গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

খাতুনে জান্নাত

অরুণাভা

ধীরে ধীরে নীল রঙ হারিয়ে কমলা-ধূসর তুলির টানে ছেয়ে গেছে আকাশ পট মার্বেলের মতো গড়াতে গড়াতে সূর্যটা মেঘের নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় উদ্যান মধ্যস্ত রাস্তা দিয়ে হাঁটছে পারাপারের মানুষ বন্দুকের নালীর মত সবার চোখ তার দিকেই তাক করা গোধূলি -সন্ধ্যার উদ্যান ভালো নয় রসায়নিক মেয়েরা নেমে পড়বে বানিজ্য পসারে লাইন ধরবে খদ্দের যারা একাকিত্বের ছুতো ধরে বিশ মিনিটের সঙ্গসুধা বনাম ইন্দ্রিয়সুধা লাভের দাবীতে সোচ্ছার এদের মধ্যে নাকি হাইজাকার, চিঁছকে চোর, মাদক, চোরাকারবারি অস্ত্রবহণকারীর সহযোগিরা বেশি থাকে

তরুলতা বসে আছে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের রাস্তা লাগোয়া একটা বেঞ্চে; উল্টা মুখ করে তার পরণে কালো গাঢ়-হালকা বটলগ্রিন ফুল লতাপাতার একটি জর্জেট শাড়ি মুখে আলতো মেকাপ চোখে কাজল, কালিজিরাসম একটি টিপ দুভ্রুর মাঝখানটায় ইতস্তত কাঁপছে কুঁচকে আছে ভ্রু মুখে অস্বস্তি মেশানো আবীর, চাতক মন আনত ত্রিকোণ মুখ তুলে পার্কের টিএসসি সংলগ্ন গেইটের দিকে বার বার তাকাচ্ছে জোড়া ভেঙে কপোত কপোতি উঠে যেতে থাকে গাঢ় ভয়ের লাল পিঁপড়ে কুটকুট করে কাটতে না কাটতেই সামনে বিস্মিত দুটি চোখ, মায়াময় খোলা হাসি, ঝলকে উঠা প্রাণ! দেখেই উঠে দাঁড়ায় তরু নিয়ন ধপাস করে বসে পড়ে উদ্যানের সিটে স্থির দৃষ্টিতে দেখছে তরুকে কথা যেন হারিয়ে গেছে চশমার কাছে জীবন দৃষ্টি, স্থির অচঞ্চল
-চল বলে ধাক্কা দেয় তরু
-তুমি - সুন্দর, চোখ আধো বুঁজে আসা কণ্ঠ এতদিন লুকিয়ে রাখলে! এতদিন! নিটোল!তোমার তো একেবারে শিল্পীর আঁকা ফিগার
-যা! কিযে বলে! এত দেরি হলো কেন সেটা বল?
-সময়ে ধরতে তো পেরেছি সময়! - এখন থেকে শুধু শাড়ি পড়বে শাড়ি এমন মিহীন, মানুষ এত মিষ্টি আমি সৌভাগ্যবান নানা থাক; ওই পর- সাদা ড্রেস, বড় সাদা লেসের ওড়না মাথা মুড়ানো
-কেন?
-হারিয়ে ফেলবো যে!
-পাগল!
-হয়ে যাব
-না পাগল হয়ো না পাগল কর, মাতাল কর, অবশ কর শূন্য থটে পৌঁছে যাই
-কেন এত ভালোবাসো বল তো? জানো না পৃথিবী কেমন! জান তো?
-জানি 'পৃথিবীর মানুষেরা দেখ কেমন হায়েনা ওরা যদি পারত তুলে নিত ফুলের সুগন্ধ, নদীর কলতান, চাঁদের হাসি
-'হা হা হা' পার্কের নির্জনতা ভেঙে খান খান তরুর মুখে নিজের চিঠির বাক্য কেমন মায়াবী বেদনার্ত পৃথিবী একটা গোখরো সাপ ফণা তুলে রাখে খেয়ে নিতে হৃদয়ের সব আয়োজন একসময় হাত ধরে হেঁটে যায় দুজন আজ তারা একসাথে থাকবে দীর্ঘ পার্ক, ফোন, কার্ড আর চিঠির জীবন থেকে আজ ঘরে মুখোমুখি আজ তারা ফুল হবে, ফুলের বুকের সুঘ্রাণ হবে আজ তারা পৃথিবীর কোলাহল থেকে দূরে, নির্জন, ভয়হীন পিঁপড়ে জীবন

দেখার বাইরে লেখার আবেশ ভেঙে প্রথম যেদিন দেখা- সবুজ চত্বর জুড়ে ছিল কলতান কেউ তাকাতে পারেনি কারো চোখে নিয়নের দৃষ্টি ঘাসের মূলরোম পরীক্ষারত আর তরু ঘাড় সোজা করে সামনে সামনে যেন বৃক্ষ নেই, মানুষ নেই, নেই চানাচুর-আমড়া-বাদামওয়ালারা শুধু ফুল আর তারায় তারায় খচিত দুটো মন এক হওয়ার গভীর তাগিদ অনুভব করে উন্মাতাল বাতাস উড়িয়ে দিচ্ছিল তরুর সফেদ লেসের ওড়না বহুদিনের জমাট ভয় আর দ্বিধা ভেঙে নিয়ন কথা শুরু করে... চিঠিতে যা ছিল কাব্যের- গানের- সুরের ঘোমটায় তা বাস্তবতার চৌকাঠে দৃঢ় স্বকণ্ঠ-
-যদি বলি শুধু তোমার জন্য আমি শহরে চলে আসতে চাই সেই বৃষ্টিভেজা গ্রাম, মেঠোপথ, পাহাড়ের নির্জনতা আর আত্মীয়স্বজন ছেড়ে নানা আমার কোন আত্মীয় নেই আছে গুটিকয় সুহৃদ, আপনজন শুধু তোমার জন্য চলে আসবো অচেনা শহরে তরুর ছায়ায় বাঁধতে চায় বিষাদ নিয়ন
-আমার মন তো এই চায় শুধু তোমার সাথে থাকাতবে তো আমার আর কোন কষ্ট থাকবে না, তরুর সহজ উত্তর, অকপট
-সত্যি বলছো তো তরু? এত সহজে বলো না গো সখি আজই বলো না আরো সময় নাও
-আজ নয়ত কখনো নয়
-সে কি! তুমি বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ে আবেগের ঘনঘটা শেষে জীবন পানসে হয়ে যায়
-সময় আমাকে ধরা দিয়েছে নিয়ন তরুর কণ্ঠ ভারী আর সময় নেয়ার প্রয়োজন নেই আমার কোন দ্বিধাদ্বন্ধ নেই ওসব আমি ঝেড়ে ফেলেছি আজ আমাদের পরিচয়ের এক বছর পূর্ণ হলো ৫২ সপ্তাহ, ৩৬৫ দিন...
২১,৯০০ মিনিট, ১৩,১৪,০০০সেকেন্ড নিয়ন শেষ করে বাকিটা
-এই একটি বছর আমার হাসিকান্না, চলন একাকীত্ব সবকিছু তুমি দখল করে রেখেছো আমি হারিয়ে ছিলাম আমার আমি থেকে তুমি আমার আমি বা আমার সত্তা তবে কী বলবো; আরো কী সময় নেবো!
-না গো না সোনা নিজকে এত সৌভাগ্যবান মনে করি না জানো না আমার জীবন ভাঙাচোরা, রিক্ত, বেদনা এবং বেদনাই যার সব কথা
-আমার জীবনে বেদনা নাই তবে সবদিকে শূন্যতা অনুভব করি সব থেকেও না থাকার যন্ত্রণা!সে শূন্যতা তুমি পূর্ণ করে দিয়েছো তুমি যা তাই আমার অথবা যেটুকু দিবে সেটুকু আমার
-না গো সখী আমার সবটুকু তোমার আমি কণ্টকময়; তাই ভয় কিছুটা কেটে যেতে পারে তবে ক্ষত নয়, কাঁদাতে পারে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না
-ভালোবাসা থাকলে ব্যথায় প্রলেপ হবে কেন যেন আমার মন বলছে তোমার সব বিষ গ্রহণ করে নীলকণ্ঠ হয়ে যাই

টিএসসির সাদাকালো স্টুডিওতে দুজনের একটি ছবি তোলে সাক্ষী থাকুক সন্ধ্যার দ্রুবতারা আজ দুজন নতুনভাবে নিজেদের খুঁজে পেতে চায় তবে নিয়ন একটু দুরু দুরু একটু সুরমার ছায়া চোখের তারায়
-তরু
-বলো নিয়ন
-কোন সমস্যা হবে না তো?
-নিজকে ভয় পাও; না আমাকে?
-তোমাকে নিয়ে ভাবছি তোমার নিষ্কলঙ্ক জীবনটা আবার ব্যথায় মুচড়ে না যায় তবে তোমাকে আমি কোন কষ্ট দিব না

রিকসায় লেগে আছে দুটো শরীর দুজনের শ্বাস পড়ছে শ্বাসে শরীরে সেতার, অবশ অবশ আড়াল করতে হুড টেনে দেয়া হয়েছে রিকসাটা যেন একটু বেশি ছোট কাঠ বাঁচাতে গিয়ে ব্যবসায়ী ছোট করে ফেলেছে নয়ত মিস্ত্রি ভুল তরু একটি হাত নিয়নের পেছনে দিয়েছে নিয়নের শরীর কাঁপছে তরু জড়িয়ে রেখেছে তাকে শরীর আজ শরীরের ভাষা বুঝে নিয়েছে জড়তা, দ্বিধা দ্বন্ধ মুছে ফেলে আপন গরিমায় মিশে যেতে চাইছে নিজেদের দেখা হওয়ারও ছয় মাস পেরিয়ে গেল রিকসায় পাশাপাশি অনেক বসেছে্ পার্কের পুকুর পাড়ের ঘনঝোপে গভীর চুমুও খেয়েছে কিন্তু আজ যেন সত্যি সত্যি জিরো থটে চলে যাচ্ছে শরীর আজ যেন সত্যি সত্যি নিজকে খুঁজে পাচ্ছে না কেউ
-তরু
-হু
ঘননিঃশ্বাসে বিবশ প্রাণ কী কথা বলবে! শুধু সপে দেওয়া শুধু গলে গলে বয়ে চলা

হোটেল বয় খাবার দিয়ে যাওয়ার পর দরোজা এঁটে দেয় নিয়ন তরুর ঠোঁট টেপা হাসি মাথাটা গুলিয়ে দিচ্ছে না শক্ত হতে হবে আধভাঙা জীবনের গল্প করবে সে তরুর জীবন এত সাধাসিধা বিশ বছরের জীবনে মেয়েটি একটি চুমু খেয়েছে তাও অনিচ্ছায় সে কি মেনে নেবে দুঃসহ কষ্টের অবিরাম কোপান ভাবনার মাঝে বাধা দেয় পেছন দিক থেকে তরুর ঝাপটে ধরা সত্যি মনে হচ্ছে স্পর্শ প্রথম ঘুরিয়ে এনে বুকে বুক, ঠোঁটে ঠোঁট অনাবিল সুখের গভীর নিশ্বাসে লেপ্টে থাকে তারা আজ কোন দেখে ফেলা নেই, নেই কোন তাড়াহুড়া তরু বাসায় বলে এসেছে সাথীর বাসায় থাকার কথা সাথী বিএসসি পড়া তার কলেজ বন্ধু অতএব পুরো একটি দিন তারা নিতে পারে কারো চোখ খোলা নেই দেখে নিচ্ছে ভালোবাসার আদ্যপ্রান্ত, পড়ে নিচ্ছে সংসারের প্রথম পাঠ এই তো সংসার! সংসার মানে সঙ্গ, সংসার মানে জীবনের গান কান পেতে শোনা
-নিয়ন
-হু
- জীবন এত সুখের যদি বিশ্বাস হয় না সংসারের গ্যাড়াকলে মানুষ কেন কাঁদে, বলো? পাশাপাশি দুটো বালিশে মুখোমুখি শোয়া
- শরীর সুখের যদি সে শরীর মনের স্পর্শ পায় যখন শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে তখন প্রাত্যহিক জীবন তত সুখের নয় ঘটিবাটি ঘাঁটাঘাঁটি
-তবে এভাবেই থাকি
-এভাবে তো থাকা যায় না জীবনকে সামনে নিতে হয় জীবনের প্রয়োজনে
-কেন?
-তুমিই একদিন সে জবাব পাবেহয়তো আমাকে জানলে এখনই রাত দুপুরে বের হয়ে টেক্সি ডাকবে
-তবে থাক তোমাকে জানা
-কেন, ভয় পাও?
-হু হারাবার ভয় যে বললে টেক্সি...
-কেন হারাবে! আমি তো তোমার আছি তোমার থাকবো
- জেনে কী হবে! তুমি আজ আমার আমার থাকবে চিরদিন তা আমি মনে করি না আমি বহু পাথরকে গলে যেতে দেখিছি কত ভালোবাসা নীরবে কাঁদে; কত প্রেম শূন্যতার আহাজারি হয় শেষ পর্যন্ত
-বাহ ঘরের ভেতর তোমাকে আরও সুন্দর লাগছে আরও মায়াময় আরও জীবন অভিজ্ঞও যেন ভয় হয় সব পাওয়া হয়ে গেলে একসময় স্পর্শও ভালো না লাগতে পারে
-তবে থাক সে পাওয়া
-কিন্তু শরীর তো একসময় ভাঙতে চায় গভীর সুরের গভীরে ডুবে যেতে চায়
-জানি
-তবে?
-তবে আর কি নিয়নের বালিশে শুয়ে মাঝখানে একটি মাথার বালিশ রেখে দেয় নিয়ন হাত বাড়িয়ে মাথাটি বাহুর উপর রাখে তবে সে দিনটিকে আমরা আরও দূরে নিয়ে যাবো শুধু দেখব, দেখব আর দেখব অন্তবিহীন সুরে না ভেসে অবগাহন করব সুর-সংগম যেন প্রেম বিজয়ী হয় নিয়নের চোখের উপর রাখে আলতো ঠোঁট; মুখটা নিয়ে আসে বুকের কাছে নাকটা একটু ঘষে দেয়
-এত বাড়িও না; বাঁধ ভেঙে ফেলব তবে
-না! শর্ত ভাঙা যাবে না সে দিনটিকে আরও দূরে নিয়ে যাব তোমার কথা শুনব, বলো

কখন যে ভোর খলবলিয়ে বেরিয়ে পড়ল ছয় তলা হোটেলের জানালা দিয়ে, স্বাগত জানালো রোদের রশ্মি নির্মেঘ আকাশের হাসি আর দিনের নকশায় নতুন এক জীবনে প্রবেশ করে দুজন জগৎ শুধু আলোর ভেলা নয় ঝড়ের মাতমে ডুবেভেসে চলমান জীবন কখনো হাঙ্গরের থাবা কখনো রুদ্রাক্ষের মালা শিল্পি নিয়ন ভালোবেসে হিন্দু ধর্মের কল্পনাকে বিয়ে করে মুসলমান সে- নিজেই ধর্মান্তরিত হয় নিয়ম ভেঙে একাকী নির্জনে দারিদ্রতম বাস শেখে দুজনের কণ্ঠে সরস্বতী সে নূপুরের ঘরে হঠাৎ কল্পনা হাসতে হাসতে দম আটকে মারা যায় উদ্ভ্রান্ত সমাজচ্যুত নিয়ন ভাসতে থাকে ভাসমান মেয়েদের সাথে শহরে শহরে কোন এক মেয়ের কণ্ঠে মধুর গান শুনে চমকে উঠে তারও তো ছিল সুর, হৃদয়ে আবেগ সেই থেকে গান আর সুরই তার জীবন আধার নিজের কঠিন জীবনের করুণতায় ডোবে বুঝতে পারেনি কখন ঘুমিয়ে গেছে তরুলতা কতটুকু শুনেছে সে? শেষটুকু না শুনলে তো ক্ষমা করা কঠিন হবে কী নিষ্পাপ শিশুর মতো ঘুমুচ্ছে তরু শ্বাসে যেন অক্সিজেন ছড়াচ্ছে
অধীর প্রতীক্ষা ভেঙে ঘড়িতে ঢং একটা বাজার শব্দে ঘুম ভাঙে বসে থাকা নিয়নের কোলে মাথাটা ঠেলে ঢুকায় তরু তার সিগারেট মাখানো হাতের পাতা গালে ঘষায়
সূক্ষ্ম চোখে দেখছে নিয়ন গালে লেগে যাওয়া কাজল মুছে দেয় তর্জনীর মৃদু স্পর্শে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে তরু চোখে বিষাদ না আনন্দ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না বিষাদ নিয়ন