গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

শান্তিময়কর




নিহত বাসনা                       

                                           
                    সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই মনটা কেমন কু গাইছিল সুলতার । রাত্রে ঘুমের মধ্যে কি রকম বিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন দেখেছিল সে, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না এখন আর ।  মনটা কেমন যেন ভারি হয়ে আছে এবং তার কেবলই মনে হচ্ছে একটা অঘটন কিছু ঘটতে যাচ্ছে । সকালে জেগে ওঠার পর থেকে ঘর সংসারের হাজার কাজ, ছেলেমেয়েদের তৈরি করে স্কুলে পাঠানো, ঠিকে কাজের মাসি তিন চারদিন ধরে আসছে না । সুতরাং ঘর ঝাড়ু দেওয়া, বাসন মাজা, সবই করতে হবে একা হাতে । তারপর সাত তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে স্বামীকে খাইয়ে অফিস রওনা করানো, ইত্যাদি অনেক কাজ । এত কাজের মধ্যেও বুকের ভিতরটা মাঝে মাঝে কেমন যেন খালি লাগছে তার । প্রতিদিন সকালে কত সুন্দর ঝরঝরে ফুরফুরে শরীর - মন নিয়ে ঘুম ভাঙ্গে তার, কিন্তু আজ এ কী হল ? কিছুতেই মনটাকে শান্ত করতে পারছে না সে --- আসলে মনটাই যেন তার বাগে নেই । কি করবে তাও ভেবে উঠতে পারছে না সুলতা । স্বপ্নের ব্যাপারটা অনেক বারই তার মনে এল, কিন্তু না, কিছুতেই মনে করতে পারছে না সে । এ কী অস্বস্তিকর অবস্থা ! কাজের ফাঁকে তার উদাস আনমনা ভাবটা স্বামী সন্দীপের নজর এড়ায় না । কী হয়েছে তার জিগ্যেস করায়, " ও কিছু না " বলে এড়িয়ে গেছে সে । স্বামী অফিস রওনা হবার পর স্নান সেরে ঠাকুর ঘরে ঢুকেছে সুলতা । নিবিষ্ট মনে তার পুজো করাও হয়ে উঠছে না । মাঝে মধ্যেই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে । সে মনে মনে বলে, " ঠাকুর, তুমি তো দয়াময়, সব বিপদেই তো তুমিই রক্ষা কর । আমাকেও রক্ষা কর ঠাকুর "। কোন রকমে পূজো পাঠ শেষ করে রান্নাঘর থেকে জলখাবারের প্লেটটা নিয়ে সে এসে খাবার টেবিলে বসে । খাবার টা নিয়ে কিছক্ষণ নাড়াচাড়া করে প্লেট টা পাশে সরিয়ে রাখে । তার একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না । একবার ভাবে বন্ধু সুশীলা কে ফোন করে । ফোনের রিসিভারটা হাতে তুলে নিয়েও নামিয়ে রাখে ।
                    এমন সময় কল বেলের আওয়াজে সে চমকে ওঠে । এই অসময়ে কে আবার এল । উঠে গিয়ে দরজা খুলেই সে হতচকিত হয়ে যায় । এ কে তার সামনে দাঁড়িয়ে ? কেমন একটা অজানা আশংকায় তার সারা শরীর ঝিমঝিম করে ওঠে । শরীরের সমস্ত রক্ত যেন হিম হয়ে যায় । মেরুদণ্ড বেয়ে যেন একটা হিমবাহ নামতে থাকে । মুখ, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে , পা দুটো থরথর করে কাঁপতে থাকে তার । এতকাল পর আবার যে তাকে সামনের মানুষটার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, সুলতা তা কল্পনাও করতে পারেনি কোন দিন । তাই সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে বিহ্বল, বিমুঢ় হয়ে যায় সে । সামনের মানুষটাও তার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যায় । 

                    একটা সময় ছিল যখন ঐ মানুষটাই ছিল সুলতার ধ্যান, জ্ঞান, জীবন । কখনও ভাবতেই পারতো না যে তাকে ছেড়ে কোনদিন অন্য কারও সাথে তাকে ঘর বাঁধতে হবে । যৌবনের সাত-সাতটা বছর কোথা দিয়ে কেমন করে পার হয়ে গেছল স্বপ্নের ঘোরে, আজও তার স্পষ্ট মনে পড়ে । বিয়ে হবার পর প্রথম প্রথম সে বুকে পাথর চাপা দিয়ে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করেছিল, তবুও মাঝে মাঝে তার মনটা উদাস হয়ে কোথায় হারিয়ে যেত । কথায় বলে সময় সব কিছুকে বদলে দেয় । মানুষের মন, মানসিকতা, অনুভব সব কিছুই একদিন না একদিন পালটে যায় । দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, বেদনা, শোকও সময়ের ব্যবধানে মানুষকে স্বাভাবিক করে তোলে । তাই স্বামী, সন্তানদের নিয়ে ঘোরতর সংসারী হয়ে উঠে প্রাগ-বিবাহিত জীবনের সব কথা সে ভুলে যায় । স্বামীর অফুরন্ত ভালবাসা আর সন্তানদের নিয়ে সে আজ সুখী, প্রকৃতই সুখী । এক সময় তার যে আর কারো সাথে কোন সম্পর্ক ছিল, সেটা সে ভুলেই গেছলো । কিন্তু আজ হঠাৎ সামনে তাকে দেখে সুলতার মনে উত্তাল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় । যে সত্য সে এতকাল স্বামীর কাছে অতি কষ্টে গোপন রেখেছিল, তার আশংকা, একবার যদি তা কোন ভাবে প্রকাশ হয়ে যায়, তাহলে তো তার পায়ের তলায় সামান্য মাটিটুকুও আর অবশিষ্ট থাকবে না । সে ভেসে যাবে অসহায় খড়কুটোর মত । এক নিমেষে এত সব কথা তার মনের মধ্যে খেলে যায় । তার চোখের সামনে, শরীরের খুব কাছাকাছি কেউ একজন দাঁড়িয়ে থেকে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সে কথা সে বিস্মৃত হয় । আচমকা তার কথায় সুলতা সম্বিত ফিরে পায় ।
          ---  আমি যে এতক্ষণ তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, দেখতে পাচ্ছ না সুলতা ?
          ---  অতনু, তুমি হঠাৎ এতদিন পর ?
          ---  কেন, আসতে পারি না আমি ? কোন বাধা আছে না কি ?
          ---  না, কোন বাধা নাই । তবু বলি, না এলেই ভাল করতে ।
          ---  আসতে আমাকে হতই সুলতা । না এলে চলত না । অনেক কষ্টে তোমার      
               এখানে এসেছি । আমার কথাগুলো তোমাকে বলতে না পারলে একটুও
               শান্তি নেই যে আমার ।
          ---  আমি তো তোমার কোন কথা আর শুনতে চাই না । তাছাড়া শুনেই বা 
               কী লাভ ?
          ---  এতদিন পর এলাম, একটু বসতেও বলবে না, বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে ?
          ---  সরি, ভিতরে এসে বসো । আর যা বলার আছে তাড়াতাড়ি বলে 
               তুমি চলে যাও এখান থেকে, প্লিজ ।
          ---  বাঃ, সুন্দর ঘরটা তো তোমার । আর তুমি আগের থেকে আরও অনেক
               বেশী সুন্দরী হয়ে উঠেছো ।                      
          ---  অধিকারের সীমা ছাড়িও না অতনু । মনে রাখবে আমি এখন একজনের
               স্ত্রী এবং দুই সন্তানের মা ।
          ---  ভুল বোঝ না সুলতা । সুন্দর চিরদিনই সুন্দর ।

                    কথার মাঝে সুলতা আবার তার অতীতের স্মৃতিতে হারিয়ে যায় । কী ছিল সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো । এই মুহূর্তে তার দুহাত দূরে যে মানুষটা বসে আছে, তাকে নিয়ে কত স্বপ্নই না দেখেছে এককালে । অতনু ঠিক সেই আগের মতই আছে তবে শরীরটা আরও একটু রোগা হয়েছে । সাদামাটা প্যান্ট শার্ট আর একগাল খোঁচাখোঁচা দাড়িতেও সুন্দর লাগছে তাকে । তাকে দেখা অব্দি পুরনো দিনের সব কথা, সব স্মৃতি তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে । কত কষ্ট আর কত চেষ্টায় এতদিন সে যা ভুলে থেকেছে, আজ তা আবার নতুন করে তার মন, সত্ত্বা, অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে । কত রঙিন আর স্বপ্নময় ছিল অতনুর সাথের দিনগুলো তার । একটা দিনও এমন ছিল না যেদিন তারা নিভৃতে, একান্তে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা না পার করে দিত । হাতে হাত রেখে গঙ্গার তীরে বা ময়দানের সবুজে বসে কতই না আনন্দ আর সুখের মুহূর্ত কেটেছে তাদের । স্বপ্নে রঙিন উচ্ছল দুটি যুবক যুবতী ভবিষ্যতের সুখ স্বপ্নে মশগুল হয়ে থাকতো । আবেগ-ঘন মুহূর্তে তারা হারিয়ে যেত নিজেদের মধ্যে । বেশ মনে পড়ে  সুলতার, একদিন অতনু তাকে বলেছিল ----
          ---  এবার মনে হয়  তোমার সাথে পাকাপাকি ঘর বাঁধার সময় এসে গেছে সুলতা ।
          ---  সত্যি বলছো ? বলো না আর কতদিন এ ভাবে অপেক্ষা করে থাকতে হবে ?
                আমি যে আর পারছি না ।
          ---  সে কথাই তো বলছি । আজ তোমাকে এমন একটা সারপ্রাইজ দেবো
               শুনে চমকে উঠবে ।
          ---  কি খবর বল না জলদি ।
          ---  আসামের চা বাগানে আমার একটা চাকরি হয়েছে । মোটা টাকা মাইনে । কাল 
                বাদে পরশু আমি আসাম যাবো । চাকরিতে যোগদান করে একমাস পর এসে 
                তোমায় বিয়ে করে সাথে নিয়ে ফিরবো ।
          ---   কী আনন্দই না হচ্ছে । কত ভাল কথাই না শোনালে তুমি । কিন্তু ভাবছি এই
                একটা মাস কাটাবো কেমন করে ?
          ---   কোন চিন্তা করো না । মাত্র তো একটা মাস, আমি রোজ তোমাকে ফোন 
                 করবো ।
          ---   আচ্ছা ঠিক আছে । ওখানে পৌঁছেই ফোন করো, আমি খুব চিন্তায় থাকবো ।

                    ঠিক দুদিনের মাথায় অতনু বাড়ীর লোকজন এবং সুলতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসাম যাত্রা করেছিল । ওখানে গিয়ে পৌঁছা সংবাদ দেবার পর প্রায় দু সপ্তাহ কেটে গেছে, অতনুর আর কোন খবর বা ফোন আসেনি । ভীষণ দুশ্চিন্তা নিয়ে সে অতনুর বাড়ী যায় । ওখানে গিয়েও জানতে পারে, তারাও আর কোন খবর পায়নি । তারা অতনুর কোম্পানিতে যোগাযোগ করে জানতে পারে যে অতনু কাজে যোগদান করার পরদিন থেকে আর অফিস আসছে না । সুলতার তখন কী করুণ অবস্থা ! চিন্তায় চিন্তায় অস্থির, পাগলের মত হয়ে যায় সে । একটা চাপা কান্না সব সময় তার বুকটাকে ভারী করে রাখে । অনেক চেষ্টা করেও অতনুর বাড়ীর লোক তার আর কোন হদিশ পায় না । তার কথা ভাবতে ভাবতে সুলতা কেমন যেন হয়ে যায় । কত অশুভ চিন্তা তার মাথায় ভিড় করে আসে । আপন মনে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কীই বা করতে পারে সে ? তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে । পরে পরে সুলতা অবশ্য জানতে পেরেছিল অতনুর বাড়ীর লোকেরা তার খবর জানতো । কিন্তু তাকে তারা তা জানায়নি । সুলতাকে তাদের অপছন্দের কারণেই হয়তো তাকে জানায়নি বা জানানো প্রয়োজন বোধ করেনি।

                    এদিকে সুলতার বাড়ীর লোকেরা অতনুর ফিরে আসার আর কোন সম্ভাবনা নাই দেখে একরকম জোর করেই তার বিয়ে দিয়ে দেয় প্রাইভেট কোম্পানির উচ্চ পদস্থ অফিসার সন্দীপের সাথে । কালক্রমে সব দুঃখ, ব্যথা, বেদনা ভুলে গিয়ে সুলতা এখন সুগৃহিণী, কর্তব্যপরায়ণা গৃহবধূ । সুখের সংসার তার । সুলতা অনুভব করে আজ হঠাৎ আবার অতনু এসে তার মনটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে । ঐ অধ্যায়টা তো সে কবেই বন্ধ করে দিয়ে এসছে । তাহলে আজ আবার অতনু কেন এসেছে তার কাছে ? তবে কি তার জীবনে নেমে আসতে যাচ্ছে আরও কোন বড় আঘাত যা তার এই সুখের সংসারটাকে তছনছ করে দেবে ? সে সোজাসুজি অতনুর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ---
         
          ---  সেদিন তো তুমি আমাকে অকূল পাথারে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেছলে । অনেক
                কষ্টে, অনেক চেষ্টায় আমি নিজেকে শান্ত করে একটা শান্তির নীড় গড়ে 
                তুলেছি। আবার কেন তুমি এলে এতদিন পরে ? তোমার সাথের দিনগুলোর 
                কথা আমি তো আর মনে করতে চাই না ।
          ---  এটা কিন্তু তোমার অভিমানের কথা । কেন আমি তোমার সাথে যোগাযোগ 
                করতে পারিনি বা কেনই বা ফিরে আসিনি, শুনলে তুমি আমাকে নিশ্চয়ই
                ক্ষমা করে দেবে । আর তুমি ক্ষমা না করলে অপরাধ না করেও যে আমায় 
                চিরদিন অপরাধী হয়েই থাকতে হবে তোমার চোখে ।
          ---   আমি তো তোমার কাছে কোন জবাবদিহি চাইছি না ।
          ---  জবাবদিহির ব্যাপার নয় । আর তাছাড়া তোমার কাছে কোন সাফাই পেশ
               করতে আসিনি সুলতা । সত্যিটা বলতে এসেছি আর তা না বলে আমি এখান
               থেকে এক পা ও নড়বো না । না বলে আমার যে মরেও শান্তি নেই ।

                    সুলতাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অতনু যা বলে তা এক কথায় মর্মস্পর্শী ও ভয়ঙ্কর । আসামের চা বাগানের চাকরিতে প্রথম দিন যোগদান করে কাজের শেষে সে যখন কোম্পানির গেস্ট হাউসে ফিরছিল, তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। নির্জন রাস্তাটা দিয়ে সে যখন হাঁটছিল, তখন অতর্কিতে কালো মুখোশ পরা চার পাঁচ জন লোক তাকে ঘিরে ধরে । ভয়ে, আতংকে তার সারা শরীর হিম হয়ে যায়, পা  দুটো থরথর করে কাঁপতে থাকে । তাদের মধ্যে একজন অতনুর কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে তার হাতে বড় একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে একটা নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দিতে বলে, অন্যথায় তাকে গুলি করে হত্যা করার ভয় দেখায় । অনন্যোপায় অতনু সেই প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সেই ঠিকানার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে কোথা থেকে একদল পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় । ঐ প্যাকেটের মধ্যে নাকি বহু লক্ষ টাকার চোরাই হীরে আর অন্য কি সব নিষিদ্ধ বস্তু ছিল । অনেক কাকুতি মিনতিতেও সে পুলিশ কে মানাতে পারেনি যে তার কোন দোষ নাই, সে নিরপরাধ, ষড়যন্ত্রের শিকার । কোন যুক্তি, কোন অনুরোধেই কিছু হয় না । এমনকি তাকে মুক্ত করার জন্য তার কোম্পানির সব চেষ্টাই বিফল হয়ে যায় । আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে তাকে পাঁচ বছরের সস্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হয়। এক সপ্তাহ আগে মেয়াদ শেষে সে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ী ফিরেছে । অনেক কষ্টে সুলতার ঠিকানা জোগাড় করে এখন সে তার সামনে । নিহত বাসনার তীব্র যন্ত্রণায় তার সমস্ত দেহমন বিধ্বস্ত । বিনা দোষে আজ সে সুলতার বিচারে শাস্তিযোগ্য আসামী । সে তো ক্ষমার্হ নয় সুলতার কাছে । তার তো সব শেষ হয়ে গেল, এমন কি বেঁচে থাকার ইচ্ছাটুকুও । অতনুর কথা শুনতে শুনতে সুলতার বুকের মধ্যে একটা গভীর ব্যথা টনটনিয়ে ওঠে । সে আর স্থির থাকতে পারে না, ব্যাকুল হয়ে ওঠে তার মন । মাথা ঘুরে যায়, টাল সামলাতে না পেরে সে পড়েই যাচ্ছিল --- অতনু তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে ফেলে । অচেতনের মত কিছুক্ষণ থাকার পর সুলতার সম্বিত ফিরে এলে তাকে কেমন উদ্ভ্রান্ত আর দিশেহারা লাগে । অপলক চোখে সে অতনুর দিকে তাকিয়ে থাকে --- কত করুণ আর অসহায় ঐ মুখটা, কত কষ্টই না পেয়েছে আর পাচ্ছে ঐ মানুষটা । দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অসহায়ের মত শক্ত মুঠোয় তার হাত দুটো চেপে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে সুলতা । অনেক কষ্টে তাকে কিছুটা শান্ত করে অতনু বলে ---

          ---  সুলতা, স্থির হও । আমি তোমার কাছে কোন আবেদন নিয়ে আসিনি । আসিনি আমার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ফিরে পেতে । এ জীবনে যা হবার ছিল না, তা হল না । তাই বলে ভালবাসা মিথ্যে হয়ে যায় না সুলতা । আমি তোমাকে আজও ভীষণ ভালবাসি । পৃথিবীতে সব চাইতে বেশী ভালবাসি আমি তোমাকেই । আমার বুকভরা ভালবাসার সবটুকু শুধু তোমার জন্যই । তাই আমি সত্যিই চাই, তুমি যেখানেই থাকো, সুখে থাকো । একটা জন্ম কেন, আমি জন্ম জন্মান্তর তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবো । আমার সম্বন্ধে তোমার মনে যে ভুল ধারণা, তা দূর করতে সত্যি ঘটনাটা তোমায় বলে ভারমুক্ত হতে চেয়েছিলাম, আজ আমি সত্যিই মুক্ত । কোন ক্ষোভ, কোন দুঃখ আর রইল না আমার মনে । আমার জন্য তোমাকে কখনও, কারও কাছেই ছোট হয়ে যেতে দেব না --- এ আমার দৃঢ় প্রতীজ্ঞা । ভালো থেকো । সুখে থেকো ।

                  এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে অতনু দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে । সুলতা তার চলে যাওয়ার পথের দিকে উদাস নয়নে অপলক তাকিয়ে থাকে আর দরদর ধারায় তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে তার বুক ভাসিয়ে দেয় । চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে ওঠে ।