সকাল থেকেই মেজাজটা খুব ফুরফুরে । আজ পনেরোই
আগষ্ট ।বছরের এই দিনটা দেশোপ্রেম যেন চলকে ওঠে । মাইকে দেশাত্মবোধক গান বাজছে
। দুপুরের খাওয়া সেরে বেরোলাম।আজ আর ঘরে বন্দি থাকতে ইচ্ছে করছে না।শ্যামবাজার থেকে
ধর্মতলা গামী বাসে চড়ে বসলাম । আজ সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি ।আজ নিশ্চই রাস্তায় ভিড়
কম থাকবে। বাস থেকে নামলাম। বৃষ্টিটা আবার তেড়ে এল। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে ,দ্রুত পায়ে একটা শপিং মলে ঢুকে
পড়লাম। পূজোর আর বেশি দেরি নেই তাই মনে হয় থিকথিক করছে ভিড় ।কালো পিঁপড়ের মত কালো
কালো অজস্র মাথা।
ভিড় ঠেলে
ঠেলে জেন্টস সেকশানে পৌঁছে গেলাম । অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম হিমাদ্রির জন্য একটা
শার্ট কিনব।সামনের মাসে ওর বসের মেয়ের বিয়ে।চোখের সামনে আলমারিটা ভেসে উঠল। সব
মিলিয়ে গোটা ছয়েক শার্ট আর টি শার্ট আছে । একটাও বিয়েবাড়ি পরার মত না।এখানে দেখছি
অনেকগুলোই বেশ পছন্দ হচ্ছে।কিন্তু দাম দেখেই মুখের আলো নিভে যাচ্ছে। উফ
কি ভিড়!রীতিমতো গরম লাগছে। এমনভাবে মানুষ কেনাকাটি করছে যেন এক্ষুনি না কিনলে আর
পাওয়া যাবেনা।আচ্ছা, সত্যি কি টাকা মাটি ?দাম নিয়ে কারো কপালে চিন্তার
ভাঁজ নেই । পছন্দ হলেই ট্রায়াল রুম। আয়না যদি একবার ও. কে. বলে দেয়,
সোজা বিল
কাউন্টার । বেরোনোর আগে আমি এ কৌটো ,ও বাক্স হাতড়ে সাড়ে চারশ টাকা
পেয়েছি। ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রেখেছি। যা ভিড়! কেউ যদি হাতিয়ে নেয় তো গেল। ছেলেটার
দুমাসের মাইনে দেওয়া বাকি । নেহাত ছেলেটা ভাল পড়াশোনা করে তাই স্যারেরা চাননি।
মেয়েটার নাচের স্কুলে ফোর্থ ইয়ার পরীক্ষার টাকা দিতে হবে।গত মাসের বাড়িভাড়াটাও
বাকি পড়ে গেছে! দূর বাবা ! এখন আবার এ সব চিন্তার মেঘ
মাথায় আসছে কেন!সারি সারি ফ্যাকাসে মুখের মিছিল মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছে কেন
! অভাব তো আমার পোষা অসুখ ! আছা, তাই বলে কি একদিন ও রানি হতে
পারিনা? ---- আরে ,আরে দাদা দেখে হাঁটুন ?
দিলেন তো
চটিটা মাড়িয়ে? এ হে ! স্ট্র্যাপটা ছিঁড়েই গেল ! ইসস,
কি করে যে
বাড়ি ফিরব? কি যে করেন না? একটু দেখে তো হাঁটবেন !
----- সরি,
ম্যাডাম,
আমি একদম
খেয়াল করিনি । রিয়েলি, আমি সরি। ----- আপনি তো “সরি”বলে সরে পড়বেন।আমি কি করে বাড়ি
ফিরি বলুন তো ! ------ বললাম তো ,দিদি ,খেয়াল করিনি। আর কি করব বলুন ?
------আরে দিদি,
উনি তো
বলছেন উনি খেয়াল করেননি। ভিড়ের মধ্যে এ সব তো খুব কমন ব্যাপার।আপনারা মেয়েরা না
বড্ড অবুঝ !একটুতেই এত হইচই করেন ! এত ভিড়ে বেরোন কেন বলুন তো?বেরোতে হলে পোক্ত চটি পরে আসেন
না কেন? ----সঙ্গে সঙ্গে এক রাশ সুলভ মন্তব্যের ফোয়ারা ছুটতে লাগল ! আমি
নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।আর একটাও কথা বললাম না । এক ঝাঁক লজ্জা ,গ্লানি মৌমাছির মত আমার কাঁধে
এসে বসল। মনে হল ,কেন যে বড় লোকের জায়গায় আসার দূর্মতি হলো
।তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। সেফটি পিন দিয়ে জুতোটা আটকালাম। তারপর ঘরমুখো বাসে উঠে
বসলাম ।স্বাধীনতা দিবস বলে রাস্তার ধারে ধারে প্রচুর তিরঙ্গা উড়ছে । কোথাও কোথাও
রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে।আজ পথে অনেক মহিলাকে লাল পাড় সাদা অথবা সাদা
গেরুয়া বা সাদা সবুজ শাড়িতে দেখা গেল ।স্বাধীনতা বেশ সেজেছে
শহর জুড়ে। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।মনটা ভারি হয়ে আছে।ভাবনার
গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিলাম।শ্যামবাজার এসে গেল। বাস থেকে নেমে বাড়ির দিকে
এগোচ্ছি । হঠাৎ গলির মুখে একটা বস্তিতে জটলা দেখে দাঁড়ালাম। একটা পনেরো-ষোলো বছরের
ছেলে চিৎকার করে কাঁদছে। -------“ মা ,রক্তের অভাবে মরে গেলে ! অনেক
চেষ্টা করে একটুও রক্ত আনতে পারিনি । ঘরে টাকা পয়সা নেই ! তোমাকে পোড়াবার আগুন কোথা
থেকে জোগাড় করবো বলো না মা !” পথ দিয়ে যারা যাচ্ছে ,তারা সবাই চলে যাচ্ছে।যারা
হেঁটে যাচ্ছে। যারা গাড়িতে চড়ে যাচ্ছে । সবাই চলে যাচ্ছে। আমার পা দুটো থেমে
গেলো।মনটা আটকে গেলো । চেঁচিয়ে বললাম –এই ছেলে,চুপ কর! আজ স্বাধীনতা দিবস। তোর
মাকে পোড়াতে না পারলে দেশের লজ্জা। ব্যাগ থেকে সাড়ে চারশো টাকা বের করে বললাম—এটা রাখ,
তোর মাকে
পোড়াবি । ছেলেটি কি বুঝল সেই জানে । কিন্তু হঠাৎ কান্না থামিয়ে দিল । আমি ফিরলাম আমার
অভাবের বাসায়।