গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

দোলনচাঁপা ধর


এমনও হয়

         কোনোকিছু আপ্রাণ চাহিয়াও না পাইলে মানুষ এমন ভাব করিয়া থাকে যে জিনিষটি কস্মিনকালেও সে চায় নাই,শক্ত পৃথিবীর সাথে মোকাবিলা করিবার ইহা একটি প্রাচীন হাতিয়ার তাহা বলাই বাহুল্য তথাপি আমার ব্যক্তিগত অভিমত সত্যের বড় পথ নাই, একবার অপারগতার কথাটা স্বীকার করিতে পারিলে বাকি জীবন শান্তি ও নির্বিঘ্নে কাটানো যায় নচেৎ যাহা এতদিন চাহি না কহিয়াছি তাহাই সুযোগ পাইয়া গ্রহণ করিলাম এবং কি প্রকারে কিছু অধিক পাইতে পারি সে ব্যাপারে সচেষ্ট হইবার ত্রুটি রাখিলাম না এ বড় বিড়ম্বনার।

          পাখি ছিল অসামান্যা সুন্দরী কিন্তু সে সাজিতে জানিত না,নারী হইয়া সাজিতে না পারা কিরূপ বেদনার তাহা নারী মাত্রেই জানে। যে কোনও অনুষ্ঠানে তাহাকে দেখিতাম দুইটি বেশ স্থুল বেণী ঝুলাইয়া, দুই ভ্রু মধ্যে একটি কালোজিরা র ন্যায় খয়েরী বিন্দিয়া টিপ ও তাহার চিরপরিধেয় সালোয়ার কামিজ পরিয়া মা পিসিমার সহিত উপস্থিত হইত।তাহার সমবয়সী মেয়েরা তখন ছায়াছবির অনুকরণে নানা বাহারের পোশাক পরিত,আমরা তার চেয়ে বেশ ছোট তবু এ ব্যাপারে তাহাকে কিছু বলিলে পরম অবজ্ঞায় সে মুখ ফিরাইত, দেখিয়া মনে হইত কি করুণাই না ঝরিয়া পড়িতেছে ইহাদের নিমিত্ত তার দুই চোখে। যথাকালে পাখির বিবাহ হইল ও স্বামীর সহিত তাহার কর্মস্থল মুম্বাই চলিয়া গেল। বেশকিছুদিন পাখির খবর জানি না, বছর দুয়েক বাদে মুনিয়া র বিবাহে ( পাখির সহোদরা) তাহাকে আবার দেখিলাম আর দেখিতেই রহিলাম, এ কোন পাখি? এ তো কোনও চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবির ন্যায়, সুন্দরী সে পূর্বেই ছিল সন্দেহ নাই কিন্তু সে রূপ চোখে সহ্য হইত এখনের এই রূপ যেন খাপখোলা তলোয়ার,অন্যের কথা আর  কি কহিব, আমি নারী হইয়াও অসিবিদ্ধ  হইলাম।সে যে এত সুন্দর সাজিতে শিখিয়াছে তাহা চর্চার বিষয় হইয়া দাঁড়াইল, শাড়ি পরিবার কায়দা, গহনার ও সুগন্ধীর  ব্যবহার এবং সর্বোপরি বিভিন্ন রঙের ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করিল, শুনিলাম তাহার স্বামী এখন হইতে কলিকাতাতেই রহিবেন, ফোর্ট উইলিয়ামে তাহার বদলি হইয়াছে, অতয়েব মধ্যে মধ্যেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাহার সহিত দেখা হইতে লাগিল, এতদ্ব্যাতীত সে প্রায়শই পিতৃগৃহে আসিত তাহাতেও সাক্ষাতের অবকাশ হইত।

          ইতোমধ্যে এক প্রভাতে শুনিলাম ধলা জ্যাঠা (পাখি র পিতা)  মারা গিয়াছেন, বাড়ির সকলের সাথে ছুটিলাম ওবাড়ি। ওখানে তখন শোকের পরিবেশ, ভোর রাত্রে মারা গিয়াছেন জ্যাঠা, আত্মীয় স্বজন কিছু কিছু আসিতে শুরু করিয়াছে জেঠিমা আর মুনিয়া মৃতের দেহ ছুঁইয়া আকুল কাঁদিতেছেন, যদিও দায়িত্বকর্ম কিছু বাকি ছিল না তবু মৃত্যু সর্বদা শোকের, বিশেষ জ্যাঠার জননী তখনো জীবিতা, তিনিও অশ্রুপাত করিতেছেন থাকিয়া থাকিয়া, বয়সের ভারে বেশীক্ষণ কিছু মনে রাখিতে পারিতেন না এই যা স্বান্তনা।বেলা বাড়িতে লাগিল একে একে সকল আত্মীয়রা আসিয়া পড়িলেন মৃতদেহ সৎকারের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত এদিকে পাখির দেখা নাই। তাহার অপেক্ষায় বসিয়া বসিয়া সকলের অশ্রু শুকাইল তথাপি পাখি আসিয়া উপস্থিত হইতে পারিল না , শ্মশানযাত্রী মানুষ জন আর অপেক্ষা করিতে চাহিল না তাহারা হরি বোল ধ্বনি দিয়া মৃতদেহ স্কন্ধে তুলিয়া বাহিরে রক্ষিত শকটের দিকে লইয়া চলিল এমনই সময় পাখি আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া শ্মশান যাত্রী রা হরি বোল কহিতে ভুলিল আর জেঠিমার অশ্রু সজল চক্ষু নিমেষে ক্রোধে রক্তবর্ণ ধারন করিল। পাখি আসিয়াছে দুধসাদা ঢাকাই শাড়িতে ,অঙ্গের জামাটিও তদ্রুপ , পদ্মপলাশ নয়ন দুটি রোদচশমায় ঢাকা আর তার বব ছাট বাদামী রঙা কেশ হাওয়ায় উড়াইয়া, তবে সে যে সীমন্তিনী তার প্রমান স্বরূপ এয়তির লক্ষণ কিঞ্চিত সিন্দুর তাহার সীমন্ত আলো করিয়াছিল।

         যাহা হউক সে পর্ব মিটিলেও তাহার সাজের কথা আজিও আমাদের চর্চার বিষয়, পরে সেইদিন প্রসঙ্গে যখন তাহাকে কেহ কিছু কহিতে গিয়াছে পাখির জবাব--- সে দেশে কেউ মারা গেলে সাদা কাপড় পরে যাওয়াই প্রথা, আমার ছিল না তাই গড়িয়াহাট থেকে শাড়ি কিনে পরে তবে গেছিলাম