গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০২০

সৌগত রাণা

হরিপদ বাবু


               
                     হরিপদ বাবু চেষ্টা করেন আজকাল দ্রুত হাঁটতে, কিন্তু এখন যেন কি হয়েছে, পথ শেষ হতে চায় না ! একটা ভারি মূর্তি বয়ে বয়ে পাশের গ্রামে পৌঁছে দেয়া, সেটা এখন আর জানে সয় না ! হরিপদর অনেক ইচ্ছে ছিলো পাল বাবু হওয়ার ! সেই ছোকরা সময় থেকে প্রায় হাজার খানেক মূর্তি গড়েও তা আর হয়ে ওঠা গেলো না ! তবে আজকের কাজটার খরিদ্দার শহরের এক বড় বাবু, বাবু বলেছেন এটা নাকি বিদেশের কোন এক নামী মিউজিয়ামে বসবে, হাজার মানুষ পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে দেখতে আসবে হরিপদর এই মূর্তি, ভাবতেই সুখে চোখ চক চক করে উঠলো ! কাদা পায়ে হাঁটার গতি আরো বেড়ে গেলো ! কদিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে গাঁয়ে, পথ- ঘাট নেয়ে একাকার। মেয়েটা খুব বায়না ধরেছে, এবার ঘরের চালাটা বদলে দিতে হবে। রোজ রাতে বৃষ্টির জলে আর নাইতে পারবে না । এক রত্তি মেয়ে, দেখতে দেখতে কেমন বড় হয়ে গেলো ! একটা ভালো ছেলে পেয়েছে হরিপদ, এবার বিয়েটা দিতেই হবে । ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো হরিপদর । কতো ইচ্ছে ছিল মেয়েটাকে পড়াবে, তা আর হলো কই? বছরে যে কয়টা কাজ জোটে, তাতে ঘরের চালা তো দুরের কথা, খাবারের চালই হয় না । প্রতিদিন কাদা মাটি ঘেটে ঘেটে নিজেকেই মাঝে মাঝে জীবন্ত মূর্তি মনে হয় হরিপদর ! তবে সাত গাঁয়ে হরিপদর নাম আছে । অনেকে বলে হরিপদর হাতে নাকি মূর্তির মুখ জীবন্ত হয়ে হাসে, এটাই বা কম কিসে ? বেলা বয়ে এলো বুঝি, মাথার উপর সূর্যটা পশ্চিমে হেলেছে, লাল আভা আসি আসি করছে, হাঁটতে হাঁটতে গাঁয়ের মাঠটায় যখন এলো, মনে হলো একটু বিশ্রাম নিলে হতো । ঘামে শরীর পুরো ভিজে গেছে,বুক ধড়ফড় করছে, একটু জল পেলে মন্দ হতো না। ভাবতেই ছুটে চলা পা দুটো অচল হয়ে এলো ! মাঠের কোনায় কামরাঙ্গা গাছটাতে একটু বসে নিলে হয়, কাঁধে থেকে নামিয়ে খুব যত্ন করে মৃন্ময়ী সহযাত্রী কে পাশে রেখে কামরাঙ্গা ছায়ায় বসলো হরিপদ । কি যে অসহ্য গরম ! একটু আগের গাঁয়ে পাঁকা রাস্তা হয়েছে, দলে দলে বাবুরা এসে মিল-কারখানা করেছেন, বাতাসে সেই কালো ধোয়া এসে এই গাঁয়ে গরম বাড়িয়েছে । শোনা যাচ্ছে এই গাঁয়েও রাস্তা পাঁকা হবে, গাঁয়ের ধনীরা খুব খুশী, জমির দাম বাড়বে, পয়সা হবে ! কিন্তু কপাল পুড়বে হরিপদর, সরকারী খাস জমিতে কোনো মতো একটা ছাউনি তুলে থাকে, এক রত্তি বউটা বিয়ের পর থেকে সেটাকে রোজ লেপে মুছে মন্দির বানিয়ে রেখেছে ! মন্দিরই বটে, কতো দেবতার মূর্তি থাকে সময়ে সময়ে ! হরিপদর বউ মেয়ে ভালো ! এতোদিনের সংসারে কোনো অভিযোগ করেনি কোন কাল, শুধু মুখ বুঁজে মোটা চাল খেয়ে হরিপদর সংসারটা আগলে রেখেছে, আসে পাশের জল জংলা থেকে শাক,সবজি তুলে এনে ঠিক ঠিক চালিয়ে নিচ্ছে ! মাঝে মাঝে কাজের চাপে হরিপদর গঞ্জে যাওয়া হয়ে ওঠে না। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ হাসি পেয়ে গেলো হরিপদর, যখন বিয়ে করে নিয়ে এলো মেয়েটাকে, কি খিলখিল করেই না হাসতো প্রথম প্রথম, খুব ভালো লাগতো দেখতে ! বউটা বাপের বাড়ী গিয়ে সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলতো, "আমার বর শিল্প মানুষ ! মূর্তি গড়া কি মুখের কথা ! বিদেশে এই কাজে মানুষ কতো টাকা পায়, মেডেল পায় ! তোমরা দেখে নিও, আমার উনিও একদিন মেডেল পাবেন ! " মাঝে মাঝে খুব দুঃখ হয় বউটার জন্য, কম বয়সে হরিপদর ঘরে এসে সংসার সংসার করতে করতে জীবনটা পার করে দিলো ! পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পরেছে বউ, হরিপদরও খুব গর্ব হয় বউকে নিয়ে, নিজে তো নাম দস্তখতই করতে পারে না ! পারবেই বা কি করে ? সেই ছেলেবেলায় বাপ নিরুদ্দেশ হলে, মা মামা বাড়ী চলে যায় দুই বছরের হরিপদকে ঠাকুরমার কাছে রেখে । পরে মামারা মাকে অন্য গাঁয়ে নিয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়। হরিপদ শুনেছে, খুব বড় ঘর ছিল সেটা। মা প্রথম প্রথম লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলেকে দেখে যেতো, কিছু টাকা পয়সাও দিতো, একসময় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়, নতুন সন্তান পেলে যা হয় আরকি ! বুড়ো বুড়ী মারা যাওয়ার পর,গাঁয়ের লোকেরা জোর করে হরিপদকে পাল বানিয়ে দিলো ! ছেলেবেলা থেকে কাদা মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে সেই মাটি হরিপদর হাতে সুন্দর সুন্দর পুতুল হয়ে যেতো ! সবাই বলতো কি সুন্দর ! কি সুন্দর ! মাঝে মাঝে দুই একটা পূজোর কাজ করতে করতে মূর্তি বানানোটা হাতে উঠে যায় হরিপদর ! এভাবেই একদিন মূর্তির কারিগরি শেখা হয়ে যায়।
বিকেলের লাল আভা মুখে পড়তেই হরিপদর ভাবনায় ছেদ পরে, সূর্যটা নামি নামি করছে, ঝির-ঝির বাতাসে ঘুম এসে যাচ্ছে । শরীরটা ইদানিং ভালো যাচ্ছে না,মাঝে মাঝে বুক ব্যাথা করে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মেয়ে প্রতিদিন বলে গঞ্জে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে। আজকাল গঞ্জের উন্নতি হয়েছে, শহরের বড় ডাক্তার বসেন ছুটির দিনে।
কিন্তু বসলে কি হবে, রোগী পেলে গলা কাটতে ভোলেন না ডাক্তার বাবুরা ! তারপর এই টেষ্ট সেই টেষ্ট, প্রায় হাজার টাকার ধাক্কা ! মেয়ে বললেই তো আর হলো না, এতো টাকা হবে কোত্থেকে ? এ বছর কাজ জুটেছে মাত্র চারটি ,এতে তো খাবার পয়সাই হয় না ! তবে সত্যি বলতে কি, মাঝে মাঝে শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়, তাই যাই যাচ্ছি করে মেয়েকে ফাঁকি দেয়া আর কি ! মেয়েটা তার মায়ের মতোই হয়েছে, খুব মায়া করে। অথচ কোন পূজায় মেয়েকে একটা নতুন জামা দিতে পারে না হরিপদ, বউ পাশের বাড়ী থেকে চেয়ে চিন্তে পুরোনো জামা এনে দেয় । সত্যি বলতে কি তাতেই প্রতিমার মত লাগে মেয়েটাকে !  হরিপদর মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর, জন্মের পর সবাই দেখে বলেছিলো, " হরিপদ, তোর ঘরে মা দূর্গা এসেছে রে, কি ডাগর ডাগর চোখ, দুধে-আলতা গায়ে রং, ঠিক হরিপদর মায়ের মতো ! হরিপদর মাও খুব সুন্দরী ছিলেন, দেখতে ভালো বলে সাত গাঁয়ে নাম ছিল। মেয়েদের রুপের গন্ধ ছড়ায় তারাতারি ! না এসব ভাবতে ভাবতে গায়ের ঘাম শুকিয়েছে অনেক আগেই, ঢের বিশ্রাম হয়েছে, এবার চলতে হবে। সন্ধ্যার আগে ডেলিভারি দিতে হবে। কাল সকাল সকাল শহর থেকে গাড়ি এসে নিয়ে যাবে মূর্তি। যদি বাবুদের দেখে পছন্দ হয়, তবে বিদেশে যাবে প্রদর্শনীতে। অনেক দামে বিক্রি হবে, হরিপদেলর নাম হবে, উড়োজাহাজে চড়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগও হয়ে যেতে পারে ! হরিপদর ও খুব শখ, তার নিজের একটা মেডেল হবে। দশ গাঁয়ের লোক ভিড় করে সেই মেডেল দেখতে আসবে। নিজেকে শিল্পী ভাবতে হরিপদর ভালই লাগে। মেয়ে তো বলেই, "একদিন তোমার মেডেল হবেই বাবা, দেখে নিও তুমি, মেডেল হলে কিন্তু আমি সেটা আমার সাথে করে আমার শ্বশুর বাড়ী নিয়ে যাবো, সবাইকে দেখাবো, বলবো, দেখো আমার বাবা শিল্পী মানুষ, দেশ-বিদেশে কতো ডাক নাম, এই দেখো তার সোনার মেডেল, তাতে শ্বশুর বাড়ী আমার ভারি সন্মান হবে বাবা "! মেয়ের কথা শুনে হরিপদ মেয়েকে বকে দেয়, "ধুর পাগলি, আমাকে কে দেবে মেডেল ? বছরে যে কয়টা কাজ করি পূজোর শেষে তা নদীর পেটে যায়, মাঝে মধ্যে ছেলে ছোকরারা কিছু ছবি তুলে রাখে বটে, কিন্তু এতো কষ্টের বানাবো শীল্প আবার সেই কাদা মাটি হয়ে যায় নদীর জলে মেশে ! খুব কষ্ট হয় যেদিন বিষর্জন হয় প্রতিমার ! এতো কষ্টের কাজ জলের পেটে চলে যায় ! কিন্ত মূর্তি বেঁচে দিলে সেটার উপর আর অধিকার থাকে না শিল্পীর, বিনিময়ে সেই পাঁচশ হাজার টাকা, তাতেই খুশী হতে হয় । কোনো স্রষ্টাই চায় না তার সৃষ্টি নষ্ট হোক ! মাঝে মাঝে মনে হয়, নিজের মনের মতো করে একটা মূর্তি গড়ে নিজের কাছে রেখে দেবে, তা আর হয়ে ওঠে না হরিপদর, টাকার যে খুব প্রয়োজন ! মনের ক্ষুদা পেটের ক্ষুদার কাছে তুচ্ছ ! ভাবতেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস পরে হরিপদর বুক চিরে ! তবে এবারের কাজটা খুব সুন্দর হয়েছে, বউ, মেয়েতো বলে, এবার এটাতেই হরিপদর মেডেল হয়ে যাবে। অবশ্য হরিপদর ভালো লাগেনি সেইভাবে। একটা নারীর অর্ধনগ্ন অবয়ব ! হরিপদ বুঝতে পারে না,অর্ধনগ্ন হতে হবে কেন ? পোষাকেও তো নারী রুপসী হতে পারে, তাই না ? হরিপদ কাজটা করতে চায়নি প্রথম প্রথম, কিন্ত শ্যামল বাবু, গ্রাম পঞ্চায়েতের সভাপতি, উনি বললেন যে, ওরা ভালো টাকা দেবে, প্রথমে পাঁচ হাজার, পরে মেডেল পেলে আরো পাঁচ হাজার ! হরিপদ আর মানা করেনি, মন্দ হবে না, মেয়ের বিয়ের আর্ধেক টাকা হয়ে যাবে এতে। গেলো বছর পূজোয় মেয়ে মামা বাড়ী গিয়েছিলো , সেখানে এক বড় ঘর থেকে সমন্ধ এসেছে, ওরা কিছু নেবে না, শুধু কয়টা বরযাত্রী খাইয়ে দিলেই হবে,বিয়ের খরচা ছেলেই দেবে ! ছেলে মোটা মাইনের সরকারি চাকুরে,বাপেরও অনেক পয়সা আছে, এক বাপের এক পুত,তাই হরিপদ আর মান করেনি । খুব যত্ন করে এই কাজটা করেছে হরিপদ, শুধু গায়ে কাপড় থাকলেই হরিপদর মনে হতো কাজটা পূর্ন হয়েছে ! 
যাই হোক, বেলা পড়লো বলে, এবার আর দেরি করা যাবে না, শক্ত করে ধরে আবার কাঁধে তুলে নিলো স্বপ্নের মূর্তিটিকে । কাদা মাটির পা শুঁকিয়ে চরচর করছে, সেই মাটি পা নিয়েই হরিপদ আবার গাঁয়ের কাঁচা পথ ধরে চললো। গঞ্জে সড়ক পার হলেই শ্যমল বাবুর দোকান ঘর, ডেলিভারী সেখানেই। পেমেন্ট সামনে সপ্তাহে,সে হলেই হলো, টাকা হাতে পেলেই হয় ! টাকাটা খুব দরকার, যতোই দেবতা গরুক না কেন, টাকাটাকেই আজকের মানুষ দেবতা বানিয়েছে ! তাই হরিপদ ও ভুলেছে তার শিল্প সুখ, মেয়েটার জন্য টাকা দরকার, নিজের কষ্ট তো আর মেয়েকে দেয়া যায় না ! জোরে পা চালাতে হবে, খুব দ্রুত হেঁটে প্রায় ঘন্টা খানেকের মধ্যে মূল সড়কে পৌঁছে গেলো হরিপদ । পথের শেষে এসে কষ্ট হালকা হয়ে যায় মানুষের, হরিপদরও তাই হলো, কাঁচা মাটি ছেড়ে পাঁকা রাস্তায় উঠলো হরিপদ । সাবধানে রাস্তাটা পার হতে হবে, এই গঞ্জের রাস্তা আজকাল ভীষণ ব্যস্ত, দুরের অনেক গাড়ি এখন এখানে দিয়ে যায়। তাই গাড়ীও ছোটে চিলের মতো ! পথের মাঝখানে একটা ক্রসিং, সেখানে খানিক দাড়িয়ে দুদিক দেখে হরিপদ তার ক্লান্ত পা বাড়ালো ।
হঠাৎ করে পেছেন থেকে একটা কালো গাড়ী মুহুর্তেই সামনে এসে গেলো, হরিপদ শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করলো মূর্তিটার যেন কিছু না হয়, কিন্তু পারলো না, গাড়ীর ধাক্কায় টাকার মূর্তি ভাঙ্গলো কাঁচের মত করে ! রাস্তার লোক জমে গেলো মুহুর্তেই, গলগল করে লাল স্রোত বইছে হরিপদর মাথা দিয়ে। ঝাপসা চোখে অনেক মানুষ দেখতে পেলো হরিপদ । চারিদিকে শুধু হাপিত্যেস,"আহারে লোকটা বুঝি বাঁচলো না।" আস্তে আস্তে হরিপদর কানে শব্দগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে, চোখের সামনে হঠাৎ যেন ছবির মত ভেসে উঠলো বউয়ের সেই খিলখিল হাসি, আবার পরক্ষনেই মায়ের সেই চলে যাওয়ার কষ্ট দিন, দুই হাত তুলে সেই মাকে আটকানোর চেষ্টায় হরিপদর বাম হাত শুন্যে উঠে গেলো ! মেয়েটার শ্বশুর বাড়ী আর বুঝি মেডেল নেয়া হলো না ! কালো সড়ক গলগলে রক্তে ভেসে যাচ্ছে, হরিপদর আর বাবু হওয়া হয়ে উঠলো না ! ঘাম,রক্ত, মাটি সব মিশে একাকার হয়ে গেছে ভাংগা মূর্তির মাটির সাথে, শুধু অর্ধনগ্ন মূর্তির উন্মুক্ত বক্ষ ভেংগে ছিটকে পরে রইলো হরিপদর ছেঁড়া হাতের সাথে ! হঠাৎ যেন বুকটা উপরে উঠে কি যেন একটা বেড়িয়ে গেলো বুকের ভেতর থেকে, হরিপদর বুক হালকা হয়ে গেলো, খুব হালকা ! অনেক সাধের কামনার জীবন হরিপদর চোখে ভাসলো অনন্ত শুন্য এক নিয়ে ! পেছনে পরে রইলো টাকার মূর্তির চূর্ন মাটি আর হরিপদ পাল বাবুর সোনার মেডেল !