অন্য মানুষ, পণ্য মানুষ
এক নিওন আলোয় পণ্য হল আজ যা কিছু ব্যক্তিগত । লোকটাকে অদ্ভুত কায়দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল সুগত। পায়ের উপর পা রেখে এক বিচিত্র ভঙ্গিমায় শুকনো মুড়ি চিবুচ্ছিল। চপ, চানাচুর বা টমাটোর উপস্থিতি অনাবশ্যক । একটি কাচালঙ্কাও মহার্ঘ্য । আর তখনই চোখ চলে গিয়েছিল তার অনাবৃত পায়ের দিকে। দাদ অথবা একজিমা কিছু একটা হবে... তার দাগ ও বহমান চিহ্ন সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে পায়ের নগ্ন অংশে ।ঠিক এই ছবিটাই এখন সুগতর সবচেয়ে বেশি দরকার ।
কোম্পানি বলেছে – একজন জলজ্যান্ত একজিমার রোগী ধরে আনতে, বিষয়টিকে লাইভ করতে এরকম মডেল খুব জরুরি। দ্যা মার্কেট হ্যাজ বিকাম কম্পিটিটিভ । প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বিজ্ঞাপন কে হতে হবে ম্যাগনেট । অন্যান্য কোম্পানি গুলো ঠিক এখানেই তাদের ল্যাং মেরে ফেলে দিচ্ছে।সেলিকল বা বি-টেক্স এগিয়ে গেছে কতদূর । তারা পড়ে আছে সেই তিমিরেই । অন্ধকার কি এগিয়ে আসছে । সূর্যের দিকে তাকাল সুগত। আলোর সোনালিরেখা এখনও রয়েছে ।চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখে নিল সে ।অন্য কোম্পানির লোকজন এসে পড়েনি তো ? না, কেউ খবর পায়নি । একটা দমবন্ধ চিন্তাভাবনার হাত থেকে নিস্তার পেয়ে যাওয়ার মসৃণ আনন্দে সে নেচে উঠতে গিয়েও পারল না । এখানে অন্যমনস্ক হওয়ার কোনও সুযোগ নেই । চ্যালেঞ্জ , অ্যাট এনি কস্ট তোমাকে এগোতেই হবে। পুরানো হলুদ হয়ে যাওয়া কথাগুলো আজকের তাৎপর্য নিয়ে ফিরে আসে ।
অদ্ভুত বৃত্তভুমির মধ্যে সাংকেতিক চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সময় । লোকটার দিকে আরেকবার তাকাল সুগত ।- আঃ; কি কপাল । এরকম মডেল রাও মুড়ি চিবোয় .... শুকনো মুড়ি , চপ পেঁয়াজি ছাড়াই , নির্জলা মুড়ি । ভালো কোম্পানির হাতে পড়লে বরাত ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারতো । অথচ ... । এ দেশের কিস্যু হবেনা। হতাশাব্যঞ্জক এই মন্তব্য থেকে সরে এসে সুগত ছুটে যায় লোকটার কাছে ।
- এই যে... লোকটা কিছুই বুঝতে পারেনা
- আমার কথা শুনতে পাচ্ছ ? লোকটা উত্তর দেয়না। নির্বাক এবং আশ্চর্যজনক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। উদাসীন এক ধুসর পৃথিবী তার চোখে আলোর বলয় তৈরি করে । এবার সে দেখতে পায় সংকেত ।
- তুমি ক্যা বাপ ?
- আমি, আমাকে চেন না ?
- না ত । লতুন লক , ই ধারে ত কনহদিন নাই দেখি।
- হ্যা, নতুন , কিন্তু টি ভি তে রোজ আমার ছবি দেখায় । দুবেলা । নিয়মিত।
- অ টি ভির লক । সিটা বইলবে ত । লোকটা তার পা চুলকোয় , একজিমা নিঃসৃত আদ্র তরল গড়াতে থাকে । লুঙ্গিতে মলিন ছাপ পড়ে । আঁশটে গন্ধে জমাট বাঁধতে থাকে চারপাশ । রক্তাক্ত ক্ষতস্থান চুলকোতে চুলকোতে সে মাথা নাড়ে
– মায়ের কিরা , তুমাকে চিনতে লারছি বাপ ।
সুগত সব কিছু বুঝিয়ে বলে। তাদের কোম্পানির নাম ধাম । ইয়ার্লি টার্ন ওভার । আগামি দশ বছরে তাদের কোম্পানি কোথায় যেতে পারে এইসব ।আসলে সেমিনারে তাকে যা যা শেখানো হয় সে সমস্ত কিছু উগরে দেয় এই সুযোগে । লোকটা তাকায় । বোধগম্য হয়না । এ তো অন্যমানুষ । ভাষা বুঝতে পারে না । আপন মনে মুড়ি চিবুতে থাকে। কষ বেয়ে লালা ঝরে । অনর্গল মুড়িতে মিশে যেতে থাকে এনজাইম । সুগত জরিপ করে চারপাশ । ততক্ষনে আরও স্পষ্ট ও নির্মল ভাবে চেনা যায় পায়ের দুষ্টু দাগ । সিদ্ধান্তের গভীরতায় পৌঁছে যায় সন্দেহাতীত ও দ্বিধাহীন – যে সে লোক নয় । মডেল হওয়ার উপযুক্ত । স্থির ও সচল ছবি তুলে আজকেই পাঠাতে হবে, দ্বিমত নেই এ বিষয়ে । সারাদিন ধরে খুঁজে খুঁজে অনেক কষ্টে সে উপযুক্ত মানুষের কাছে নিজেকে ছুড়ে দিতে পেরেছে । চান্স মিস করা যাবে না কোনোমতেই । ইউরেকা বলতে গিয়ে ঈষৎ টাল খেল সুগত । ওর সামনে দাড়িয়ে এক আগন্তুক। ভদ্র ধোপদুরস্ত চেহারা ।
- আপনি কোন কোম্পানির ? সুগতর গলায় আকস্মিক জিজ্ঞাসা । সন্দেহ হতাশা ও অনিশ্চিতি ভাবনা থেকে এক ধরনের বিপন্নতা তৈরি হয় যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষের বোধ নিরেট অর্থহীনতায় থমকে যায় ।
দুই
তোমার ময়লা জামা, ছেঁড়া জিন্স এনামেল উঠে যাওয়া দাঁত-এই তো দুস্প্রাপ্য ছবি চড়া দামে কিনে নেব আজ।
আমি একটি টেলিফিল্মের স্ক্রিপ্টরাইটার । টেলিফিল্ম বোঝেন তো ? লোকটির কথায় সম্বিত ফিরে আসে সুগতর । যাক বাঁচা গেল । প্রতদ্বন্দ্বী নয় । সুগত ইতিবাচক মাথা নাড়ে ।
-তারই স্ক্রিপ্ট তৈরি হবে – খিদের রঙ । মানুষের অভাব দারিদ্র নিয়ে নিউ কনসেপ্ট । একটু অন্যরকম ভাবনা । নিরীক্ষা মূলক । বাজারি বস্তাপচা গল্পের বাইরে নতুন থিয়োরি । ফরেন এ যাবে । এসব গল্প পাব্লিক খুব খায় আজকাল
-ভালো , খুব ভালো । আশ্বস্ত হয় সুগত । আপনার নাম ?
- পলাশ দেব । শুনে থাকবেন হয় তো । চারদিকে এত কাজের চাপ । টি ভি তে প্রায় ই ... পলাশ দেব নাম টা মনে করতে পারল না সুগত। তবু বলল
- খুব চিনি, আপনি পলাশ দেব, কী সোভাগ্য আমার । বেশ বুদ্ধিজীবি হাসি হাসল পলাশ
- আপনি ?
-আমি সুগত বাসু , এক্সিকুটিভ ডাইরেক্টর । তারপর কোম্পানির নাম খুব মৃদু স্বরে বলল । অনেকক্ষণ ধরে লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করে পলাশ দেব । ওর খাওয়ার ধরণ । পোশাক এবং ঘা- ময় শরীর । এসব পুরোপুরি লিখতে পারলে দারুন জমবে
– ফাটাফাটি । মার্কেট এমন সাবজেক্ট পেলে ক্যাচ করে নেবে । সুগতও দেখতে থাকে এক নাগাড়ে । ভাবে - লোকটা যে সে লোক নয় , মার্কেট ভ্যালু আছে । কপাল মন্দ তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুড়ি খাচ্ছে । অথচ আশ্চর্য সব মানুষজন রয়েছে চারদিকে । এখনও যাদের মেরুদণ্ড নেই , শিরদাঁড়া নেই , মেধা মনন এমনকি একজিমাও নেই তবু করে কম্মে খাচ্ছে কর্তার ইচ্ছেয় । চেতনার গভীর তল থেকে এই বার্তা ভেসে আসে সুগতর মনে । লোকটা তাকায় নির্মেঘ আকাশে । যা তার আশ্রয় ,এতদিনের ঘরবাড়ি । বাস্তুচ্যুত হওয়ার ভয় কি ওকে পেয়ে বসেছে ? ওর কাছাকাছি এল সুগত ।
এই যে শুনছ , শুনতে পাচ্ছ , আমার সাথে এস।
-আপনার সাথে মানে ? পলাশ দেবের চোখে আগুন ।
-আমার সাথে মানে আমার সাথে । এটা না বোঝার তো কারণ নেই।
-আমি অলরেডি ওকে বুক করেছি।
- মগের মুল্লুক না কি ? মামাবাড়ির আবদার
– বুক করেছি ।
- আমার ছবিতে ওর বিরাট রোল । সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার ।
- সেই কোন সকাল থেকে ওকে দেখছি , দুমিনিট দেখেই আপনার হয়ে গেল । আমি ওকে মডেল বানাব । মডেল
-কত টাকা দিতে পারবেন ওকে । আপনাদের মুরোদ আমার দেখা আছে ।
- বাজে বকবেন না । আপনি মশাই আচ্ছা দু নম্বরি মাল তো ।
- মাল । স্ল্যাং লাঙ্গুয়েজ ইউজ করছেন , আচ্ছা ছোটলোক তো ।
-আপনি মশাই থার্ড পার্সন । আমাদের দুজনের মাঝে অযথা নাক গলাতে আসছেন ।
- আ বে চোপ ।
- আমি ওকে কাজ দেব । বহুত কাজ ওর লাইফ বদলে দেব ।
- আমি ওকে পরিচিতি দেব । অনেক লোক চিনবে ।
লোকটা এখনও বসে আছে ফুটপাথে । এরকম ব্যক্তিত্বকে কি আর লোক বলা যাবে ? যদিও আলাদাভাবে এর কোন পরিচয় নেই । এখনও ঘেয়ো মাছি ছিঁড়ে খাচ্ছে পুষ্টিকর খাবার । রক্তাক্ত ঘা থেকে গড়িয়ে পড়ছে জলীয় দ্রবন । লোকটির দূষিত রক্ত থেকে গন্ধ ভেসে আসে যেখানে পরজীবিদের যাতায়াত । বায়ুতাড়িত গন্ধসন্ধানী সেইসব কৃমিকীট জড়ো হয় প্রাকৃত উৎসবে । নর্দমার কাদার মত সে পড়ে থাকে লক্ষহীন । তার জীবনে থাকে আঁকুপাঁকু খিদে । এই ঘা মারাত্মক । সংক্রামক রোগের চেয়েও ভয়ানক । কোন শিল্পই নেভাতে পারেনা এই দাহ । বজ্রপাত হয় তবু বৃষ্টিহীন । ফসলের আকাঙ্খা থেকে বহুদূরে পড়ে থাকে শস্যভুমি । লোকটা উঠে দাঁড়ায় । মুড়ি শেষ হয়ে গেছে কখন । খিদে মরেনি তবু । শালপাতার ঠোঙা ছুঁড়ে দেয় আস্তাকুড়ে । ততক্ষনে কুকুরেরা টানাটানি ও ভাগাভাগি শুরু করে দিয়েছে এঁটো পাতার অংশীদারি নিয়ে । এখানেও ঝগড়া কোলাহল যুদ্ধের প্রস্তুতি । দাঁত ও নখের আয়োজন । কোথায় যাবে সে ? লোকটা দেখে
- বিচ্ছিন্ন নীরব আঁধারে শুয়ে আছে আধপোড়া পৃথিবী ।