গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০

সন্দীপ গঙ্গোপাধ্যায়


পরিচয়

 ঐশীর জীবনের স্বপ্নগুলো আজ কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতো নিরুদেশে হারিয়ে গেল চিরতরে অভিলাস বাড়ি ফিরছিল সিটবেল্ট বাঁধার ফাঁকে সামান্য চিন্তিত, কোথায় যাবে?নিজের বাড়ি না পরিচয়ের কাছে? এই মাত্র ঐশীর অস্থি ভাসিয়ে এলো গঙ্গায়,সঙ্গে একরাশ  অভিপ্রায় একলহমায় মনের ভ্রুকুটি সরিয়ে গাড়ি এখন পরিচয় অর্থাৎ ঐশীর ফ্ল্যাটের অভিমুখে

 অনেক স্বপ্ন দেখতো ঐশী, কখনো নীলিমা সেনের মত রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার, কখনো বিমানসেবিকা হওয়ার আবার কখনো বা  সমাজসেবিকারঅভিলাসের সঙ্গে তার আলাপ যৌবনের দোরগোড়ায় অভিলাস কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক অন্য দিকে ঐশী ছিল কালবৈশাখীর ঝোড়ো হওয়া, অনেকেই ভেসে যেত তার নির্মেদ সান্নিধ্যে দুজনের স্বভাবের মিল খুব একটা না থাকলেও বন্ধুত্বের বন্ধন ছিল বেশ জমাট অভিলাসের মনে পরে গেল ঐশীর সঙ্গে তার আলাপের প্রথম দিনের কথাঐশী হাসতে হাসতে বলেছিল " খোকা তোমার কিছুই বোঝে না মা, খোকা তোমার বড্ড ছেলেমানুষ..."

  অভিলাস বড় হয়েছে অনেক না পাওয়াকে সঙ্গী করেতার প্রধান লক্ষ ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের পায়ে দাঁড়ানো গ্রীষ্মের গুমোট অলিন্দে কিছুটা দখিনা বাতাসের ছোয়া দেওয়া তাই সমবয়সীদের  মত তার জীবন প্রেমের মূর্ছনায় ভেসে যায় নি অন্যদিকে ঐশীর কাছে জীবনের সঙ্গা ছিল আকর্ষণসে জীবন কে চাইত উল্টে পাল্টে দেখতে সময়ের আবর্তে তাদের যোগাযোগ ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে যদিও অভিলাস তার অনেক একলারাতে কবির গানের সাথে ঐশীর কথায় হারিয়ে যেত-"কিরে তুই তো দেখি রবীন্দ্রনাথের থেকেও বড় দার্শনিক হয়ে গেলি.."

   অভিলাস এখন সাংবাদিক এক দৈনিকের, বেশ কয়েক বছর পর কলকাতায় ফিরেছে মাস তিনেক আগে এক সন্ধ্যায় খবরের সন্ধানে গেছে রবীন্দ্রসদনেসেখানে নারীদিবস উপলক্ষে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীরা তাদের কথা শোনাবে অভিলাসের চোখ আটকে গেল চেনা চোখে...ঐশী একটু পিছনে চলে গেল,মনে পড়ে গেল বেশ কয়েক বছর আগে ঐশীর কথা, " আমাদের আবার দেখা হবে হয়তো অনেক অনেক শীতের পর, সবুজ বসন্তে" সেদিন রাতে তার সেলফোনে অচেনা নম্বরের খোঁজ- ঐশী, তার চেনা প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হল তাদের,বর্তমান অবস্থার নয় চুরি যাওয়া বন্ধুত্বের "তোর মনে আছে কলেজের নবীনবরনে তোর আমার যৌথ আবৃত্তি" ঐশীর কথায় অভিলাসও ফিরে গেল স্মৃতির দিগন্তে, বললো তোর মনে পড়ে " তোর গাড়িতে আমাদের আকাশ দেখতে যাওয়া,আর তুই গেয়েছিলিস...."দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলো" হৃদয় আমার প্রকাশ হল.." কয়েকদিনেই তাদের বন্ধুত্ব আবার নিবিড় হয়ে উঠল, রোজই কথা হত বহুদিন  পর অভিলাস পেল বর্ষার খোলা বারান্দা যেটা মনের আনন্দের সঙ্গে তাকে প্রাণের বিলাসিতাও দিল

  ঐশী এখন বিমানসেবিকা  দুমাস আগে কলকাতায় ফিরেছে তার ছয় বছরের সংসার খেলা সাঙ্গ করে সাথে তাদের অপ্রেমের সন্তান পরিচয়বেঙ্গালুরুতে ঐশী প্রলয়ের         ভাল-বাসাটা কোন দিনই ভালোবাসায় পরিণত হয়নি বরাবর নাটকের মঞ্চই রয়ে গিয়েছিল যার একমাত্র সফল মঞ্চায়ন পরিচয় একসময় দুজনেই ছদ্মবেশে ক্লান্ত হয়ে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়পরিচয় এখন চার বছরের এক ছুটির দিনের সন্ধ্যায় ঐশী অভিলাসের সঙ্গে পরিচয়ের পরিচয় করে দিয়েছিল নন্দনে একটা শিশুদের ছবি দেখার আমন্ত্রণে ওখান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে ঐশী তার উদাত্ত কন্ঠে বলে উঠেছিল " রাখিও বল জীবনে রাখিও চির আশা, শোভনে এই ভুবনে রাখিও ভালোবাসা.." ছোট্ট পরিচয়ের চোখে তখন একরাশ বিস্ময়

  গতকাল সন্ধ্যায় প্রবল ঝড় বৃষ্টি হয় ,জ্যাম জোটে বাড়ি ফিরতে কিছুটা দেরি হয়ে যায় অভিলাসের কাজের চাপে সারাদিন ঐশীর সঙ্গে কথা হয়নিরাতে বেশ কয়েকবার অভিলাস ফোন করে কিন্তু প্রতিবারই ঐশীর  ফোন বন্ধের কথা শুনতে হয় মাঝরাতে অভিলাসের ঘুম ভাঙে সেলফোনের ঝংকারেএত রাতে অচেনা নম্বরের ফোন দেখে কিছুটা সঙ্কিত হয়ে গেল সে,ইতস্তত  করতে করতেই ফোন কেটে গেলদ্বিতীয় বার ফোন বাজতেই ধরে ফেলল, ওপার থেকে যে সংবাদ ভেসে এলো তাতে অভিলাসের সামনে পৃথিবীটা দুলে উঠল পরক্ষনেই সম্বিত ফিরে পেয়ে ছুটে চলল নার্সিংহোমের দিকে,ঐশীর একসিডেন্ট হয়েছে যে ভাবেই হোক ওকে বাঁচাতে হবে ভাবতে ভাবতেই দ্রুত গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেল নার্সিংহোমে বৃষ্টির শহরে ঐশীর গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখোমুখি হয়েছিল এক দশ চাকার বিভীষিকার ডাক্তারদের সকল প্রচেষ্টাকে ব্যার্থ করে ঐশী চলে গেল তার প্রেরকের কাছে হয়তো নতুন কোন স্বপ্নের সন্ধানে

   আলোকোজ্জ্বল তিলোত্তমায় অভিলাসের ঝাপসা দৃষ্টিতে ভেসে এলো ঐশীর নারীদিবসের নিবেদন "জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ"গাড়ির গতিবেগ কিছুটা বাড়িয়ে দিল অভিলাস পরিচয় যে অপেক্ষায় আছে  আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রনের অভিলাস খুঁজে পেতে চায় জীবনের পূর্ণতা  পরিচয়ের হাত ধরে