গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

মৌ দাশগুপ্তা


অনির রথ

রথের দিন আষাঢ়ের আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘড়িতে সকাল ছটা কিন্তু বাইরে আলো একদম নেই । রাত রাত লাগছে । নিমাইয়ের চায়ের দোকানের পিছনে বাঁশের বাখারী দেওয়া চার দেওয়ালের ওপর খড়ের চাল, গতকাল মোটা প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা হয়েছে বলে আজ জল টপকাচ্ছে না তবে জলের ছাঁট আসছে। ঘরে সাকুল্যে একটা তক্তাপোষ তাতেই কাকা ভাইপোর সংসার। ছোট্ট অনি পাড়ার দেবুদাদার গত বছরের বই নিয়ে দুলে দুলে ইতিহাস পড়ছে, ‘মানবসভ্যতার প্রথম অবদান চাকা আবিস্কার।পড়তে পড়তে আড়চোখে কাকা কোথায় দেখতে গিয়ে আনমনা হয়ে যায় অনি, এবারের রথের কি খবর ওদের নয়ানপুরে ?। পুঁটে মাধুদের জন্য রথ কি কেনা হয়েছে ? আর রঙিন কাগজ, রাংতা, ফুলমালা ? প্রসাদের চিনি আর কলা ? ওখানেও কি আজ বৃষ্টি
হয়েছে? ঠাকুমা যে বলতো,রথের দিন নাকি বৃষ্টি হবেই। এবারও রথের মেলায়  গাছ বিক্রি হবে নিশ্চয়ই ? সবেদা পেয়ারা জামরুল লেবু রক্তচন্দন, সাথে জবা, গন্ধরাজ, রঙ্গন, আর স্থলপদ্মের চারা ।

রথের মেলা জুড়ে দেদার বিক্রি হবে পাঁপড়, নিমকি, কুচো গজা, ফুটকড়াই, ফেনী বাতাসা,বাদামভাজা, গরম জিলিপি এছাড়াও আসবে বাঁশীওয়ালা সনাতনদাদু, কমল নামের হাসিখুশী বেলুনওয়ালা দাদাটা , মাধোপুরের করিমচাচা আসবে বুড়ির চুল নিয়ে , চৌকানো কালো কাপড় ঢাকা বাক্স নিয়ে রহিমদাদা দেখাবে আজব সিনেমা, থাকবে রঙ বেরঙা কাগজের চরকি. লাট্টু, সাবান ফেনার বুদবুদ, কত যে মজা হবে। পুঁটে মাধু বিন্তি সোনু কানাই,মান্তিরা কি মজাটাই না করবে আজ, আচ্ছা ওদের কি আজ একবারও অনির কথা মনে হবে ? অনির বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করত, গত বছর এই রথের দিনেই বাড়ী ফেরার পথে লরী চাপা পড়েছিল, চাকার তলায় পিষে রক্তমাখা দেহটা চেনার উপায় ছিলনা অনিকে তাই কেউ দেখতেও দেয়নি । অনি মাকে দেখেনি কোনদিন। ওর ঠাকুমা বলতো জন্মকালে মরে মা তার দুঃখ ঘোচে না। সে ঠাকুমাও তো নেই। মরে হেজে থাকার মধ্যে এই এক কাকা। গত কয়েকমাস কাকার চায়ের দোকানেই কাকা ভাইপোর সারাদিনের সংসার। আজ রথ কিনা,আজ ওদের পথশিশুদের ইস্কুলেও ছুটি তবে খুব কাজ আজ দোকানে, বড় কড়া চাপবে, বেগুনী পেঁয়াজী পাপড় ভাজতে হবে। সকাল থেকেই খাটতে
হবে। কাকা কাল রাত থেকেই পাখীপড়া করে বলে দিয়েছে। সব যোগাড়-যাগার করে
হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে তারপর শুয়েছে গতকাল।

আজও অনি ঘুম ভেঙে ওঠার আগে থেকেই দোকান খুলে একা হাতে চা বানাচ্ছে কাকা। এবার না গেলে বকা দেবে। অনি উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাইরে থেকে নিমাইয়ের গলা ভেসে আসে -       বলি ও নবাবপুত্তুর, আর কত পড়ার কেত্তন করবি ? উনুন যে নিভতে চললো, বলি সুজ্জি যে মাথার ওপর উঠলো সে খেয়াল আছে? হতচ্ছাড়া ছেলে, আয় বলছি একফালি জানলায়  দাঁড়িয়ে জলে ভেজা পথ দেখছিল ছেলেটা। আর রথ সাজানো নেই, মেলায় যাওয়া নেই। কাকার মৃদু বকুনি কানে আসতেই  যন্ত্রচালিতের মত হাতের বই তক্তাপোষের নীচে ঢুকিয়ে রেখে দেওয়ালে টাঙানো পুরানো জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার ক্যালেন্ডারে ঢিব করে প্রনাম ঠুকেই দৌড় লাগালো । সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর ফুরিয়ে বিকেল, বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যা নামছে ধীর পায়ে । মায়াজড়ানো আবছা আলোয় জড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট মানুষজন ।

দোকানের সামনে দিয়ে ষষ্ঠীতলার মদনমোহন মন্দির যাবার রাস্তা । লোকজন, হৈচৈ, মেলা বসে কিনা মন্দির ঘিরে তাই মা বাবার হাত ধরে বাচ্চারা আসছে, যাচ্ছে, কেউ রথ টানছে, কেউ বাঁশীতে ফু দিচ্ছে, কেউ ভেঁপু বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছে,কারো হাতে পুতুল, কাঠের খেলনা, বেলুন, কারো হাতে কাগজের লাল নীল চরকি। ককার নির্দেশ মেনে শালপাতায় মুড়ে বেগুনী, ফুলুড়ি, ঝালবড়া ,পাপড়, কি জিলিপি অর্ডার মত লোকের হাতে তুলে দিতে দিতে অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে অনি। কেমন যেন একটা হচ্ছে বুকের মধ্যে, যেখানে স্মৃতিরা ঘুমিয়ে থাকে ... । বিষাদ আর আনন্দের মাঝামাঝি ... কিছু একটা, ঠিক বোঝানো যায়না । বারবার কিসের একটা না পাওয়ার দুঃখে চোখ আবছা হয়ে যাচ্ছে। বারবার কাকার বকুনী খাচ্ছে আর বকুনী খেয়েই চটকা ভেঙে পরনের ময়লা গেঞ্জিতে চোখ মুছে হাত চালাচ্ছে অনি কাজ করতে করতে আড়চোখে ভাইপোর ম্লানমুখ নিমাইও দেখছে কিন্তু ও বেচারাই বা কি করে । ছোট্ট দোকান, অল্প মূলধন, লোকও কাকা ভাইপো বই কেউ নেই। এই উৎসব-টুৎসবেই যা দুটো বিক্রিবাটা হয় । তবু বাপ মা মরা ভাইপোটার ম্লানমুখ নিমাইয়ের কাজের গতি শ্লথ করে দেয় । মন খারাপ কাটাতে অনিকেই ধমকে ওঠে। অনির চোখের জলের মত জল ছলছল আকাশে শুরু হয় বৃষ্টি, আবছায়া নেমে আসা রাস্তায় তখন টলমল করছে ছোটো ছোটো রথ। কাঁসর বাজছে । বৃষ্টি বাড়তে লোকজনও ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক, বাড়ীর দিকেই দৌড় অধিকাংশের । বৃষ্টি ভিজে মেলা দেখার থেকেও টিভি সিরিয়াল আর ঘরের নিভৃত আশ্রয়ই বেশী ভালো লাগে সবার । অনিও দুদন্ড ফুরসত পায় । রাস্তায় চোখ রাখে। শালপাতা, ফাটা বেলুন, চকোলেট আইসক্রীমের মোড়ক, কাগজের টুকরো, ছেঁড়া ফুল, খুচরো পয়সা স্মৃতির মতো ছড়িয়ে পড়ছে জনহীন রাস্তায় । জলে জলে এলোমেলো হয়ে গেছে চারধার।  মাটি দেখা যাচ্ছে না, অনি ভাবে যা বৃষ্টি, ওর ফেলে আসা গ্রাম ঘেঁষে বয়ে চলা বউমরা খালে নিশ্চয়ই আজ হইহই করে জল বইছে। আর পুঁটুদের মাছচাষের পুকুরও তাহলে এবার ঠিক ভেসে গেছে। সব মাছ পালিয়ে যাচ্ছে খালের জল বেয়ে   মাছেদের মুক্তির আনন্দ ওর ভেতর দিয়ে বয়ে যায় ওর না মেটা আনন্দ হয়ে, ভাবে, হে ভগবান, ওরা যেন পালাতে পারে । ফিরে যেতে পারে নিজের জায়গায়, বাধা না পায়। এদিকে  জল আসতেই এক হাতে রথ আর কোলে রথের ক্ষুদে চালককে তুলে দৌড় দিয়েছে কোন এক  মা। তাড়াহুড়োয় ঈশ্বর পড়ে রয়েছেন পথেই, ঝড়জলে। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে,অসহায় ঈশ্বর ভিজছেন জনহীন পথে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বৃষ্টিতেই ভিজতে ভিজতে পথে নেমে আসে অনি,কেউ কোথ্থাও নেই, দুহাত দূরের দৃশ্যও ঝাপসা


ভীরু হাতে রথের দড়ি হাতে তুলে নেয় অনি। গেঞ্জিটা খুলে ভেজা রথের ওপর চাপিয়ে দেয়। যদি জল একটুও আটকানো যায় । ধীরে ধীরে রথের রশিতে টান পড়ে। জলে
ভাসা পথে টলোমলোভাবে এগোয় রথ, একটু এগোতে না এগোতেই বিপত্তি, হাল্কাহাতে রশিতে টান দিলে জল কেটে এগোচ্ছে না রথ আর জোরে টানলে উল্টে পড়ে যাচ্ছেন জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা, হঠাৎই রথের কাঠামো সাবধানে দুহাতে সামলে কেউ ধীরে ধীরে ঠেলা দেয় সামনে,রথের চাকা ঘোরে, রথ এগোয়চমকে তাকাতেই অনি দেখে দোকান ফেলে বৃষ্টিতে ভেজা কাক হয়ে কাকাও নেমে এসেছে পথে। অপরাধীমুখে লাজুক হাসে অনি । নিমাইয়ের মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। ভক্তের ভগবান ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণে বরুনদেবকে পাঠিয়ে দিয়েছেন মাটির পৃথিবীতে, অকৃপন হাতে জল ঢালছেন বৃষ্টির দেবতা । অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মহানন্দে কাকার সাথে রথ
টানতে থাকে অনি।