডারদের মুখে পেচ্ছাব করি ক্রোধ তরল আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ছিলো, ঝড়ের বেগে বের হয়ে আসার সময়ও ভাবেনি, ভেবেছে আরো পরে যখন শীতল শৈথিল্য এসেছিলো, তার শিক্ষা - রুচি - আজন্ম সংস্কার ভেঙ্গে ওরকম কুৎসিত কথা সে কিভাবে উচ্চারণ করতে পেরেছিলো ?

কতগুলি দিন পার হয়েছে বস্তিবাসের? মনে পড়ছে না কেন! আশ্চর্য বোধ করে কেকা। প্রথম প্রথম দিনগুলির হিসাব থাকতো, মাসের, বছরের, এখন এরকম কিছু মনে পড়ে না, যেন অনন্তকাল তারা এখানেই বসবাস করছে। অনন্তকাল! সে কি নিজের অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলে? কে জানে, আরও কতদিন এখানে থাকতে হবে তাদের? হয়তো আরও অনেকদিন কিংবা অল্পদিন, এখন এসব আর তেমন করে আসে না ভাবনায়, যদি আকাশটাকে একটু দেখা যেতো! আর একবার কেকা ভাবে, ‘আমি আকাশটাকে বুকে জড়িয়ে একটা সমস্ত রাত ঘুমাতাম, অনেকদিন কোন সম্পূর্ন আর স্বাপ্নিক ঘুম আসেনি।‘ ‘আগামীকাল শব্দটাকে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সে মিছিলের মুখ হয়ে যেতে থাকে।