গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী


মৃগনয়নী ( আগের সংখ্যার শেষ অংশ )


"আসব?" ভারী পর্দার ওপাশ থেকেই জিজ্ঞেস করলো মানসপ্রতিম
"
কে দাদুভাই? এসো ভেতরে"
ঘরে ঢুকে দেখে দাদামশায়ের ঘরটা যেন প্রাচীন কলকাতার কোনো বাড়ির একটা ঘর। ঠিক তেমনি, প্রায় মাটি অবধি লম্বা, শুধু গরাদ দেওয়া, একটা সেট কাঠের একটা সেট কাঁচের পাল্লা ওয়ালা জানলা। লাল মেঝেতে একপাশে দস্তখান পাতা। দাদামশায় একটা বিশাল আরাম কেদারায় আধ শোয়া হয়ে বই পড়ছেন। ঘরের দেয়াল প্রায় দেখাই যায়না এত্ত বই। শ্বেতপাথরের টপওয়ালা টেবিল একপাশে দাঁড়ানো তার ওপর রুপোর জলের গেলাস ঢাকা দিয়ে রাখা, আর একটা রুপোর পাত্রে কিছু সুগন্ধি ফুল। উজ্জ্বল রঙের হ্যান্ডলুমের পর্দা টাঙানো; দাদামশায় পাইপ টানছেন, তামাকের মিষ্টি গন্ধ সারা ঘরে। রিমলেস চশমা সহ মুখে তুলে ওদের এক বার দেখে জিজ্ঞেস করলেন
"
সাথে কে?"
"
আজ্ঞে এ সুনয়নী; মঞ্জিরার বন্ধু"
"
বন্ধু দিদিভাইয়ের, অথচ তার অবর্তমানে তোমার অতিথি" কথাটার মানে বুঝলো দুজনেই
"
জলখাবার খাওয়া হয়েছে?" বই এর পাতার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন
"
আজ্ঞে"
"
তারমানে সকাল সকাল বেড়িয়ে আসা হয়েছে"
"
জি" এবারে উত্তর দিল সুনয়নীই
"
বাড়িতে জানিয়ে আসা হয়েছে কি, কোথায় কার কাছে আসা হচ্ছে?"
"
জি কোথায় আসছি জানিয়ে এসেছি"
"
কার কাছে টা জানানো হয়নি; অর্থাৎ মিথ্যা বলে এসেছ?"
"
জি না তো মিথ্যা তো বলিনি; সত্যটা গোপন করেছি মাত্র"
এমন দৃঢ়তার সঙ্গে বলল কথাটা; দাদামশায় চোখ তুলে তাকাতে বাধ্য হলেন।
"
পুরো নাম?"
"
জি, সুনয়নী শামিমা চৌধুরী" বলে প্রনাম করলো
"
শামিমা___"
"
জি, আমার দাদির নাম"
"
কি করা হয়?"
"
জি একটা স্কুলে পড়াই"
"
সার্থক নাম্নী; বেশ তাহলে দুপুরে খাবার টেবিলে দেখা হবে"
"
জি"

দুপুরে খাবার আয়োজনও দারুন; সুনয়নী যেই লক্ষ্য করলো ছেলেরা বসেছে মেয়েরা পরিবেশন করছে, সে ও আপত্তি জানালো বসতে। কিন্তু দাদামশায়ের নির্দেশে মানসপ্রতিমের পাশের চেয়ারেই বসতে বাধ্য হলো। একটু পরেই বুঝলো বাড়ি শুদ্ধু সকলেই দেখছে তাদের কেউ কেউ মুগ্ধও হচ্ছে যুগল মূর্তি দেখে; অস্বস্তিতে পড়েছিল একটু। খেয়ে উঠে আবার ষ্টুডিওতে, এই কয়েক ঘন্টায় মানসপ্রতিম যেন আরো ঘনিষ্ঠ বোধ করছে; গা ঘেঁষে বসেছে সুনয়নীর, একটা হাত নিজের দুই হাতে ধরা।
"
তোমায় যে আর যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না; কি করলে বলোতো?"
"
তাহলে তো ভারী মুস্কিল, না আসাই উচিত ছিল" ঠোঁট চিপে হাসে সু
"
না -আ" কেমন আর্তনাদের মত শোনালো
"
তুমি রোজ যদি আসতে পারতে, বেশ হতো"
"
আসবতো, তুমি চোখ বুজলেই আমি আসব। যেমন করে তুমি রোজ ওই ঘোড়াটায় চড়ে আমার কাছে যাও।"
"
তুমি শুনলে হয়ত অবাক হবে, কাল এগ্জিবিশন থেকে ফিরে প্রথম কিছু সময় খুব অস্থির লাগছিল পরে ওই চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে যায় ঠিক ওই রকম একটা স্বপ্নে; আমি যেন ঘোড়ায় চড়ে আমার স্বপ্নের রাজকন্যার সামনে উপস্থিত। এমন একটা অনুভূতি হচ্ছিল যেন আমার গত জন্মের কথা"
"
তোমার কি দুপুরে ঘুমের অভ্যেস?"
"
যদি হয় তাহলে? তুমি আমায় ঘুম পাড়াবে?" গভীর দৃষ্টিতে আরো একটু কাছে টানে সু কে
"
না তো, আমি তাহলে চলে যাব। সামনে থাকব আর তুমি ঘুমিয়ে কাটাবে সেটাও হবেনা আবার আমার উপস্থিতিতে তোমার ঘুম বিশ্রাম হবেনা সেটাও আমার খারাপ লাগবে"
"
নাঃ সেই অভ্যেস নেই, আর তাছাড়া___"
"
কি, তাছাড়া?"
"
তুমি সামনে থাকলে এমনিই ঘুম উড়ে যায়" হাসছে মানসপ্রতিম দুষ্টুমি আওয়াজে, চোখে। কপট রাগ দেখালো সুনয়নী চোখ পাকিয়ে। সারাটাদিন যেন কোথা দিয়ে কেটে গেল; বিকেল হয়েছে এবারে সুনয়নীর ফিরতে হয়
"
আমার ঘরটায় একবার যাবেনা?" ওমনি উঠে দাঁড়ালো সুনয়নী
"
হুঁ, চলো" ষ্টুডিও থেকে বের হয়ে ডান হাতে কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেড়তলায় মানসপ্রতিমের ঘর। ঘরের জানলা গুলো বন্ধ কিন্তু ঘরে একটা স্বপ্নীল আলো আর মিষ্টি ফুলের গন্ধ; আসবাবে বনেদিয়ানার ছাপ, কাঠের একটা দারুন সুন্দর লম্বা টানা ড্রয়ার নজর কাড়ে।
"
খুব সুন্দর"
"
তুমি থাকবে আমার সাথে এই ঘরে?" আচমকা কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নে লাজুক ভালোলাগায় মিষ্টি হাসিতে মাথা নীচু সু এর
"
তুমি জানো? এই ঘরের মানুষটা আজ কত যুগ পর যেন আবার থাকতে চাইছে এই ঘরে?" অবাক দৃষ্টি সুনয়নীর
"
হ্যাঁ, এত খারাপ স্মৃতি ছিল এই ঘরে যে একা থাকলেও সে সব আমায় তাড়া করে ফিরত; পারতামনা থাকতে। মনেহত ষ্টুডিওতেই আমি কম্ফর্ট ফীল করি, ওটাই আমার জায়গা।"
"
তুমি আবার ভুল করছ নাতো?"
"
কিসে?"
"
না, এই এত দ্রুত আমায় প্রস্তাব দিচ্ছ? দেখো দুটো মানুষ যতক্ষণ না এক ছাদের নীচে চব্বিশ ঘন্টা কাটাচ্ছে, ততক্ষণ কিন্তু পরস্পরের ভালো না লাগার দিকগুলো চোখে পড়েনা"
"
কথাটা একদম ঠিক, কিন্তু সু তোমায় প্রথম বার দেখার পর থেকেই আমি ফীল করছি তুমিই সেই। সেদিন কিন্তু কোনো কথা আমাদের হয়নি বলো? আমার ষ্টুডিওতে কাটাবে বলে গোটা একটা দিন থাকলে; আমার রঙ তুলিকে ছুঁয়েছ, ওদের দেখলে তোমারও ভালো লাগছে। হ্যাঁ, আমি জানি যে স্কুল করে এসে হয়ত তোমার এমন এনার্জি থাকবেনা যে তুমি রোজ বা প্রতিটা উইকেন্ড আমার ষ্টুডিওতে কাটাবে। কিন্তু এটাও ঠিক তুমি আমায় অ্যাটলিস্ট বুঝবে তো, আমি মধ্য রাত্রে ষ্টুডিও চলে গেলে বা রাতভর ওইখানে থাকলে তোমার অভিযোগ হবেনা। মঞ্জি না থাকাকালীন তুমি আমার এগ্জিবিশন গেলে, সেখানে প্রতিটা ছবি মন দিয়ে দেখেছ; আমি না বলতেই আমার মনের কথা বুঝে তুমি শেষ অবধি অপেক্ষা করেছ। তুমি আমার ছবি, আমার সবচাইতে ভালোলাগার ভালবাসার জনকে ভালোবেসেছ; এর চেয়ে বড় আর কি চাইতে পারি আমি? আর আমি যতটা তোমায় গ্রহণ করেছি তুমিও মনেমনে ততটাই কি তারও বেশি, বলো ঠিক না? কাল গাড়িতে তুমি যে বললে তুমি আমায় কফি অফার করতে নির্দ্বিধায়; তার মানে কি হয় সু? তোমায় দেখার পর থেকেই আমার ছবি আঁকার উৎসাহ বা আইডিয়া কত বেড়ে গেছে। আরোও প্রমান চাই আমি ভুল করছিনা?"
মাথা নেড়ে না জানালো সুনয়নী; বিছানায় বসে কথা বলছিল মানসপ্রতিম আর এত সময় সুনয়নী দাঁড়িয়ে ছিল ওই লম্বা টানা ড্রয়ারটায় হেলান দিয়ে। হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসালো প্রতিম; আর অবশ্যই ছেড়ে দিলনা হাত।
"
আমি জানি দাদামশায় ঠিক বুঝেছেন, বাড়ির লোকেরাও হয়ত বুঝেছেন, আমি আজকেই কথা বলব দাদামশায়ের সঙ্গে। কি, কিছু বলবেনা? শুধু হাসবে?"
"
আজ তাহলে ___"
"
আর দু'মিনিট থাকো, খুব ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে যে"
"
দু'মিনিট থাকলেই বুঝি সব আশ মিটে যাবে?" জেনে শুনেই ঠোঁট ফোলায় সুনয়নী
"
একেবারেই নয়, খুব ভালই জানো; আসলে অন্য একটা ইচ্ছে____"
"
কি?"
"
তোমার কপালে একটা টিপ আঁকতে খুব ইচ্ছে করছে"
"
সেটা বরং সেই বিশেষ দিন বা বলা ভালো সেই বিশেষ রাতটার জন্য থাক" হাত দুটো নিজের বুকে চেপে ধরল মানসপ্রতিম।

এর পরের ঘটনা প্রত্যাশিত; দাদামশায় নিজেই সেই রাত্রে সকলকে বললেন
"
আজ একটি মেয়ে দাদুভাইয়ের অতিথি হিসাবে এসেছিল; মেয়েটির নাম সুনয়নী শামিমা চৌধুরী। তোমরা সকলেই তাকে দেখেছ এবং আশাকরি ওদের পরস্পরের প্রতি মনোভাব বুঝতে পেরেছ। আমি চাই দাদুভাইয়ের সাথে মেয়েটির বিয়ে হোক।" বলতেই কাকা, কাকিমা তো বটেই বাবারও মুখের অভিব্যক্তিতে খুব একটা সুখের প্রকাশ পেলনা। কাকিমা মুখ খোলেন "দেখুন বাবা, আপনি আপনার নাতির প্রতি যে দুর্বল সেটা আমাদের কারোরই জানতে বাকি নেই; কিন্তু বাবা আপনি এই ভাবে অন্য জাতের একটি মেয়েকে আপনার পরিবারের বউ করে আনলে বাড়ির বাকি ছেলে মেয়েদের সামলানো যাবে?"
"
ছোট বৌমা, রানী মৃগনয়নীও কিন্তু রাজপূত ছিলেন না; তিনি ছিলেন গুর্জর। আমাদের চোখে এস.সি,এস.টি, অথচ উনি কিন্তু রাজা মানের সাথে যুদ্ধেও গিয়েছিলেন।"
"
এখানে তাঁর প্রসঙ্গ আসছে কি করে?"
"
জানিনা, হয়ত এমন সার্থক নাম্নী মেয়ে বলেই; ওর নামের দুটো ভাগই ওর সাথে মেলে শামিমা অর্থ সুগন্ধ আর সুনয়নী তো ও বটেই। আগের বার তো, তোমার বুদ্ধি অনুযায়ী স্বজাতের মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছিল কি লাভ হলো? দাদুভাইয়ের মত শান্ত, নির্ব্বিবাদী, আপন ভোলা মানুষের সাথেও সে টিকতে পারলনা।  এই মেয়েটি বনেদী পরিবারের মেয়ে অথচ আয়েশী নয়; যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্না, স্বচ্ছন্দ, স্বাব্যস্ত। শিক্ষকতা করে মানে উপযুক্ত শিক্ষিতা। দাদুভাইয়ের টানে সে এ বাড়ি এসে একটা গোটা দিন কাটিয়ে গেল, কাজেই দাদুভাইয়ের শুন্যস্থান পূরণ করতে পারবে এই আশা আমার আছে। আগের বারেও অবশ্য সেই মেয়েটি আসত কিন্তু তখন দাদুভাই কে এত উজ্জ্বল আমি দেখিনি। আমি থাকতে থাকতে দাদুভাইকে বিবাহিত এবং খুশি দেখতে চাই। আর হ্যাঁ, এবারে যত শীঘ্র সম্ভব ছোট করে অনুষ্ঠান করে বিয়েটা সেরে ফেলার বন্দোবস্ত করা হোক; কারণ, রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের সামনে কাঁচা মাংস রেখে তাকে সংযম করতে বলাটা নিতান্তই বালখিল্য আচরণ হবে। আর বাড়ির বাকি ছেলে মেয়েদের প্রশ্নে আমি বলব জাত, ধর্ম আমার কাছে কোনো ব্যাপার নয় এটা তোমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, পরস্পরের উপযুক্ত কিনা সেটাই আমার কাছে যথেষ্ট। তারা নিজেরা যদি নিজেদের জীবন সঙ্গী খুঁজে নেয় তাতে আমার কোনো আপত্তি থাকবেনা, তবে বিয়েটা আমি দিতে চাইব এটুকু বলতে পারি।"

নিজেদের মধ্যে গজ গজ করা ছাড়া আর যে কিছুই করতে পারবেনা সেটা অবশ্য সম্যক জানত বাবা, কাকা, কাকি। মা বেজায় খুশি সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জিকে ফোন করে জানালো আর কাকার মেয়ে সায়ন্তনী যদিও ছোটই অনেকটা তবুও বাড়িতে বিয়ে শুনলে কে না খুশি হয়; সুনয়নীর পরিবারের লোকজনও মেনে নিল। ইতোমধ্যে ভরে উঠলো সুনয়নীর নিজের ক্যানভাস।
মূলতঃ রেজিস্ট্রি করেই ওদের বিয়ে হলো তবু সুনয়নীদের তরফে ধুমধাম কিছু কম হলনা। অসম্ভব সুন্দর পোশাকে সেজেছে শামিমা; তাকে কোনো মুঘল রাজপরিবারের মেয়ে বা বউ মনে হচ্ছে, চোখ ফেরানো দায়। অবশ্য মানসপ্রতিমের খুব একটা ইচ্ছেও আছে তা নয়। বাসর ঘরের রীতিরিওয়াজ বেশি ঘটা করে না মানায় স্বস্তি পেল উভয়েই। সবাই চলে যাবার পরেও নির্বাক বসে দুজনে; প্রতিম মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আর সেই দৃষ্টির সামনে ভালোলাগার লজ্জায় ডুবে যাচ্ছে শামিমা সুনয়নী। আস্তে আস্তে কাছে টেনে গাঢ় স্বরে বলল
"
এত সুন্দর সেজেছ টিপ পড়নি সু?"
"
সেটা বুঝি ভুলে যাওয়া হলো? কি কথা ছিল? তোমার ক্যানভাসে অন্য কাউকে আঁকতে দেব নাকি?" মিষ্টি করে হাসে সু। শক্ত বন্ধনে ধরল পরস্পরকে, কপালে চুমো দিল মানসপ্রতিম
"
আমার ক্যানভাস" ধীরে ধীরে সরাতে থাকে সুনয়নীর চুলের, মাথার, কানের সব গয়না; আর চুমো দিতে থাকে সবখানে
"
যাবে ষ্টুডিওতে?" মাথা নেড়ে সায় দিল শামিমা; চুপিসাড়ে গেল দুজনে। 

বাড়িতে বেশ লোকজন, বিয়েবাড়ি বলে কথা; কেউ জেগে থাকলে তাদের এই অসাধারণ আনন্দের মুহুর্তকে দেখে ফেললে সব মাটি। তারা টের পেতে দিতে চায়না কাউকে, এ যেন তাদের গোপন অভিসার। ষ্টুডিওতে গিয়ে দ্রুত হাতে এক ভাগ ব্রাউন আর তিন ভাগ সাদা মিশিয়ে চন্দন রঙ তৈরী করলো মানসপ্রতিম, একটা তিনপাতার আকারের পাত্রে। আর দুটো পাতায় লাল আর সাদা রঙ নিল। তর সইছেনা বলে খপখপ যে যে নম্বরের তুলি হাতে এলো মুঠি করে নিয়ে বেডের কাছে, যেখানে সুনয়নী তার অপেক্ষায়, সেখানে গেল। নিজের বলিষ্ঠ হাতের ওপর প্রায় শুইয়ে নিয়ে টিপ আঁকতে লাগলো ওর কপালে। তুলির ছোঁয়া, প্রানের মানুষটার দৃঢ় বন্ধন, গাঢ় শ্বাস শিহরিত করছে সুনয়নীকে; বুঝতে পেরে গালে, কানের লতিতে, ঠোঁটে, গলায়, ঘাড়ে, চিবুকে, কাঁধে ইচ্ছে মত কখনো রঙ না লাগানো অন্য তুলির টান কখনো ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগলো মানসপ্রতিম। সুখানুভুতিতে কাঁপছে শামিমা; অবধারিত আত্মসমর্পণ। কুমারী থেকে শ্রীমতি হলো সুনয়নী শামিমা।


পর পর বিভিন্ন জায়গা থেকে আমন্ত্রণ আসছে ছবি প্রদর্শনীতে যোগ দেবার; যোগ দিতে না পারলেও অন্ততঃ কিছু ছবি যদি পাঠানো যায় এমন অনুরোধও আসছে। সবখানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করাও সম্ভব নয়; শহর বা তার আসেপাশের গুলোতে যেতে থাকলো আর বাইরের থেকে পাওয়া নিমন্ত্রণের মধ্যে গোয়ালিয়র আর দিল্লীর এই দুটোই শুধু গ্রহণ করলো। এই দুটোখানেই সস্ত্রীক যাবে জানিয়ে দিল।
গোয়ালিয়র ফোর্ট থেকে সামান্য দূরে দারুন সুন্দর হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ওদের। হোটেলটাও বেশ রাজকীয় ছাঁদে তৈরী। এগ্জিবিশন ফোর্টের কাছেই হচ্ছে; কাজেই রথ দেখা কলা বেচা সকলেই সারছেন। এত কাছে এসে ফোর্ট দেখবেনা তাই কি হয়? বিভিন্ন দ্রষ্টব্য ফোর্টের, গাইড ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে সবাইকে মান মন্দির, হাথিয়া পৌর, তেলি কা মন্দির, করণ মহল, ভিক্রম মহল, গরুড়া মন্যুমেন্ট, ভীম সিং রাণা কি ছত্রী আরও কত কি। ইচ্ছে করেই ওরা রানী মৃগনয়নীর প্রাসাদ গুর্জরী মহলে দলছুট হয়ে গেল। গুর্জরী মহল এখন অর্কিয়লোজিকাল মিউজিয়াম। পঞ্চদশ শতকে রাজা মান সিং তোমর, অসামান্য রূপসী ও সাহসী গুর্জর রাজকন্যা মৃগনয়নীর প্রেমে পড়েন এবং তার হৃদয় জয় করতে সক্ষম হন; গুর্জররা রাজপুতদের স্বজাতীয় নন। রানী মৃগনয়নীর ইচ্ছায় আলাদা মহল তৈরী করে দেন রাজা মান, যেখানে স্থানীয় রাই নদীর জল সবসময় পৌঁছে যেত। মৃগনয়নী যে শুধু মাত্র রূপসী ছিলেন তাই ই না বুদ্ধিমতি সাহসী ও ছিলেন, রাজা মানের অন্যান্য রানীদের মত পর্দানশীন ছিলেননা; রীতিমত যুদ্ধেও গেছিলেন রাজার সাথে।
গুর্জর মহলের বিশাল চত্তরে কত সময় হাত ধরে ঘুরল দুজনে, মহলের কারুকাজ দেখল আর যতটা পারে ক্যামেরা বন্দী করলো।
"
ইস্স এক্ষুনি আঁকতে পারলে কি ভালই হত; সবকিছু নিয়ে আসা উচিত ছিল। ভাবিনিতো এত ভালো লাগবে।"
"
সেই জন্যই তো এত ফটো তুলছি, যাতে কোনো একটা দিক একটুও বাদ না পড়ে; কি করবে বল ঘরে ফেরা অবধি অপেক্ষা তো করতেই হবে" সুনয়নী স্বান্তনা দেয়; কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি মানসপ্রতিমের।
বিকেলে প্রদর্শনীতে "দৃষ্টি" থিমেরই কয়েকটা ছবি নিয়ে যোগ দিয়েছিল মানসপ্রতিম। ছবি গুলো প্রশংসাতো পেলই স্থানীয়দের কথায় বোঝা গেল সবাই ধরেই নিয়েছে রানী মৃগনয়নীকেই আঁকতে চেয়েছে সে। আয়োজকরা তার ছবি গুলো রেখে দিল বিক্রি করে তাকে চেক পাঠিয়ে দেবে। কারণ তখনি অনেকেই ছবির দাম জিজ্ঞেস করছিল। রাত্রে সব সেরে হোটেলে ফেরার পথে ঝমঝম বৃষ্টি। দুজনেরই ভেজার ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু যেহেতু দিল্লীর কাজ বাকি তাই সংযত রাখল নিজেদের। সারারাত বৃষ্টির পর সকালের সোনালী রোদ ভরে দিল ওদের ঘর। নিয়মিত অভ্যাস অনুযায়ী সুনয়নী কিন্তু সময় মতই উঠে গোসল করে প্রার্থনা সেরে নিয়েছে; বৃষ্টিস্নাত সকালের মতই পবিত্র, উজ্জ্বল দেখাচ্ছে তাকে। বিছানায় ঘুমন্ত প্রতিমকে আস্তে আস্তে ডাকলো
"
ওঠো, দেখো কিসুন্দর সকালটা। আজ না আমাদের দিল্লী যাওয়া? তৈরী হতে হবে তো?"
"
তোমার সব হয়ে গেছে? এত মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ কিসের?" ঘুমজড়ানো গলায়, হাতটা টেনে নিজের মাথার নীচে ভরে আবার চোখ বন্ধ।
"
বোঝো, আমার হাতটা আটকে রাখলে চলে? অ্যাই ওঠো কিন্তু" বলে নিজের হাত ছাড়ানোর বিফল প্রয়াস
"
ইস্স, এত সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম"
"
কি দেখছিলে? রানী মৃগনয়নী? স্বাভাবিক সুন্দরীদের গল্প শুনলে স্বপ্নেও যে তাদেরকেই দেখবে। তবে জানতো আমিও দেখেছি"
"
রাজা মানকে নিশ্চয়ই"
"
হ্যাঁ, একদম; রাজপুত রাজারা কত সুন্দর হত বলো?"
"
সেই সেই" বলে বুকের ওপর নিয়ে নিল সুনয়নীকে; হাসছে দুজনেই
"
শুধু একটাই মুস্কিল, রাজার মুখটা বড্ড চেনা, আর হাতে তরোয়াল না তুলি সেটাই বুঝতে পারলামনা"
"
হুমম তাই বুঝি?"
"
না গো, সিরিয়াসলি আমি না, স্বপ্ন দেখলাম তোমার কিছু একটা অসুবিধে হয়েছে, আর আমি যেন রানী মৃগনয়নীর মতই তোমার সাথে সাথ দিয়ে লড়াই করছি। কি যে সব ভুল ভাল স্বপ্ন; এবার বলো তুমি কি দেখলে?"
"
আমি যেটা দেখেছি সেটা মুখে বলার নয় কাজে করে দেখানোর" বলে দুষ্টুমির হাসি হাসতে হাসতে চট করে বিছানায় নিজের হাতের ওপর শুইয়ে ফেলল সুনয়নীকে নিজে ঝুঁকে পড়ল ওর ওপর।
"
আমার মৃগনয়নী" এমন অদ্বুত করে ডাকলো, আর ঠোঁট ছুঁয়ে গেল চোখের পাতা; আনন্দে ভেসে সু ভুলেই গেল কখন ওদের বেরোনো আর কখন দিল্লী যাওয়া।

সাত সাড়েসাত ঘন্টা মত লাগে বাসে গোয়ালিয়র থেকে দিল্লী; সকাল সকাল বেরোতে পারলে ভালো, কিন্তু দেরিই করে ফেলল ওরা। দিল্লীর অর্গানাইজারদের সাথে পরামর্শ করে এটাই ঠিক করলো যে সন্ধ্যের বাস ধরবে, তাহলে সারারাত ট্রাভেল করে সক্কাল সক্কাল পৌঁছে যাবে। তারপর সারাটাদিন বিশ্রাম করুক অথবা রাজধানী ঘুরুক, এগ্জিবিশন তো বিকেলে। আর তাহলে আরও কিছু ঘন্টা গোয়ালিয়র ভ্রমনও হয়ে যাবে। সেই অনুযায়ী নিজেদের জিনিষপত্র নিয়ে হোটেল থেকে চেকআউট করে আগে বাসের টিকিট কাটল; তারপর বাকি দিনটুকু ঘুরল আবার গুর্জরমহল এবং গতদিনের ফোর্টের না দেখা অংশে। খাওয়া দাওয়া সেরে, রাস্তার জন্য কিছু শুকনো খাবার সংগ্রহ করে রওনা দিল দিল্লী অভিমুখে। জানলার ধারে বসলো মানসপ্রতিম কারণ একটু পরেই অন্ধকার নামবে, দেখার বা ফটো তোলার কিছু নেই। তাছাড়া এমনিও এসি বাসের জানলা দিয়ে ফটো তুলতেও পারবেনা আর সুনয়নী যেমন ঘুম কাতুরে একটু পরেই ঘুম দেবে বাস চললে; কাজেই তার জানলার ধরে বসার তো কিছু নেই। তেমন ভীড়ও নেই বাসে দুজনে সবার চোখের সামনে কিন্তু আবার উঁচু সিটের আড়ালে কাজেই খানিক খুনসুটির পর ঘনিষ্ঠতা বেশ উপভোগ করতে করতে যাচ্ছিল। কত অচেনা অজানা জায়গার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে বাস। বাইরে অন্ধকার নেমেছে, বাসের ভেতরেও সবাইই প্রায় ঘুমের তোড়জোড় করছে; সুনয়নী অবশ্য মানসপ্রতিমের বক্ষলগ্না হয়ে আদর খেতে খেতে দিয়েছে ঘুম। হঠাৎই একটা বিকট ঝাঁকুনি সাথে প্রচন্ড শব্দে সব তালগোল পাকিয়ে গেল সবার।
জ্ঞান ফিরতে সুনয়নী বুঝলো স্থানীয় কোনো হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে সে, হাত পা কেটে গেছে সেলাইও পড়েছে কয়েকটা কিন্তু এছাড়া আর কোনো বড় ধরনের চোট নেই; নিজেকে নিয়ে ভাবার আগেই মনেহলো মানসপ্রতিমের কথা, সে কোথায়, কেমন আছে? ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করে জানলো একটা এসইউভি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের বাসে সজোরে ধাক্কা মারে; দুটোরই গতিবেগ বেশি থাকায় ক্ষয়ক্ষতি ভালই হয়েছে। গাড়ির আরোহীরা কেউ বেঁচে নেই, বাসের কেউ মারা না গেলেও আশঙ্কাজনক অবস্থা অনেকেরই; বিশেষ করে জানলার ধারে যাঁরা বসেছিলেন। নিজের কষ্টের অনুভূতি ভুলে মানসপ্রতিমকে খুঁজতে দৌড়ল সুনয়নী। তাকে খুঁজে বের করা ছাড়াও আরও কত দায়িত্ব। পুলিশের কাছে নিজের ব্যাগ মোবাইল সনাক্ত করতে হবে যদি পাওয়া যায় আদৌ; নাহলে পুলিশের সাহায্য নিয়ে বাড়িতে এবং দিল্লীর অর্গানাইজারদের খবর করতে হবে। সম্ভব হলে মানসপ্রতিমকে অন্যত্র আরো ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে এমন কোথাও নিয়ে যেতে হবে, এই ঢোলপুরে আর কত ভালো চিকিৎসা পাবে? কাজেই নিজের দিকে তাকানোর সময় কই? আহতদের দেখতে গিয়ে খুঁজে পেল মানসপ্রতিমকে, যদিও তার শরীরের বেশিরভাগ অংশই ব্যান্ডেজে ঢাকা। ডানহাত ডানপা ভেঙ্গেছে, মাথায়ও চোট আছে বুকের পাঁজরও ভেঙ্গেছে তবু একটাই যে প্রাণে বেঁচে গেছে। দৌড়দৌড়ি করে পুলিশের সাহায্য নিয়ে বাড়িতে এবং দিল্লীতে খবর জানালো; অর্গানাইজারদের কল্যানে তক্ষুনি আগ্রা নিয়ে যাবার ব্যবস্থা হলো, সে ও বেশ কয়েক ঘন্টার রাস্তা ঠিকই তবু যদি বেটার ট্রিটমেন্ট পায়। হয়ত কিছু অপারেশনও করতে হবে, সেই সবও একটা বড় জায়গায় অনেকটা ভালো এই আশা।
ছবির এগ্জিবিশন সেরে যেদিন ফেরার কথা তার চেয়েও আরও দু'তিনদিন পর অর্ধম্মৃত মানসপ্রতিমকে নিয়ে অসুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরল সুনয়নী। বাড়িতে তখন তুমুল গন্ডগোল। সুনয়নীরা গোয়ালিয়র যাবার পর পরই মঞ্জিরা তার এক সহকর্মীকে বিয়ে করে এসে দাঁড়ায় দাদামশায়ের সামনে। ছেলেটি যে তার অনুপযুক্ত তা নয়; কিন্তু স্বাধীনতার অপব্যবহার সহ্য হয়নি দাদামশায়ের। সে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায় এটা জানলে তিনি খুশি মনে আশীষ সহ বিয়ে দিতেন ওদের। ধাক্কা এমনিই লেগেছিল সাথে কাকিমার বাক্যবান আরওই জর্জরিত করেছে। তারওপর প্রিয় নাতির এমন খবরে শয্যা নিয়েছেন তিনি। এদিকে উঠতি শিল্পীর এমন খবরে তার বাড়িতে সংবাদ মাধ্যমের লোকজন ভীড় করেছে, জ্বালিয়ে মারছে ঘরের মানুষদের কে। সুনয়নী ঝড়ের মুখে এসে পড়ল; সুযোগ বুঝে একজোট হয়েছে বাবা, কাকা, কাকি, তারা সুনয়নীকেই সব কিছুর জন্য দায়ী করছে। তাদের তো প্রথম থেকেই আপত্তি ছিল এই বিয়েতে এখন ঝোপ বুঝে কোপ একঘরে করে দিল ওদের; বাবার মতে, কোনো সাহায্য পাবেনা ওরা এই সংসার থেকে, নেহাত মানবিকতার খাতিরে তাড়িয়ে দিচ্ছেনা ওদের। মুরদ থাকেতো নিজের স্বামীর চিকিৎসা নিজেই করাক, তাকে রেঁধে বেড়ে খাওয়াক, আর না থাকে তো দায় স্বীকার করে সরে যাক তার ছেলের জীবন থেকে। মা তখন কার দিকে তাকায় ছেলে না শ্বশুড়? সুনয়নী নিজেও তো সবল নয় সে মানসপ্রতিমের সুশ্রুষা করবেকি আর স্কুলের ছুটি না হয় আরো কত দিন বাড়িয়ে নিল কিন্তু তারপর?? নাঃ নিজের শেষ নিঃশ্বাস অবধি লড়বে সে মানসপ্রতিমের জীবন থেকে সরে যাবার কোনো প্রশ্নই নেই; শুধু সময়ের অপেক্ষা আর এখন বুদ্ধি করে চলতে হবে। নিজের মায়ের কাছে সব বলায় নিঃশব্দে একটা সাহায্য পেল শামিমা। যে বুয়া তাকে ছোটবেলায় দেখভাল করতেন পরদিন হাজির মানসপ্রতিমদের বাড়ি। বুয়ার বয়স হলেও এখনো শক্তপোক্ত যথেষ্ট। আশ্বাস দিলেন সব কিছুই সামলে দেবেন তিনি। ষ্টুডিওর কুকিং স্টেশনেই রান্না করবেন; সুনয়নীর স্কুলে যেদিন জয়েন করতে হয় সে করতে পারে। সুনয়নী কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত কিন্তু বুয়া সে সব পাত্তা দেন না
"
অত আপ্লুত হয়ে কাজ নাই; আমার টাকার দরকার তোমাদের বিশ্বাসী কাজের মানুষ ব্যাস" সুনয়নী জানে এই গুলো বুয়ার মুখের কথা মাত্র, আবেগকে উনি প্রশ্রয় দিতে নারাজ; কিন্তু জান লড়িয়ে দেবেন। বুয়া আসায় অনেকদিকের স্বস্তি হলো শামিমার; বাজার, রান্না, কাপড়জামা ধোয়া কাচা, বাসন ধোয়া আর দিনভর মানসপ্রতিমের সেবা কোনটা নিয়েই ভাবতে হচ্ছেনা তাকে। নিজেকে সুস্থ করছে, নাহলে মানসপ্রতিমকে দেখবে কি করে? স্কুলে যায় আর তারপর এসে পুরোটা সময় প্রতিমকে দেয়। গল্প করে করে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়; খেতেও কষ্ট হয় মানসের, ঘুমও সহসা আসেনা, শুতেও পারেনা ঠিক করে। ওদিকে দাদামশায় জীবন্মৃত হয়ে পরে রইলেন, কখনো সেন্স থাকে কখনো না। বুয়া রাত্রে ষ্টুডিওতেই থাকেন। সারারাত সজাগ থাকে শামিমা; মানস অবাক হয় অত ঘুম কাতুরে মেয়েটা রাত্রে মানসপ্রতিম একটু নড়লেও বুঝে যায়। মনেমনে যদি ডাকে তা ও যেন শুনে ফেলে সু। রোজ মাহেন্দ্রক্ষণে গোসল করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে প্রার্থনা করে সুনয়নী, দৃশ্যটা মানসপ্রতিমের বড় প্রিয়। রোজ দেখে আর ভাবে একদিন সুস্থ হয়ে ঠিক এঁকে রাখবে এমন পবিত্র নির্ভরতার দৃশ্য; মনে মনে সে ও ওপরওয়ালাকে বলে এই মেয়েটার মনের কামনা পূর্ণ কোরো। আর সুনয়নী শক্তি চায় ওপরওয়ালার কাছে, সে যেন তাঁর দেওয়া এই সব ঝড় হাসি মুখে পেরোতে পারে তার জন্য শক্তিতো ওপরওয়ালারই দিতে হবে। ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে মানসপ্রতিম, কিন্তু যে কয়বার ডাক্তারের কাছে নিতে হয়েছে সেটা খুবই যন্ত্রণার সব দিক দিয়েই। অত বড়সড় চেহারার মানুষটাকে তার ঘর থেকে ওই দুচারটে সিঁড়ি ভেঙ্গে নামানোটাই তো একটা বিশাল পর্ব। সুনয়নী বুঝলো এর চেয়ে ষ্টুডিওতে থাকতে পারলে বেটার। মাথার চোট তেমন ছিলনা, রিব ইনজুরির জন্য অপারেশন হয়েছে, বাকিটুকু সময়ের ব্যাপার নিজে নিজেই ঠিক হবে। তবে ওই জন্যই খেতে ঘুমোতে কষ্ট। সাথে হাতে পায়ে প্লাস্টার। ষ্টুডিওতে থাকতে পারলে হয়ত মানসপ্রতিমেরও মন ভালো লাগবে, হয়ত আরেকটু দ্রুত সুস্থ হবে। কিন্তু ষ্টুডিওতে তো বাথরুম নেই; বাড়িতে অনুমতি চাইল যে ষ্টুডিওর একটা অংশকে বাথরুমে পরিনত করতে পারে কিনা। শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি পেল; শর্ত হলো ওরা তাহলে শুধু ষ্টুডিও তেই থাকতে পারবে, মানসপ্রতিমের ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে।
বেশ, মেনে নিল সুনয়নী; বুয়াই খুঁজে পেতে মিস্তিরি নিয়ে এলেন যারা ষ্টুডিওটাকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে দিল। ইজেল গুলো একপাশে ঢাকা দিয়ে রাখল, আর এঘরে এলো সেই লম্বা ড্রয়ারটা। কাপড়জামা রাখতে হবে,বাসন পত্রও আর রং তুলিও ভরে রাখল ওতেই। বুয়াকে রাত্রে ছেড়ে দিতে হবে এখন, কিন্তু বুয়া বাড়ি যাবেন কি করে অত রাত্রে? সুনয়নী কোনো এক কালে ড্রাইভিং শিখেছিল বটে, কিন্তু লাইসেন্স কোথায় আর এত দিনের অনভ্যাস। তত্পরতার সঙ্গে আবার লাইসেন্স বের করলো অ্যাক্সিডেন্টে সব হারিয়ে গেছে বলে; রোজ মানসপ্রতিমকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে, কাঁপা কাঁপা হাতে প্রতিমের গাড়িটাই নিয়ে পৌঁছতে লাগলো বুয়াকে। গাড়িতে উঠলেই যেন কান্না ঠেলে আসে, কেবল মনেহয় প্রতিম চালাচ্ছে আর সে পাশে বসে। তবে আবার গাড়ি চালাতে পারলে মানসপ্রতিমকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া টা সহজ হয় আরেকটু।

আজকাল আর কথাও বলেনা মানসপ্রতিম, প্রথম কষ্ট হত বলতে এখন মনের দুঃখে বলেনা। বুঝতেতো পেরেছে সবই তার নিজের বাড়ির মানুষদের আচরণে নিজেই লজ্জিত; কিন্তু সে শান্তিপ্রিয়, নির্ব্বিবাদী মানুষ, কাজেই প্রতিবাদ ও তার আসেনা,দাদামশায় অনেকটা আড়াল করতেন। কৃতজ্ঞ সুনয়নীর প্রতি, সে কি করছে সেটাও নজর এড়াচ্ছেনা। এই ভাবে লড়াই করে সুস্থ করে তুলছে তাকে, নিজের শরীর ঠিক হবার আগের থেকেই। একটা একটা করে টিভি, ওয়াশিং মেশিন, ছোট্ট ফ্রিজ সব টুকটুক করে কিনে কিনে সংসার সাজিয়েছে এই স্বল্প পরিসরেই। মা রোজ পুজো দিয়ে প্রসাদ আর প্রসাদী ফুল দিয়ে যান লুকিয়ে; যদিও সেই সময়টায় বাবা, কাকা বা কাকি বাড়িতে থাকেনা, কিন্তু বাকি কাজের লোকজন তো আছেই কোথার কথা কোথায় যায় আবার তাই নিয়ে কি নতুন অশান্তি। তবু প্রথম সন্তান ওই ভাবে পড়ে আছে, আর ওই মেয়েটা কি লড়াই লড়ছে তাও হাসে; হাতের মেহেন্দি যাবার আগেই যেন ঝড়ের মুখে পড়ল, মা হয়ে চুপ করে এত সহ্য করেন কি করে?
হাতে পায়ের প্লাস্টার খোলার পর ফিজিওথেরাপি শুরু হতেই একটা একটা করে ইজেল রেডি করলো আবার সুনয়নী। রোজ সন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফিরে উত্সাহিত করে, বাচ্ছাদের প্রথম পেন্সিল ধরতে শেখানোর মত করে তুলি ধরতে সাহায্য করে। হতাশ মানসপ্রতিমকে আদর করে, ভুলিয়ে অনুপ্রানিত করার চেষ্টা করে। ইজেল গুলো একেকটা এক এক দুরত্বে রাখা প্রতিটায় রঙ তুলি আগের মত করেই সাজিয়ে রেখেছে; যাতে যদি একপা একপা করে গিয়ে ছবি আঁকতে পারে মানসপ্রতিম। এমনকি ছোটো ইজেল যেটায় পেপার লাগাত সেটাকেও রেডি করলো, যদি বসেবসে আঁকতে চায়, চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখলোনা। সুনয়নীর কেমন একটা জেদ চড়ে গেছে কারণ অবাক কান্ড মানসপ্রতিমের অ্যাক্সিডেন্টের পর পর দুনিয়ার মিডিয়া হাজির হয়েছিল কে কার আগে এই খবরটা বেচবে, কিন্তু আজ মিডিয়া তো দূর অর্গানাইজাররা বা অন্য কেউ খোঁজও নেয়না একবার?! সে ঠিক করেছে মানসপ্রতিমকে সুস্থ করে আবার ছবি আঁকিয়ে তাক লাগিয়ে দেবে সবাইকে; যারা পাত্তা দেয়নি তারাই সামনে এসে মাথা নোয়াতে বাধ্য হবে। আর বাড়ির লোকেদের কেও দেখিয়ে দেবে যে সে কি করতে পারে তার ভালবাসার জন্য।

সেদিন বিকেলে গোয়ালিয়র থেকে একটা চেক পেল, মানসপ্রতিমের যে ছবি গুলো দিয়ে এসেছিল মোটা অঙ্কের দামে সেগুলো বিক্রি হয়েছে; অর্গানাইজাররা খুবই কৃতজ্ঞ এবং মানসপ্রতিমের কুশল, দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছে। আনন্দের শুরু সুনয়নীর। চাঁদের আলো ষ্টুডিওর ফ্যানলাইট দিয়ে ঢুকছে, সারা ঘর স্বপ্নীল আলো-আঁধারীতে ভরে যাচ্ছে। সেই রকিং চেয়ারটায় বসিয়েছে মানসপ্রতিমকে, পায়ের কাছে মাটিতে বসে সুনয়নী, চাঁদ দেখবে আজ দুজনে। অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছে ক্লান্তিতে। "আমার মৃগনয়নী" ডাকে আর কাঙ্ক্ষিত একটা স্পর্শে চোখ মেলল; নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা তার। প্রতিটা ইজেল ভর্তি; কোথাও গুর্জর মহলে, কোনটায় প্রার্থনারত, কোনো ছবিতে প্রেমিকা রূপে তার প্রিয় পুরুষের বক্ষলগ্না, কোনটায় সেই স্বপ্নের দৃশ্যের মত অসুস্থ স্বামীকে ঘোড়ায় করে নিয়ে চলেছে। রানী মৃগনয়নী সুনয়নী মিলে মিশে গেছে শিল্পীর দৃষ্টিতে; হাসছে মানসপ্রতিম, অ্যাপ্রনে রঙ মাখা হাতে তুলি ধরা অবস্থাতেই জড়িয়ে ধরল সুনয়নীকে। আনন্দ আজ অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে শামীমার চোখ দিয়ে; এতগুলো দিনের জমে থাকা আদরে ভরে তুলল পরস্পরকে। চাঁদ তখন ফ্যানলাইটের ওপারে।