রক্তের গন্ধ
অলকেশ একটা সাধারণ লাইব্রেরীয়ান হতে চেয়েছিল । আজকাল পাঠক সংখ্যা কিভাবে যে কমে আসছে । এখন এই অলকেশকিছু কাজ
সেরে নেয় । মিলিয়ে নেয় বইয়ের সংখ্যা । তারপর বইগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে সঠিক না পড়া বইটিকে খুঁজে মুখ গুঁজে দেয় অলকেশ । আজ সে বের করেছে বাংলায় লেখা সেক্সপীয়রের ' ম্যাকবেথ' । এতোবার বইটা পড়েছে যে মুখস্হ হয়ে গেছে । ডাইনিবিদ্যা চর্চা বইটা পড়ে অনেকদিন অভ্যাস করেছে অলকেশ । কিন্তু কারো ওপর কোনোদিন প্রয়োগ করে নি। শশ্মানে গিয়ে শবের উপর বসে তন্ত্র চর্চা করে ও ভেবেছে বিরাট ক্ষমতা আর অর্থের অধিকারী হবে । কিন্তু পরে বুঝেছে এসব ফালতু ।
তবে আজ কেন যে ম্যাকবেথ খুলে বসল কে জানে ! ম্যাকবেথ পড়তে পড়তে অলকেশ আজ যেন অদ্ভুত হয়ে পড়ে । ওর মধ্যে একটা খুনি জেগে ওঠে । হাত ছুরির জন্যে নিশপিশ করতে থাকে । একজন মহিলা পাঠিকা এসে দাঁড়িয়েছে এই সন্ধ্যার মুখে । অনেক না পাওয়া জেগে উঠেছে অলকেশের মধ্যে । নয়নার সেই শ্লেষ, সেই প্রত্যাখ্যান তাকে পাগল করে তুলেছিল সেদিন ।
মেয়েদের প্রতি সেই থেকেই বিদ্বেষ ।
সুন্দরী এই পাঠিকা প্রতিদিন এই সময় এসে
ঐতিহাসিক উপন্যাস চায় ।
কিন্তু অলকেশ আজ এক
অন্য মানুষ । কিন্তু কিছু বোঝার আগেই পেন্সিল কাটা ছুরিটা মহিলার গলার নলিতে চালিয়ে দেয় । দেহটা বইয়ের রাকের আড়ালে চালান করে বই দিয়ে ঢাকা দেয়। বেসিনে সুগন্ধি সাবানে হাত ধুয়ে নেয় । তারপর ঝড়বৃষ্টি মাথায় বাড়িতে ফিরে হাত ধুতে গিয়ে দেখে হাতে রক্তের গন্ধ । বারবার সেন্ট , আতর দিয়েও যাচ্ছে না। অলকেশ পাগল হয়ে যেতো লাগলো । কিছু খেতে পারে না। পরের দিন লাইব্রেরী থেকে একটা পচা গন্ধ ছড়াতে থাকে । দারোয়ান রামলাল উঁকি মেরে দেখে মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে একটা মহিলার দেহ যে কালসন্ধ্যায় বই নিতে এসেছিল ।
পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। অলকেশ আর রামলালকে ইন্টারোগেশনের জন্যে থানায় ডেকে পাঠানো হয়। পেন্সিল
কাটা
ছুরিটা পাওয়া যায় না। লাইব্রেরী
সিল করে চলে গেছে পুলিশ । অলকেশ
বাড়িতে ফিরে আবার হাতের ভেতর রক্তের গন্ধ পায় । হাত ধুয়ে সে ওর পড়ার টেবিলে ফিরে
আসে । চমকে ওঠে সেখানে পড়ে আছে কাল আনা
ম্যাকবেথ বইটা । বইটার ভেতর থেকে একটা
দুর্গন্ধ অলকেশের নাকে এসে লাগে
- ভেতরে সেই রক্তাক্ত ছোরা যার সারা গায়ে রক্ত শুকিয়ে একটা অদ্ভুত রূপ নিয়েছে । রাত বাড়ছে । জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ । অলকেশ দরজা
খোলে ।
সেই নারী , পিছনে পুলিশ । অলকেশ ক্রমশ পিছিয়ে আসতে থাকে সেই পেন্সিল কাটা ছুরি নিয়ে । নিজের শবটা স্পষ্ট দেখতে পায় অলকেশ । তার উপর এক ভৈরবী - বাতাসে অট্টহাসি আর রক্তের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে । অলকেশ কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ।
ইলিশ
সবসময় বর্ষা এলে ইলিশের গন্ধ পাওয়া যেত সুকোমল বাবুরমুখে । সেই
কবেকার ছেড়ে আসা ঢাকা বিক্রমপুরের ধীপুরগ্রাম । নদী পাড়ে দাঁড়ালেই জেলেরা ছুঁড়ে
দিত পাঁচআনার পাঁচটি কিলো সাইজের ইলিশ ।
আর সেই ইলিশের কি তেজ ! কি ঝাঁপ ! ইলিশ মাছের
গন্ধে জিবেতে জল আসে । সেই পূর্ব
বাংলা ছেড়ে পশ্চিমবাংলার খখন্ড নিকটবর্তী বরাকরের বাজারে যা পাওয়া যায় তা চালানি । কুলটি বাণীতলায়ও সেই বরফ ঢাকা মাছ বেশি টাকা দিয়ে নিতে সত্যিই গায়ে লাগে । বিড়ালও আসে না। সর্ষে বাটাও আজ রেডিমেড ।
সুকোমল বাবু ইলিশ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন । লোককে বলেন , দাঁতের
সমস্যা , গ্যাসট্রিক , হার্টের
ট্রাবল । কিন্তু শুভানুধ্যায়ীরা বুঝে যান ধীপুর তাকে ছাড়ছে না। একদিন বাবলার মা নেমতন্ন করে এলেন । বারাসাতের হৃদয়পুরের সুকান্ত পল্লীতে রিটায়ারমেন্টের পরে বাড়ি করেছেন সুকোমলবাবু । বাবলার মার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। কলাপাতায়
সাদা ধবধবে ভাত। ভাজা মুগের ডাল । শুক্তো । আলুভাজা । কচুশাক নারকেল
দিয়ে ইলিশের মাথা । আর বড়ো
বড়ো ইলিশ মাছের পিস্। সর্ষে ভাপা ।
খাবেন কি !
কাঁদছেন সুকোমল বাবু। বাবলার মা পাখার বাতাস
করছেন । জিজ্ঞেস করছেন, শরীর খারাপ লাগছে দাদা, কমিয়ে
দেব!
ধীপুরের গন্ধে সুকোমল বাবু বিভোর । তার আঙুল গুলো ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে ভাতের গর্তে । শুক্তোডালের পর ফিরে যাচ্ছেন তিনি সেই ইলিশেই, আর
গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে সেই খাওয়ায় ।