গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

হারকিউলিসের ক্ষোভ



 সময়ঃ ১৯৭১, অশান্ত কোলকাতার কোন এক দিন ।
স্থানঃ রাজপথ ।

অসহায় গিরগিটির জান্তব অমসৃণ লেজের মতো হাজার মানুষের সুদীর্ঘ মিছিলটার পাশ দিয়ে ওরা দু’জনে হাঁটছিল। ওরা একই সঙ্গে কলেজে পড়ে, একই সঙ্গে কফি হাউজে আড্ডা দেয়। অনুরূপের হাতে চার্মিনার সিগারেট – অসহ্য বিরক্তি ডিম পাড়ছিল তার কথায় – ‘কল্লোলিনী কলকাতা আজ মিছিল নগরী – হায় জীবনানন্দ!’
মেয়েটি প্রতিবাদ করলো – ‘মানুষের এই পথে বেরিয়ে পড়া সেও তো জীবনেরই সন্ধানে।’ অনুরূপের কিছু উত্তর দেয়ার ছিল না। হাটতে হাটতে মেয়েটা একবার তাকালো সামনের সিনেমা পোষ্টারের দিকে, একবার তাকালো ছেলেটার বলিষ্ঠ চেহারাটার দিকে।
শূন্যময়তায় ভর করে বেরিয়ে এল মেয়েটার কথাগুলো – ‘সত্যি অনুরূপ, বুঝে উঠতে পারি না কোনটা জীবন, এ যেন একটা ধাঁধা!’
ওরা এমনি ভাবেই দিনের পর দিন পথ হাঁটে আলোয় অন্ধকারে, আশা নিরাশার অরণ্য সংকুলতায় ওরা পথ হারায় – তবুও ওদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ বেড়িয়ে পড়তে চায়, সময়ের রেলিং ধরে দাঁড়াতে চায় সময়ের মুখোমুখি।


সময়ঃ  আরো এক দিনের ভয়ার্ত সন্ধ্যা ।
স্থানঃ  জনবিরল রাস্তা ।

লোডশেডিং। তবু পূর্ণিমার চাঁদ ঝুলে ছিল বিধবার মতো। এতক্ষণে স্বাস্থ্যবান লম্বা লোকটাকে দেখা গেল, কাঁধে ঝোলা। ইতস্ততঃ করলো শ্যামলী – খবরটা দেয়া উচিত কিনা?
‘শুনুন’ ,  শ্যামলী ডাকলো – ‘আপনাদের বাড়ী সার্চ হচ্ছে, আপনি ওদিকে যাবেন না।’
অকৃত্রিম হাসলো দিগন্ত চৌধুরী – ‘ধন্যবাদ, আমিও এইমাত্রই খবরটা পেয়েছি।’
দিগন্তকে আরও চিন্তিত দেখালো এই মুহূর্তে। ‘একটা কাজ করবে? জানি তুমি পারবে।’ কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই ব্যাগ থেকে একটা ভারী মোড়ক আর কাগজে মোড়া কতগুলো বই বের করে শ্যামলীর হাতে দিতে দিতে সে বললো –‘তোমার কাছে রেখে দাও – পারলে পরে এই ঠিকানায় পৌঁছে দিও – কিন্তু সাবাধান।’
‘এ সমস্ত করেও আপনারা কি কিছু করতে পারবেন?’ – শ্যামলী রৌদ্রময় প্রশ্ন ছোড়ে দিগন্ত চৌধুরীকে।
‘কিছু না পারি, অন্ততঃ ভাবতে তো পারবো, আমরা কৈফয়েৎ চাইবার চেষ্টা করেছি সামাজিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে।’
অদৃশ্য হয়ে যায় দিগন্ত। পাশের রাস্তা দিয়ে পরপর চলে যায় দুটো পুলিশ ভ্যান।


সময়ঃ  অস্থিরতাময় ক্লান্ত রাত এগারোটা 
স্থানঃ  জেলের উঠোন ।

উড়ো ঝামেলায় এ ভাবে জড়ানোর হয়তো কোনো মানেই ছিল না। আপত্তিকর বইপত্র ও পিস্তলসহ সেদিনই শ্যামলী ধরা পড়ে গেছে। আজ ঠিক ঠিক টিকিট কেটে হয়তো অনুরূপ তার জন্যে অপেক্ষা করেছিল একাডেমীতে। কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল!
চারদিকে কড়া পাহারা। হঠাৎ শ্যামলী দেখলো আরও একজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে আসছে। হয়তো ওদেরই দলের কেউ না কেউ হবে। প্রথমটায় একটুও করুণা হলো না শ্যামলীর, বরং চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো – ‘বোগাস্ আপনারা। বোগাস্ আপনাদের বিপ্লবী বুলি!’
একটু পরেই দুখঃ ও সহানুভূতিতে দপদপ করতে লাগলো তার ভেতরটা – যেন একটা জ্বলন্ত দীপশিখা !
মানুষটা এবার স্পষ্টতর হলো নৈকট্যে। চমকে উঠলো শ্যামলী। মুখ দিয়ে তার গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, তবুও চোখ দুটো তার উজ্জ্বলতায় ভাস্বর।
লোকটাকে দেখিয়ে পুলিশ অফিসার জিজ্ঞাসা করলো শ্যামলীকে – ‘ দেখুন তো, একে চিনতে পারেন কিনা? আই মিন, এ লোকটা দিগন্ত চৌধুরী কিনা?  একে সনাক্ত করা আমাদের ভীষণ দরকার – আর এই সনাক্ত করতে পারার পেছনেই আপনার ছাড়া পাওয়া নির্ভর করছে।’
শ্যামলী চোখ তুললো, তাকালো একবার মানুষটার দিকে – অবশেষে স্পষ্ট উত্তর দিল –‘না, চিনি না’ !
যেন এই মানুষদুটো কেউ কাউকে চেনে না – কোনও দিনও না, কোন ও দিন ও না । অথচ .......
অর্ডার এলো বড়বাবুর - ‘ইসকো উয়োমেন সেল পর লে যাও।’
নুয়ে-পড়া হারকিউলিসের কাঁধে একটা আস্ত পৃথিবীর ভার। অ্যাটলাসের থেকে যে পৃথিবীটার ভার সে কাঁধে তুলে নিয়েছে, তারই উপর অন্যায় ভাবে চলছে কিছু সৌখীন মানুষের উল্লাস – হাসাহাসি – নাচানাচি, যেন পৃথিবীটা তাদের একার।
তাই কখনো কখনো দুনিয়ার হারকিউলিসেরা ক্ষেপে ওঠে – কেন তারা পৃথিবীর অন্যায়ের বোঝা একা বইবে? কাদের স্বার্থে?
উয়োমেন সেলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে এই মুহূর্তে আরও গভীরতর ভাবে শ্যামলীর মনে হতে লাগলো দিগন্ত চৌধুরীর রক্তাক্ত চেহারাটা যেন দিক দিগন্তে খেত খামারে গর্জে ওঠা অসংখ্য হারকিউলিসদের মাঝে আরও একটা হারকিউলিয়ান গর্জন, আরও একটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ!