গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

শান্তিময় কর


সর্ষে মাহাত্ম     


            সেদিন কয়েকজন বন্ধু মিলে আমরা এক জায়গায় বসে রাজনীতির নানা রঙ আর রাজনীতিকদের, মানে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের আচার আচরণ, কাজ-কর্ম নিয়ে আলোচনা করছিলাম, যদিও এই রকম আলোচনায় অংশ নেওয়ায় আমার বরাবরের অনীহা কারণ এই রকম আলোচনা এমন একটা আকার ধারণ করে যে শেষ পর্যন্ত চিৎকার, চেঁচামেচি এবং প্রায় মারপিটের অবস্থায় গিয়ে শেষ হয় তাই আমার এই অনীহা কিন্তু কী করা যাবে ? বন্ধুদের আড্ডায় হালকা আলাপ আলোচনার মধ্যে অবধারিত ভাবে রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠে আসবেই সুতরাং তা থেকে বিরত থাকতে না পেরে ওই আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়তেই হয় পাড়ার কোন এক নেতা তথা পাড়ার দাদার দাদাগিরি নিয়ে তিতিবিরক্ত আমাদের এক বন্ধু চিৎকার করে উঠলো, “যদি পারতাম, মেরে ভূত ভাগিয়ে দিতাম এই ভূতের কথায় আমার মনে , সত্যিই তো, ভূতেদের আচরণ সব অদ্ভুত, কিম্ভুত কিমাকার একবার ঘাড়ে চেপে বসলে আর রক্ষে নেই মার ছাড়া ভূত ভাগানো অসম্ভব এই আলোচনা ক্রমশঃ গম্ভীর আকার ধারণ করছে দেখে বললাম, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে কি লাভ ? আর বিশেষ করে এই দাদাদের শায়েস্তা করার জন্য যতদিন না জনমত তৈরি করা যাচ্ছে আর জনবল সঙ্গে থাকছে ততদিন বৃথাই এই আস্ফালন আইন কানুন বলে তো কিছু নাই, যারা আইনের রক্ষক, তারাই তো এই সব দাদাদের, এই সব সমাজ বিরোধীদের রক্ষা করে চলেছে কথায় বলে, সরষের মধ্যে ভূত যে সর্ষে ভূত ভাগাবার কাজে লাগে, সে সর্ষের মধ্যেই যদি ভূত বাসা বাঁধে, তাহলে ভূতকে ভাগায় কার বাপের সাধ্য তাই এই প্রসঙ্গে ইতি টেনে আমরা যে যার বাড়ী ফিরে গেলাম

            বাড়ী ফিরে প্রতিদিনের মত খাতা কলম নিয়ে বসলাম কিছু লেখার জন্য, যদি নতুন কোন প্লট পাই আমি আগেও দুএকবার বলেছি যে আগে থেকে কোন প্লট ভেবে নিয়ে আমার কোন দিনই লেখার অভ্যেস নেই খাতার সামনে কলম খুলে খাতার উপর হিজিবিজি কাটতে কাটতে হঠাতই কোন না কোন বিষয়বস্তু পেয়েই যাই আজকেও ঠিক তেমন ভাবেই একটা প্লট আমার মাথায় উদয় কিছুক্ষণ আগের বন্ধুদের মধ্যে আলোচনার বিষয় বস্তুর দুটো কথা আমার মগজে হিট করলোভূত ভাগানো আর সর্ষের মধ্যে ভূত সত্যিই তো শুধু ভূত ভাগানোর কাজেই কি সর্ষের দরকার হয় ? গুনীজন, মহাজন, মহান মহাপুরুষদের যেমন অনেক মাহাত্ম, যেমন নাম মাহাত্ম, স্থান মাহাত্ম, আরও অনেক অনেক মাহাত্ম, তেমনি সর্ষেরও কি কম মাহাত্ম ?

            ঝোলে, ঝালে, অম্বলে, ফোড়নে সর্ষে অপরিহার্য সর্ষে ছাড়া গতি নাই, যত মশলা পাতিই থাক না কেন, রান্না ঘরকে সর্ষেহীন করে রাখা, নৈব, নৈব বেশ মনে পড়ে একদিনের কথা মিত্তির মশাই শহরে গেছলেন ফেরার পথে বাজারে খুব বড় একটা ইলিশ মাছ কিনে ঝোলাতে ঝোলাতে বাড়ী এসে ডাক পাড়লেন, “এই দেখো কি নিয়ে এসেছি গিন্নি এসে সামনে দাঁড়াতেই মিত্তির মশায় বলে ওঠেন, “সস্তায় পেয়ে গেলাম, আমি মাছটা কেটে কুটে দিচ্ছি, তুমি সর্ষে ইলিশ বানাও জম্পেশ করে খাওয়া যাবে মিত্তির গিন্নি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “বলি তোমার কি ভীমরতি ধরেছে, নাকি উন্মাদ হয়ে গেছো ? বেলা দুটো বাজে, সবে রান্না বান্না শেষ করে মাথায় দুমগ জল ঢেলে এসেছি, এখন আবার সর্ষে বাঁটতে বসবো তোমার সর্ষে ইলিশ বানাবো বলে? আমি আর এত ঝামেলা করতে পারি না তার চেয়ে মাছটা কেটে ধুয়ে দাও, ভেজে রেখে দিচ্ছি, কাল সর্ষে বাঁটা আর ঝিঙে দিয়ে ঝোল বানিয়ে দেবো ফ্রিজ তো নেই যে মাছটা তুলে রাখবো মিত্তির মশাই গিন্নির মুড বুঝতে পেরে আর কিছু উচ্চ বাচ্য না করে ইলিশ কাটতে বসে যান

            পরদিন সকালে থলি হাতে গুটি গুটি পায় বাজারের দিকে যাচ্ছি, হঠাৎ রাস্তায় গাঙ্গুলি বাবুর ছেলের সাথে দেখা আমায় দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছেন কাকাবাবু, কাকীমা ভালো আছেন তো” ? আমি বললাম, “হ্যাঁ, সবাই ভালো আছি আমরা তা তুমি এই সাত সকালে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছিলে” ? সে লজ্জা লজ্জা মুখে বলে, “আপনি শুনেছেন নিশ্চয়, আমাদের একটি ছেলের জন্ম হয়েছে মাস দুয়েক এই দেখুন না হাতের এই থলিতে সর্ষে আছে মা বলল, যা সর্ষে দিয়ে একটা বালিশ বানিয়ে নিয়ে আয় সর্ষের বালিশে ছোট বাচ্চার মাথা না রাখলে নাকি মাথার সেপ খারাপ হয়ে যায় মা বলেছে বালিশের অর্ডার টা দিয়ে তুই কলুর বাড়ীতে গিয়ে এক লিটার ঘানির খাঁটি সর্ষের তেল নিয়ে আসবি আমি বললাম, অত ঝামেলায় কি দরকার, রামদেব বাবার পতঞ্জলির কাচ্চি ঘানির তেল নিয়ে আসছি, তাহলেই তো মা বলল, না, তাহলেই না, ওই সব সর্ষের তেল দিয়ে আমি বাচ্চার শরীর মালিশ করবো না তোকে যা বলেছি, তাই কর অগত্যা তাই করার জন্য বেরিয়েছি আসি কাকু, আবার পরে দেখা বে এরপর বাজারে গিয়ে হাজির লাম একটু দেরীই হয়ে গেল গাঙ্গুলি বাবুর ছেলের সাথে কথা বলতে গিয়ে শাকসব্জি কেনা কাটা শেষ করে মাছের বাজারে ঢুকলাম মাছের বাজারে সারি সারি মাছের দোকান দোকানিরা সব উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করছে, মানে মাছের প্রশস্তি গাইছে চিৎকারে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম কোথাও বেশী চিৎকার চেঁচামেচি লে লোকে বলে যেন মাছের বাজার ইচ্ছে ছিল রুই মাছ কেনার কিন্তু দাম শুনে চোখে সর্ষে ফুল দেখার জোগাড় মাছওয়ালা বলল, “ কাকু, রুই মাছ তো রোজ খাচ্ছেন আজ এই চারাপোনাটা নিয়ে যান আহা, সর্ষে বাঁটা দিয়ে যা জমবে না কাকু কি আর করি, চারা পোনাই কিনে আনলাম সত্যি, সর্ষে বাঁটা দিয়ে যা জমেছিল না, অনেক দিন সে স্বাদ ভোলার নয়  

            ছেলেবেলায় খুব দুরন্ত না লেও কম বয়সের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির কারণে একটু বেশীই দৌড়ঝাঁপ, লাফালাফি করতামই খেলাধুলোর মধ্যে ফুটবল খেলা আমার বেশী পছন্দ ছিল একবার গ্রামের আম বাগানে আমাদের পাড়ার সাথে ব্রাহ্মন পাড়ার ফুটবল প্রতিযোগিতা চলছিল খেলা শেষের হুইসেল বাজার কয়েক মিনিট আগে ধাক্কা ধাক্কিতে পড়ে গিয়ে ডান পাটা মচকে গেল সে কী যন্ত্রণা, হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল পাড়ার বন্ধুরা প্রায় কাঁধে উঠিয়ে বাড়ি নিয়ে এলো বাড়ী ফিরতে আমার অবস্থা দেখে মায়ের সে কী অবস্থা বাড়ীর বাকীরা আমাকে তখন ঘিরে ধরেছে ওই ব্যথা যন্ত্রণার কাতরানির মধ্যেও নিজেকে কেমন ভি আই পি মনে হচ্ছিল আমার দাদু ডাক্তার ছিলেন, আশপাশের গ্রামের মধ্যে আমার দাদুই একমাত্র ডাক্তার আমার দাদা দাদুর কাছ থেকে ওষুধ এনে আমাকে খাইয়ে দিল কিন্তু যন্ত্রণা এমন আকার ধারণ করল যে আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না মা তো সেই বাড়ী আসার পর থেকে ঠায় বসে রাত্রি প্রায় আটটার সময় আমার জেঠিমা এসে বলে সর তো তোরা একটু দেখি তারপর জেঠিমা একটা বাটিতে গরম সর্ষে তেল এনে ভালো করে আমার মচকে যাওয়া পায়ের উপর লাগিয়ে দিয়ে তার উপর গুঁড়ো ধুনো ভালো করে ছড়িয়ে দিয়ে একটা সাদা কাপড় কে ব্যান্ডেজ বাঁধার মত করে বেঁধে দিল তারপর জেঠিমার মাথায় হাত বুলনোর মধ্যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি ভোরবেলায় ঘুম ভেঙ্গে দেখি, পায়ের ব্যথা অনেক কমে গেছে এইভাবেই সর্ষের তেল আর ধুনোর আশীর্বাদে পা টা আমার সম্পূর্ণ সেরে গেল

            সর্দি কাশির ধাত আমার বরাবরের এখনও এত বছর পরেও সর্দি কাশি আমার সঙ্গ ছাড়েনি বা বলতে গেলে পিছন ছাড়েনি আমার বয়স এবং এই সর্দি কাশির বয়স প্রায় সমান সমান ছোটবেলায় দেখতাম, সর্দি কাশি লে বা বুকে কফ জমে গিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট লে মা বা জেঠিমা একটা বাটিতে অনেকটা সর্ষের তেলের মধ্যে রসুনের কোয়া আর মাসকলাই (কালো বিউলি) ফেলে সেটাকে ভালো করে ফুটিয়ে ওই তেলটা আমার বুকে মালিশ করে দিতেন আশ্চর্যের ব্যপার, এতেই আমি সুস্থ হয়ে উঠতাম এখন আর ঐভাবে তেল মালিশ হয় না এখন তো আর মা জেঠিমা নেই সর্দি কাশি হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন,  বাড়াবাড়ি লে হাসপাতালের চক্করএন্টিবায়োটিকে না লে স্টেরয়েড, তারপর ছাড়া পেয়ে আবার পরের বারের জন্য অপেক্ষা জানি এই রোগটার থেকে আমার রেহাই নেই কথায় বলে শরীর ব্যাধির মন্দির ঠিক কথাই আমাদের দেশে অজস্র মন্দির আছে যার মধ্যে বিভিন্ন দেব দেবীর অধিষ্ঠান, তেমনি মানুষের শরীর রূপী মন্দিরে বিভিন্ন প্রকার রোগের অবস্থান পার্থক্য শুধুমাত্র এই যে মন্দিরের দেব দেবীদের ভক্তি ভরে পূজা করা হয় এবং তাঁদের রক্ষা করা হর শরীর মন্দির থেকে রোগ জ্বালা ব্যাধিকে তাড়াতে পারলেই যেন বাঁচি

            ভোজন রসিক বা খাদ্য বিলাসী আমি কোনদিনই ছিলাম না আমি কোন কালেই খুব বেশী পরিমাণ খাবার খেতে পারি না পরিমিত খাবার খাওয়াই আমার অভ্যেস কিন্তু আমার মায়ের মনের ইচ্ছে থাকতো সব সময় আমাকে অনেক রকম খাবার বানিয়ে খাওয়াতে তাই বেশ বড় কাঁসার থালায় অনেক রকম পদ সাজিয়ে আমাকে খেতে দিতেন একদিন দেখি, ভাতের পাতে কি একরকম খাবার সাজান আছে বাকী তরি তরকারির সাথে কি জিনিষ ওটা জানতে চাইলে মা বললেনএটা সর্ষের পাত পোড়া আমি অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, “সর্ষেটা কে একটু মোটা করে বেঁটে তার মধ্যে রসুনের কোয়াগুলোকে টুকরো টুকরো করে মিশিয়ে শালপাতায় মুড়ে উনুনের কাঠ কয়লার আগুন নীচে রেখে তার উপর মোড়া শালপাতা রেখে আবার উপরেও আগুন চাপিয়ে মিনিট দশেক রাখতে হয় তারপর খাবার সময় ওই মোড়কের থেকে খুলে ভাতের সাথে খাওয়া কী অপূর্ব খাবার চাকরির খাতিরে বাইরে থাকতাম, কিন্তু যখনই বাড়ী আসতাম এই সর্ষের পাত পোড়া আমার খাদ্য তালিকায় থাকতোই মা এই সর্ষে বাঁটার সাথে আবার মাঝে মাঝে পস্তু বাঁটাও মিলিয়ে দিতেন সর্ষে শাকের সাথে পালং শাক মিলিয়ে আদা বাঁটা, টমেটো কুচি ইত্যাদি নানা মশলা দিয়ে এমন উপাদেয় একটা খাবার তৈরি হত বাড়ীতে, যা এখন দুর্লভ আমার মেয়ে তো আবার অদ্ভুত একটা জিনিষ বানায় সর্ষে দিয়ে গোটা সর্ষে কে বোতলের মধ্যে ভরে সামান্য জল দিয়ে একটা ভেজা কাপড় বোতলের মুখে বেঁধে দিলে দুতিন দিনে অঙ্কুর বেরিয়ে যায় ওই অঙ্কুরিত সর্ষে সালাদের সাথে মিশিয়ে খেতে অদ্ভুত ভালো লাগে, একটু কাসুন্দির স্বাদ আর গন্ধও পাওয়া যায় দুপুরের খাবার আগে পুকুর পাড়ে বসে সমবেত সর্ষের তেল মর্দন কোথায় হারিয়ে গেছে আর রাত্রে নাকে সর্ষের তেল দিয়ে নাসিকা গর্জন সহকারে নিদ্রা, কী সুখই না ছিল সেই দিনগুলোতে

            সত্যি সর্ষে, কি মহিমা তোমার আগেই বলেছি ঝোলে, ঝালে, অম্বলে, ফোড়নে তুমি অদ্বিতীয় ছিলে, আছো এবং থাকবে তাছাড়া, তুমি কিসে নেই, কোথায় নেই ? তুমি সর্বত্র বিরাজমান, তুমি সর্ব ঘটে বিল্বপত্র, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো তোমার মহিমা অপার তুমি মহান, অসীম তোমার মাহাত্ম