গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০২০

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

ছোটোবিবি


বুড়ো বরের কাণ্ডখানা চোখ বড়বড় করে দেখছে আফরোজা। ফুল আর আতরের গন্ধে ম-ম করছে বদ্ধ ঘরের বাতাস। ঘরে পা দিয়েই সেই গন্ধ আচমকা নাকে ঢুকতেই মাথা দপদপ করতে শুরু করেছিল তার। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল আর মধ্যমা দিয়ে নিজের কপাল টিপে ধরে খাটে  বসতে গিয়েও ইতস্তত করছিল। তখনই তার বুড়ো বরতার দুই কাঁধে ঈষৎ চাপ দিয়ে তাকে খাটে বসিয়ে দিয়ে নিজে উবু হয়ে বসে পড়েছে তার পায়ের কাছে। আফরোজা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার পায়ের হাওয়াই চপ্পল-জোড়া খুলে নিয়ে খাটের তলায় রেখে সেখান থেকে পানি-ভর্তি গামলা টেনে এনেছে আফরোজার পায়ের নীচে। তারপর সেই গামলা থেকে আঁজলা-ভর্তি পানি তুলে আফরোজার পায়ের পাতা দুটি সযতনে ধুতে লেগেছে। হতভম্ব আফরোজা ‘করেন কি, করেন কি’ বলতে বলতে নিজের পা খাটের উপর তোলার চেষ্টা করতেই সে সটান সেগুলিকে টেনে নামিয়ে গামলার পানিতে চুবিয়েছে। হুমড়ি খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল আফরোজা, কোনোক্রমে খাটের ছত্রি ধরে সামলেছে।
একে বুড়ো, তায় আবার ঢিলে তার! আচমকা আফসোস হতে থাকে আফরোজার। এ-বিয়ে কবুল না করলেই হত! তার মতো ত্যাঁদড় মেয়েও এমন ভুলটা করে বসল! কিছুই তো বোঝা যায়নি আগে। গতকাল মৌলবি আর মুসলিম রেজিস্ট্রারের সাক্ষাতে শাদি কবুল হল, দেনমোহর স্বীকার করে নিকাহনামায় আর রেজিস্ট্রারের খাতায় সইসাবুদ-টিপছাপ হল। বুড়োর কাঁচাপাকা দাড়ি-ভর্তি প্রসন্ন বদন দেখে কে আন্দাজ করবে যে তার মাথার তারগুলোই ঢিলে! আব্বু না হয় বুড়োর কাছে মোটা টাকা খেয়েছে, কিন্তু সে তো আব্বু-আম্মা আর তাদের আরও পাঁচটা সন্তানের খাতিরে নিজেকে এই পঞ্চাশ বছরের বুড়োটার কাছে নিজেকে কুরবানি দেওয়ার জন্যে তার চার নম্বর বিবি হতেরাজি হয়নি। তার রাজি হওয়ার পিছনে একটা পরিষ্কার হিসেব ছিল। তবে সেই হিসাবের মধ্যে লোকটার মাথার গণ্ডগোলটা ধরা হয়নি। তেমন কোনো খবরই যে ছিল না। এখন দেখা যাক ঠিক কী ধরনের দড়ি পাকানো আছে বুড়োর মাথায়? খাটের উপর পা তুলে আরাম করে বসল আফরোজা।
হাজি মইনুদ্দিন ততক্ষণে তার পা-ধোয়া পানি গামলা থেকে একটা বদনায় ভরেঘরময় ঘুরছে আর বদনার পানি হাতে ঢেলে চারদিকে ছিটোতে লেগেছে। হাসি পেয়ে গেল আফরোজার। এ তো দেখি হিন্দুদের ছুঁচিবাই মেয়েদের মতো অবস্থা! তারা যেমন করে গঙ্গাজল ছিটিয়ে সব শুদ্ধ করে তেমনই কাণ্ড না কি?



    আফরোজা তার আব্বু-আম্মার প্রথন সন্তান। তার বাকি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ছোটোটা এখনও আম্মার মাই চোষে। ইয়াসিন মণ্ডল যে শহরতলির বস্তিতে জন্মেও সরকারি অফিসের পিওনের কাজে বহাল হতে পেরেছিল সে কেবল তার ঠাণ্ডা, হিসেবি মাথার দৌলতে। নইলে পকেটমার বা বড়োজোর ওয়াগন-ব্রেকার হওয়াটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। আফরোজা সেদিক দিয়ে তার আব্বুরই মতো। আম্মার প্যানপ্যানে স্বভাব, কথায় কথায় চোখে পানি, একদমই সহ্য করতে পারে না সে। আব্বুর তৈরি করা শহরতলির বস্তিতে দু-কামরার পাকা বাড়িতে নিত্য-অভাব আর কুশ্রী পরিবেশে থাকতে থাকতে সে অল্প বয়স থেকেই সেয়ানা হয়ে উঠেছিল। আব্বুর দৌড় যে সরকারি অফিসের নিচুতলা আর বস্তির মক্তব-মসজিদ পর্যন্ত সেটা বুঝে নিতে দেরি হয়নি তার। তাই মক্তবের পাঠ শেষ হতেই সে নিজের জেদে কাছাকাছি একটা মেয়েদের হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল। তাকে সাহায্য করেছিল একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ইয়াসিন মণ্ডলের মনোবাসনা ছিল তার সমস্ত সামর্থ্য তার ছেলে দুটির পিছনে ব্যয় করার। মেয়েদের ধর্মকর্মের জন্য মক্তবের শিক্ষাই যথেষ্ট। তাদের বিয়েশাদির কথাটা কেবল মাথায় রাখলেই চলবে। এই নিয়ে বাবা-মেয়ের দ্বন্দ্ব খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একদিন গায়ে হাত তুলতে গিয়েই এগারো বছরের মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ইয়াসিন মণ্ডল বুঝে যায়, মেয়ে তার কর্তৃত্বের বাইরে চলে গেছে। তারপর কয়েক মাস একে অন্যের সংশ্রবহীন হয়ে থাকার পর ফের যখন তারা কাছাকাছি হল, তখন ইয়াসিন তার মেয়েকে সমীহ করতে শিখে গেছে। আফরোজা ততদিনে বস্তির বাচ্চাদের নিয়ে একটা সান্ধ্য স্কুল খুলে ফেলেছে। সেই বাচ্চারা চেয়েচিন্তেই হোক, বা চুরিচামারি করেই হোক,তাদের মাস্টারনির হাতে দু-দশ টাকা তুলে দেয় কখনোসখনো। তাতে আফরোজার নিজের খরচটুকু দিব্যি চলে যায়।
    আফরোজার যখন ক্লাস ইলেভেন, তখন একটা ছেলে তার পিছনে পড়ে গেল। ভদ্রলোকের লালটুস ছেলে। হেঁটেই স্কুলে যেত সে। যে গলি দিয়ে যেত সেই গলিতেই ছেলেটার বাড়ি। স্কুলে যাওয়ার পথে আসার পথে সে তার বাড়ির গেটের কাছে এসে দাঁড়াত আর সতৃষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। একমাস গেল, দু’মাস গেল, কিন্তু তার বেশি এগোনোর সাহস হল না ছোঁড়ার। হাসি পেত আফরোজার। বস্তির ছেলেদের হাবভাব খুব সোজাসাপটা। কেউ হয়ত সিটি বাজিয়ে চোখের ইশারা করল; কেউ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, -- হেভভি লাইক করি তোকে মাইরি, চল একদিন ঘুরতে যাই; অথবা বেপরোয়া মাস্তান সন্ধেবেলায় রাস্তার মধ্যেই বুকে থাবা বসিয়ে বলল, -- আই লাভ ইউ, মেরে জান। তের-চোদ্দ বছর বয়স থেকেই এসব ছুটকো-ছাটকা হামলা সামলাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে আফরোজা। সুবিধে করতে না পেরে বস্তির রোমিওরা এখন তার প্রতি উদাসীন হয়ে গেছে। কিন্তু এই বোবা-উপদ্রবটা সামলাবে কী করে ভেবে উঠতে পারছিল না সে।
    মাস ছয়েক কেটে যাওয়ার পরেও যখন ছোঁড়ার রুটিন বদলাল না, তখন আফরোজার মজা পাওয়ার অনুভবটা বদলে গেল বিরক্তিতে। ড্যাবড্যাবে দুটো করুণ চোখ স্বপ্নে এসে ঘুম নষ্ট করতে লাগল তার। একদিন আর না পেরে সটান গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়াল সে। তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, -- কী চাই?
--না তো – না তো – করে তোতলাতে লাগল ছোঁড়া। তার ফরসা মুখ, কান টকটকে লাল হয়ে গেল।
আফরোজা বলল, -- বাইরে এসো, কথা আছে।
গেটের বাইরে এসে সে খানিক স্বস্তি পেল মনে হল। আফরোজা বলল, -- আমাকে কি বিশেষ কিছু বলার আছে তোমার?
--কি বলি- কী বলি– কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?
আফরোজা বলল, -- ভ্যানতাড়া মেরো না। তোমার ধান্দাটা কী? আমার বুক চটকাতে চাও? না কি একেবারে লাঙল চালাবার ইচ্ছে?
--যাঃ! সেসব আবার কি –
--তাইলে সকাল-বিকেল, দিনের পর দিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকাটা কিসের জন্যে?
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল ছোঁড়া। সাহস করে আফরোজার চোখের দিকে একবার তাকাল। সেখানে ভরসা পাওয়ার মতো কিছু দেখল বোধ হয়, তারপরে বলল, -- ইয়ে – তোমার চোখ – আর চুল – খুবই বিউটিফুল, লাভলি –
--বিউটিফুল! লাভলি! আমার চোখ-চুল?
এমন অর্থহীন কথা কখনও শোনেনি আফরোজা। খুবই বিরক্ত হয়ে বলেছিল, -- তোমার কি কোনো কাজকম্ম নেই?
প্রশ্নটি শুনে অপ্রতিভ না হয়ে যেন চাগিয়ে উঠল ছোঁড়া। জড়তা ঝেড়ে ফেলে স্মার্ট ভঙ্গিতে জবাব দিল, -- আছে তো। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে এখন শরীরচর্চায় মন দিয়েছি। জিমে যাই। মডেলিং করার ইচ্ছে আছে। মাঝে মাঝে অবশ্যি ফ্যামিলি বিজনেসে বেগার খাটতে হয়।
--এসব কথা তোমার হবু শ্বশুরের জন্যে জমা করে রাখো। রোজ রোজ আমার দিকে বকের মতো চেয়ে থাকো কেন? এটা বন্ধ করতে হবে, আমার অসুবিধে হচ্ছে।
একটুক্ষণ ফ্যালফ্যালে চোখে চেয়ে থেকেই অদ্ভুত এক কাণ্ড করে ফেলল ছোঁড়া। আফরোজার কাছে এগিয়ে এসে খপ করে ধরে ফেলল তার হাত দুটো, কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, -- মরে যাবো তাইলে – সত্যি বলছি!
এই প্যানপ্যানানি দু-চোখের বিষ আফরোজার। তবে কাছ থেকে দেখে মালুম হল, চমৎকার চেহারা ছোঁড়াটার। বেশ লম্বা, পেটানো শরীর, মুখের গঠনেও টান আছে এক ধরনের। দ্রুত হিসাবে মন দিল সে। এর সঙ্গে প্রেম করে লাভ নেই। তাকে বিয়ে করতে হলে যে ঝঞ্ঝাট হবে সেটার মোকাবিলা করার সাহস কোনোদিনই হবে না এই প্যানপ্যানে ছোঁড়ার। কিন্তু একে হাতে রাখা দরকার। চেহারাও কিছু ফেলনা জিনিস নয়, কখনও না কখনও কাজে লেগেও যেতে পারে তার।
    আলতো করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল আফরোজা। তারপর বলল, -- ঠিক আছে। মরে কাজ নেই, বাঁচার সুযোগ একটা করে দিচ্ছি। সপ্তাহে এক দিন, রবিবার – বিকেল চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ইস্কুলের পেছনের পার্কে একটা বেঞ্চে এসে বসে থাকব। তুমি তার উলটো দিকের বেঞ্চে বসে আমার চোখের দিকেই হোক বা চুলের দিকেই হোক – প্রাণভরে তাকিয়ে নেবে। কিন্তু কথা বলার কোনো চেষ্টা করবে না। আর কাল থেকে এই গেটের সামনে যেন আর না দেখি।
    অনেকখানি ঘাড় হেলিয়ে চুক্তিতে সায় দিল ছোঁড়া আর আফরোজা বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে বহুক্ষণ নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মইনুদ্দিন সাহেব সারা ঘরে মালকিনের পা-ধোয়া পানি ছিটিয়ে ঘরটিতে ছোটো বিবির অধিকার কায়েম করেই খাটের পাশেই উজু সেরে নিয়ে দোয়া করতে বসলেন, -- হে আল্লা! আমার প্রতি প্রেমে পরিপূর্ণ করে দাও ছোটোবিবিকে; সে আমাকে পূর্ণ তৃপ্তিতে গ্রহণ করুক; সর্বশ্রেষ্ঠ মিলনে আমাদের দুই আত্মা এক হোক।
    দোয়া শেষ করে বাসরঘরের খাটে উঠে আফরোজার মুখোমুখি বসলেন তিনি। তার কপালে হাত রেখে দ্বিতীয় বার আল্লার দোয়া মাঙলেন, -- হে আল্লা! তোমার আমানত হিসাবে আমি একে গ্রহণ করেছি। তোমার আদেশ মোতাবেকই এই ছুটকি আমার বিধিসম্মত বিবি, এরই মাধ্যমে তুমি আমাকে সুসন্তান দাও।
    প্রার্থনা শেষ করে পরিতৃপ্ত মুখে একটা পাশবালিশ টেনে নিয়ে তাতে হেলান দিলেন মইনুদ্দিন সাহেব। ঠোঁটে হাসি টেনে আফরোজার হাতে হাত রাখলেন। আফরোজার বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। বিড়বিড় করে অচেনা শব্দে কীসব প্রার্থনা করছিল তার বুড়ো বর, সেসব তার মাথায় ঢোকেনি। সে জিজ্ঞেস করল, -- এইগুলা সব কী করলেন আপনি?
মইনুদ্দিন সাহেব বললেন, -- পবিত্র কোরান হাদিসে বলা আছে, বাসররাতে এইভাবে আল্লার দোয়া মাঙতে হয়। তাইলে বরবধূর মধ্যে ভালোবাসা হয়, সুসন্তানের জন্ম দিতে পারে তারা।
আফরোজা বলল, -- আমার তিন বড়ো বুবুর বাসরঘরে এইগুলা করেন নাই আপনি?
--করবো না কেন?শুনো ছোটোবিবি – ইসলামে আছে, একজন সাচ্চা মুসলমান চারটা পর্যন্ত বিয়া তখনই করতে পারে যদি সে চার বিবিকেই সমান ভালবাসতে পারে।
--আপনি আমার তিন বুবুকেই সমান ভালবাসেন তো?
--নিশ্চয়। ওদের সাথে তুমার কথা হয় নাই? কেউ কিছু বলে নাই তুমাকে? বড়োবিবির কাছে একটা খাতা আছে দেখবে। সেখেনে রুটিন করা আছে কুন কুন দিন আমি কুন কুন বিবির ঘরে রাতে থাকব। আজ থিকা তুমার নামও ওই খাতায় উঠে গেল। তুমাকেও আমি সমান ভালবাসব।
মনে মনে খুব একচোট হেসে নিল আফরোজা। তারপর বলল, -- কিন্তু ভালবাসার ভাগটা তিন থেকে চার হয়ে গেলে পরিমাণ কমে গেল না!
--মশকরা কইরো না ছুটো, এইগুলা মশকরার বিষয় নয়। আল্লা ইমানদার মানুষকে অগাধ ভালবাসার দিল দেছেন, শত ভাগেও তার পরিমাণ কমে না।
আফরোজা মুখের হাসি মুছে নিয়ে বলল, -- আপনের এতখানি আর্জির পরেও আল্লা তো কাউকেই, সুসন্তান দূরের কথা – কোনো সন্তানই যে দিলেন না।
মইনুদ্দিন বললেন, -- আল্লার মর্জি বোঝা দায়। সেই জন্যেই তো তুমাকে নিকাহ করে ঘরে আনতে হল ছোটোবিবি।
আফরোজা বলল, -- ভাগ্যিস!
মইনুদ্দিন বললেন, -- এইবারে আল্লা নিশ্চয়ই আর্জি মঞ্জুর করবেন।
আফরোজা বলল, -- আমারও তাই মনে হয়।

মইনুদ্দিন সাহেবের অগাধ সম্পত্তি। এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে পুরনো দিনের জমিদার বাড়ির মতো বিশাল এলাকা নিয়ে উঁচু প্রাচীর-ঘেরা বাড়ি। ভূসম্পত্তি-চাষবাস ছাড়াও দীর্ঘদিনের ঝুঁকিহীন পারিবারিক ব্যাবসা। বাড়িতে ঝি-চাকর থেকে শুরু করে অঢেল কর্মচারী। আব্বুর এক বন্ধু যখন তার বড় মেয়ের জন্যে মইনুদ্দিন সাহেবের চার নম্বর বিবি হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে এসেছিল, আব্বুও রাজি হয়নি প্রথমটায়। তারপর লোভনীয় দেনমোহর ছাড়াও সম্ভবত আব্বুর জন্যেও কোনো বিশেষ পারিতোষিকের প্রতিশ্রুতি পাবার পর আব্বু খুবই ভয়ে ভয়ে আফরোজার কাছে প্রস্তাবটি পেশ করেছিল। আফরোজা তখন কলেজে, ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। প্রস্তাব শুনে প্রতিক্রিয়াহীন তার মুখের দিকে তাকিয়ে খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিল আব্বু। সে জানত আফরোজার সেই নির্লিপ্ত ভঙ্গির তাৎপর্য। অর্থাৎ, তাকে রাজি করানো আল্লারও সাধ্যাতীত। কিন্তু তার বন্ধুটির মুখে হাজি মইনুদ্দিন আলির অবস্থার বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে আগ্রহের আভাস দেখা গেল তার মুখে। আসলে আফরোজা তখন তার ক্ষুদ্র, নীচ গণ্ডি থেকে মুক্তির গন্ধ পাচ্ছিল। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যে সে নিজে সরেজমিন তদন্ত করবে সেই শর্ত আরোপ করেছিল। শর্তানুযায়ী মইনুদ্দিন সাহেব নিজের গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাকে। আফরোজা একটা গোটা দিন তার হবু সতীনদের সঙ্গে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এসে বিয়েতে তার মত দিয়েছিল। তার আগে পর্যন্ত চুপচাপই ছিল আম্মা। কিন্তু আফরোজা বিয়েতে মত দিতেই ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না জুড়ে দিল, -- শিক্ষিত মাইয়া তিন-তিনখানা সতীন-কাঁটা নিয়া ঘর করবে কেমনে!
আফরোজা ধমক দিয়ে তাকে থামায়, -- ন্যাকামো রাখো তো! তোমার তো সতীন নাই। তাতে কোন সুখে গড়াগড়ি খাচ্ছো?
    তার সেই তিনখানা সতীন-কাঁটাকে চৌরস করতে তিন মাসের বেশি লাগল না আফরোজার। তাদের নিজেদের মধ্যে মন-কষাকষি, ঝগড়াঝাঁটি ভালোমতোই ছিল। আফরোজার মধ্যস্থতায় তাদের ভালোই সমঝোতা হয়ে গেল। সে তার তিন বুবুরই প্রিয়পাত্রী বনে গেল। তিন বুবুই বেশ সুশ্রী। মইনুদ্দিন সাহেবের রুচির প্রশংসা না করে উপায় নেই। বাচ্চা না হওয়ায় তিনজনেরই শরীর-স্বাস্থ্য অটুট। বড়ো বিবির বয়স চল্লিশের কোঠায় হলেও ঋতুচক্র চালু আছে এখনও। তিনিই প্রথম পোয়াতি হলেন। পরের মাসেই মেজোবিবি, তার পরের মাসেই সেজো। সবশেষে ছোটোবিবি আফরোজা স্বয়ং।
   
বিবিঘরের হাজিরা খাতা অনুযায়ী আজ ছোটোবিবির ঘরে ডিউটি পড়েছে মইনুদ্দিন সাহেবের। আফরোজার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর এখনও পাননি তিনি। মিলনরাতের জন্য নির্দিষ্ট বিবিঘরে হেকিম সাহেবের ব্যবস্থাপনায় তৈরি বিশেষ সুগন্ধি মশলা-সমন্বিত দু-খিলি পান রাখা থাকে। মইনুদ্দিন সাহেব বিছানায় বসে প্রথমেই নিজের হাতে এক খিলি পান খাইয়ে দেন বিবিকে। অন্যটি নিজে মুখে দেন। আজ আফরোজার ঘরে ঢুকে নির্দিষ্ট জায়গায় খিলি দুটি দেখতে পেলেন না তিনি। ইতিউতি চাইছেন, আফরোজা তার হাত দুটি ধরে মৃদু টানে বিছানায় নিয়ে এল তাঁকে। তারপর হাতের মুঠো খুলে নিজের অঙ্গুষ্ঠ ও মধ্যমা সহ একটি খিলি তাঁর দুই ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিয়েই মইনুদ্দিন সাহেবকে হতবাক করে তাঁর কোলের উপর উঠে বসল। তাঁর কানে নিজের ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল, -- চার বিবিকে সমান ভালবাসার পরীক্ষায় আল্লা আপনাকে সসম্মানে উতরে দিয়েছেন হাজিসাহেব। আমিও মা হতে চলেছি।
আহ্লাদিত হাজিসাহেব ভেবেচিন্তে বললেন, -- চার বিবির বাসরঘরে আমি তো একইরকম ভাবে আল্লার দোয়া মেঙেছিলাম ছোটোবিবি। তা-ও আল্লা এতদিন আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করেননি। নিশ্চয়ই নিক্তি পরিমাণ হলেও গলদ ছিল আমার ভালবাসার ভাগে।
আফরোজা হাজিসাহেবের দাড়ির মধ্যে মুখ লুকোতে লুকোতে বলল, -- আপনার হিসাবে কোনো গলদ নাই মিঞাসাহেব, তবে আল্লার চেয়ে বড়ো কাজী তো আর কেউ নেই এই দিনদুনিয়ায়। কোথাকার গলদ কোথায় নিয়ে গিয়ে তিনি মেরামত করেন কে বলতে পারে!
হাজিসাহেব নরম স্বরে বলে ওঠেন, -- আলবাত আলবাত –
আফরোজা বলে, -- আপনারে চুপিসারে কই মিঞাসাহেব, আমার যে এই চোখ আর চুল দেখছেন, এর মধ্যেই আল্লা সব হিসেব চুকিয়ে দিয়েছেন।
অবাক হয়ে কেমন যেন ঘোর লাগা চোখে তাঁর ছোটোবিবির চোখ-চুলের দিকে তাকিয়ে রইলেন হাজি মইনুদ্দিন।